জয়ঢাক গল্প প্রতিযোগিতা ২০১৬ :
এ প্রতিযোগিতা হয়েছিল রাজকুমার রায়চৌধুরিমশাইয়ের অসামান্য সাইফি “তাতিয়ানার মোবাইল“-এর একটা উপযুক্ত সিকোয়েল লেখবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে। সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল বেশ কিছু তাজা কলম। প্রথম ন’টি গল্প পুরস্কৃত হয়েছে বইমেলায় আমাদের অনুষ্ঠানে। জয়ঢাক গল্প প্রতিযোগিতা ২০১৬ –দ্বিতীয় পুরস্কার
রাত ২টো বেজে ২০ মিনিট, ১৭ই, সেপ্টেম্বর, ২০১৭
মাঝরাতে তাতিয়ানা উঠে বসল বিছানায়। এরকম আজকাল প্রায়ই হয়, ঘুম ভেঙে যায় রাত্রিবেলা, বালিশের পাশের পুরনো মোবাইটা নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। যদি আবার আসে সেই অদ্ভুত এস এম এস! তবে ওর দাদা তন্ময় বলে আবার এস এম এস আসার সম্ভবনা কমই। সত্যিই তো শেষ বার্তা আসার পরে দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে গেছে। আর কোন নতুন খবর আসে নি। ইতিমধ্যে তন্ময়ের অনার্স শেষ হয়ে মাস্টার্স করে খড়গপুর আই আই টিতে রিসার্চ করছে। তাতিয়ানার এস এম এস কাণ্ডের পরে তন্ময় ইচ্ছে করলেই বিদেশে গবেষণা করতে পারতো, কিন্তু দেশ ছাড়ার কোন ইচ্ছেই তার নেই। ওদিকে তাতিয়ানাও স্কুল শেষে বেশ ভালো রেসাল্ট করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পুটার সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়েছে। মাঝে মাঝে কলেজ থেকে ফিরে এসে নাসার মডেলটার সামনে বসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, আর সেই পুরনো মোবাইল আর সিম কার্ডটা সবসময় ব্যাগের মধ্যে রেখে দেয়। প্রফেসর খাসনবীশ অনেক দিন আগেই ফিরে এসেছেন নাসা থেকে ব্যার্থ হয়ে। নাহ! ছবিতে পাওয়া তারাপুঞ্জের সাথে আমাদের গ্যালাক্সির কোন অংশেরই সম্পূর্ন মিল পাওয়া যায়নি। যেটুকু গেছে সেই অংশে কোন বাইনারি স্টারের অস্ত্বিতের প্রমান নেই। তার উপর সেই অদ্ভুত ২৪ টি ডিজিটের সংখ্যা, যেটি ভাবা হয়েছিল নির্দেশ করছে বুদ্ধিমান গ্রহের অবস্থান। সেই সংখ্যাটির অর্থ খুঁজে বের করতে অক্ষম নাসার সুপার কম্পিউটারও। বহুরকম প্রচেষ্টার পরে ডঃ হিল্টন, খাসনবীশ আর শ্রীনিবাসন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। নাসা ছেড়ে আসার দিন ডঃ আথাটনের শ্লেষ মাখা মুখটা এখনো মনে পড়ে খাসনবীশের। তবে প্রজেক্টটা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। এখনো একটা ছোট অংশ নাসার মধ্যে বিভিন্ন টেলিস্কোপ আর সুপার কম্পিউটার নিয়ে খুঁজে চলেছে সঙ্কেতের উৎস। কিন্তু কিভাবে বহু আলোকবর্ষ দূর থেকে এস এম এস আসা সম্ভব তার যুক্তিগ্রাহ্য কোন সমাধান মেলেনি!
