বিদেশি গল্প কাপড়-মেলা দড়ির রহস্য ক্যারোলিন ওয়েলস অনু অমিত দেবনাথ বসন্ত ২০১৯

অমিত দেবনাথ    এর সমস্ত লেখা

কাপড়-মেলা দড়ির রহস্য

অনুবাদঃ অমিত দেবনাথ

অব্যর্থ গোয়েন্দা সংঘের অব্যর্থ গোয়েন্দারা ফকির স্ট্রিটের ঘরে সবে গুছিয়ে বসেছেন, ঘরে ঢুকলেন সংঘ সভাপতি হোমস, অন্য দিনের তুলনায় বিষণ্ণ বদনে, বিষণ্ণ মেজাজে এবং তৎক্ষণাৎ সবাই বুঝে গেলেন বড়  কোনও ঘটনা ঘটেছে।

“বড় ঘটনাই ঘটেছে”, তাঁদের বুঝে ফেলা বুঝে ফেলে বললেন হোমস, “খুবই রহস্যময় ঘটনা – বড় পুরষ্কার আছে সমাধান করতে পারলে। কিন্তু পেয়ারে ভাইয়োঁ, আমার ঘোর সন্দেহ আছে তোমরা এতে দাঁত ফোটাতে পারবে কি না। তোমরা এ ব্যাপারে কোনও শুলুকসন্ধানও আমাকে এনে দিতে পারবে কি না সন্দেহ, যাতে আমি নিজেই সমাধানটা করতে পারব।”

“হুঃ!” একটা অবজ্ঞাসূচক আওয়াজ বেরিয়ে এল এক অব্যর্থ গোয়েন্দার মুখ থেকে, যাকে সবাই থিংকিং মেশিন বলে জানে। যে কোনও ধরণের মৌলিক চিন্তা ভাবনায় এঁর জুড়ি নেই।

“এ যে দেখছি মানসম্মান নিয়ে টানাটানি করে”, বললেন র‍্যাফেলস তাঁর মোহন হাসি হেসে, “হোমস, বলে ফেল দিকি, ব্যাপারখানা কী?”

“দারুণ রহস্যময় একটা ঘটনা ঘটেছে শহরের পুব দিকে।” হোমস মানুষটি দীর্ঘ, কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর বক্তব্যটি তিনি হ্রস্ব করেছেন, কারণ তাঁর বাছাই করা সহকর্মীদের এদৎ আচরণে তিনি অত্যন্তই বিরক্ত। তবে যেহেতু তাঁর সঙ্গে ওয়াটসন আছেন, অতএব তিনি এঁদের – এই অতীত দিনের বিখ্যাতদের আচার ব্যবহারকে পাত্তা দিলেন না।

“পুব দিকের সমস্ত ঘটনাই কি রহস্যময় নয়?” জিজ্ঞেস করলেন আর্সেন লুপিঁ, তাঁর চোখে বিজ্ঞ চাহনি।

 হোমস তাঁর কপালে ক্লান্তভাবে একবার হাত বোলালেন। এঁদের নিয়ে কাজ করা যে কী সমস্যার ব্যাপার, তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।

“ইনস্পেক্টর স্পায়ার যাচ্ছিলেন উঁচু রেলপথ দিয়ে”, বললেন হোমস, “তো তিনি যখন – যেখানে ভাড়া বাড়িঘর বেশি, সেই জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর নজরে আসে একটা বাড়ির উঁচু জানলা থেকে আরেকটা বাড়ি পর্যন্ত একটা জামাকাপড় মেলার দড়ি টাঙানো আছে, মাঝখানে উঠোন।”

“সেদিন কি সোমবার ছিল?”জিজ্ঞেস করলেন থিংকিং মেশিন, যিনি সেই মুহূর্তে নিজেকে ওয়াশিং মেশিন ভাবছিলেন।

“তাতে কিছু আসে যায় না। সেই দড়ির মাঝখানে ঝুলছিল –”

“জামাকাপড়ের ক্লিপ দিয়ে কি?” দু’তিনজন অব্যর্থর একযোগে প্রশ্ন।

“ঝুলছিল এক সুন্দরী মহিলা।”

“গলায় ফাঁস দিয়ে?”

