বিদেশী গল্প-ইংরিজি -আয় বৃষ্টি ঝেঁপে আইজ্যাক অ্যাসিমভ। রেইন রেইন গো অ্যাওয়ে। অনুবাদ দীপ ঘোষ বসন্ত ২০১৮

দীপ ঘোষের আগের লেখা তাতিয়ানার মোবাইল দ্বিতীয় পর্ব

Untitled-1 copy

আসিমভের “রেইন রেইন গো অ্যাওয়ে”-এর অনুবাদ-দীপ ঘোষ

“ওই দেখো জর্জ, আবার ওই মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে” – লিলিয়ান জানালার পর্দাটা পালটাতে পালটাতে বলল। আমি তখন খুব মন দিয়ে টিভির কেবলটা পরীক্ষা করছিলাম, আরেকটু পরেই ফুটবল শুরু হবে আর ছবিটা এখনই গণ্ডগোল করছে। আনমনে বললাম – “কোন মেয়ে ?”

“আরে মিসেস স্যাকার! এবার নিশ্চই জিজ্ঞাসা করবে কে সেটা ? আরে আমাদের নতুন প্রতিবেশী! কিছু যদি খেয়াল থাকে তোমার!”, ঝাঁঝিয়ে উঠল লিলিয়ান। “ওহ তাই ?” – এইসব ব্যাপারে আমার বউকে বেশি ঘাটাইনা আমি।

“রোদ পোয়াচ্ছে, যখনি পরিষ্কার আকাশ থাকে তখনি ওঁর ওই এক কাজ। তবে আজকে বাচ্চা ছেলেটাকে দেখছি না তো। ছেলেটা সারাদিন ওদের লনে বল নিয়ে খেলে, তুমি দেখেছো ওকে জর্জ ?”

“নাহ, খেয়াল করিনি, কিন্তু শুনেছি বিলক্ষণ। সারাদিন দেওয়ালে ধাঁই ধাঁই করে বল ছুঁড়লে, না শুনে যাব কোথায়?”

“ছেলেটা বেশ ভালো জানো, আমাদের টমির বয়সী, বছর দশেক হবে। টমির সাথে ওর বন্ধুত্ব হলে বেশ হয়।”

“আমার মনে হয় না টমি যেচে গিয়ে ছেলেটার সাথে বন্ধুত্ব্ব  করবে” – আমার সুচিন্তিত মতামত জানালাম।

“হুম সেটা খারাপ বলনি, এই স্যাকাররা পাড়ায় কারো সাথে মেশে না। এমনকি মিঃ স্যাকার যে কি করে তাই ছাই আমি জানি না।”

“লিলিয়ান, স্যাকারদের ব্যাপারে এত কৌতূহল দেখানো কিন্তু ঠিক নয়।”

“কিন্তু আমি তো ভদ্রলোককে কখনো বাড়ি থেকেই বেরোতে দেখিনা!”

“আমিও তো কাজে যাই না।” খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললাম আমি।

“তুমিতো লেখক, বাড়ি বসে কাজ কর, সেটা আলাদা ব্যাপার।”

বউয়ের সাথে তর্ক করে কেই বা জিতেছে, তাও আমি মৃদু স্বরে বললাম , “ আমার মনে হয় মিসেস স্যাকার নিশ্চই জানেন তার স্বামী কি করেন, আর ঠিক তোমার মতই কৌতূহলে ভোগেন, আমি কি করি ভেবে।”

লিলিয়ান জানালা থেকে সরে এসে বলল, “জর্জ, আমাদের কিন্তু ওদের সাথে আলাপ করতে যাওয়া উচিত। ওরা এই পাড়ায় এসেছে দুমাস হয়ে গেল কিন্তু এখনো ওদের সাথে কোন কথাই হয়নি আমাদের। “

“কিন্তু তুমি তো প্রথম দিনেই গেছিলে ওদের বাড়ি!”

