অস্ট্রেলিয়া নাকি এক বিশাল বড় দ্বীপপুঞ্জ! পড়ার টেবিলে যে অ্যাটলাস বলটা আছে, তা খানিক ঘোরালেই তার কিছুটা আন্দাজ অবশ্য পাওয়া যায়। আমাদের ভারতের প্রায় আড়াইগুণ বড়!
তবে লোকসংখ্যার হিসাবে নেহাতই পুঁচকে এ দেশ, সে কথা বলাই বাহুল্য! এই মহাদেশের মস্ত একখানি পেটও রয়েছে আবার! বা, বলা ভাল, কিঞ্চিৎ পেট-সর্বস্ব এই মহাদেশ। সেই কোন ছোট্টবেলা (মানে এই তোমাদের বয়সী যখন ছিলাম আর কি! এখন তো ধাড়িবুড়ি হয়েছি একেবারে!) থেকে শুনে আসছি বলো তো কত কথা আজগুবি এই দেশ নিয়ে! এই যেমন ধরো, দক্ষিণ গোলার্ধে থাকা এই দ্বীপপুঞ্জে সবকিছুই কেমন যেন উলটো উলটো! এখানে বর্ষার জন্য আলাদা কোনো ঋতু নির্দিষ্ট নেই আমাদের মতো। অক্টোবর থেকে এপ্রিল— যখনতখন নাকি ঘটতে পারে তার আবির্ভাব! শুধু যে বৃষ্টি হয়েই রক্ষা করবে, তা কিন্তু নয়— তার সাথে নেমে আসে হুশহুশ বাতাস আর এলোপাথাড়ি ঝড়। ছাতা টাতা তখন উলটে একেবারে একশা!
আসলে প্রশান্ত সাগর ঘিরে রেখেছে তো এই মহাদেশের (অস্ট্রেলিয়া আমাদের সাতটি মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে ছোট)আশপাশ, তাই প্রকৃতির অহেতুক খামখেয়ালীপনায় বড় বেহিসাবী এখানকার আবহাওয়া। চারটে ঋতুতে নামকে ওয়াস্তে ভাগ করা যায় বটে অবশ্য ঋতুকাল—গ্রীষ্ম, শরত, শীত আর বসন্ত, তবে সত্যি কথা বলতে কি ভাগটা নেহাতই ক্যালেণ্ডার মেনে। আর বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে বলে তো মনে হয় না। এই শনশন করে এমন হাওয়া খেলে গেল, হাড়ের মধ্যে যেন প্রলয়নাচন হওয়ার জোগাড়! সত্যি বলছি গো— চারটে লেপ গায়ে দিয়েও তখন শান্তি মিলবে না একদম! পরক্ষণেই রোদ্দুরটোদ্দুর উঠে গরমের হলকা বইবে বাতাসে! যেন রাজস্থানের মরুভূমি! দিনের বেলা ৪৫ ডিগ্রি টেম্পারেচারও তখন আশ্চর্য করে না সাহেবসুবোদের। তবুও সবসময় মোটা জ্যাকেট একটা বয়ে চলাই শ্রেয়— কখন যে তার প্রয়োজন পড়বে তার ঠিক নেই কিনা!
আরও একটা মজার ব্যাপার কী জানো তো! বললাম না আগে এখানে সব উলটপুরাণ হয়ে বসে আছে! এদের জানুয়ারি মাসে গ্রীষ্মকাল শুরু হয় আর জুন মাসে পরে শীত! তাহলেই বোঝো কাণ্ডখানা! সবে আমাদের ভারতবর্ষের গ্রীষ্মকাল পার করে কোনোক্রমে এই ভিনদেশে এসেই শুনি কিনা সামনে আবার দাবদাহের সময় আসছে! বলো কী বাজে ব্যাপার!
তার মধ্যে আমার তিনি বলে দিলেন, “সিডনি কিন্তু একদম সমুদ্রের পাড়ে। জানোই তো এসব জায়গায় আবহাওয়া নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় সমুদ্র থেকে আসা জলজ বাষ্পে। ওসব শীতের জামাকাপড় ওখানে লাগবে না। তার চেয়ে আরও কিছু টিশার্ট প্যাক করে নাও— গরমে পরে আরাম!”
