বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি
শঙ্খচূড়ের ডেরায়
“উ সার…সার… গ্রাম থেকে মুরগির খাঁচা এসে গেছে।” মাদ্রাজি ছোকরা চাকরের ডাকে আমার দিবানিদ্রাটা ভেঙে যেতে কাঁচা পাতায় তৈরি ঝুপড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এলাম আমি। জায়গাটা নুল্লামুল্লির একটা উপত্যকা। বনাগনপল্লির বিখ্যাত হিরের খনির কাছেই।
আমি তখন ঐ হিরের খোঁজেই ও-তল্লাটের জঙ্গল তোলপাড় করে চলেছি। তবে তা বনাগনপল্লির হিরে নয়। ও-এলাকায় নাকি বুওয়াপটম বলে এক জায়গায় আরো একটা হিরের খনি ছিল এককালে। সেখানকার হিরের নাকি তুলনা হয় না। খবর শুনে লণ্ডনের এক সিণ্ডিকেট তখন আমায় ভাড়া করেছে জঙ্গল ঢুঁড়ে সেই বুওয়াপটমের পুরোনো খনি খুঁজে বের করবার জন্য।
বনাগনপল্লির খনিগুলো দেখে নিয়ে সেইখান থেকেই আমি আমার খোঁজখবর শুরু করেছিলাম। পুবে নান্দিয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে তখন এক সপ্তাহ ধরে জঙ্গলে ঘুরছি। তিন হাজার ফিট উঁচু ঈশ্বরনাকুপমের চুড়ো অবধি বেয়ে উঠেছি। সে-ছাড়া ও-এলাকার যত টিলা আর খাদ আছে কোথাও দেখতে বাকি রাখিনি।
এই ঘোরাফেরা করতেকরতেই এক স্থানীয় গাইডের কথায় মনে একটু আশা জেগেছিল আমার। নাকি আমি যা খুঁজছি সে-জিনিস রয়েছে ঈশ্বরনাকুপমের উত্তর-পুবের গহিন জঙ্গলের ভেতর। নুল্লামুল্লির পুবের ঢালের পাদদেশের সে-জঙ্গলে বাইরের মানুষ যেতে সাহস পায় না। একমাত্র চেঞ্চু নামে একজাতের বুনো মানুষের বাস সে-জঙ্গলে।
কিন্তু সেখানকার কিছু এলাকায়, এমনকি দুঃসাহসী চেঞ্চুরাও পা দিতে ভয় পায়। যে হিরের খনি আমি খুঁজছি, সে খনি নাকি তেমনই এক ভয়ঙ্কর এলাকায় সত্যি সত্যিই আছে। তবে তা আছে এক ভয়ানক জন্তুর পাহারায়। “সাক্ষাৎ নাগরাজ পাম্পুর বংশ সে-হিরের মালিক সার,” বলতে বলতে ভয়ে কেঁপে উঠেছিল সেই গাইড, “ও-হিরে নাগদের চোখ যে! গভীর উপত্যকার তলায় তাদের গোরস্থান। তার পাহারায় থাকেন নাগরাজ পাম্পু নিজে। নাগজয়ী গরুড়দেওকে একটা মোষ বলি দিয়ে খুশি করলে তবে সে-জায়গায় যাবার অনুমতি মেলে।”
গল্পটা আমাকে সিন্ধবাদের অভিযানের একটা কাহিনির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। সেই অতিকায় সাপ আর ঈগলে ভরা রত্ন-উপত্যকার গল্প। তবে এখানকার গল্পটা নিজেই বহু পুরোনো। পঞ্চদশ শতকের প্রথমদিকে নিকোলো কন্টি এই এলাকা ঘুরতে এসেও একই গল্প শুনে গিয়েছেন। তাঁর লেখায় আছে, “যে-পাহাড়ে হিরের খনি, সেখানে অতিকায়, বিষধর সাপদের আড্ডা। স্থানীয় বাসিন্দারা হিরের পাহাড়ের কাছাকাছি আরও উঁচু পর্বতের মাথায় ষাঁড় নিয়ে এসে বলি দেয়। তারপর তাদের মাংসের তাল ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে হিরের পাহাড়ের দিকে। মাংসের তালের গায়ে অনেক সময় হিরের টুকরো আটকে যায়। পাহাড়ের চুড়োর কাছাকাছি এলাকায় ঈগল আর শকুনের বাসা। খাবারের গন্ধে তারা হিরের পাহাড়ের গায়ে উড়ে গিয়ে সেই মাংসের তাল নিজেদের বাসায় নিয়ে আসে। তারপর এদের বাসা থেকে লোকজন সেই হিরে খুঁজে আনে।”
অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে কিছু কুলি আর গাইড জোগাড় করে নিয়ে অবশেষে আমি রওনা দিলাম নুল্লামুল্লির পুব ঢালের সেই পাহাড়শ্রেণির দিকে। সাধারণত জঙ্গল অভিযানে আমি তাঁবুটাবু সঙ্গে নিই না। পাতাওয়ালা গাছের ডাল আর ঘাসটাস দিয়ে রাতের ডেরা বানিয়ে নিই। ওতে দুটো সুবিধে। জঙ্গল আর খাড়াই পাহাড়ে তাঁবুর বোঝা বইতে হয় না, আর সেই সঙ্গে ক্যানভাসের ছাউনির চাইতে অনেক বেশি ঠান্ডা আর আরামের হয় এই আস্তানা।
স্থানীয় চেঞ্চুদের কয়েকজনকে ভাড়া করে জঙ্গল সাফ করে রাস্তা দেখানো আর ক্যাম্পের আস্তানাগুলো গড়বার কাজে লাগিয়েছিলাম আমি। তাদের সর্দারকে খানিক তামাক উপহার দিতে সে ভারী খুশি হয়ে বলে, “সাহেব যা শিকার করতে চাইবেন সব আমি খুঁজে দেব।”
হিরের খনির কথা জিজ্ঞেস করতে অবশ্য সে হাত উলটে বলে ও-সব ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। একটুকরো হিরে বের করে তাকে দেখাতে তার মুখ দেখে বোঝা গেল ও-বস্তু সে চেনেই না মোটে। অতএব এইবার আমি অন্য পথে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম।
ও-এলাকায় নাগরাজ পাম্পুর বাসা কোথায় আছে সে-খবর জিজ্ঞাসা করতেই হাতেনাতে ফল পাওয়া গেল। দেখি ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে উঠেছে। বলে, কাছেই একটা নিচু পাহাড়শ্রেণি আছে, তার ঢালের কিছু পুরোনো খাদানে তাঁদের বাসা। তবে সেখানে নিয়ে যাবার জন্য কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না সে-তল্লাটে। সাক্ষাৎ মানুষখেকো রয়েল বেঙ্গলকে তার নিজের ডেরায় ঢুকে পিটিয়ে মারতে চেঞ্চু পিছপা হবে না। ভালুকের গুহায় ঢুকে তার গোঁফ উপড়ে আনতে বললেও সে এক পায়ে খাড়া। কিন্তু এই নাগরাজ পাম্পুর কথা উঠলেই সে ভয়ে একেবারে কেঁচো হয়ে যাবে।
সাপের সমস্ত প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বিষধর আর সবচেয়ে হিংস্র হল এই ওফিওফ্যাগাস এলাপ্স বা শঙ্খচূড়। লম্বায় সাধারণত সতেরো ফিট অবধি বাড়ে। কুরনুলের জঙ্গলে তো কিছুদিন আগে সাড়ে আঠারো ফিট লম্বা একটা শঙ্খচূড়ও শিকার করা হল। হাওয়ার আগে ছোটে। গাছ বাইতে হনুমানের চেয়েও দড়। সামনে মানুষ, জন্তু যাকে পায় বিনা কারণে তেড়ে এসে আক্রমণ করে। কাজেই যে-জঙ্গলে সে বাসা করে, আর সমস্ত জীবজন্তু, এমনকি মানুষও সে-জঙ্গলকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে।
অন্য সাপ তার প্রধান খাদ্য বলে বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন ওফিওফ্যাগাস। তবে ভারতবর্ষের বনবাসী বহু মানুষই সে-কথা মানেন না। তাঁদের দাবি, শঙ্খচূড়ের প্রধান খাবার হল হনুমানের ছানা। নাকি এহেন খানার নাগাল পাবার জন্য সে দিনের পর দিন বড়ো বড়ো গাছের ডগায় মরার মত অপেক্ষা করতে পারে।