“হ্যাঁ, কিন্তু তখন ওরা জিনিসপত্র গোছাতে এতই ব্যস্ত ছিল যে হ্যালো ছাড়া আর কিছুই বলার সময় হয়নি। তবে একটা কথা বলছি – মহিলা কিরকম অদ্ভুত যেন!”

“অদ্ভুত?”, টিভিতে খেলাটা যদি জমে উঠেছিল, তাও নড়ে বসলাম।

“মহিলা সবসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন! আর আকাশে যদি একটু মেঘও দেখা যায় তো, উনি বাড়ি থেকেই বেরোন না। সেদিন দেখলাম ছেলেটা বাড়ির সামনে খেলছিল, হঠাৎ ওর মা চেঁচিয়ে বলল বৃষ্টি আসছে, ঘরে চলে আসতে। আমি শুনে ভাবলাম, বাইরে শুকোতে দেওয়া কাপড়গুলো তুলে ফেলি। আর বাইরে গিয়ে দেখি নাকি বেশ ভালোই রোদ, শুধু আকাশের এক কোনে এক চিলতে মেঘ।”

“তারপর বৃষ্টি হল ?”

“নাহ, ওইটুকু মেঘে বৃষ্টি হয় নাকি ? আমি তো মিছি মিছি দৌড়ে গেলাম।”

ততক্ষণে টিভিতে খেলাটাও বেশ জমে উঠেছিল, একটা বিজ্ঞাপন শুরু হতেই আমি বললাম, “আরে ওরা তো এসেছে অ্যারিজনা থেকে, এদিকের আবহাওয়া সম্পর্কে ওদের কোন ধারনাই নেই।”

লিলিয়ান রান্নাঘরে ঢুকেছিল, আমার কথা শুনে বেড়িয়ে এসে বলল, “তুমি কী করে জানলে ওরা অ্যারিজোনা থেকে এসেছে?”

“কেন টিমি তো ওদের ছেলেটার সাথে মাঝে মাঝে কথা বলে, ওই ছেলেটাই ওকে বলেছে নিশ্চই। তবে হ্যাঁ, টিমি আবার ঠিক করে বলতে পারল না যে ওটা অ্যারিজোনা না অ্যালাব্যামা। জানোই তো তোমার ছেলে যেমন অন্যমনস্ক। তবে বৃষ্টি নিয়ে ওদের এত চিন্তা থাকলে ওটা অ্যারিজোনাই হবে।”

“এতো বড় খবরটা তুমি আমায় বলনি?”

“আরে, টিমি এটা আজ সকালেই আমায় বলল। আর আমি ভেবেছিলাম তুমি এটা জানো। আর সত্যি বলতে কি এটা বলার মত কোন কথাও মনে করিনি।”

লিলিয়ান আবার জানালার পাশে সরে দাঁড়াল, “আমায় যে করেই হোক মহিলার সঙ্গে আলাপ করতেই হবে। জর্জ দেখো দেখো …”

আমি তখন খেলা দেখতে এতোই ব্যস্ত ছিলাম যে লিলিয়ানের কোন কথাই আমার কানে গেল না।

“মহিলা আবার মেঘের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, আর এখন তড়িঘড়ি বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছেন!”

দিনদুয়েক পরে আমি লাইব্রেরিতে গেছিলাম কয়েকটা বই খুঁজতে। বাড়ি ফিরতেই লিলিয়ান খুব উত্তেজিত হয়ে দৌড়ে এল। “কাল নিশ্চয়ই তুমি কিছু করছ না?”

এটা প্রশ্নের মত শোনালেও আমি জানি এর মানে কাল আর কোন কাজ হবে না। আমার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করেই লিলিয়ান বলল, “কাল আমারা মারফি পার্কে ঘুরতে যাচ্ছি, সাকারোজদের সাথে।”

“সেটা আবার কারা?”

“ওহ জর্জ! আমাদের পাশের বাড়ির প্রতিবেশী! তুমি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে কী করে!”

“কিন্তু তুমি আলাপ করলে কবে ওনাদের সাথে?”