কী যে ঠকেছি তাকে বিশ্বাস করে, কী আর বলব তোমাদের! এখন তো সেপ্টেম্বর পড়ে গেছে— মানে নিয়মমাফিক বসন্তকালও শুরু, তবু একদিন রাতে ঠান্ডায় ঘুম আসে না, তো পরদিন গরমে। সকাল সাতটায় আট ডিগ্রি, তো বেলা বাড়তেই তা ছুঁয়ে গেল পঁয়ত্রিশ। শরীর তো বুঝতেই পারছে না কেমন ভাবে নিজেকে মানিয়ে নেবে পরের দেশে এসে! কী যে জ্বালাতন!
সে যাকগে! এসে যখন পড়েইছি দূরদেশে সব্বাইকে ছেড়ে, তোমাদের কিন্তু এখানকার বেশ কিছু গল্প না শুনিয়ে ছাড়ব না। এই যেমন, আবহাওয়ার তো একটা আভাস পেলে— এও বুঝলে, সমুদ্র প্রধান দেশ এই অস্ট্রেলিয়া। তাই বলে কি আর পাহাড় নেই? আমাদের হিমালয়ের মতো অত বড় কিছু না থাকলেও ছোটখাট এদিক-ওদিক ঢালু জমিও আছে, রয়েছে ছোট বড় নানান উপত্যকা, টিলা আবার পাহাড়ও। সমুদ্রের পাড় বরাবর উঠে যাওয়া এই পাহাড়িয়া পাথুরে প্রকৃতির নিজস্ব এক অভিনব রূপ রয়েছে কিন্তু! চোখে দেখলে মন ভরে না— ছুঁয়ে দেখতে সাধ হয়। বিকেলে কিছুক্ষণ নীরবে এমন কোনো উপত্যকায় বসে ম্যাগপাই, কাকাতুয়া আর নাম না জানা বসন্তের সব পাখিদের কাণ্ডকারখানা দেখতে, সত্যি বলছি, মন্দ লাগে না কিন্তু।
গাছের একটা পাতা পড়লেও সেই আওয়াজ তোমার ঘোর ভাঙিয়ে দেবে, শান্ত এই নির্মল পরিবেশ ছেড়ে যেতে মন কেমন করবেই তোমার! কয়েকটা ঘণ্টা ফেসবুক, ফোন, ইণ্টারনেট ছাড়াও দিব্যি কেটে যাবে তখন!
পাহাড়ি এলাকায় আন্দাজ মতোই ঠাণ্ডাও সমতলের থেকে কিছু বেশি। খুব যে সেলসিয়াসের মাত্রার তারতম্য ঘটে তা নয়। সমস্যাটা হাওয়ায়। এত জোরে হঠাৎ কনকনে হাওয়া আছড়ে পড়বে যে ফুটন্ত চা কফি মুহূর্তে ঠাণ্ডা! দাঁতে দাঁত লেগে কথাটথা জড়িয়ে ভারী বিপদে পড়তে হয় তখন! আমি ভুক্তভোগী হাড়েমজ্জায়। সেই ঘটনাটা এখানে একটু বলেই দিই তোমাদের।
সিডনি থেকে দেড় ঘন্টার ড্রাইভে পৌছে যাওয়া যায় ওলংগঙ বলে ছবির মতো সুন্দর এক পাহাড়ি উপত্যকায়। একপাশে ঘননীল প্রশান্ত মহাসাগর অন্যদিকে বেশ কিছুটা খাড়াই। দুপুর দেড়টায় যখন আমার এক বন্ধু পিক আপ করে নিল আমায় সিডনি থেকে, তখন বেশ গরম। গরম জামা বলতে উলিকট রয়েছে, তাতেই মনে হচ্ছে, ইশ, না পরে এলেই হত। তা সে যাই হোক— ওলংগঙে হেলেন্সবার্গে দক্ষিণ ভারতীয় ধাঁচের এক বিশাল মন্দির রয়েছে। ওখানে পৌছে গাড়ি থেকে নামতেই হাওয়ার ধাক্কাটা প্রথম খেলাম। কোনোক্রমে মন্দিরে ঢুকে তো পড়লাম,থাকলামও বেশ কিছুক্ষণ। গণেশ চতুর্থী উপলক্ষে ভারী সুন্দর পুজো হয় এখানে। (এখানে কয়েকজন গণেশ ঠাকুরও কিন্তু সোয়েটার পরে নেয়! আমার যে কেন অমন সুবুদ্ধি হল না সেদিন!)
