অরিন্দম দেবনাথ এর সমস্ত লেখা
খেদাই বাগদির বেঁচে ফেরা
অরিন্দম দেবনাথ
“সাপের মেলা? কবে, কোথায়?” বন্ধুর মুখে অদ্ভুত মেলার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলাম আমি।
“আরে সেটাই তো মনে নেই। ওই ট্রেনে যেতে যেতে দুই প্যাসেঞ্জার আলোচনা করছিল সেটাই খানিক কানে এসেছিল,” বন্ধুটি বলল।
“একবার জিজ্ঞেস করতে পারলি না!”
“না জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু ভুলে গেছি।”
“দাঁড়া একবার ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখি,” আমি বললাম।
“স্নেক ফেস্টিভ্যাল … ওয়েস্ট বেঙ্গল … পূর্ব বিষ্ণুপুর… খেদাইতলা, নদীয়া জেলা…”
“মনে পড়েছে, খেদাইতলা, চাকদহ স্টেশন থেকে বাসে বা অটোতে যেতে হয়। মনসা পুজোর দিন মেলা হয়।”
“ঠিক বলেছিস, নেট-এও টাইমস অফ ইন্ডিয়ার খবর তাই বলছে।”
সাপেদের নিয়েও নাকি মেলা হয়। তাও কোলকাতা শহরের খুব কাছে। মনটা ছুঁকছুঁক করে উঠল। গেলে হয়! দুয়েকজন বন্ধুকে ফোন করলাম, “যাবি নাকি সাপের মেলা দেখতে?”
“না রে, সময় হবে না।”
“সাপ দেখলেই আমার গা গুলিয়ে ওঠে।”
“ধুর! ওই গ্রামের মেলা দেখতে কে যাবে?”
“জানিস, ওই সময় কত গরম হবে? তোর যত ক্ষ্যাপামি। তুই একাই যা।”
অর্থাৎ কেউ যাবে না। জানতাম, খুব কম লোকেরই উৎসাহ হবে গ্রামগঞ্জের অপরিচিত মেলা নিয়ে। অথচ যদি বলতাম পুষ্কর মেলায় যাব ভাবছি, তখন আমার অধিকাংশ পরিচিতই বলে উঠত, “টিকিট কেটে ফেলছি, হোটেল নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই শুধু ক্যামেরা নিয়ে চল।”
এদিকে আমাদের আশপাশে এমন অনেক অনেক কিছু ঘটে চলেছে যে, তার খবর আমরা প্রায় জানিই না।
শিয়ালদহ মেন স্টেশন থেকে ১৫ টাকার টিকিট কেটে ৮.৫০ মিনিটের আপ শান্তিপুর লোকাল ট্রেনে ৬২ কিলোমিটার দূরত্বের চাকদহ যেতে সময় লাগে ঘন্টা দেড়েক। দেবজ্যোতিকে সঙ্গী করে চাকদহ পৌঁছতে আমাদের সময় লাগল পাক্কা সাড়ে তিন ঘন্টা। টিটাগড়ে কয়েক হাজার কর্মীর এক জুটমিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার শ্রমিকরা রেললাইনে বসে পড়েছে জুটমিল খোলার দাবীতে। নিত্যযাত্রীদের ঘন্টা দেড়েক ভিড়ঠাসা ট্রেনে আর স্টেসানে স্টেসানে দাঁড় করিয়ে রেখে ঘন্টা দেড়েক পর লাইনে বসে পরা শ্রমিকদের সরিয়ে ট্রেন চলল ঠিকই, কিন্তু জানা গেল না হাজার হাজার রেলযাত্রীর কৃচ্ছসাধনে জুটমিল খুলল কী না।
ওহ্, গরমটাও পড়েছে সাংঘাতিক। দরদর করে ঘাম ঝরছে। রুমালের কম্ম নয় এই ঘাম শোষার। তাই লোকলজ্জা সরিয়ে ব্যাগ থেকে টুক করে গামছাটা বের করে নিলাম। লক্ষ্য করলাম আমাদের মত অনেকেই জিনসের প্যান্ট আর চকচকে টিশার্ট পরে কাঁধে গামছা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
একটা জুতসই চায়ের দোকান খুঁজতে গিয়ে একটা দোকানে একটা বড় ওলটানো তামার পাত্র নজরে এল। দেবজ্যোতি কানের কাছে ফিসফিস করে উঠল, “চল ওই দোকানে যাই। ওই যে পাত্রে চা হচ্ছে, ওটা কী জান?”
