কোনও এক বিষণ্ণ শীতের বিকালে কেইজি তার বাড়ির দিকে ফিরছিল। সহসা কিছু একটা চোখে পড়ায় ভাবতে লাগল, সামনে ওটা কী দেখতে পাচ্ছি? খানিকটা এগিয়ে সে একটা আহত সারসপাখিকে দেখতে পেল। সে মনে মনে বলল, আচ্ছা! একটা নিরীহ পাখিকে আঘাত করার মতো নিষ্ঠুর কাজ কার দ্বারা করা সম্ভব? পাখিটার সামনে গিয়ে সে বলল, “তুমিআঘাত পেয়েছ। চিন্তা কোরো না। আমি তোমায় যথাসাধ্য সাহায্য করব। যতক্ষণ না এই তিরটা তুলে নিচ্ছি ততক্ষণ পর্যন্ত নড়াচড়া না করে শান্তভাবে বসে থাক।”
তিরটা তুলতে তুলতে সে বলল, “তোমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে। তোমার পালকগুলোই তোমার রক্ষাকবচ।”
ধীরে ধীরে সারসটি উঠে দাঁড়িয়ে কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করল।
“না না, আমায় ধন্যবাদ জানিয়ে ছোটো করতে হবে না। তুমি কী সুন্দর! তোমায় সাহায্য করতে পেরে আমি যারপরনাই খুশি।”
দ্রুত ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সারসপাখি অনেক দূরে শূন্যে মিলিয়ে গেল। কেইজিও প্রসন্ন মনে বাড়ি ফিরে এল।
দিন যায় রাত যায়, এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। একদিন কেইজি আর তার বাবা যখন মাঠে চাষের কাজে ব্যস্ত, একজন পথভোলা অনাথা কিশোরী তাদের বাড়ি এসে উপস্থিত হল।
সে গৃহকর্ত্রীকে শুধাল, “মা, আমাকে এই বিশাল বনভূমি থেকে বেরিয়ে যাবার পথ বলে দিতে পারবেন?”
গৃহকর্ত্রী সানন্দে বলল, “কেন নয়, বাছা! নিশ্চয়ই পারব। কিন্তু তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আজ রাতটা আমাদের বাড়িতেই কাটিয়ে কাল সকালে মুখহাত ধুয়ে প্রাতরাশ সেরে নতুন শক্তি নিয়ে রওনা দিও।”
“সেটাই খুব ভালো হবে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।” মেয়েটি বলল।
সারাটা দিন মেয়েটি কৃতজ্ঞচিত্তে কেইজির বৃদ্ধা মাকে বাড়ির কাজকর্মে সাহায্য করল। কেইজির মা আপন মনে ভাবতে লাগলেন, মেয়েটা ভারী মিষ্টি স্বভাবের।
সন্ধ্যাবেলা কেইজি আর তার বাবা চাষের কাজ সেরে মাঠ থেকে বাড়ি ফিরল যখন, সুস্বাদু খাবারের মিষ্টি গন্ধে তখন চারদিক ম ম করছে।
“আমাদের নতুন অতিথি মিডোরিকে ধন্যবাদ জানাও। ওই আজ আমাদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করেছে। আমাদের রাতের খাবার তৈরি করেছে।”
খেতে বসে কিছুক্ষণ বাদে কেইজি বলল, “তুমি আমার মায়ের এত সাহায্যে লেগেছো!”
“আচ্ছা মিডোরি, তুমি আমাদের বাড়িতে আরও কিছুদিন থেকে যাও না!” গৃহকর্ত্রী বললেন। কেইজির বাবাও তাকে আরও কিছুদিন থাকার জন্য অনুরোধ জানালেন।
“তোমরা সবাই আমার উপর এত সদয়! ঠিক আছে, আমি সপ্তাহ খানেক থেকেই যাব ভাবছি।” মেয়েটি জানাল।
তাদের সঙ্গে সুখে দুঃখে এক সপ্তাহ কাটানোর পর কেইজির মা বললেন, “বাছা! আমরা তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি, তুমি কি আমাদের সঙ্গে থেকে যেতে পার না?”
“আমিও আপনাদের বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি। আপনাদের কাছে থাকতে পারলে নিজেকে কৃতার্থ মনে করব।”
সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে গেল। মিডোরি তাদের পরিবারে সুখেই কাটাল। তার প্রেমে পড়তে কেইজির দেরি হল না। একদিন একান্তে কেইজি বলেই ফেলল, “মিডোরি, আমার ইচ্ছা তুমি আমায় বিয়ে কর।”
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সামনে বিপদ ঘনিয়ে এল। একদিন কেইজির বাবা বাড়ি ফিরে বললেন, “হায়! হায়! আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। অসময়ে তুষারপাতের ফলে আমাদের সমস্ত পরিশ্রমের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। আগামী কয়েকটা মাস আমাদের প্রবল কষ্টে কাটাতে হবে।”
মিডোরি হতাশ মুখে বলল, “বাবা! আমি আর মিছিমিছি তোমাদের বোঝা বাড়াব না। আমি বরং চলেই যাই।”
কেইজির বাবা বললেন, “না না, তুমি এরকম কথা বলছ কেন?” কেইজি তাকে থেকে যাবার জন্য অনেক অনুরোধ জানাল। তার মা বললেন, “তুমি আমাদের জন্য এতকিছু করেছ যে ছেড়ে দিতে মন সায় দিচ্ছে না।”
মেয়েটি বলল, “তোমরা যখন এত করে বলছ তবে আমি থেকেই যাব। কিন্তু আমাকে তোমাদের উপকারে লাগতে দিতে হবে। আমি বুটিদার রেশমি কাপড় বুনে দেব। তোমরা সেটা বাজারে বিক্রি করে সারাটা শীতকালের জন্য যথেষ্ট খাবার ক্কেনবার টাকা পেয়ে যাবে।”
“তাহলে আমি বাজারে গিয়ে কাপড় বোনার জন্য রেশমের সুতো এনে দিই,” কেইজি বলল।
“না না, তার দরকার হবে না। জিনিসপত্র আমি নিজেই জোগাড় করে নেব। আমাকে শুধু তিনদিন তিনরাত একেবারে একলা থাকতে দিতে হবে।”
“কিন্তু… তোমার খাওয়াদাওয়া কীভাবে হবে?”