খাসনবীশের প্রেসিডেন্সির অফিসে একটা বড় বোর্ডের উপর এখনো বড় বড় করে লেখা আছে-“Greetings from Sara Beral. Indicate your posiho.” পাশে বড় করে ল্যামিনেট করা তারাপুঞ্জের ছবিটা। এখনো যেন চ্যালেঞ্জ করছে খাসনবীশকে। পাঁচ বছর তিনি লড়াই করছেন এর পিছনে। পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যম অনেকদিন আগেই পুরো ঘটনা থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি কিছু কাগজ তো ব্যাপারটা হোক্স বলে অনেক নিন্দাও করেছে। যদিও ভারতীয় বিজ্ঞান পরিষদ ও নাসা সবসময় খাসনবীশের সাথে থেকেছে। তন্ময় এখনো তার গবেষণার মাঝে মাঝে প্রেসিডেন্সিতে এসে পুরনো স্যারের সাথে দেখা করে যায়। আর আসে তাতিয়ানা, সে এখনো হাল ছাড়েনি। খাসনবীশ মেয়েটাকে দেখে মাঝে মাঝে নতুন করে অনুপ্রেরণা পান। ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চেষ্টা চালিয়ে যান কোন সূত্র খুঁজে পাওয়ার।
দুপুর ৩টে, ১৮ই,সেপ্টেম্বর, ২০১৭
তাতিয়ানা ক্লাসে আনমনা হয়ে বসে আছে। কাল নবারুণ কাকুর কাছে গেছিলো ক্লাসের পরে। কাকুকে দেখলে খারাপ লাগে তাতিয়ানার, মানুষটার বয়স এই পাঁচ বছরে যেন কুড়ি বছর বেড়ে গেছে! কাকু কিছু না বললেও তাতিয়ানা বোঝে বৈজ্ঞানিক সমাজে বেশ কিছুটা সম্মানহানি হয়েছে নবারুণ খাসনবীশের। তার উপর কালকেই খবরে দেখেছে এক বিশাল সাইক্লোনে জাপানে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, অনেক লোক মারাও গেছে, বহু মানুষ গৃহহীন। কী যে হচ্ছে এই গত কয়েক বছর ধরে, আজ চিলিতে ভুমিকম্প, তো কালকে অস্ট্রেলিয়ার জলোচ্ছ্বাস। প্রকৃতি যেন রুখে দাঁড়িয়েছে মানুষের বিরুদ্ধে! তাতেও কি হুঁশ আছে মানুষের? সৃষ্টির শেষ দিন পর্যন্ত সে লুঠ করে যাবে প্রকৃতির সম্পদ। এসব ভেবে মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে তাতিয়ানার নিজেকে। হঠাৎ প্রফেসর বিবি ঘোষের মুখে নিজের নাম শুনে বাস্তবের মাটিতে নেমে এল তাতিয়ানা। কলেজে তাতিয়ানার বেশ একটা খ্যাতি আছে, সেটা যত না পড়াশুনার জন্যে তার থেকে বেশি সেই মোবাইলের বার্তার জন্যে। অনেক বন্ধু ওকে বেশ ঈর্ষার চোখেও দেখে। প্রফেসররাও অনেকে ওকে নিয়ে পিছনে হাসাহাসি করেন, সেটাও জানে তাতিয়ানা। কিন্তু তন্ময় ওকে বুঝিয়েছে, এসবে বেশি কান না দিতে, যতদিন এই রহস্যের সমাধান না করা যাচ্ছে ততক্ষণ লোকে এরকম বলবেই। যাই হোক সব কথা মাথা থেকে সরিয়ে তাতিয়ানা ক্লাসে মন দিল। প্রফেসর ঘোষ বয়স্ক মানুষ, তাতিয়ানাকে বিশেষ স্নেহ করেন। এখন কমপিউটার গ্রাফিক্সের ক্লাস চলছে। বিবিজি ভালোই পড়ান। কিন্তু তাতিয়ানার খুব একটা ভালো লাগে না বিষয়টা। খালি অঙ্ক দিয়ে কী করে ছবিকে কমপিউটারে দেখানো যায় আর তাকে কিভাবে পরিবর্তন করা যায়, তার তত্ত্ব। বিবিজি বোঝাচ্ছিলেন ট্রু কালার কাকে বলে। কিভাবে রেড গ্রিন আর ব্লু – এই তিনটে রঙ দিয়ে কম্পিউটারে ছবি আঁকা যায়। এর সাথে থাকে যদিও শেড আর হিউ এর তথ্যও। হঠাৎ একটা কথা মাথার মধ্যে খোঁচা দিয়ে গেলো তাতিয়ানার! “ট্রু কালারে থাকা রঙকে ২৪টা বিট দিয়ে ব্যখ্যা করা যায়। তার মানে লাল, সবুজ আর নীল রঙের প্রত্যেকটির জন্যে ৩ বাইট করে তথ্য।” বিবিজি বলে যাচ্ছিলেন।
ক্লাস শেষ হতেই তাতিয়ানা ছুটল বিবিজির অফিসে।
“স্যার আপনি যে বললেন, ২৪ বিটের রঙ বোঝানো যায় ট্রু কালারে, তাহলে ২৪ ডিজিট সংখ্যা দিয়ে কি কোন রঙ বোঝানো যায়?”
“হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ, ২৪ বিট দিয়ে আমরা ২২৪ অথবা১৬,৭৭৭,২১৬ টি আলাদা রঙ দেখাতে পারি।”
“তাহলে এই ২৪ ডিজিটের সংখাটা দিয়ে কোন রঙ বোঝানো যায় ?” – তাতিয়ানা খাতার পিছনে লিখে ফেলল মুখস্ত হয়ে যাওয়া সংখ্যাটা।
“কিন্তু, তাতিয়ানা, দেখতেই তো পাচ্ছ, সংখ্যাটা দশমিক রাশির উপর তৈরি, কিন্তু বিট এর একক হল বাইনারি বা দ্বিঘাত রাশি। তাই এই সংখ্যাটিকে কোন রঙের সাথে মেলানো সম্ভব নয়।”
তাতিয়ানা নিরাশ মুখে বিদায় নিল বিবিজির অফিস থেকে।
সকাল ৭টা, ১৯শে,সেপ্টেম্বর, ২০১৭
পরেরদিন সকাল সাতটা নাগাদ হঠাৎ তাতিয়ানার নতুন মোবাইলটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর, ধরতেই উলটো দিকে চেনা গলা। “আমি বিবিজি বলছি, ডঃ খাসনবীশের নম্বরটা দাও তো।”
অবাক তাতিয়ানা নম্বরটা দিতেই বিবিজি বলে উঠলেন,”যত তাড়াতাড়ি পার আমার অফিসে চলে এস।”
সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে যাদবপুরের বিবিজির অফিসে পৌছে তাতিয়ানা দেখল উত্তেজিত মুখে নবারুণ কাকুও বসে আছেন। বিবিজিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারা রাত ঘুম হয়নি। সামনের কম্পিউটারে নানা রকম ছবি আসছে যাচ্ছে। কয়েকটা ছবিকে তো বেশ চেনাই মনে হচ্ছে! অনেকটা সেই এস এম এসে আসা নক্ষত্রপুঞ্জের মত। বিবিজি তাতিয়ানাকে দেখে বলে উঠলেন, “এসো, তোমার জন্যেই ওয়েট করছিলাম। কাল তুমি চলে যাবার পরে ওই সংখ্যাটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলাম। হঠাৎ মনে হল যদি সংখ্যাটা ডেসিমাল সিস্টেমে না হয়ে বাইনারি হয়? তোমারা কি জানো আধুনিক বিজ্ঞানের বহু বছর আগে পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের মানুষেরা ২ ঘাত বিশিষ্ট রাশিমালা আবিষ্কার করেছিল? আমি প্রত্যেকটি ঘরের সংখ্যাকে দশমিক থেকে দ্বিঘাত সংখ্যায় সরাতেই একটি ৩*২৪ ডিজিটের ম্যাট্রিক্স পেলাম। এরপর কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না সেটাকে নিয়ে কী করব। হঠাৎ মনে পড়ল ওই তারকাপুঞ্জের ছবিটার কথা। ওটার কপি ইন্টারনেট থেকে সহজেই পেয়ে গেলাম। তারপরেই মাথায় এল যদি ছবিটাকে মাস্কিং করে কোন তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়ে থাকে? আর সেই মাস্ক সরানোর উপায় আছে এই ম্যাট্রিক্সের মধ্যে। সারা রাত ওই সংখ্যাটাকে চাবি হিসেবে ছবিটার উপর ব্যবহার করে গেছি। অনেকরকম ছবি এসেছে যার কোন মানেই হয় না। কিন্তু অবশেষে সকাল ছটার সময় এই ছবিটা পেয়েছি দেখুন।”
কম্পিউটারে আঙুল ছুঁইয়ে বিবিজি বের করে আনলেন একটা ছবি। “আরে এতো দেখে মনে হচ্ছে স্যাটেলাইট থেকে তোলা একটা ম্যাপ!” – অবাক হয়ে বলে উঠলেন খাসনবীশ।
“হ্যাঁ, তবে যেকোন ম্যাপ নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের ম্যাপ এটা, কিন্তু কোন অংশের সেটা বোঝা যাচ্ছে না। আর মাঝের এই লাইন গুলোই বা কী সেটাও আমি জানিনা। কিছু কিছু জায়গায় যে বড় কালো বৃত্ত দেখা যাচ্ছে সেগুলোও কি আমি বুঝতে পারছি না।”
প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে খাসনবীশ ফোন বের করলেন, এখুনি সব খবর জানাতে হবে নাসায়! এ তো বিশাল আবিষ্কার! তাহলে কি এতোদিন ভুল দিকে সন্ধান করছিলেন তারা! মহাকাশ থেকে নয়, বার্তা কি আসছে পৃথিবীর সাগরের নিচের কোন গোপন অংশ থেকে! হায় ভগবান, এতোদিন কি তবে সময় নষ্ট করলেন তাঁরা!