“ইয়ে মানে অনেকবছর আগে জম্মুর এক দোকানে চা খেতে গিয়ে এইরকম একটা জিনিস দেখেছিলাম বটে।”
“এটাকে বলে ‘সামোভার’। রাশিয়ানদের চা তৈরির যন্ত্র। কয়লা বা কাঠকয়লা দিয়ে জল গরম করার আদর্শ জিনিস। দ্যাখো ওই ওপরে যে চোঙ্গার মত বস্তুটা আছে ওটা হল ওর চিমনি। ওখান দিয়ে কয়লা ঢালে। আর নীচ দিয়ে পোড়া কয়লা বের করার জায়গা আছে। পাত্রটা ধাতুর হওয়াতে এতে খুব তাড়াতাড়ি খুব কম জ্বালানিতে জল গরম হয়। আর ভেতরের ধিকি্ধিকি্ আগুনে জল গরম থাকে অনেকক্ষণ। এই পাত্র রাশিয়া ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ, ইরান, আফগানিস্থান সহ কাশ্মীরে বহুল ব্যবর্হিত হয়।”
যতই গামছা কাঁধে স্থানীয় লোক সাজার চেষ্টা করি না কেন, স্থানীয় দোকানদাররা কী করে যেন বহিরাগতদের ঠিক চিনে ফেলে।
“দাদারা কি বেড়াতে এসেছেন? মেলায় যাবেন নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“এই প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে বনগাঁর রাস্তায় একটু এগিয়ে গেলেই মেলায় যাবার ম্যাজিক গাড়ি পেয়ে যাবেন। চা দেব?”
“অবশ্যই, ইয়ে মানে বলছিলাম এই চা তৈরির পাত্রটা কোথা থেকে জোগাড় করলেন? এটা তো এখানকার জিনিস নয়!”
“এটা আমার ভগ্নিপতি হায়াদ্রাবাদ থেকে এনে দিয়েছিল। অনেক টাকা লেগেছিল, প্রথমে বুঝতে পারিনি এটা এত কাজের হবে।”
চাকদহ মাঝারি মানের শহর। মূলত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। রাজ্যের সবচাইতে বড় সবজির হাট বসে এই শহরেই। শহরের ধার দিয়ে চলে গেছে ন্যাশান্যাল হাইওয়ে চৌঁত্রিশ।
ম্যাজিক গাড়ি কী ঠিক জানতাম না। এখানে এসে বুঝলাম। জিপগাড়ির সৎতুতো দাদার মাসতুতো ভাই। জিপের পুঁচকে সংস্করণ। আকারে জিপের ঠিক অর্ধেক। অটো বা টোটোর থেকে ঢের ভাল। চার চাকা! চেপেচুপে জনা দশেক বসতে পারে। ড্রাইভারের পাশে বসে কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ রেখে বুঝলাম এই গাড়ির সর্বোচ্চ গতি ৪০ কিলোমিটার।
ম্যাজিকে চেপে এগোতে লাগলাম চাকদহবনগাঁ রাস্তা ধরে। মসৃণ চওড়া রাস্তা। দুপাশে ঘন গাছপালার সার। মাঝে মাঝেই চোখে পরে দু একটা বাহারি রংচঙে বাড়ি। রাস্তাতে গাড়ি চলাচল তুলনামূলক কম। আহা রাজ্যের সব রাস্তাগুলো যদি এরকম ঝাঁকুনিবিহীন হত!
মিনিট কুড়ির মধ্যে চলে এল দক্ষিণ বিষ্ণুপুর গ্রাম। ড্রাইভার সাহেব জানালেন এখান থেকেই যেতে হয় খেদাইতলা।
গাড়ি থেকে নেমে দেখি লোকের ভিড়ে আক্ষরিক অর্থেই পা ফেলার জায়গা নেই। একটা সরু পিচের রাস্তা, তার দুপাশে খানকয়েক স্থায়ী দোকানের সামনে মাথার ওপর একটা প্লাস্টিকের ছাউনি খাটিয়ে সার দিয়ে খেলনা আর জিলিপি কচুরির দোকান। কোন ফারাক নেই রাজ্যের আর পাঁচটা গ্রাম্য মেলার সাথে। প্রথমেই চোখ আটকে গেল এক পানের দোকানে। ‘এখানে ফায়ার পান’ পাওয়া যায়।
‘ফায়ার পান’ সেটা আবার কী? গুটিগুটি পায়ে লোকের কনুইয়ের গুঁতো সামলে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
“ফায়ার পান বস্তুটি কী হে?”
“স্যার আপনার মুখে জ্বলন্ত মশলা পান ঢুকিয়ে দেব।”
“মানে মুখাগ্নি?”
“কী যে বলেন স্যার!”
“মুখ পুড়বে না?”
“মুখ পুড়লে কী আর আস্ত থাকতাম স্যার।”
“খেতে কি রকম?”
“একটা খেয়ে দেখুন স্যার, মাত্র কুড়ি টাকা।”
বরফের ওপর রেখে ঠাণ্ডা করা পান আগে খেয়েছি। ভাবলাম একটা জ্বলন্ত গরমাগরম পান খেয়ে দেখি।
“জর্দা দেওয়া পান হবে? না স্যার ওটা তো তামাকু হয়ে গেল। জ্বলন্ত তামাকু মুখে ঢোকাতে পারব না।”
আমি এমনি পানই খাই না। পানের ব্যাপারে জানিও না সেরকম কিছু। হামবড়াই দেখাতে গিয়ে জর্দা পানের কথা বলে ফেলেছি।
“ঠিক আছে মিষ্টি পান দাও একটা।”
অর্ডার তো দিলাম! এদিকে মনে মনে কিন্তু ধুকপুকানি চলছে। কী জানি মুখের ভেতর কীভাবে না কীভাবে আগুন ঢোকাবে। মুখ পুড়ে গেলে কী হবে, বার্নল না সিলভারএক্স লাগাব। বার্নল পেটে চলে গেলে পেট খারাপ হবে না তো?