মন্দিরের পেছনে খাওয়া দাওয়ার কিছু স্টল ছিল। এমন হাওয়া দিতে শুরু করল হঠাৎ, বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ সেইসব স্টল গুটিয়ে এক চাতালের তলায় সেঁধিয়ে গেছে। কথা বললে ধোঁয়া বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। গায়ে যেন পিন ফুটছে হাওয়ায়। এরমধ্যেই আবার শুরু হল ঝিরঝিরে বৃষ্টি— উফ্ কী যে কষ্ট হয়েছিল সেদিন!
পাহাড়ের মাথায় আরও একটা পয়েন্ট আছে— ওখান থেকে পুরো পাহাড় আর সমুদ্রতট একসাথে দেখা যায়। দেখলাম, পাহাড়ের মাথায় জমাট বাঁধছে কালো মেঘের সারি—যেন কোনো আগ্নেয়গিরির মুখ! কী যে সুন্দর লাগছিল!
তবে গরম জামা না থাকায় বেশিক্ষণ দাঁড়ানোই যেন বিড়ম্বনা সেখানে! কয়েক মিনিট দাঁড়িয়েই টের পেলাম, আমার নাক চোখ দিয়ে অবিরাম জল পড়ে চলেছে। সর্দি নয় কিন্তু, কেবল জল!বন্ধু নিজের গাড়িতে এক্সট্রা এক সেট জ্যাকেট ভাগ্যিস রেখেছিল— সে যাত্রায় তাই রক্ষে পেলাম বলতে পারো! নাহলে কে এসব গল্প শোনাত বলো তোমাদের!
ঠাণ্ডা এত বলে আবার ভেবে বোসো না গরম নেই! যখন গরম পড়ে, তাপমাত্রা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যেও ঘোরাফেরা করে বেশ কিছুদিন। মুশকিল একটাই। রাতে হয়তো আবার তা নেমে কুড়ির নিচেও চলে যায়। দিনের রাতের হেরফের বেশ ভোগায় জনসাধারণকে। নানা ধরণের ফ্লু, ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে। এখানের সরকার তখন প্রতিষেধক বিনামূল্যে বণ্টন করে সবাইকে নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য।
এখানে আরও কিছু মারাত্মক রোগের কথাও কিন্তু দেখা বা শোনা যায় প্রতিনিয়তই। বিশেষ করে ‘মেলানোমা’ বা চামড়ার একজাতীয় মারাত্মক ক্যান্সার। অ্যাণ্টার্কটিকার এক জায়গায় ওজোনমণ্ডলে ফুটো থাকায় ক্ষতিকারক অতিবেগুনী রশ্মি ঢুকে পড়ে আমাদের বায়ুমণ্ডলে। অস্ট্রেলিয়া যেহেতু খুব দূর নয় এই মহাদেশের থেকে, তাই এর ক্ষতিকারক প্রভাব ভীষণভাবে পড়তে দেখা যায় এখানে। নেহাৎ চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত এদের, তাই যা রক্ষে!