“আজ সকালে তুমি বেড়িয়ে যাবার পরেই ওনাদের বাড়িতে গেছিলাম। ওদের সাথে আলাপ করা মোটেও সহজ কাজ নয়! প্রায় পাঁচমিনিট ধরে বেল বাজানোর পরে ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন!! তবে আমিও ছাড়ার পাত্রী নই। দরজা না খুললে বেল বাজিয়েই যেতাম।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী? সোজা ঢুকে নিজের পরিচয় দিলাম। মহিলা তো খুব ভদ্র ব্যবহার করলেন। বললেন উনি খুব খুশি হয়েছেন আমি আসায়। আমি তারপর কথায় কথায় বললাম, আমাদের বাচ্চাদের একসাথে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া উচিত। মার্ফি পার্কের কথা বলায় উনি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন। হাজার হোক মায়ের মন তো, বাচ্চাটা আনন্দ করবে, কোন মা না চায়। তবে জর্জ, তুমি যদি ওদের বাড়িটা দেখতে!”

“লিলিয়ান, দয়া করে আমায় জানলার পর্দা আর বিছানার চাদরের গল্প শুনিয়ো না এখন। তুমি জানো এই সব গল্প আমার মোটেও ভালো লাগে না!”, তবে কবেই বা লিলিয়ান আমার কথায় পাত্তা দিয়েছে? তাই খুব আগ্রহ সহকারে সে বলে যেতে লাগলো দেরাজের মাপ থেকে পর্দার রঙ, সব কিছুই।

“আর যদি দেখতে কী সুন্দর চকচকে ওদের মেঝে! একটুও নোংরা বা ধুলো নেই কোথাও। আর রান্নাঘরের কথা কী আর বলব! দেখে মনেই হচ্ছিল না যে ওখানে রান্না হয়েছে কোনদিন। যেন সবে তৈরি করে বসানো হয়েছে সবকিছু। আমি এক গেলাস জল চেয়েছিলাম। ভদ্রমহিলাম হাতে দস্তানা পড়ে খুব জত্ন করে গ্লাস ধরে জল ভরে দিলেন, যাতে এক ফোঁটা জলও যেন বাইরে না পড়ে! সাথে আবার একটা কাগজের তোয়ালেও দিলেন হাত আর মুখ মোছার জন্যে। আমার তো মনে হচ্ছিল হাসপাতালে এসে পড়লাম নাকি!”

“উনি এক কথায় পার্কে যাবার জন্যে রাজী হয়ে গেলেন!”

“না, মানে তাই কি আর হয়। প্রথমে ওঁর স্বামীকে ফোন করে কালকের আবহাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলেন। ওঁর স্বামী বললেন যে খবরের কাগজে বলেছে রৌদ্রজ্জ্বল দিন কিন্তু টিভির সাম্প্রতিক আবহাওয়ার খবর শুনে তারপর উনি তার মতামত জানাবেন।”

“কোন কোন কাগজ দেখলেন উনি?” আমি মজা করে বললাম।

“আমার তো দেখে মনে হল শহরের সমস্ত কাগজই ওনারা নেন। তারপর মহিলা আবহাওয়া অফিসে ফোন করে কালকে ঝড়বৃষ্টি হবে কিনা খোঁজ নিলেন। শেষে বললেন, কাল সকালে আকাশ পরিষ্কার থাকলে ওরা ফোন করে আমাদের জানাবেন।”

“আচ্ছা দেখা যাক তবে।”

পরের দিন সকালে সাকারোজদের মুখোমুখি হলাম আমরা। সাকারোজ দম্পতি দুজনেই কমবয়সী আর যথেষ্ট আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী। লম্বা লনের রাস্তা ধরে ওরা আমাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল। লিলিয়ান আমার দিকে ঝুঁকে আমার কানে ফিসফিস করে বলল – “সাকারোজের জামার পকেটে ওটা কী বলত?”