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি পানওয়ালার হাতের দিকে। বেচাল দেখলেই টাকা দিয়ে পান না খেয়ে পালাব।
“স্যার খেজুর দেব তো? আমসত্ত্ব? কিশমিশ?”
চুপচাপ ঘাড় নেড়ে চলেছি। দেখি পানওয়ালা দ্রুত দুটো আধাআধি পান পাতার ওপর খেজুর, আমসত্ত্বের টুকরো সহ রকমারি মশলা ছড়িয়ে পানটা টেবিলের ওপর রেখে একটা খামের ভেতর থেকে একটুকরো চক্চকে্ এ এ্যলুমিনিয়াম ফয়েলের মত কিছু বের করে পানের মশলার ওপর বসিয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে একটা সস্তার লাইটার বের করে ফস করে আগুন জ্বালিয়ে বলল, “স্যার মুখটা হাঁ করে একটু সামনে আসবেন, যেই আগুনসুদ্ধু পান আপনার মুখে ঢুকিয়ে দেব ওমনি মুখ বন্ধ করে দেবেন।”
লাইটারে আগুন জ্বালাতে দেখে আমার অবস্থা খারাপ। কেন যে সাপের মেলা দেখতে এলাম! যদিও বা এলাম কী দরকার ছিল আগুনে পানের সামনে দাঁড়ানোর। রক্ষে কর মা মনসা। সামনের চায়ের দোকান থেকে দু’প্যাকেট মাদার ডেয়ারির দুধ কিনে সামনে যেই সাপুড়েকে পাব তাকেই দিয়ে দেব।
“স্যার খুব ঘামছেন, আগে গামছা দিয়ে ঘামটা মুছে নিন।” কানের পাশ থেকে ফিসফিস করে আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি বাদামি হয়ে যাওয়া একসার দাঁত বের করে তালাপাতার টুপি মাথায় দেওয়া একটা খোঁচাখোঁচা সাদাকালো দাড়িওয়ালা লোক আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সামনে মোবাইলের ক্যামেরা তাক করে দেবজ্যোতি, পেছনে টোকা মাথায় অচেনা লোক। যে দিকেই তাকাই সবাই মনে হচ্ছে আমার দিকে হাসি হাসি মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে।
“স্যার তাড়াতাড়ি মুখটা বাড়ান, বেশিক্ষণ আগুন জ্বালিয়ে রাখা যাবে না।”
যা আছে কপালে দেখা যাবে। মুখটা হাঁ করে বাড়িয়ে দিলাম পানওয়ালার দিকে।
লোকটা ফস করে এলুমিনিয়াম ফয়েলের মত কাগজটায় আগুন জ্বালিয়ে পানটা নিয়ে আস্তে আস্তে হাতটা এগোতে লাগল আমার মুখের দিকে। আগুনের শিখা কেঁপেকেঁপে উঠছে পানের ওপর থেকে। আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি ক্রমশ এগিয়ে আসা অগ্নিশিখার দিকে। একফোঁটা ঘাম কপাল বেয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে ঢুকে গেল চোখের ভেতর। চোখদুটো জ্বালা করে আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা ঢুকে গেল আমার মুখের ভেতর। আমার মুখের দিকে এগোতে থাকা দুটি হাত জ্বলন্ত শিখাতে একটা মোচড় মেরে ঠেসে ধরল মুখের ভেতর।
“মুখ বন্ধ করে দিন স্যার। টেস্ট কেমন? বিয়ে বাড়িটারিতে পানপার্লার লাগলে বলবেন স্যার। ঠিকঠাক দাম নিয়ে করে দেব। ফোন নাম্বারটার ছবি তুলে নিয়েছেন তো?”
আঃ, সব দুশ্চিন্তা নস্যাৎ করে দিয়ে মুখটা ভরে গেল মিষ্টি স্বাদে। গাল ফুলিয়ে পানওয়ালাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগিয়ে মিশে গেলাম ভিড়ের মাঝে।
সামান্য এগোতে না এগোতেই ভিড়টাই ঠেলে ঢুকিয়ে দিল একফালি কংক্রিট বাঁধানো সরু রাস্তায়। রাস্তাটা মেরেকেটে ফুট পাঁচেক চওড়া হবে। রাস্তার দুপাশে, গাছের ছায়ায়, লোকের বাড়ির উঠোনে সার দিয়ে পসরা নিয়ে বসে আছে বিক্রেতা। গ্রাম্য চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে আদর্শ বস্তুসম্ভার। কী নেই?
বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার জাল। নানান মাপের সস্তার কাঠের ফ্রেম বাঁধানো আয়না।
ছাপা শাড়ি। মাছ ধরার চেরা বাঁশের ঘের। মাছ ধরে, সেটা রাখার হাতলওয়ালা ঝুরি।
চাষের জমিতে কাজ করার সময় রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য তালপাতার টোকা। ছাতা।
বিভিন্ন মাপের বঁটি দা।
মাছ ধরার ট্যাঁটা।
পাখির খাঁচা।
নানা আকারের বাঁশি, ঝুড়ি, ধামা, কুলো।
পেতলের ছোট ছোট ঠাকুর, পুজোর বাসন।
পাথরের ছোট ছোটঠাকুরদেবতার মূর্তি।
কাঠের টুল, বেঞ্চ, রুটি বেলনি, ঠাকুরের সিংহাসন। সস্তার প্লাস্টিকের খেলনা…। একদম সব পেয়েছির আসর।
কিন্তু সব ছাপিয়ে নজর কেড়ে নিল মাটিতে শুইয়ে রাখা সার সার কালোবাদামি নানা রঙের আর মাপের হুঁকো।
হাফ পাঞ্জাবী আর ধুতি পরা এক ভদ্রলোক হুঁকো বিক্রেতার সামনে দাঁড়িয়ে হুঁকোতে মোক্ষম টান দিয়ে যাচাই করে নিচ্ছেন হুঁকোর মান। একটা কিনে ফেললাম। কালেক্টরস আইটেম!
কিন্তু যেই জন্য আসা সেই সাপুড়ে আর সাপের দল কোথায়? আর মনসা মন্দির? আমার পেছনের এক মহিলাকে জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে বলল “পরথম বার এইসেছেন? এই রাস্তা ধরি চল্তি থাকেন … মাইল দেড়েক পরে মনসার থান আইস্বে। যা গরম। একদিকি ভাল। বিরিস্টি হইলে কাদা দিয়ে হাঁইটতে পাইরতেন না গো বাবু। এই রাইসাতাটা তো হালে হইয়েছে।”
“সাপুড়েরা কি ওই মনসা মন্দিরের কাছেই বসে?”
“যাতি যাতিই মাঠের মধ্যে দেখতি পাবেন গো। ও দিদি পুজো হইয়ে গেল?”
উল্টোদিক থেকে আসা আরেক পরিচিত ভদ্রমহিলাকে দেখে, দুজনেই রাস্তা ছেড়ে হাতে হাত জড়িয়ে নেমে দাঁড়ালেন। রাস্তার মধ্যে দাঁড়াবার জো নেই। মানুষের স্রোত ঠেলে নিয়ে যাবে সামনে। বাচ্চা বুড়ো সব বয়সি নারীপুরুষ টুকটুক করে এগিয়ে চলেছেন। আশ্চর্য একটুকু হইহট্টগোল নেই? মাইক বাজছে না কোথাও! এত সুশৃঙ্খল বঙ্গের মানব স্রোত!
হুঁকোর দোকান পার হয়ে আসার খানিক সময়ের মধ্যে মাথার ওপর থেকে গাছের সার আচমকা উধাও হয়ে গেল। দুদিকে সার দিয়ে সব্জির ক্ষেত। কোন বড় গাছ নেই এখানে। একদম নির্ভেজাল চাষের দুনিয়া। সবকটা সব্জি চিনি। লতানে গাছের ডাল থেকে ঝুলছে হাজার হাজার পটল, ঝিঙ্গে আর শসা। ঝকঝকে নিল আকাশে সাদা সাদা পেঁজা মেঘের ফাঁক দিয়ে ঝলমলে রোদ্দুর গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে। কাঁচা পাঁপড় খানিক ফেলে রাখলে রোদের তাপে সেঁকা হয়ে যাবে। এরই মাঝে বড় বড় রঙিন ছাতা মাথায় দিয়ে ব্যাপারির দল ঘাসের ওপর বসে আছে। দরদর করে ঘাম ঝরছে। সঙ্গে আনা জলের বোতল খালি। শুকনো গলায় জ্বালা হচ্ছে। আশপাশে জলের চিনহ্ পর্যন্ত নেই। এই পথের শেষ কতদূর? সঙ্গী দেবজ্যোতি যে কোথায় আছে কে জানে? ওর কাছে জল আছে কী। ফোন করব? এই রে টাওয়ার নেই।
ঘাসের ওপর গোটা কয়েক মাছ ধরার জাল স্তূপ করে ছাতা মাথায় বসে থাকা এক বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম “একটু জল কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?”
লোকটি একটি আধা শেষ হয়ে যাওয়া জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন “গলা ভেজাবেন নাকি বাবু? খুব গরম হয়ে আছে। এই আর খানিক হাঁটলেই মথুরাগাছি গ্রাম আসবে। ওখানেই কারো বাড়ির চাপাকল থেকে জল পেয়ে যাবেন।”
জলের বোতলটা নিতে একটু দোনামনা করছিলাম। আমি যদি খানিক জল খেয়ে নেই তাহলে এই পাঁপরসেঁকা রোদ্দুরে লোকটার জন্য আর কতটুকু জলই বা থাকবে। লোকাটার কাছে তো আর কোন জলের বোতল দেখতে পাচ্ছি না!