“না। আগে শোন! দুহাত দিয়ে ঝুলছিল আর চেষ্টা করছিল এই বাড়ি থেকে ওই বাড়ি যাওয়ার। তার মুখচোখের অবস্থা দেখে ইন্সপেক্টরের বদ্ধমূল ধারণা হল সে আর বেশিক্ষণ ঝুলে থাকতে পারবে না। তিনি তক্ষুনি সিট ছেড়ে লাফিয়ে উঠে নামতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।”

“মহিলা কি করছিল সেখানে?”

“পড়ে গেল কি?”

“তাকে দেখতে কেমন লাগছিল?”

এরপর এরকম গাদা গাদা গাধাটে প্রশ্ন ছিটকে ছিটকে বেরোতে লাগল অব্যর্থ গোয়েন্দাদের মুখ থেকে।

“আস্তে। চুপ কর সবাই, যতটা জানি বলছি। মহিলা শৌখিন, কারণ তার পরনে ছিল একটা শিফনের ইভনিং গাউন, যেগুলো গোটানো যায়। গায়ে ছিল দামি গয়না, পায়ে ছিল মনিমুক্তো দেওয়া দামি চপ্পল। গোড়া বাঁধা একঢাল চুল পিঠ অবধি ছড়ানো।”

“যাচ্চলে! এসবের মানে কি?” বললেন মঁসিয়ে দুপিঁ, যিনি বরাবরই সোজাসুজি কথা বলা পছন্দ করেন।

“আমি এখনও জানি না”, সত্যি কথাই বললেন হোমস। “আমি তো মাত্র কয়েকমাস ধরে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি। তবে বার করে ফেলব, চিন্তা নেই। ওই ভাড়াটে বাড়ির পুরো ব্লকটাই ভেঙে ফেলতে পারলে ভাল হয়। কোনও না কোনও সূত্র সেখানে আছেই।”

“সাবাস, হোমস! সাবাস!” ঘরের কোনায় রাখা একটা ফোনোগ্রাফ থেকে বেরিয়ে এল কথাটা। ওয়াটসন ঘরে না থাকলে ওটা এভাবেই ঠিক করে রেখে যান, আর এই মুহূর্তে তিনি ঘরে নেই।

“পুলিশ আমাদের ব্যাপারটা দেখতে বলেছে, সমাধান করতে পারলে পুরস্কারও মিলবে। কাজেই তোমরা দেখ মহিলা কে, সে কি করছিল এবং কেনই বা করছিল।”

“আর কোনও ক্লু?” জিজ্ঞেস করলেন মঁসিয়ে ভিডক, এবং প্রায় একই সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন মঁসিয়ে লেকক, “পায়ের ছাপ-টাপ?”

“একটাই পায়ের ছাপ আছে, আর কিছু নেই।”

“সেই পায়ের ছাপটা কোথায়?”

“মহিলা যেখানে ঝুলছিল, ঠিক তার নিচে।”

“কিন্তু তুমি বললে দড়িটা মাটি থেকে ওপরে ছিল?”