তবে তোমরা আবার ভয় পেয়ে বোসো না কিন্তু! ঠিকমতো সানস্ক্রিন লাগালে আর শরীর ঢাকা জামা পড়লে বিপদের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। আমি বলছি না গো এ কথা। বলছেন স্বনামধন্য সব সায়েণ্টিস্টরাই।
চলো, এবার তাহলে রোগভোগের বালাই পেরিয়ে তোমাদের নিয়ে ঢুকে পড়ি এই দেশের কিছু উল্লেখযোগ্য ইতিহাসের গণ্ডিতে। আমাদের মতো এত সুপ্রাচীন সভ্যতা কিন্তু নয় এখানের। বরং, বলা যেতে পারে, নিতান্তই ছেলেমানুষ এরা আমাদের সমৃদ্ধ পুরাকালের হিসাবে।
আনুমানিক ১৬০০ সাল থেকে বিভিন্ন সময় বেশ কিছ ডাচ জাহাজ এসে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রান্ত বরাবর সমুদ্র উপকূলে। তখন সেই জাহাজগুলির নাবিকেরা এই প্রান্তরের নাম দেয় “টেরা অস্ট্রালিস ইনকগনিটা” বা “অজানা দক্ষিণপ্রান্তের দেশ”।
পাকাপাকি ভাবে খাতায় কলমে অস্ট্রেলিয়ার আবিষ্কারের সন অবশ্য ১৭৭০ সাল যখন ইংল্যাণ্ডের ক্যাপটেন জেমস্ কুক অন্য এক অভিযানে যাওয়ার পথে হঠাৎই আবিষ্কার করে ফেলেন এই সুবিপুল দ্বীপমালার একাংশ যেখানে আজকের এই সিডনি শহর অবস্থিত। এরপর বিশেষ কিছু আর বাকি থাকে না তেমন। একে-একে এই সমস্ত মহাদেশ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের অধীনতা বরণ করে। আজ আর অস্ট্রেলিয়া কারও সরাসরি তত্ত্বাবধানে না থাকলেও লণ্ডনের রানিকেই নিজেদের অধীশ্বরী বলে সম্মাননা এবং স্বীকৃতি দিয়ে চলে। এদের ডলারেও তাই রানীর মুখ জ্বলজ্বল করে আজও।
সেইসব গল্প তোমাদের তো জানাই রয়েছে, কী বলো! না জানা থাকলেও ইতিহাস বই ঘাঁটলেই পেয়ে যাওয়া যায় এইসব তথ্য। তবু এর পিছনে ধামা-চাপা পরে থাকে আরও এক ইতিহাস যা কষ্টের, অপমানের, দুঃখের, নৃশংসতার। সেই গল্প বরং কিছুটা এবার ভাগ করে নিই তোমাদের সাথে।
প্রায় আড়াইশোরও বেশি উপজাতির বাস ছিল এই মহাদেশে। সাহেবরা এখানে ঘাঁটি গাড়বার অনেক আগে থাকতেই। ইউরোপিয় নাগরিক সভ্যতার প্রভাব যেহেতু এই সুদূর দক্ষিণে এসে পৌছয়নি তখনও, নিজেদের মতো করেই দিব্য জঙ্গলে পাহাড়ে সমুদ্রে ঘুরে দিন কেটে যেত তাদের। নিতান্ত প্রয়োজনীয় সব জিনিস যেমন সুষম খাদ্য, অস্ত্র সবেরই সংস্থান করত তারা প্রকৃতির বুক থেকে। বাকি পৃথিবীর খবর তাদের জানা ছিল না। পৃথিবীর এই এক খণ্ডই ছিল তাদের বিচরণভূমি কেবল। শিকার করে, ঘুরে বেড়িয়ে দিব্যি কেটে যেত তাদের।
হঠাৎই ১৬০০ শতাব্দীর কিছু পর থেকে ইউরোপিয় ডাচ কলোনির কিছু সদস্য ঘটনাচক্রে প্রথম পদার্পণ করে অস্ট্রেলিয়ায়। কেউ যায় দক্ষিণে তাসমানিয়া অঞ্চলে, কারো জাহাজ ভুল করে ভিড়ে যায় উত্তরে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে। এমনই কিছু সাহেবের ডায়েরি ঘেঁটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সভ্যসমাজের থেকে এতটাই দূরে বাস ছিল এই আদিবাসী সভ্যতার, সাহেবদের গায়ে পরা জামাকাপড় দেখে তারা এদের অন্য কোনো প্রাণী পর্যন্ত ভেবেছিল! শেষে সব জামা প্রায় খুলে সাহেবদের প্রমাণ দিতে হয়, তারাও মানুষ! বোঝো কাণ্ড!