“ইয়ে, মানে বলছিলাম, আপনার বোতলেও তো সামান্য জল পরে আছে। আমি এখান থেকে…”
“মা মনসার থানে এয়েচেন আর জল নেই বলে কষ্ট পাবেন? দুঢোঁক খেয়ে নিন।আমার লাগলে আমি এনে নেব।”
সামান্য জল গলায় যেতে খানিক স্বস্তি পেলাম। জলের বোতল ফেরৎ দিতে দিতে বললাম “আচ্ছা ভাই এইটা তো সাপুড়ে আর সাপের মেলা বলে শুনেছি, তা সাপুড়েরা কোথায়?”
“বাবু ওরা এই মাঠেই বসত। এইখান থেকে শুরু করে সেই মন্দির পর্যন্ত ওঁদের দেখা যেত। কত দুর দুর থেকে যে আসত! এবার পুলিশ আর ফরেস্টএর লোকজন ওঁদের বসতে দেয়নি। গতবছরই পুলিশ বলে দিয়েছিল যে এবার থেকে একজন সাপুড়েকেও বসতে দেবে না। কোন সাপুড়েকে সাপ নিয়ে দেখলেই এরেস্ট করবে।”
“কিন্তু কেন?”
“বাবু অবোলা জীবদের দিয়ে খেলা দেখানোটা কী ঠিক? ওঁরা অনেকেই বিষ দাঁত না ভাঙ্গা সাপদের মেলায় আসা লোকেদের গায়ে ছুঁড়ে দেবার ভয় দেখিয়ে টাকা পয়সা আদায় করত। এইসব করে দুএকজন আগে মারাও গেছে। তাই প্রশাসন খুব কড়া হয়ে গেছে। পুজা কমিটিও বলে দিয়েছে কাউকে সাপ নিয়ে খেলা দেখাতে দেখলেই পুলিশের হাতে দিয়ে দেবে।”
“তাহলে তো মেলার গুরুত্ব কমে গেল?”
“কেন বাবু? এ’বছরও তো একইরকম লোকের ভিড়। এরকম মেলা এই তল্লাটে খুঁজে কোথাও পাবেন না। কোন ঝুটঝামেলা হয়নি আজ পর্যন্ত।”
“তার মানে সাপুড়েরা বনদপ্তরের কথা শুনে এবার আর আসেনি।”
“না বাবু, ওঁরা আছে তবে এখানে নয়। এখান থেকে খানিক দূরে ছোট খেদাইতলা নামে আরও একটা মন্দির গড়ে উঠেছে।ওখানেও একটা ছোটখাট মেলা বসে। খবর পেয়েছি ওইখানে সাপ নিয়ে অনেক সাপুড়ে এসেছে।”
“পুলিশ ওঁদের ধরবে না?”
“বাবু পুলিশ আর কত করবে, মানুষ সচেতন নাহলে কিছু হয় নাকি?”
যাক, আসল কাজটা পুলিশ আর প্রশাসন এখানে করতে পেরেছে। ‘মানুষকে সচেতন।’
সঙ্গে একটা ছাতা পর্যন্ত নেই। একটু ছায়া পেলে বড় আরাম হত। আশপাশ দিয়ে প্রায় সবাই চলেছে ছাতা মাথায়। কানে এল ঢোলের আওয়াজ। জলদাতা বলে উঠল “এগিয়ে যান বাবু সামনে মাদারি দড়ির ওপর হাঁটার খেলা দেখাচ্ছে। খেদাইতলা আর খুব দূরে নেই।”
মাঠের ওপর দিয়ে খানিক হেঁটে আবার সেই ঢালাই রাস্তায় এসে উঠলাম।একটা বাঁক নিতেই নজরে এল দূরে একটা অসমাপ্ত পাকা বাড়ি। তার উল্টোদিকে একফালি লম্বা ফাঁকা জমিতে দুপাশে দুটো করে আড়াআড়ি খুঁটির সাথে বাঁধা একটা মোটা লম্বা দড়ির ওপর দিয়ে একটি বাচ্চা ছেলে হাতে সরু এক বাঁশের ডাণ্ডা নিয়ে দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে। পরনে একটা ঘিয়ে রঙের ফুল প্যান্ট আর সবুজ হাফ হাতা জামা। মাথায় লাল টুপি। দুপাশে ছড়ানো সামান্য ভাঁজ কড়া হাতের কনুই বেয়ে টপ্ টপ্ করে ঘাম ঝরছে। সামনে ভিড় করে থাকা দর্শকদের একজন দড়ির ওপর দিয়ে টলতে টলতে এগোতে থাকা সদ্য কিশোরটির পায়ের নীচে দাঁড়িয়ে শিস দিয়ে টাকা দেখিয়ে চলেছে। কতই বা বয়স হবে ছেলেটির? বছর বারো। ছেলেটি কিন্তু একবারও একবারও টাকা নিতে হাত বাড়াল না। ওঁর লক্ষ্য স্থির। দড়ির ওপর প্রান্ত। ও ভালই জানে শূন্যে ভাসমান দড়িতে ব্যালেন্স করে এগোনোর সময় একটু বেসামাল হলেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। শূন্য থেকে নীচের জমিতে আছড়ে পরে শুধু হাতপাই ভাঙ্গবে না, সাথে জুটবে দর্শকদের কটূক্তি।