“একশো ফুটেরও ওপরে।”

“আর সে নেমে এল আর মাত্তর একখানা পায়ের ছাপ ফেলল! যত্তসব!” তাঁর বিজ্ঞ হলদে মাথাটি নেড়ে বললেন থিংকিং মেশিন।

“সে ওরকম কিছুই করেনি”, বিরক্ত হয়ে বললেন হোমস, “কথা না শুনে মন্তব্য করলে এইরকমই হয়। শোন সবাই, বাড়ির সব ভাড়াটেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু সে সময় কেউই নাকি  বাড়িতে ছিল না। সামনের রাস্তায় একটা প্যারেড হচ্ছিল, সবাই সেটা দেখতে গেছিল।”

“তার আগের রাত্রে হালকা তুষারপাত হয়েছিল কি?” ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন লেকক।

“ঠিকই বলেছ”, বললেন হোমস, “না হলে আর আমরা এত সব জানলাম কী করে? যাই হোক, মহিলার পা থেকে জুতো খুলে পড়েছিল এবং যদিও জুতোটা খুঁজে পাওয়া যায়নি, কারণ বাড়িতে যে ভাড়াটে প্রথম ফিরেছিল, সে-ই ওটাকে ঝেড়ে দেয় – আমি পায়ের ছাপটা একবার দেখেছিলাম। চপ্পলটার মাপ হল আড়াই ডি। মহিলার পক্ষে বড্ড ছোট।”

“তুমি জানলে কী করে?”

“মহিলারা সব সময় ছোট চটিই পড়ে।”

“তা হলে সে চটিটা খুলল কী করে?” বলে উঠলেন র‍্যাফেলস, যেন যুদ্ধজয় করে ফেলেছেন।

হোমস তাঁর দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকালেন, “মহিলা পা থেকে চটিটা ঝেড়ে ফেলেছিল বেশি টাইট বলে। মহিলারা সবসময়েই চটি ঝেড়ে ফেলে – ব্রিজ খেলার সময়, অপেরা বক্সে থাকার সময়, ডিনারের সময়।”

“কাপড় টাঙানোর দড়ি পারাপারের সময়ও করে নিশ্চয়ই?” তীব্র ব্যঙ্গোক্তি শোনা গেল লুপিঁর গলায়।

“করে বইকি”, বললেন হোমস কপালে ভাঁজ ফেলে। “পায়ের ছাপ দেখে পরিস্কার বোঝা গেছে মহিলা ধনী, ফ্যাশনদুরস্ত, উচ্চতায় সামান্য খাটো, একশো ষাট পাউন্ড ওজন, প্রাণবন্ত স্বভাব –”

“ঝুলন্ত প্রাণবন্ত”, বললেন সুরসিক লুথার ট্র্যান্ট, সাথসঙ্গত করলেন সায়েন্টিফিক স্প্র্যাগ, “ঠিক দামোক্লিস-এর কফিন, বা ওই রকম কিছুর মতো।”

এঁদের বাচালতায় ভারি বিরক্ত হচ্ছিলেন হোমস। “এসবের মানে কি আমাদের বার করতে হবে”, তাঁর গলা অত্যন্ত গম্ভীর, “আমি পায়ের ছাপের একটা ট্রেসিং রেখেছি।”

“আমার সিসমোস্পিগমোগ্রাফ এতে কাজ করবে কিনা সন্দেহ”, চিন্তায় পড়ে গেলেন ট্র্যান্ট।

“পায়ের ছাপের ব্যাপারে আমিই শেষ কথা”, বাগাড়ম্বর শোনা গেল লেককের গলায়, “একটা টুসকি মেরে সমাধান করে ফেলব।”

“সবাইকে আবার বলছি, চেষ্টার যেন কোনও ত্রুটি না হয়”, বললেন তাঁদের অতি বিখ্যাত সভাপতি, “তবে আমার ঘোরতর সন্দেহ, তোমরা কিসুই করবে না, কারণ মোটা বুদ্ধির লোকেরা  এসব সূত্র থেকে কিছুই খুঁজে পায় না। যাকগে, এ ব্যাপারে ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে আজ থেকে ঠিক এক সপ্তাহ বাদে তোমাদের উত্তর কাগজের এক পিঠে পরিষ্কার করে টাইপ করে আমার সঙ্গে দেখা করবে।”