বিকেল ৫টা, ১৯শে,সেপ্টেম্বর, ২০১৭
বিকেলের মধ্যে নাসা থেকে খবর চলে এলো। ছবিটি মিলে গেছে ৭ বছর আগের নাসার স্যাটেলাইটে তোলা প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বিশেষ অঞ্চলের সাথে। জায়গাটির নাম অনেকেই জানে, মারিয়ানা ট্রেঞ্চ! পৃথিবীর সবথেকে গভীর অংশ। আন্দাজ করা হয় এর চ্যালেঞ্জার ডিপের গভীরতা প্রায় ১১ হাজার মিটার, মানে হিমালয় পর্বত সম্পূর্ণ ডুবে গেলেও অনেকটাই জলের নিচে থেকে যাবে। এত গভীরে জলের চাপও প্রায় সমতলের থেকে হাজার গুন বেশি। মানুষের পক্ষে পৌঁছানো সেখানে অসম্ভব বললেই চলে। সেই মারিয়ানা ট্রেঞ্চের ছবিই পাঁচ বছর আগে এসেছিল তাতিয়ানার মোবাইলে। কিন্তু ওই লাইন আর বৃত্তগুলো? লাইনের রহস্যও উদ্ধার করেছেন সমুদ্র বিশেষজ্ঞরা। ওগুলো প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে অশোধিত গ্যাস আর তেলের লাইন। বিভিন্ন বহুজাতিক তেলের কোম্পানি অনেক খরচ করে বছর কুড়ি আগে ওগুলি বসিয়েছে। কিন্তু বৃত্তের রহস্য এখনো বোঝা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে তন্ময়ও চলে এসেছে খড়গপুর থেকে। খাসনবীশের অফিসে চরম ব্যস্ততা। অনবরত ভিডিও মিটিং চলছে নাসা ও বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞান পরিষদ গুলির সাথে। রাধাকৃষ্ণ আর বিবিজি দুজনেই সাহায্য করছেন খাসনবীশকে। তন্ময় আর তাতিয়ানাও হাতে হাতে যেটুকু সম্ভব করে যাচ্ছে। এটুকু বোঝাই যাচ্ছে যে সমস্ত রহস্য লুকিয়ে আছে সমুদ্রের নিচের ওই অঞ্চলেই। ইতিমধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে সংবাদ মাধ্যমের কাছে। পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় খবরের কাগজ আর নিউস চ্যানেলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি। বিবিজিকে কিন্তু কেউ খুঁজে পাচ্ছে না, প্রচারবিমুখ প্রৌঢ় মানুষটি সংবাদ মাধ্মের হাত থেকে বাঁচার জন্যে আশ্রয় নিয়েছেন খাসনবীশের ল্যাবরেটারিতে। উনি আর রাধাকৃষ্ণ ভেবে চলেছেন এস এম এসের সাথে পাওয়া কথাগুলির যদি এই নতুন পাওয়া তথ্যের আলোয় অন্য কোন অর্থ করা যায়।
এর মধ্যে রাত এগোরোটায় খবরটা এল। এডয়ার্ড হ্যারল্ড নামে এক আমেরিকান ভদ্রলোক টিভিতে খবরটি দেখে নাসার সাথে যোগাযোগ করেছেন। তাঁর বক্তব্য উনি জানেন ওই বৃত্তগুলির মানে কি। ভদ্রলোক নাসার বিজ্ঞানীদের সাথে ভিডিও মিটিং এ আছেন। সবাই ঝুঁকে পড়ল কম্পিউটার স্ক্রিনের উপর। হ্যারল্ড ছোট খাটো মানুষ, পেশায় পরিবেশ বিজ্ঞানী। সমুদ্রের দূষণের উপরে কাজ করেন। কম্পিউটারের পর্দায় সমুদ্রের নিচের ছবিটি দেখিয়ে হ্যারল্ড বললেন, “ভদ্রমহোদয়গণ, এই বৃত্তগুলি আর কিছুই নয়, তেলের আর গ্যাসের লাইনে