মাদারিদের থেকে খানিক এগোতেই আবার শুরু হয়ে গেল বাড়িঘর। বুঝলাম এটাই মথুরাগাছি গ্রাম। মা মনসার থানও যে বেশী দূরে নেই টের পেলাম সরু রাস্তার দুধারে বসে থাকা পুজোর উপকরণ বিক্রেতাদের দেখে। সরু রাস্তার দুধার জমজমাট ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়ে। শুনলাম এই মেলাটা বছরে এই একদিনের জন্যই বসে শ্রাবণ সংক্রান্তির দিন।
রাস্তার ধারের একচিলতে এক দোকানের কাছে খুঁজে পেলাম দেবজ্যোতিকে। সে আরামকরে দোকানির বাড়ির গাছের নিচে এক বাঁশের মাচায় বসে ছিল। কি আশ্চর্য ওই দোকানে বোতলবন্দি ঠাণ্ডা জলও পেয়ে গেলাম। খিদেটা মাঝে মধ্যে মিনমিন করে খোঁচা দিচ্ছে। একটু চা পেলে ভাল হত। লুচি ঘুগনি, রুটি তরকারি, ভাতডালসব্জি সব পাওয়া যাচ্ছে। শুধু চায়ের খোঁজ নেই। জনাকয়েক পুলিশকর্মী বসেছিল অন্য একটি দোকানের সামনে, ওই দোকানে গিয়ে চায়ের সন্ধান করতেই একসাথে হেসে উঠলেন ওঁরা। “ওফ্ কখন থেকে যে চায়ের খোঁজ করছি, কোত্থাও চা পাইনি।”
এতক্ষণে একটা মাইকের হাল্কা আওয়াজ কানে এল। শুনতে পেলাম ঢাকের বাদ্যি। পথ নির্দেশের প্রয়োজন নেই। ভিড়ের স্রোতে নিজেকে গুঁজে দিলেই হল।
ভিড়ে ভর করে পৌঁছলাম এক বিশাল পুকুরের ধারে। পুকুর না বলে দীঘি বলাই ভাল।
বাঁশ আর প্লাস্টিক টাঙিয়ে গোটা কয়েক অস্থায়ী দোকানের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল এক মন্দির। অসমাপ্ত সদ্য তৈরি। মনটা দমে গেল। একে তো সাপ আর সাপুরদের দেখা পাইনি। ভেবেছিলাম অন্তত একটা প্রাচীন স্তাপত্য দেখতে পাব। কোথায় কী?
তবু গুটিগুটি এগিয়ে গেলাম মন্দিরের দিকে। আচমকা ঢাক আর ঢোলের আওয়াজ শুরু হয়ে গেল মন্দিরপ্রাঙ্গনের এক টিনের চালার তলা থেকে। ঢাক ঢোলের আওয়াজকে ছাপিয়ে কানে এল ছাগলের আর্তনাদ। আর এগোলাম না। চলে এলাম পুকুরের ধারে। রক্তপাত আমার সহ্য হয় না। শুনেছিলাম পশুবলি নাকি বন্ধ হয়ে গেছে!
পুকুরের পারে আলাপ হল শ্রী অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে। ৭৪ বর্ষীও এই মন্দিরের পুরোহিতের কাছ থেকে জানা গেল অনেক ইতিহাস।
“প্রায় ৩০০ বছর ধরে এইখানে পুজো হয়ে আসছে। মনসা মায়ের পুজো হলেও এটা আসলে গাছের পুজো। নদীয়া জেলার বহু জায়গায় এই দিন গাছের পুজো হয়।একটা সময় এই পুরো অঞ্চলটাই ছিল জলা জায়গা। যে সামান্য কিছু লোক এই অঞ্চলে বাস করত তারা প্রায় সকলেই ছিলেন মৎস্যজীবী ও চাষি। বর্ষাকালে এই অঞ্চলে প্রায় একবুক জল হয়। এখন কিছু ঘরবাড়ি হলেও আগে প্রায় কিছুই ছিল না। বর্ষাকালে কলা গাছের ভেলা নিয়ে এখানে মাছ ধরত বাগদি সম্প্রদায়ের মানুষরা।” বললেন অশোক বাবু।
এতক্ষণে বুঝলাম কেন এত মাছ ধরার সরঞ্জামের ছড়াছড়ি মেলা জুড়ে।
“আসাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মিজোরাম, উড়িষ্যা, বিহার থেকে প্রচুর সাপুড়ে এখানে আসে এই সময়। বৃষ্টির জল জমা হলেই মাটির গর্ত ছেড়ে সাপের দল বেড়িয়ে আসে। সেই সাপ ধরে তার বিষ সংগ্রহ করতেই আসে সাপুড়েরা। যেহেতু ৩১শে শ্রাবন মনসা মায়ের পুজো উপলক্ষে এই মেলা, তাই মনসার বাহন হিসেবে সাপের খেলা ও প্রদর্শনীর চল্ হয়ে ছিল। মায়ের অশেষ কৃপা এবছর থেকে সাপেদের নিয়ে খেলা বা প্রদর্শনী পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে।”