“দেখে তো মনে হচ্ছে একটা পকেট রেডিও। বাজি রাখতে পারি ওটা আবহাওয়ার খবর রাখার জন্যে।”

সাকারোজের ছেলেটা একটা গোল চাকতির মত যন্ত্র নিয়ে খেলতে খেলতে গাড়িতে উঠল। কাছ থেকে দেখে বুঝলাম ওটা একটা ব্যারোমিটার। ছেলেকে নিয়ে ওরা তিনজন পিছনের সিটে বসল। রাস্তায় যেতে যেতে আমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম। সাকারোজের ছেলেটার সাথে টমির খুব ভাব দেখলাম। তবে মাঝে মাঝে মিস্টার সাকারোজ পকেট থেকে রেডিওটা বের করে কানে চেপে ধরছিলেন। খুব আস্তে বাজলেও আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে উনি আবহাওয়া অফিসের খবর শুনছেন।

যাই হোক আমরা যখন পার্কে পৌঁছলাম, তখন আকাশ পরিষ্কার আর সত্যিই সুন্দর ছিল দিনটা। এমনকি মিস্টার সাকারোজও তন্নতন্ন করে আকাশ আর ব্যারোমিটারটা দেখার পরে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। লিলিয়ান টমি আর সাকারোজের ছেলেটাকে নিয়ে বাচ্চাদের নাগরদোলার টিকিট কাটতে গেল। মিসেস সাকারোজ ওদের সাথে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার স্ত্রী জানালো যে সেই বাচ্চাদের খরচটা দিতে চায়।

টিকিট কেটে লিলিয়ান যখন ফিরল তখন আমি গোমড়া মুখে ডারিয়ে ছিলাম।

“কি হল, সাকারোসেরা কই?”

“ওরা খাবার জায়গায় চলে গেছে। আমি তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।” অপ্রসন্ন গলায় জানালাম আমি, “ওই মিস্টার সাকারোজ বড্ড নাকউঁচু! হতে পারে ওরা বড়লোক, কিন্তু এমন ব্যাবহার আমার পছন্দ নয়।”

“কেন ? কী হল আবার?”

“আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম ও কী কাজ করে। তাতে আমায় বলল মানব চরিত্র পর্যবেক্ষণ করাই ওর কাজ। “

“বাহ! বেশ দার্শনিক উত্তর তো! তাই জন্যেই বোধহয় ওরা অতগুলো খবরের কাগজ নেয়!”

“কমবয়সী, ভালো দেখতে, টাকাও আছে ভালোই বলে মনে হল। এত রহস্য করে কথা বলার কী দরকার? যাই হোক লোকটা আরিজোনা থেকেও আসেনি।”

“কী করে জানলে?”

“আমি মিস্টার সাকারোজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে ওরা অ্যারিজোনার থেকে এসেছে কিনা। শুনে ভদ্রলোক এমন মুখ করলেন যেন অ্যারিজোনার নামই শোনেনি। তারপর আবার আমায় জিজ্ঞাসা করলেন ওঁর উচ্চারণ শুনে সেরকম লাগে কিনা।”

“আমার তো ওদের উচ্চারণ শুনে স্প্যানিশ মনে হয়। দক্ষিণে অনেক লোকের উচ্চারণ ওরকম হয় দেখেছি। আর সাকারোজ পদবিটাও বোধহয় স্প্যানিশ।”

“আমার তো সাকারোজ শুনলে জাপানী বলে মনে হয়”, আমার সুচিন্তিত মতামত জানালাম। “ওই দেখ ওরা ডাকছে আমাদের। চল দেখি কী খাবার কিনল।”

সাকারোজরা তিনটে করে কটন ক্যান্ডি কিনেছিল। মেলায় যেরকম গোলাপী রঙের তুলোর মত চিনি আর মিষ্টি সিরাপ দিয়ে কাঠির গায়ে জড়ান ক্যান্ডি পাওয়া যায়, এগুলো তার থেকেও বড়ো ছিল। আমরা ভদ্রতা করে একটা করে ক্যান্ডি নিলাম। বাচ্চা দুটো ক্যান্ডি খেয়ে নাগরদোলা চড়তে গেল, আর আমরা চারজন গল্প করতে করতে পার্কে ঘুরতে লাগলাম। পার্কের মাঝে মেলায় নিজেদের ছবি তুলে আর বল ছুঁড়ে পুরস্কার জেতার খেলায় সাকারোজরা সময় কাটাতে লাগল।