এ-ছাড়া শূকরছানা, হরিণছানা, বুনো কুকুরেও তার অরুচি নেই। নিতান্তই নাচার না হলে নিজের জাতের প্রাণীদের মুখে তোলে না সে।
তবে কথা হল আমি নিজেই একবার একটা তেরো ফিট লম্বা শঙ্খচূড়ের ভবলীলা সাঙ্গ করেছিলাম বন্দুকের মুখে। সে তখন তার রাজকীয় খানা সারছিল। আমার বন্দুকের একটা ছ-নম্বর চার্জ যখন তার মেরুদণ্ডটা ভেঙে দেয় তখন সে সবে তার সেদিনের খানা আটফুটি এক পাইথনের অর্ধেকটাকে গলঃধকরণ করেছে। মুখ থেকে তখনো তার শিকারের মোটাসোটা চারফুটি লেজটা ঝুলছে। সেই অবস্থাতেও ভাঙা কোমর নিয়ে সে যেভাবে পাল্টা লড়াই দিতে রুখে দাঁড়িয়েছিল সেটা একটা দেখবার মত ব্যাপার।
সাধারণত তিন ধরনের গোখরো মেলে। একটা হল ছ-ফুট অবধি লম্বা হওয়া সাধারণ গোখরো, তার ফণায় চশমার মত চিহ্ন থাকে। অন্যটা বাংলা এলাকার পদ্মগোখরো। তার ফণায় পদ্মের মত ছাপ। আর তিন নম্বর হল এই রাজ গোখরো বা শঙ্খচূড়। সবচেয়ে দুর্লভ, গভীরতম অরণ্যের বাসিন্দা। এর ফণায় থাকে একটা কালো চক্কর। এ-দেশের উপকথায় বলে, ফুটখানেক চওড়া ফণার মালিক এই সরীসৃপই নাকি কৃষ্ণের মুখে ছাতা ধরেছিল তার ফণা দিয়ে। ভারতের সমস্ত অরণ্যেই এদের পাওয়া যায়। ত্রিবাঙ্কুর, নীলগিরি, আসাম, বার্মা বা ছোটোনাগপুর, সর্বত্রই এদের শিকার করবার খবর মিলেছে। একবারে আঠারোটা অবধি ডিম পাড়ে এদের মেয়েরা। কিন্তু জন্মের পরে নাকি বেশির ভাগ সদ্যোজাতই মা-বাপের খাবার হয়। এদেশের লোকজনের মতে, যেখানে এদের একটা জুড়ি বাসা বাঁধে সেখান থেকে সমস্ত ছোটো জীব পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। সে-জন্যই নাকি ক্ষিধের মুখে নিজের সন্তানকেও খেয়ে নিতে এদের বাধে না।
চেঞ্চু সর্দার পেরমলকে প্রশ্ন করলাম, ঢালের খাদানে নাগরাজ পাম্পু বাসা করেছে এ-খবর সে জানল কেমন করে? জবাবে সে বলে, আগে নাকি ও-পাহাড়ে বনমুরগি মিলত বিস্তর। কিন্তু নাগরাজ এসে সেখানে আস্তানা নিতে মুরগিটুরগি সব সে-এলাকা ছেড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। তাছাড়া, চেঞ্চুরা আগে হনুমানের ডাক নকল করে হনুমান ধরত সেখানে। এখন আর সে-ডাকে ওখান থেকে কোনো হনুমানের সাড়া মেলে না। জঙ্গলের প্রবাদ বলে, নাকি কোনো জায়গায় নাগরাজ বাসা করলে তবেই এমনটা হয়।
আমি তাকে আমার দোনলা বন্দুকটা দেখিয়ে বললাম, “আমায় নাগরাজের আড্ডায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে নাকি? কোনো ভয় নেই তোমার। সে যদি দেখা দেয় তাহলে আমার হাত থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরবে না আর।”
জবাবে সে মাথা নেড়ে বলে, “দাভারু(মালিক) নাগরাজকে চেনেন না তাই অমন বলছেন। সে বিজলির চেয়েও ক্ষিপ্র। ঝোপঝাড় পেরিয়ে তেড়ে আসবে চুপচাপ। তারপর হঠাৎ ছুটে এসে, চোখের পাতাটি নাড়াবার আগে দাঁত ফুটিয়ে দেবে। আর, একবার যদি সে-দাঁত আপনার গায়ে ফোটে তাহলে খোদ আম্মাভারু (কালী)রও সাধ্যি নেই আপনাকে বাঁচান।”