ধীরে ধীরে এই যাযাবর আদিম মানুষগুলির সাথে জানাশোনা বাড়তে থাকে সাহেবদের। বেশ কিছু সভ্য উপজাতি বাস করাও শুরু করে ‘অ্যাবরিজিনলস্’(আদিবাসীদের যে নামে ডাকে এরা) দের পাশাপাশি। আরও এক চমকপ্রদ তথ্য অনুযায়ী বারোজন বাঙালি নাবিকও নাকি সেইসময় থেকেই সাহেবদের সাথে পথভ্রান্ত হয়ে এসে এই মহাদেশেই বাস শুরু করে। শোনা যায়, সাহেবদের ঔদ্ধত্য ও অত্যাচারের থেকে এই সরল ‘কালো মানুষ’গুলিই বেশি মন টেনে নিয়েছিল সেই পথহারা নাবিকদের।
আমরা তো দেখেছি, কিভাবে ভারতবর্ষ দখল করেছিল ইংরেজরা। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলকেই ভোগ করতে হয়েছিল পরাধীনতার গ্লানি। ঠিক তেমন প্রতাপেই শেষমেষ ক্যাপটেন কুক প্রায় অপ্রতিরোধ্যভাবে দখল নেয় এই সুবিশাল অঞ্চলের। হয়ত বন্য কাঠের সামান্য অস্ত্র নিয়ে তারাও প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিল সাহেবদের— সেই মর্মান্তিক আন্দোলনের খবর আজ অবশ্য আর কেউ রাখেনি।
শোনা যায়, এরপর জোর করে ওই হার মেনে নেওয়া নিষ্পাপ মানুষগুলোর কাছ থেকে তাদের সন্তানদের একরকম ছিনিয়ে এনে ‘সভ্যতা’র পাঠ শেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সাহেবরা। তার ফলে বেশ কিছু প্রজন্ম হয়ে পড়ে অনাথ, সহায়সম্বলহীন। ভাবো তো, তোমাদের মতোই ছোটছোট ছেলেমানুষের দল— বনে জঙ্গলে বাবা মায়ের কোলেপিঠেই ছিল যাদের বাস, হঠাৎ একদিন সকালে ‘অসভ্য’ বলে চিহ্নিত হয়ে যায়। হারিয়ে যায় তাদের নিজস্ব পরিচয় থেকে। এমনকি, তাদের সমস্ত ইতিহাসও প্রায় মুছে ফেলা হয় পৃথিবীর বুক থেকে! উফ্! কী ভয়াবহ, তাই না?
এখনকার অস্ট্রেলিয়া অবশ্য অন্যরকম। চিন্তাশীল। সাহেবসুবোরাও মুখে অতটা সোচ্চার না হলেও বোঝে তাদের অন্যায়। তাই তাদের মধ্যেই কেউ কেউ নতুনভাবে সমস্ত তথ্য সাজিয়ে নতুন ভাবে পরিবেশনা করতে চায় ইতিহাস। বলা অবশ্য বাহুল্যই এখানে বড্ড দেরি হয়ে গেছে ভুল,দোষ, ত্রুটিগুলো স্বীকার করতে। সেই হারিয়ে যাওয়া আদিমতা, তার না জানা সংস্কৃতি, ধর্ম, ইতিহাস বেশিরভাগই তাই থেকে যায় আজও অধরা। হিসেব পাওয়া যায়না বিস্মৃত চিত্রপটের।
সেক্ষেত্রে, খাতায়কলমে বলতে গেলে, এই সভ্যতার এখনকার বয়স আনুমানিক ২০০ বছরের কিছু বেশি। ঝকঝকে রাস্তাঘাট হয়েছে চারধারে, প্রথম বিশ্বের তকমা লেগেছে গায়ে, সিডনি টাওয়ার, অপেরা হাউসের আলোয় ঝলমল করে উঠেছে চারদিক, সাদা চামড়ার মিথ্যা অহংকারও রয়ে গেছে অল্পসংখ্যক গোঁড়া সাহেবের মধ্যে।
তবু যেন কোথাও গিয়ে অন্তঃসারশূন্য এই সমাজ। ভারত, চিন থেকে দলেদলে লোকেরা এসে ভিড় জমিয়েছে। সাদা কালোর পাশাপাশি গমরঙা এশিয়াবাসীরও বিপুল সংখ্যক বাস আজ এ দেশে। সর্ব বর্ণ সর্ব ধর্মের সমন্বয়।
আচ্ছা, এদের মধ্যে সব ভুলে যাওয়া যে আদিবাসীরা আজও আছে, সন্ধ্যা নামলে কি তারা শুনতে পায় গগনভেদী রাতজাগা নিশাচরের ডাক? কিংবা বাঘের মতো ডোরাকাটা তসমনিয়ান শেয়াল অবলুপ্ত হয়েও কি আড়াল থেকে দেখে তাদের বিলুপ্ত আদিম প্রিয়জনদের?