অব্যর্থ গোয়েন্দারা ঘর থেকে এমনভাবে বেরোলেন, যেন সমাধান করা হয়েই গেছে এবং তা বিন্দুমাত্র আশ্বস্ত করল না তাঁদের সভাপতিকে, যিনি সবাইকে আশ্বস্ত করে থাকেন।

নির্ধারিত সাত দিন সময় তাঁরা সমস্যাটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করলেন, সাত রাত ধরেও চিন্তা করলেন, কারণ দিনের আলো হোক, কি মোমের আলো – এই আজগুবি সমস্যার সমাধান তাঁরা করেই ছাড়বেন – মিসেস ব্রাউনিং-এর মতো কাব্যিক ভাষায় বলতে গেলে।

এবং এক সপ্তাহ পর সেই অব্যর্থ গোয়েন্দার দল একের পর এক ঢুকে পড়লেন তাঁদের ফকির স্ট্রিটের ঘরে, প্রত্যেকের মুখেই চাপা এবং বোকা হাসি – এ হাসি এমন হাসি যেন অনুসন্ধান চালিয়ে তাঁরা যা জানার জেনেই ফেলেছেন, এখন হাত বাড়িয়ে পুরস্কারের টাকাটা নেওয়াই যা বাকি।

“পেয়ারে ভাইয়োঁ”, বললেন সভাপতি হোমস, “তোমাদের চোখ এড়িয়ে কিচ্ছুটি হওয়ার জো নেই, আমি জানি, কাজেই আমি ধরে নিচ্ছি তোমরা জানতে পেরে গেছ কেন ওই মহিলা ওইরকম বিপদজনকভাবে ভাড়াবাড়ির দুপ্রান্তে অনেক উঁচুতে টাঙানো কাপড়-মেলা দড়ি ধরে ঝুলছিল।”

“পেরেছি, পেরেছি”, সে কি উল্লাস, দেমাক আর বিনয়ীভাব সবার গলাতে!

“সবাই পেরেছ তাহলে”, সভাপতির বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেল, “যদিও আসল সমস্যায় কেউ ঢুকেছ কিনা আমার সন্দেহ আছে। ঠিক আছে, শোনা যাক একে একে তোমাদের শৌখিন প্রচেষ্টা।”

“এই সংস্থার সবচেয়ে পুরোন সদস্য আমিই, অতএব আমিই আগে শুরু করছি”, শান্ত গলায় বললেন ভিডক। “মহিলাকে খুঁজে পাইনি, তবে আমার মনে হয়েছে সে একজন কুশলী ট্রাপিজ অথবা দড়ির ওপর হাঁটার খেলোয়াড় – কনি আইল্যান্ড-এর দর্শকদের নতুন খেলা দেখিয়ে চমকে দেবে বলে প্র্যাকটিস করছিল।”

“বোকার মতো কথা!” বলে উঠলেন হোমস, “সে ক্ষেত্রে মহিলার গায়ে আটোসাটো পোশাক থাকত। আমাদের কাছে খবর আছে, মহিলা চমৎকার ধরণের পুরোদস্তুর ইভনিং ড্রেস পরেছিল।”

পরের বক্তা আরসেন লুপিঁ।

“সোজা, এক্কেবারে সোজা”, তাঁর গলা উদাস, “মহিলা কোনও টাইপিস্ট অথবা স্টেনোগ্রাফার, মালিক তাকে উত্যক্ত করছিল দেখে সে পালানোর চেষ্টা করছিল।”

“তোমাকে আমি আবার মহিলার পোশাকের কথাটা মনে করিয়ে দিচ্ছি”, বুকের রক্ত হিম হয়ে যাওয়া বরফ-ঠান্ডা চাহনিতে লুপিঁর দিকে তাকিয়ে বললেন হোমস।