আমি বললাম, “আমি পাহাড়ের গায়ের পুরোনো খাদান দেখতে অনেক দূর থেকে এসেছি। ও-খাদান না দেখে আমি ফিরব না। তুমি যদি আমার সঙ্গে আসতে না চাও, তাহলে আমাকে একাই যেতে হবে শেষমেষ।”
শুনে সে ফিরে গিয়ে তার দলবলের সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ শলাপরামর্শ করল। তারপর ফিরে এসে বলে, “দাভারু যদি একান্তই যেতে চান তাহলে নাগরাজকে ফাঁকি দেবার একটা কায়দা আমি করতে পারি। অনেক কাল আগে এক পাথর-ভাঙা পাগল এসেছিল এ-তল্লাটে। তাকে নাগরাজের আড্ডায় নিয়ে যাবার জন্য আমার ঠাকুর্দা এই কায়দাটা করেছিল।”
কথাটা বলে পেরমল দলবল নিয়ে তার গ্রামে ফিরে গেল। বুঝতে পারছিলাম, তার আস্তিনে একটা কোনো কৌশল রয়েছে। সে কৌশল কাজে লাগিয়ে কোনো জিওলজিস্ট ও-তল্লাটে চক্কর মেরেও গিয়েছেন এর আগে।
এর পরদিন বিকেলে আমার দিবানিদ্রাটা ভেঙে যায় আমার মাদ্রাজি ছোকরা চাকরের চিৎকারে, “উ সার…সার… গ্রাম থেকে মুরগির খাঁচা এসে গেছে।”
উঠে গিয়ে দেখি পেরমল আর তার সঙ্গী এক চেঞ্চু মিলে দুটো বিরাট বিরাট ঝুড়িজাতের বস্তু বয়ে আনছে। গোটা দক্ষিণ ভারতে এ-জাতের ঝুড়িকে মুরগির খাঁচা বলে। তবে সাধারণ মুরগির খাঁচার থেকে এ-দুটো খানিক বড়ো আর আরও বেশি মজবুত করে বোনা। জিনিসগুলো নামিয়ে রেখে পেরমল বলল, “এই যে নিন। পাম্পুর বাসার কাছাকাছি যখন পৌঁছোবেন তখন এগুলোর ভেতর মাথা গলিয়ে নেবেন। ওর বুনটের ফাঁক দিয়ে সাপের মাথা গলবে না। ফলে আচমকা কামড় খাবার ভয়ও থাকবে না। আর নাগরাজ তেড়ে এলে ঝুড়িচাপা হয়ে মাটিতে বসে পড়লেই হল। তারপর বুনটের ফাঁক দিয়ে বন্দুকের নল তাগ করে নাগরাজকে নিকেশ করে দিলেই কেল্লা ফতে।”
সাপের ভয়ে মুরগির খাঁচায় ঢোকবার দৃশ্যটা ভাবতেই আমার হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু উপস্থিত ও-রাস্তা না মানলে পেরমল আমার গাইড হবে না। কাজেই তার কথাতেই উপস্থিত রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হল পরদিন সকালে আমরা রওনা হব।
পরদিন ভোর ভোর রওনা হয়ে মাইলদশেক পথ পেরিয়ে আমরা নিচু টিলাগুলোর নাগাল পেলাম। জায়গাটা নুল্লামুল্লির প্রশস্ত উপত্যকা থেকে প্রায় দুশো ফিট উঁচুতে। চারপাশে ঘন জঙ্গল। পুরোনো বৃক্ষরাজদের আকাশছোঁয়া শরীরগুলোর মাঝে মাঝে দৈত্যাকার বাঁশের নিবিড় মহল। পায়ের নিচে ঘন কাঁটাঝোপের ভিড়।
আগে আগে মুরগির খাঁচা মাথায় চলেছে পেরমল আর তার এক সঙ্গী। তাদের পেছন পেছন দোনলা বন্দুক ঘাড়ে সাবধানে এগোচ্ছিলাম আমি।
পুরোনো খাদানগুলোর কাছাকাছি এসে দেখি মহীরুহের দল অদৃশ্য হয়েছে। বোঝা যাচ্ছিল একসময় এখানটায় জঙ্গল সাফ করা হয়েছিল। পায়ের নিচের ভালো ঝোপঝাড় থাকলেও খুব পুরোনো গাছের চিহ্ন নেই তাই এলাকাটায়।
এইখানটায় পা দিয়েই পেরমল দেখি সাবধান হয়ে গেছে। একটা খাঁচা তারা দুজন মিলে মাথায় চাপিয়ে অন্য খাঁচাটা আমাকে মাথায় চাপাতে বলল সে। একটু তা না না না করে আমিও শেষমেষ রাজি হয়ে গেলাম।