বাচ্চারা নাগরদোলা থেকে ফিরে আসার পর আমরা সবাই হ্যাম্বার্গারের দোকানের দিকে এগোলাম। কিন্তু সাকারোজরা হ্যাম্বার্গার খাওয়াতে কোন আগ্রহই দেখাল না। তারা ফিরে গেল আবার কটন ক্যান্ডির দোকানের দিকে।

আমি লিলিয়ানের দিকে ফিরে বললাম, “আরেকটা কটন ক্যান্ডি দেখলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব এবার। আমি জানি না ওরা কী করে আবার ওই মিষ্টিগুলো খাচ্ছে!”

“দেখো, ওদের বাচ্চাটাকেও আবার কতগুলো কিনে দিচ্ছে!”

“আমি ওদের হ্যামবার্গার অথবা হটডগ খাবে কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু ওদের গোমড়া মুখ দেখে মনে হল না যে ওরা ওসব খেতে ভালবাসে। কিন্তু এখন দেখ কী আনন্দ করে মিষ্টি খাচ্ছে!”

লিলিয়ান বিরক্ত মুখে বলল – “জানো আমি মিসেস সারাকসকে আপেলের রস খেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তুমি যদি ওঁর মুখটা দেখতে! আমি যেন ওনাকে বিষপান করতে বলেছি! তবে যাই হোক, হয়ত ওরা আমাদের এখানের খাবারগুলো সম্পর্কে পরিচিত নন। তবে যতগুলো ক্যান্ডি ওরা খাচ্ছে তাতে পরের দশ দিন ওদের কিছু না খেলেও চলবে।”

আমরা সারাকসদের দিকে এগোনর সময় খেয়াল করলাম আকাশটা যেন কিরকম মেঘলা লাগছে। মিস্টার সারাকস খুব চিন্তিত মুখে রেডিওটা কানে ধরে ছিলেন আর মাঝে মাঝে পশ্চিমদিকে তাকাচ্ছিলেন।

“ওহ! পঞ্চাশ টাকা বাজি, এবার ওরা বাড়ি যেতে চাইবে।” লিলিয়ান ফিসফিস করে বলল।

ঠিক তাই! মিস্টার সারাকস এগিয়ে এসে বিনীতভাবে দুঃখ প্রকাশ করে জানালেন, যদিও সময়টা খুব ভালো কেটেছে, কিন্তু এবার তারা বাড়ি ফিরতে চান। কোনরকম ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পড়ার বাসনা তাদের নেই। এর সাথে আবহাওয়া দপ্তরের ভুল পূর্বাভাসের জন্যে যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশও করলেন।

আমি ওদের বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলাম যে বছরের এই সময় মেঘলা মানেই ঝড় বৃষ্টি হয়না। আর যদিও বা হয় তাহলেও সেটা ঘণ্টা খানেকের বেশি স্থায়ী হয়না। কিন্তু এই কথাটা শোনা মাত্র সারাকসের বাচ্চাটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। মিসেস সারাকস কাতর ভাবে বাচ্চাটিকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। এরপর সবাই মিলে গাড়িতে উঠে বাড়ির পথ ধরা ছাড়া আমার কোন উপায় রইল না।

ফেরার পথে গাড়িতে কেউ কোন কথা বলছিল না। পেছনের সিটে মিস্টার সারাকসের রেডিওতে বিভিন্ন স্টেশনের একঘেয়ে আবহাওয়ার খবর শোনা যাচ্ছিল। এখন সব স্টেশনই জানাচ্ছে একটু পরেই বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত হবে। সারাকসের ছেলেটি ব্যারোমিটারটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। মিসেস সারাকস দুমিনিট পর পরই আমাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন গাড়িটা আরো জোরে চালানো যাবে কিনা।

লিলিয়ান ওদের শান্ত করার জন্যে বলল – “দেখে তো মনে হচ্ছে না খুব বেশি বৃষ্টি হবে!”