ফুটো হয়ে লিক হওয়া তেল আর গ্যাসের অবস্থান। আমরা গত তিন বছর ধরেই এই জায়গাগুলোতে লাইন সারানোর বা বন্ধ করার জন্যে আন্দোলন করে যাচ্ছি, কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানিগুলি লাভের জন্যে কিছুই করছে না।” নাসার তরফ থেকেও হ্যারল্ডের দেওয়া তথ্য মিলিয়ে দেখা হয়েছে। কালকের মধ্যে নতুন স্যাটেলাইটের ছবিও পাওয়া যাবে।
এই নতুন খবরটায় সবাই হতচকিত। এর সাথে পাঁচ বছর আগে পাঠানো এস এম এসের কি সম্পর্ক? তবে কি পুরোটাই হোক্স? কারুর নিষ্ঠুর ঠাট্টা? কিন্তু তাই বা কি করে হবে? হ্যারল্ডরা নাকি এই পাইপ লিকের ব্যাপারে জেনেছেন মাত্র তিন বছর আগে! রহস্যতো আরো জটিল হয়ে উঠছে। এর মধ্যে রাধাকৃষ্ণ ফিনিশিয় ভাষার উপর বেশ কিছু বইয়ের মধ্যে ডুবে গেছেন। ওনার মনে হয়েছে কিছু শব্দের অর্থ হয়ত অন্যরকম হতে পারে। বেশ কিছুক্ষণ পরে রাধাকৃষ্ণ যে নতুন অনুবাদটি খাড়া করলেন সেটি হল – “Greetings from princess Breral. State your position.” সারা মানে অনেক প্রাচীন ভাষাতেই রাজকন্যা, আর পোসিও মানে প্রাচীন ফিনিশ ভাষায় পসিশন।এর মানে রাজকুমারী ব্রেরাল নামে কেউ আমাদের মত কি জানতে চাইছে! কিন্তু কিসের মত? আর কে এই রাজকুমারী? এতো প্রাচীন ভাষায় সে এস এম এস এ বা কেন পাঠিয়েছে? নাহ এখনো এগুলির সম্পর্ক কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
সকাল ১০টা, ২০শে,সেপ্টেম্বর, ২০১৭
শেষ সূত্রটা এল তন্ময়ের মাথা থেকেই। ছবিতে সমস্ত তেলের লাইনের সাথে আরেকটা লাইন ছিল, যেটা তেলের নয়। বহুদিন আগে বাতিল হয়ে যাওয়া টেলিযোগাযোগের লাইন। সেটি গেছে একেবারে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের ধার ঘেঁসে। প্রায় দশ বছর আগে লাইনটিতে কাজ বন্ধ হয়ে যায় ওই এলাকার জলের টানে বারবার লাইন মেরামতি করতে হত বলে। আমেরিকা সরকারের থেকে তথ্য নিয়ে তন্ময় জানতে পেরেছে যে গত দশ বছরে মাত্র দুদিন ওই লাইনটি চালু করা হয়েছিল, কারন তখন সামুদ্রিক ঝড়ের জন্যে আসল লাইনগুলো বিপর্যস্ত ছিল। আর ওই দুই দিনেই এস এম এস পেয়েছে তাতিয়ানা! তার মানে ওই এস এম এস পাঠানো হয়েছে মারিয়ানা টেলিযোগাযোগের লাইন ব্যবহার করে। কেউ বা কারা কোনভাবে ওই লাইনটিকে দখল করে বার্তা পাঠাচ্ছে।
এখন সকাল ১০ টা। টেবিলের মাঝে রাখা আছে তাতিয়ানার পুরোন মোবাইলটা। আমেরিকান ইন্টারনেট সংস্থা জানিয়েছে ঠিক পাঁচ মিনিট আগে আবার চালু করা হয়েছে লাইনটা।