খাঁচা মাথায় আধমাইলটাক পথ পেরোতে না পেরোতেই হঠাৎ ডানপাশ থেকে একটা বিচিত্র শিসের শব্দ ভেসে এল। দুই চেঞ্চু দেখি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে পড়ে খাঁচার ভেতরের সুতো টেনে ধরেছে। ওতে করে খাঁচা বেশ শক্তপোক্ত হয়ে বসেছে তাদের ঘিরে অথচ তার দেওয়ালে হাত ঠেকছে না। পেরমল তার খাঁচার ভেতর থেকে আমাকেও ইশারায় বসে পড়তে বলছিল। তারপর ফিসফিস করে সে বলে, “একজোড়া সাপ দাভারু। মেয়েটা তার জুড়িকে শিস দিয়ে ডেকে আনছে। এক্ষুণি তেড়ে আসবে দুটোয় মিলে।”
আমি আর দেরি না করে ঝুড়িচাপা হয়ে বসে তার ভেতরের দড়িটা প্রাণপণে টেনে ধরলাম।
মিনিটপাঁচেক নিঃশব্দে বসে রইলাম আমরা। সাপের আর দেখা নেই। দুই চেঞ্চু দেখি টুঁ শব্দটি না করে পাগলের মত হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে। বোধ হয় ইশারায় কিছু একটা আলোচনা করছে। কী বলছে তারা, তা বোঝবার কোনো উপায় ছিল না আমার।
এতক্ষণে, গোটা পরিস্থিতিটা যে কতটা বিপজ্জনক সেইটে টের পেতে আরম্ভ করছিলাম আমি। খাঁচাগুলো যে কতটা দরকারি তারও একটা আন্দাজ হচ্ছিল। জায়গাটায় ঝোপঝাড় বেশ ঘন। দু-এক গজের বেশি নজর চলে না। ওর ফাঁক দিয়ে সাপ আক্রমণ করলে কামড় দেওয়ার আগে টের পাওয়া মুশকিল হত। আর টের পেলেও, ঝোপঝাড়ের ফাঁকে কিলবিলিয়ে এগিয়ে আসা সরু শরীরে বন্দুক নিশানা করাও খুব সহজ কাজ হত না।
ওদিকে দুই চেঞ্চুর হাতের নাড়ানাড়ি তখন আরো বেড়ে উঠেছে। ফাঁকে ফাঁকেই আবার তারা হাত তুলে আমার খাঁচার ওপরের দিকে ইশারা করে। সেই দেখে কী মনে হতে খাঁচার দড়ি টেনে ধরে রেখে ওপরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চাইলাম আমি। সেখানে, আমার খাঁচার দেড় ফুট ওপরে ভয়ঙ্কর সেই ওফিওফ্যাগাসের ফণাটা দুলছিল। তার চিকমিকে দুটো হিংস্র চোখ আমার দিকে ধরা। ঘুরে তাকাতে চোখাচোখি হতেই একটা রক্তজমানো ফোঁসফোঁসানির আওয়াজ তুলল সে। ফণাটা লম্বায় ফুটখানেক হবে। চওড়ায় প্রায় ন-ইঞ্চি। তার মুখ থেকে ইঞ্চিতিনেক লম্বা চেরা জিভটা বারবার লক্লকিয়ে উঠছিল। তার শরীরের ঝাঁঝালো, ভেজা গন্ধে আমার মাথা ঘুরে উঠছিল। আস্তে আস্তে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল আমার।
অথচ তখনও আমার অন্য হাতে আমার দোনলা বন্দুকটা ধরাই ছিল। ইচ্ছে করলে খুব সহজেই রাক্ষসটার মুণ্ডু উড়িয়ে দিতে পারতাম আমি। তবু, কেন যে সেই মুহূর্তে সেটা আমি করিনি তা আমি নিজেই জানি না।
আমি তখন শুধু এক হাতে আমার খাঁচার ভেতরে ঝোলানো দড়িটাকে প্রাণপণে টেনে ধরে রয়েছি। খাঁচাটা যেন একচুলও না নড়ে আমার চারপাশ থেকে, সেইটেই সে-মুহূর্তেও আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল। আর, ঠিক সেই কারণেই প্রাণটা বেঁচে গেল আমার। হঠাৎ থ্বক করে একটা শব্দ হল আর তার সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে আছড়ে পড়ে সাপটার শক্তিশালী শরীরের পরপর কয়েকটা ঝাপটা এসে লাগল আমার খাঁচার গায়ে।