“ঠিকই আছে”, এমনভাবে বললেন লুপিঁ, যেন কিছুই হয়নি। “এ ধরণের মেয়েরা ওভাবেই পোশাক পরে। আমি এরকম কত দেখেছি। কাজ করতে গিয়ে ওরা ইভনিং ড্রেস নিয়ে মাথা ঘামায় না।”

“হুঃ!” ঘুৎকার ছাড়লেন থিংকিং মেশিন, এবং অন্যরা তৎক্ষণাৎ তাঁর সঙ্গে একমত হলেন।

“পরের জন! চটপট!” বললেন হোমস।

“আমি বলছি”, বললেন লেকক। “আমার বক্তব্য, ওই মহিলা কাছাকাছি কোনও পাগলাগারদ থেকে পালিয়েছিল। সে নিজেকে একটা পুরোন ওভারকোট ভেবেছিল, আর ভেবেছিল কাপড়-কাটা মথেরা তার গায়ে বসেছে। সেই জন্যই সে কাপড় টাঙানোর দড়ি থেকে ঝুলে পড়েছিল। পাগলামির এই তথ্য থেকে এটাও জানা যাচ্ছে কেন মহিলার চুল ছিল নিচের দিকে ছড়ানো – ওফেলিয়া-র মতো, বুঝতেই পারছেন।”

“সে ক্ষেত্রে সে কয়েকটা কর্পূরের গুলি খেয়ে নিলেই পারত, মথগুলো পালাত, এত কষ্ট করে ঝুলতে হত না”, কড়া চোখে লেককের দিকে তাকিয়ে বললেন হোমস, “মিঃ গ্রাইস, তুমি অভিজ্ঞ লোক, তোমার মত কি?”

মিঃ গ্রাইস তাঁর ডান পায়ের বুটের ডগার দিকে তাকিয়ে নিলেন বরাবরের অভ্যেস মতো, তারপর বললেন, “আমার মনে হয়েছে, মহিলা একজন বস্তি উন্নয়নকারী। সবাই জানেন, দুর্দান্ত মহিলারা এর জন্য খুবই উৎসাহী থাকে। আমার আরও মনে হয়েছে, যাঁরা “কাপড় টাঙানোর দড়ি কিভাবে আরও উন্নত করা যায়”, সেই বিশেষ ধর্মে বিশ্বাসী, তিনি তাঁদেরই একজন। কাজেই তিনি দড়িতে ঝুলে দেখছিলেন, এগুলো তাঁর ভার নিতে পারছে কিনা। যদি পারে, তাহলে আর কোনও কথা নেই, ওগুলো যে উন্নতমানের, তা প্রমাণ হয়ে গেল।”

“আর যদি না পারে?”

“না পারলে – মানে আমাদের এখনকার সমস্যার সঙ্গে ওটার তো কোনও সম্পর্ক নেই, কাজেই ওটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।”

“গ্রাইস ঠিকই বলেছে”, বললেন লুথার ট্র্যান্ট, “তবে আমার মনে হয় মহিলার দড়িতে ঝোলার পেছনে অন্য কারণ আছে, আর সেটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাঁর একটু হাওয়া খাওয়ার দরকার ছিল, কারণ ওই ভাড়াবাড়িতে ভাড়াটে গন্ধ পাওয়ার পর এটা খুবই দরকার, বিশেষ করে বিশুদ্ধ ওজোন।”

“আঃ, ট্র্যান্ট, বড্ড বেশি বস্তুবাদী হয়ে যাচ্ছ”, বললেন থিংকিং মেশিন তাঁর উদাস, দুর্বল নীল চোখ মেলে। “এই মহিলা আসলে নতুন চিন্তার অনুগামী। মহিলা চায় নীরবতা, বা মনঃসংযোগের মধ্যে একেবারে ডুবে যেতে, ওরা এগুলোকে কি বলে জানি না। আর ওরা সবসময়েই এসব করার জন্য অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গা খোঁজে। ওদের এমন জায়গা চাই, যেখানে কোনও ভিড়ভাট্টা নেই। এবং আমার ধারণা, কাপড় টাঙানো দড়িতেও কোনও ভিড় নেই।”