সবাই তাকিয়ে আছে মোবাইলটার দিকে। ১০টা বেজে তিন মিনিটে বেজে উঠল মোবাইলটা, এস এম এস। ফিনিশিয় বা গ্রিক নয়, এবার খাঁটি ইংলিশে লেখা – “লাইনটা চালু করার জন্যে ধন্যবাদ, নিউ আটলান্টিস থেকে প্রিন্সেস ব্রেরাল বলছি। আর সময় নেই। যুদ্ধ এড়াতে অবিলম্বে সমুদ্র দূষণ বন্ধ কর।” – আটলান্টিস? মানে সেই গ্রীক পুরাণে বর্ণিত হারিয়ে যাওয়া শহর! সেই শহর সত্যিই আছে! আর তারা কোনভাবে এত হাজার হাজার বছর ধরে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের নিচে সভ্যতা তৈরি করেছে! তার মানে গত পাঁচ বছরের এই সমস্ত জ্বলোচ্ছাস আর ভূমিকম্পের মূলে আছে তবে এরাই। ভূপৃষ্ঠের মানুষের সাগর দূষণকে রোধ করার জন্যে এরা রুখে দাঁড়িয়েছে আজ।
এরপর যা হল, তা পৃথিবীর মানুষ কোনদিন দেখেনি। যখন বোঝা গেল মেসেজটা সত্যিই মারিয়ানা ট্রেঞ্চের অন্ধকার গহ্বর থেকেই এসেছে, রাষ্ট্রসংঘ নড়ে বসল। সমস্ত দেশের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে সভা করে ঠিক করা হল তেল আর গ্যাসের পাইপ গুলো অবিলম্বে বন্ধ করা হবে। টেলিফোন লাইনটি জরুরি ভিত্তিতে চালু করা ছিল। তাই তেলের লাইনগুলি বন্ধের কিছুক্ষণের মধ্যে এস এম এস এল–”ধন্যবাদ, নিউ আটলান্টিস, ভূমির মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে প্রস্তুত। আশাকরি বন্ধুত্বের মাধ্যমে এই পৃথিবীকে আমরা সুন্দর করে তুলতে পারব।”
বিপুল জনসমর্থনে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিকল্প শক্তি ব্যবহারের বিল পাশ হয়ে গেলো। প্রায় সমস্ত কাগজে আর টিভিতেই দুই ভাই বোনের মুখ। সাথে খাসনবীশ আর রাধাকৃষ্ণের সাক্ষাতকার। বিবিজি সেই যে বাড়ি গিয়ে দরজায় খিল দিয়েছেন যে তাকে আর কোন খবরের কাগজই খুঁজে পাচ্ছে না। আটলান্টিসের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে রাষ্ট্রসংঘের কমিটির প্রধান করা হয়েছে ভারতের প্রতিনিধি খাসনবীশকে।
অনেকদিন পরে নিরিবিলি রাতে, বাড়ির ছাদে দাড়িয়ে ছিল তাতিয়ানা আর তন্ময়। শরতের আকাশটা আজ খুব পরিষ্কার। তাতিয়ানা বলে উঠল- “ভাব দাদা, আমরা এতো বছর ধরে বন্ধু খুঁজছিলাম ওই আকাশের তারার মধ্যে, অথচ বন্ধুরা ছিল আমাদের পাশেই। নিজের অজান্তে শুধু সেই বন্ধুই নয়, নিজেদের এই সুন্দর পৃথিবীর কত ক্ষতিই না আমরা করেছি।”
তন্ময় বোনের চুল গুলো ঘেঁটে দিল, “চিন্তা করিস না রে, এই নতুন বন্ধুদের হাত ধরেই দেখবি আমরা এক নতুন পৃথিবী গড়ব।”
জয়ঢাক ২০১৬ গল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কারপ্রাপ্ত আরো গল্পঃ
ভিনগ্রহীদের হাতের পুতুল , দূর আকাশের দোসর , বন্ধু , আথেনিকার আগন্তুক
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে
Beautiful and descriptive.
I was lost in the story.
Small and compact, an excellent combination of technology and ancient Greek mythology.
Thanks for the nice fiction.
Looking forward…
LikeLike