“এই পুজোটা স্থানটি যে ৩০০ বছরেরও বেশী প্রাচীন তা আপনারা জানলেন কী করে?” আমি বললাম।
“আমরা নিশ্চিন্ত হয়েছি আমার দাদুর লেখা এক ডাইরির সুত্র ধরে। তিনি ওই ডাইরিতে এই খেদাইতলার ইতিহাস লিখে গেছিলেন।”
“আমাদের আদি পুরুষ রামশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ৩৭ বছর বয়সে স্বপ্নে দেখেন যে মা মনসা তাকে বলছেন যে ‘আমি নদীয়া জেলার এক বিশাল বিলের দক্ষিণপশ্চিম কোনে নিম গাছের নিচে আছি। তুই এসে আমাকে পুজো দে’। আমাদের আদি বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে। তিনি এই স্বপ্নকে গুরুত্ব দেননি।”
“পরের বছর আবার একই স্বপ্ন। এই শ্রাবণ মাসে। তুই বিলে গিয়ে আমায় পুজো দে। বিলের মাঝে দেখবি নিম গাছের পাশে অশ্বত্থ ও কুল গাছ আছে। সেখানেই আমাকে পাবি।”
“জানেন তো নিম গাছের তলায় জন্ম হয়েছিল ছিল বলে চৈতন্য মহাপ্রভুর নাম ছিল নিমাই।”
“এবার আর তিনি স্বপ্নাদেশ উপেক্ষা করতে পারেননি। খোঁজ করতে করতে নদীয়া জেলায় এরকম এক বিলের খোঁজ পেলেন। শুনলেন এই বিল হল সাপের আস্তানা। অনেক নদীনালা পেরিয়ে বিলের কাছে এসে বিলের দক্ষিণপশ্চিম কোনে অশ্বত্থনিমকুল গাছের সহাবস্থানের কথা জেনে, খানিক সাঁতরে সেখানে পৌঁছে পুজো দিলেন। বিলের সাপের আস্তানা যে মা মনসারই আবাস, স্থানীয় লোকেরা জেনে গেলেন। সুদূর বরিশালের সোলক গ্রাম থেকে ঘোর বর্ষায় জলে টইটম্বুর যমুনা ইছামতী নদী ধরে এসে এক ব্রাহ্মণের পুজোর কথা প্রচার হতে বিলের নাম হয়ে গেল সলাকির বিল।”
“রামশঙ্কর মারা যাবার পর তার পুত্র রামজীবন বছরে একবার এসে এই পুজোর দায়িত্ব নিলেন। রামজীবনএর পর পুজোর দায়িত্ব পেলেন গঙ্গাপ্রসাদ। তিনি দেখলেন বিলের মাঝে কলার ভেলা বানিয়ে নিমঅশ্বত্থকুল গাছের কাছে পৌঁছে পুজো দেওয়া খুবই কষ্টকর। তিনি তখন মা মনসাকে বললেন এইখানে এসে এইভাবে আর পুজো দিতে পারব না, যদি না তুমি অন্য কোন জায়গা দেখিয়ে দাও।”
খানিক থামলেন একমুখ সাদা দাড়ি নিয়ে গরমে হাঁসফাঁস বৃদ্ধ। দর্দর্ করে ঘাম ঝরছে সারা শরীর দিয়ে। মাথায় ফেট্টি দিয়ে বাঁধা গামছায় ঘাম মুছে আবার বলা শুরু করলেন।
“তারপর উনি স্বপ্নাদেশ পেলেন ‘দেখবি বিলের মাঝে এক পুকুরের ধারে ঈশানকোনে ওই একই রকম গাছ আছে। এবার থেকে সেখানে গিয়ে পুজো করবি।’ খানিক খোঁজ করতেই এক বিশাল পুকুরের ধারে মানে এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে নিমঅশ্বত্থকুল গাছের সহাবস্থান দেখা গেল। এটা এই পুকুরের ঈশানকোন। তারপর থেকে এখানেই পুজো শুরু হল।”
“এইখানে নিমগাছের তলায় মনসা মায়ের নামে পুজো শুরু হতে সাধারণ লোকেরাও পুজো দিতে শুরু করল। সর্পদেবীর জাগ্রত থান বলে পরিচিতি পেয়ে গেছে এই স্থান। কিন্তু এই স্থানটি শুধু নির্জনই নয় দুর্গমও ছিল। খড়ের জঙ্গল ছিল চারদিকে।”
“এই বিলের আসেপাশে তখন বাগদি, দুলে এই সব নিম্নবর্গের মানুষের বাস। এঁদের জীবিকা ছিল মাছ ধরা আর অন্যের জমিতে জন খাটা।”