বড্ড ভারী করে ফেললাম না লেখাটা! আক গে সেসবকথা। এবার কিছু খাওয়াদাওয়া তো করতে হবে , নাকি! চলো ঘুরিয়ে আনি তোমাদের অস্ট্রেলিয়ার রান্নাঘর থেকে।
খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনোকিছুর অভাব নেই এই দেশে। যেহেতু অনেক দেশের অনেক মানুষের একত্রে বাস এখানে, তাই ভোজনরসিকদের জন্য রয়েছে এক বিশাল আয়োজন। ভারতীয় সব রকমের খাবার তো পাবেই, এমনকি যেই রকম ভাবে চাইনিজ খাবার খাই আমরা, বা পানিপুরী— তাও মিলবে এখানে।
ছেলেবেলায় শুনেছিলাম, পয়সা ফেললে কলকাতার বাজারে বাঘের দুধও পাওয়া যায়। সে কথা সত্যি কিনা, পরখ করার সুযোগ হয়নি ঠিক কখনও। তবে, অস্ট্রেলিয়ায় যে কতখানি সঙ্গত এই উপমা, তা ইতিমধ্যেই বেশ টের পেয়েছি। শহরের বুকে যে সিডনি টাওয়ার, তারই এক বিত্তশালী রেস্তোরাঁয় বুফের মেনুটি থেকে কিছু পদ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে উদাহরণ হিসেবে।
মুরগি,গরু, শুয়োর, ভেড়ার মাংস তো খুবই সাধারণ— এদের সাথেই এখানে পাতে পড়ে চিংড়ি, অক্টোপাস, স্কুইড, কাঁচা ঝিনুক, গেঁড়ি গুগলি, স্যামন থেকে শুরু করে নানান সামুদ্রিক মাছ,এমু, এমনকি— উট, কুমির, ক্যাঙ্গারুও। অ্যাডিলেডের নাম তো শুনেইছ (এখানকার ক্রিকেট খেলার মাঠ বেশ জনপ্রিয়)— সেখানে তো আবার এক ধরণের সবুজরঙের পোকা ব্যবহার করা হয় চিজ এবং স্যালাডে। উল্লেখ্য— পোকাটি কিন্তু রীতিমত অনুভব করা যায় নিজের মুখে! ভাবতে পারছ?
তবে নিপাট বঙ্গসন্তানদের ভয়ের কোনো কারণ নেই বিশেষ। রুই, কাতলা থেকে ইলিশ — এসবও বাংলাদেশী বন্ধুদের সহায়তায় বেশ সহজলভ্য এখানে। নানাধরণের কুইজিন চেখে দেখতে চাইলেও এদেশের জুড়ি মেলা ভার। ভিয়েতনামিজ, জাপানিজ, অথেণ্টিক চাইনিজ, লণ্ডনের সাহেবদের প্রিয় ফিশ অ্যান্ড চিপ্স্,স্প্যানিশ চুরোজ্(একধরণের বিস্কুট জাতীয় নরম খাদ্যবিশেষ)— কি নেই! সাথে তোমাদের প্রিয় বার্গার, স্যান্ডউইচ,নানারকম সুস্বাদু হট চকোলেট তো রয়েছেই!