“প্রতিদিন রাতে আমার দরজার বাইরে একবাটি চাল আর একটুকরো মূলো রেখে দিও, তাহলেই হবে।”
তার কথামতো কেইজি প্রতিদিন সন্ধ্যায় দরজার বাইরে খাবার রেখে যেত আর পরদিন সকালে শূন্য বাটি ফিরিয়ে নিয়ে যেত। চতুর্থ দিনের দিন দরজার পাল্লা খুলে গেল আর মিডোরি তার গোপন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল।
“ওঃ! কী সুন্দর বুটিদার রেশমি কাপড়!” সবাই তার হাতের কাপড় দেখে বলে উঠল।
বাজারে নিয়ে যাবার পর সেই জরির বুননে তৈরি কল্কাদার কাপড় কেনার জন্য বণিকেরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল। একজন বলল, “আমি এর জন্য কুড়ি স্বর্ণমুদ্রা দিতে চাই।”
অপরজন বলল, “আমি ত্রিশ স্বর্ণমুদ্রা দিতে প্রস্তুত।”
আর এক বণিক পঞ্চাশ স্বর্ণমুদ্রার প্রস্তাব দিল।
সেদিন সন্ধ্যায় কেইজি এক থলে ভর্তি সোনার মুদ্রা নিয়ে বাড়ি এল।
বসন্তের শুরুতে মিডোরি মনে মনে ভাবল যে সে আরও একটা জরির বুটিদার কাপড় বুনে দেবে। সে বলল, “দেখ মা, আমার মনে হয় এবারের নকশাদার কাপড় বিক্রি করে তোমার এত টাকা পাবে যে তোমাদের কোনদিনই অর্থাভাব হবে না।”
মিডোরি এবার যখন ঘরের ভেতর নিজেকে বন্দি করল তখন পরিবারের সকলেই তাকে বিরক্ত না করার প্রতিশ্রুতি দিল। আগের ব্যবস্থা মতোই প্রতিদিন সন্ধ্যায় কেইজি একবাটি চাল আর মূলো ঘরের বাইরে রেখে আসত। একদিন খাবার রাখতে রাখতে সে মনে মনে বলল, মেয়েটা ঘরে একাএকা বসে আমাদের জন্য পরিশ্রম করছে! হয়ত আমি তার কোনও উপকারে লাগতে পারি। এই ভেবে কেইজি দরজাটা খুলে ভেতরে মুখ বাড়িয়ে বলল, “বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা কোরো, কিন্তু আমি…”
কিন্তু ঘরের ভেতর মিডোরি ছিল না। হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর শব্দ কানে এল তার। চমকে উঠে সেদিকে তাকিয়ে সে বলল, “তুমি কে? মিডোরি কোথায়?”
“আমিই মিডোরি। আমিই সেই সারস যাকে তুমি বেশ কিছুদিন আগে প্রাণে বাঁচিয়েছিলে। তোমার মহান ঔদার্যের জন্য ধন্যবাদ জানাতে আমি এক সুন্দরী মহিলার রূপ ধারণ করেছিলাম।”
“কিন্তু… কিন্তু…”
“ওহ্ কেইজি, তুমি যদি তোমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে, আমায় বিরক্ত না করতে তাহলে আমি চিরদিনের মতো সারসজন্ম থেকে মুক্তি পেতাম।”
“তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও।”
“আমি তো জানি তুমি আমায় পাগলের মতো ভালবাস। আর সত্যি বলতে কী, আমিও তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। একদিন হয়ত আমাদের বিয়ে হত। কিন্তু আর তা সম্ভব নয়।”
“হায় মিডোরি! এ আমি কী করলাম!”
“ হ্যাঁ কেইজি। তুমি দরজা খুলে ফেলায় আমার জাদুমন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এবার আমায় যেতে হবে। জরির তৈরি এই কলকাদার কাপড়টা বিক্রি করে দিও। তোমার এবং তোমার পরিবারের আর কখনও অর্থের অভাব হবে না।”
ঘর থেকে বেরিয়ে ডানা মেলে উড়ে অসীম শূন্যে মিলিয়ে গেল সারস। কেইজি তার প্রিয়তমা মিডোরির স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে একটা পালক তার কোমরবন্ধনীতে সযত্নে রেখে দিল।
জয়ঢাকের গল্প ঘর