“এইরকম একজন মানুষ ছিলেন খেদাই বাগদি। খেদাই বাগদির কোন সন্তানাদি ছিল না। একবার শ্রাবণ সঙ্ক্রান্তির দুদিন আগে খেদাই বাগদির বউ খেদাইকে বলল ‘আমার ইচ্ছে হয়েছে, নিমতলায় যাব মায়ের পুজো দিতে। নিয়ে যাবে আমায়?’ এইকথা শুনে খেদাই খুব রেগে গিয়ে বলল, ‘আমি ওইসব দেবদেবী মানি না। এত রাস্তা জলকাদা ভেঙে তোকে যেতে হবে না’। শুধু তাই নয়, রেগে গিয়ে কলার কাঁদি সুদ্ধু বাড়ির সব গাছ কেটে ফেলল। বাছুরের গলার দড়ি খুলে গরুর সব দুধ খাইয়ে দিল যাতে খেদাইএর রাগ দেখে, বউ আর দুর্গম নিমতলায় গিয়ে পুজো দেবার ইচ্ছে প্রকাশ না করে।”
“পরদিন সকালে অন্যের চাষের জমিতে দিনমজুর খাটতে গিয়ে সাপের কামড় খেল খেদাই। লোকজন ছুটে এসে অনেক ওঝাগুণিন ডেকেও বাঁচাতে পারল না খেদাইকে।সবাই বলল সাপে কাটা দেহ কলার ভেলায় করে জলায় ভাসিয়ে দাও। এই কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে খেদাইএর বউ বলল দেবীর অভিশাপ নেমে এসেছে, দেবীর থানে পুজো না দেবার জন্যই সাপে কেটেছে আমার স্বামীকে। নিমতলায় দেবীর থানে গিয়ে শাঁখা সিঁদুর সুদ্ধু স্বামীর সাপেকাটা দেহ ওই গাছের তলায় রেখে দেব।”
“সেই দিনটা ছিল শ্রাবণ পূর্ণিমার আগের দিন। শ্রাবণ মাস, ঝড় বৃষ্টির সময়। খেদাইএর বউয়ের ইচ্ছেতে গ্রামের লোকেরা বিকেল বেলা খেদাইএর দেহ নিমগাছের তলায় রেখে দিয়ে গেল। পরদিন ৩১শে শ্রাবণ অর্থাৎ ঠিক আজকের দিনে জলকাদা ভেঙে পুজো দিতে এসে সবাই দেখে খেদাইএর মৃতদেহ আর গাছের তলায় নেই। সে প্রান ফিরে পেয়ে ফিরে গেছে বাড়িতে। সেই থেকে এই জায়গাটার নাম হয় খেদাইতলা। মানুষের বিশ্বাসে স্থানমাহাত্য বেড়ে গেল অনেক। লোকে এসে মানত করা শুরু করল। মনের আকাঙ্খা দেবীর কাছে ব্যাক্ত করে দড়ির টুকরোর নিচে একটা ঢিল বেঁধে যেত ঝুলিয়ে দিয়ে যেত গাছে। তারপর মনকামনা পূর্ণ হয়ে গেলে সেই সুতোর টুকরো আবার এসে খুলে নিয়ে যেত। এখনও আশেপাশের সব গাছ ভর্তি হয়ে যায় সুতোর টুকরোয়। এটা দিনকে দিন বাড়ছে।”
“অথচ দেখুন শতাব্দী প্রাচীন সেই নিমগাছটাই মরতে বসেছে।” গামছায় চোখ মুছলেন বৃদ্ধ।
“এর জন্য দায়ী কে জানেন? এই আমরা! আগে এইখানে শ্রাবণ মাস ছাড়া অন্য কোন সময় পুজো হত না। আমি সারা বছর এখানে থাকি না। ২০০০ সাল নাগাত এক মিটিঙে প্রস্তাব এল, যে সারা বছর এখানে পুজোর ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? তাতে অনেক পুর্নার্থি তাঁদের মনকামনা দেবতার কাছে জানাতে পারবে। তাছাড়া এতে করে জায়গাটাও খানিক জমজমাট হবে। ঠিক হল প্রতি শনিমঙ্গলবারে পুজো হবে। স্থানীয় এক পুরোহিতকে পুজোর দায়িত্ব দেওয়া হল।”
“বহু বছর আগে আমার বাবা প্রভাত বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে একটা টিনের চালা করে দিয়েছিলেন। সেটাকে হটিয়ে নিমগাছকে বেড় দিয়ে কংক্রিটের ছাদ দেওয়া হল। ফলে গাছ তার স্বাভাবিক জল সিঞ্চন থেকে বঞ্চিত হল। উপরন্তু পূর্নার্থিদের প্রতিনিয়ত দুধ চিনির জল গিয়ে জমা হতে শুরু হল গাছের বাঁধানো গোড়ায়। দুধ আর চিনির অম্লই গাছটাকে অসুস্থ করে তোলার মূল কারণ।”
মন্দির থেকে ডাক পড়ল অশোক বাবুর।