রুলেটেবিল হেসে উঠলেন এই সময়, “তুমি একটু বেশি ভেবে ফেলছ, থিংকি”, বললেন তিনি, “মহিলা আসলে ওরকম করছিল রোগা হওয়ার জন্য। আমি মেয়েদের জার্নালে পড়েছি, তারা সবাই রোগা হতে চায়। তার জন্য তারা নানা রকম সম্ভব-অসম্ভব ব্যায়াম করে, এর মধ্যে এই কাপড় টাঙানো দড়িতে ঝুলে এধার-ওধার করাটা হচ্ছে একদম লেটেস্ট। বাজি ফেলছি, এতে অন্তত কুড়ি পাউন্ড ওজন কমবেই কমবে।”

“ওরে আমার পন্ডিত রে”, বলে উঠলেন র‍্যাফেল, “হাবিজাবি বুঝিয়ে আমাদের বোকা বানানোর ফন্দি! শোন, মহিলা নতুন ধরণের নাচ প্র্যাকটিস করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে ভাবছিল। রোববারের কাগজে দেখবে হেডিং বেরিয়েছেঃ চমক! চমক! কাপড়-টাঙানো দড়ি নৃত্য! নাচ তো নয়, যেন বিদ্যুতের ঝলক! এ সুযোগ হেলায় হারাবেন না। এই হল ব্যাপার। কী, ঠিক বলছি তো?”

“বাইরে থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করে এসো, র‍্যাফেল”, ভাল মনেই বললেন হোমস, “তোমার চোখে এখনও ঘুম লেগে আছে। সায়েন্টিফিক স্প্র্যাগ, মাঝে মাঝে তুমি বিজ্ঞানের সব দুর্বোধ্য তত্ত্ব আওড়াও। তুমি এ ব্যাপারে কিছু বলবে?”

“এখানে বিজ্ঞানের কিচ্ছু নেই”, বললেন স্প্র্যাগ হেলাফেলা করে, “যে মুহূর্তে আমি শুনেছি মেয়েটার চুল নিচের দিকে ছিল, সেই মুহূর্তেই আমি যা বোঝার বুঝে গেছি। আমার বোন তো এটা করার সময় স্কাইলাইট দিয়ে মাথা গলিয়ে দেয়, তবে এই মেয়েটা আরও সরেস। ও আরও তাড়াতাড়ি ফলাফল চাইছিল।”

এতক্ষণে বলা শেষ হল সবার। উঠে দাঁড়ালেন সভাপতি হোমস, তাঁর প্রাজ্ঞ ভাষণটি দেওয়ার জন্য।

“তোমরা বলেছ খারাপ না”, বললেন তিনি, “তবে তোমরা মহিলাদের চিরন্তন সমস্যাটাই এড়িয়ে গেছ। আমি বললেই তোমরা নিজেরাই সেটা ধরতে পেরে অবাক হয়ে যাবে। আসল ব্যাপারটা হল, মহিলা ভেবেছিল ঘরে ইঁদুর ঢুকেছে, কাজেই সে জানলার ধারে গিয়ে এক চিৎকার ছেড়ে জীবনের তোয়াক্কা না করেই কাপড়-টাঙানোর দড়ি ধরে ঝুলে পড়েছিল, তাতে প্রাণ যাক, সে-ও ভি আচ্ছা, কিন্তু ইঁদুরের সঙ্গে এক ঘরে নয়। খুবই সোজা ব্যাপার। সে ওই জন্যই মাথায় চুল ছড়িয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে দেখছিল – যে রকম তারা দেখে থাকে যে ইঁদুরটা ঘরের এককোনায় বসে আছে কিনা।”