আমরা যখন বাড়ির রাস্তায় ঢুকলাম তখন চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। হাল্কা ধুলোর ঝড়ের সাথে গাছের পাতা পাক খাচ্ছে রাস্তার উপর। তারউপর হঠাৎ বিদ্যুতের চমক যেন কেমন একটা অশুভ বার্তা বয়ে আনছিল। আমি সারাকসদের সাহস দেবার জন্যে বললাম, “ আমরা এসে গেছি প্রায়। আর দু’মিনিটের মধ্যে আপনারা বাড়িতে ঢুকে যেতে পারবেন।”

সারাকাসদের বাড়ির সামনে এসে যখন গাড়িটা থামালাম, তখনও বাইরে হয়ত দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে কি হয়নি। মিস্টার সারাকাসের মুখ অন্ধকার, যেন কোন অজানা আতঙ্কে মাঝে মাঝে শিউরে উঠছেন। কোন রকমে আমাদের ধন্যবাদ দিয়ে উনি স্ত্রী আর বাচ্চাকে নিয়ে উঠোন ধরে বাড়ির দিকে দৌড় লাগালেন।

লিলিয়ান বলে উঠল, “সত্যি বাবা, এদের দেখে মনে হচ্ছে যেন…”, আর তারপরেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি

নামল। এরকম বৃষ্টি আমরা বহুদিন দেখিনি। মনে হল যেন আজ স্বর্গের বাঁধ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গাড়ির ছাদে যেন হাজার হাজার ড্রাম একসাথে বাজতে শুরু করল। সারাকসরা তখন উঠনের মাঝ পর্যন্ত পৌঁছেছিল সবে। হতাশ হয়ে তিনজনেই আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল।

বৃষ্টি শুরু হবার সাথে সাথে তাদের মুখগুলো কেমন ঝাপসা হতে শুরু করল। তারপর আমাদের চোখের সামনে তিনজনই আস্তে আস্তে গলে গিয়ে বৃষ্টির সাথে মিশে যেতে লাগলো। চোখের পলকে সারাকাসদের জায়গায় পড়ে থাকল শুধু জলে ভেজা তিনটে কাপড়ের স্তূপ।

পুরো ঘটনাটা ঘটতে বোধহয় কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছিল। কারণ তারপরেই কানে এল লিলিয়ানের থেমে যাওয়া বাক্যের শেষটুকু, “ওরা চিনি দিয়ে তৈরি আর বৃষ্টিতে গলে যাবে।”

  জয়ঢাকের  সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

  

 

 

6 thoughts on “বিদেশী গল্প-ইংরিজি -আয় বৃষ্টি ঝেঁপে আইজ্যাক অ্যাসিমভ। রেইন রেইন গো অ্যাওয়ে। অনুবাদ দীপ ঘোষ বসন্ত ২০১৮

  1. এই গল্পটার একটা অনুবাদ ছোটবেলায় সম্ভবতঃ বিজ্ঞান মেলা পত্রিকায় পড়েছিলাম। তারপর অনেক খুঁজেছি কাচ্চাবাচ্চাদের পড়ানোর জন্য। এবার হাতে / পাতে বা স্ক্রিনে তুলে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। অনুবাদটাও দারুন হয়েছে।

    Like

  2. দারুণ লাগল । এই গল্পটি আগে পড়া ছিল না। অনুবাদ খুব ভাল। পুরো সময় আটকে রাখে গল্পে।

    Like

  3. অনুবাদ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কারণ আগের গল্পেও বলেছি এটা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল যে এটা বাংলাতেই লেখা। এক্ষেত্রেও তাই। তবে এই গল্পের সংলাপগুলো খুব ভাল অনুবাদ হয়েছে। অডিও স্টোরির মতই লেগেছে। এগিয়ে চলো কমরেড।

    Like

  4. অনুবাদটা এতই স্বচ্ছন্দ, যে মনে হয়েছে বাংলায় লেখা কোনো গল্পই পড়ছি। খুব ভালো লাগল।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s