তাকিয়ে দেখি, মাথা থেকে ফুটতিনেক নিচে এসে বিঁধে যাওয়া একটা তিরকে মুখ দিয়ে টেনে খোলবার প্রাণপণ চেষ্টায় আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে নাগরাজ। এরপর, পরপর আরো দুটো তির নির্ভুল লক্ষে উড়ে এল সাপটার শরীরের দিকে। পেরমলদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম তাদের খাঁচার দরজা সামান্য উঁচু করে সাপটার দিকে তির ছুঁড়েছে দুই চেঞ্চু।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই হাতে ধরা দড়িটায় একটা প্রবল ঝটকা লাগল আমার। মাথা উঁচিয়ে দেখি আরেকটা বিরাট শঙ্খচূড়! খাঁচার ছাদের গায়ে দড়ির বড়োসড়ো গিঁটটাকে কামড়ে ধরে ঝাঁকিয়ে ছিঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তেরো ফুট লম্বা, আঁটোসাঁটো পেশির ওই শরীরটার শক্তি বড়ো কম নয়। বুঝতে পারছিলাম, আর বেশিক্ষণ ওর আক্রমণের সঙ্গে যুঝতে পারবে না আমার প্রাণ বাঁচানো ওই দড়ির টুকরো। আর ঠিক সেই সময় শিস দিয়ে উড়ে এল আরেকটা তির। তাকিয়ে দেখি, দু-নম্বর সাপটার ঘাড়ে রক্তের একটা দাগ ফুটে উঠেছে।
একমুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়েছিল প্রাণীটা। গিঁটের কামড় ছেড়ে ঘুরে তাকাতে গিয়েছিল নতুন আক্রমণের উৎসটার দিকে। আর সেই একটা মুহূর্তই যথেষ্ট ছিল আমার পক্ষে। চোখের পলকে খাঁচার দড়িটা হাঁটুর সঙ্গে পেঁচিয়ে নিলাম আমি। তারপর খাঁচার চৌকো ফুটোর সঙ্গে বন্দুকের জোড়া নল প্রায় ঠেকিয়ে দুটো ব্যারেলই খালি করে দিলাম ওর ফণায়।
ছিটকে পড়া শঙ্খচূড় যখন তার শরীরের ঘায়ে মাটি তোলপাড় করছে তখনও তার সঙ্গী খানিক দূরে মাটিতে পড়ে প্রাণপণে গায়ে গেঁথে যাওয়া তিরগুলোর একটাকে মুখ দিয়ে খুলে ফেলবার চেষ্টা করছিল। বন্দুকের আরেকটা গুলি তাকেও থামিয়ে দিল এবার।
খানিক বাদে পারমল বলে, “ঝুড়িগুলো এ-যাত্রায় আর কাজে লাগবে না। একটা এলাকায় একজোড়ার বেশি ও-সাপ থাকে না। এদের বাচ্চাগুলো থাকলেও থাকতে পারে হয়ত। তবে সেগুলো বেজায় ছোটোছোটো, আর আমাদের আক্রমণ করবার সাহসও পাবে বলে মনে হয় না।
তিরের ফলা দিয়ে দুই চেঞ্চু মিলে সাপদুটোর ছাল ছাড়িয়ে ফেলল এবার চটপট। সাবধানে বের করে নিল তাদের তালুর হাড়, বিষদাঁত, বিষের থলি, পিত্তের থলি। সে-সব তাদের ওষুধ তৈরির কাজে আসবে। নাকি তিলের তেলে সামান্য মিশিয়ে খেলে এ-সাপের বিষ আর যে-কোন সাপের কামড়ের ভালো ওষুধ।
একজন চেঞ্চুকে সেখানেই বসিয়ে রেখে এবার আমি পেরমলকে নিয়ে পুরোনো হিরের খাদানগুলোর খোঁজে এগিয়ে গেলাম। আর, সেখানেও আরেকটা অকল্পনীয় অভিযানের মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমাকে। পরের অধ্যায়ে সেই গল্প।
এই বইটা লিস্টে আছে..দারুণ লেখা.
LikeLike