“সাবাস, হোমস! সাবাস!” বলে উঠলেন ওয়াটসন, যিনি এইমাত্র কাজ সেরে ফিরলেন।

সবাই যখন হোমসের অপরিসীম জ্ঞান নিয়ে ভাবছেন, টেলিফোনটা বেজে উঠল।

“আপনি বলছেন নাকি?” টেলিফোনটা ধরে বললেন হোমস। তিনি বরাবরই সোজাসাপটা, এক কথার মানুষ।

“বলছি, বলছি”, ওপাশ থেকে শোনা গেল পুলিশের বড়কর্তার অধৈর্য্য গলা, “আপনার সব গোয়েন্দাকে কাজ থেকে তুলে নিন। আমরা জানতে পেরেছি মহিলা কে, আর কেনই বা তিনি ওরকম করছিলেন।”

“সত্যি পেরেছেন নাকি? আমার অবশ্য বিশ্বাস হয় না”, বললেন হোমস, “যাকগে, বলুন ব্যাপারটা কি।”

“জানতে পেরেছি তো বটেই। এটা সিনেমার স্টান্টবাজি।”

“তাই নাকি! বটে! আর জুতো ছোঁড়াটা?”

“ওটা? ওটা ওই বোকাবোকা সিনেমার একটা অংশ। মহিলার নাম মিস ফ্লসি ফ্লাওয়ার। সিনেমা কোম্পানির নাম ফ্লিম ফ্লাম ফিল্ম কোম্পানি। ওরা ছয় রিলের একটা থ্রিলার বানাচ্ছে, যার নাম “দড়ির শেষে”।”

“অ”, বললেন হোমস শান্ত আর ঠান্ডা গলায়, “মিস ফ্লিপারকে তাঁর ভাল কাজের জন্য আমার শুভেচ্ছা জানাবেন।”

“সাবাস, হোমস! সাবাস!” বললেন ওয়াটসন।

ক্যারোলিন ওয়েলস (Carolyn Wells)(১৮৮২-১৯৪২); আমেরিকা। কবি, ঔপন্যাসিক এবং ছোট-গল্প লেখক। বর্তমান সময়ে প্রায় বিস্মৃত ওয়েলস একশো সত্তরটিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে বিরাশিটিই ছিল গোয়েন্দা উপন্যাস। লেখক জীবনের শুরুতে তিনি কবিতা, হিউমার এবং শিশুসাহিত্য রচনা করলেও পরবর্তীকালে রহস্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর লেখা প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস “দি ক্লু” (The Clue) (১৯০৯)। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় ডিটেকটিভ ফিকশন জ্যঁরের ওপর তাঁর লেখা ম্যানুয়াল “দি টেকনিক অব দ্য মিস্ট্রি ফিকশন” (The Technique of the Mystery Fiction)। এ ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন ক্লাসিক বলে পরিগণিত “ননসেন্স অ্যান্থোলজি” (Nonsense Anthology) (১৯০২) এবং “প্যারোডি অ্যান্থোলজি” (Parody Anthology) (১৯০৪), যার মুদ্রণ চাহিদা ছিল পরবর্তী অর্ধশতক জুড়ে।

          প্যারোডি এবং স্যাটায়ার-এর ওপর বরাবরের আগ্রহ থাকার কারণে তিনি সে ধরণের রচনা করেছেন প্রচুর, যার মধ্যে রয়েছে “টোমেইন স্ট্রিট” (Ptomaine Street) (১৯২১)। এ ছাড়াও তিনি কিছু প্যারোডি লিখেছিলেন শার্লক হোমসকে নিয়ে, যেগুলোর স্বাদ ও মেজাজ সম্পূর্ণ আলাদা।

          “দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ক্লথস-লাইন” (The Adventure of the Clothes-Line)  প্রথম প্রকাশিত হয় “দি সেঞ্চুরি ম্যাগাজিন” (The Century Magazine)–এ, ১৯১৫ সালে।

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s