খাওয়াদাওয়া বেশি হয়ে গেলেও চিন্তা নেই। অস্ট্রেলিয়াবাসীরা খেলাধূলাতেও সিদ্ধহস্ত। আমরা এদের ক্রিকেটীয় আধিপত্যের কথা তো জানিই। তবে এদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা রাগবি। ওভাল শেপের বল নিয়ে অনেকটা ফুটবলের ধাঁচেই চলে এই খেলা। এখানেও গোল হয়, গোলপোস্ট থাকে। তফাৎ একটাই— পায়ের সাথেই সমানতালে হাতের ব্যবহারও হয় এখানে। ফুটবলের মতোই বেশ উত্তেজনাপূর্ণ খেলা এটি। এছাড়া, গল্ফখেলাটিও বেশ উপভোগ করে সবাই। বয়স্করাও দিব্যি মেতে যায় ছুটির দিনে এইসব গল্ফকোর্সে।
এখানকার ঘোড়দৌড়ও কিন্তু উচ্চবিত্তদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। অনেক সাধারণ মানুষও রাতারাতি বড়লোক হওয়ার আশায় ঘোড়ার উপর বাজিও ধরে অবশ্য। চকচকে নিটোল ঘোড়াগুলি দৃপ্ততেজে উর্ধ্বশ্বাসে যখন লাইনের শেষমাথা লক্ষ্য করে দৌড়য়, নিছক তার সৌন্দর্য উপভোগ করতেই একবার রেসকোর্সে যাওয়াই যায় বোধহয়!
অস্ট্রেলিয়রা অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসও বেশ উপভোগ্য। বরফ,পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র— সমস্তটাই যেহেতু একসারি তে এসে মিলে যায় এখানে, তাই সবকিছুকে জয় করার নেশাও ঘোর লাগায় বইকি সব্বার মনে! স্কাইডাইভিং, স্কিইং, ক্যাম্পিং, সার্ফিং,ওয়াটার রাফ্টিং, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ ভ্রমণ, ডলফিনদের সাথে সাঁতারের পাশাপাশি সাইক্লিং বা নিছক রানিং শ্যু গলিয়ে দৌড়ানো, হাঁটাতেও বেশ স্বচ্ছন্দ সবাই। একটা সুবিধা অবশ্য আছে এ দেশে— গরম পড়লেও, আমাদের কলকাতার মতো তেমন ঘাম হয় না শরীরচর্চায়। হইহই করে ঘুরে বেড়ানো যায় সারা বছরই। নতুন কিছুর নেশায় মেতে হুজুগে মিশে যেতে তাই সময় লাগে না তেমন!
এদেশের খাবারের এতো যে বিপুল আয়োজন, তার পিছনে অবশ্য এখানকার প্রাকৃতিক রসদের এক বিশাল হাত রয়েছে। মোটা মোটা জার্সি গরু, ভেড়া, মুরগির পাশাপাশি বেশ দুর্লভ নানান প্রাণী ঘাঁটি বেঁধেছে এই দ্বীপপুঞ্জে।
গাছে চড়তে পারা ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি কোয়ালা ভাল্লুক,বাচ্চাকে নিজের চামড়ার পকেটে ঝুলিয়ে লাফিয়ে বেড়ানো ক্যাঙ্গারু, ওয়ালাবি, অবাক গোলগোল চোখে তাকিয়ে থাকা বেশ বড় এমু পাখি তো আছেই, সাথে হিংস্র ডাকওয়ালা শেয়াল, তসমানিয়ন ডেভিল, ডিম দেওয়া স্তন্যপায়ী হাঁসের মতো দেখনদারির ঠোঁটওয়ালা প্ল্যাটিপাস, বিষাক্ত লাল পেটওয়ালা কালো সাপ, লাল পিঠে বিষ বহন করা মাকড়সা, নীল জিভধারী টিকটিকি, কাকাতুয়া, নানা ধরণের টিয়া ইত্যাদি প্রজাতি যেমন স্থলচর রাঙিয়ে তুলেছে, জলজ সম্ভারও বিশেষ কম নয় কিন্তু! পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত প্রাণীর তকমা-আঁটা থ্যাবরা ব্লবফিশ থেকে শুরু করে ভয়ঙ্কর বিষাক্ত বাক্স জেলিফিশ, কালো রাজহাঁস, মাংসাশী সামুদ্রিক অ্যানিমোন, হাঙর, অবলুপ্তির পথে হেঁটে যাওয়া গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের প্রবাল, জলপরীদের মতো মসৃণ ডুগং, ক্লাউনফিশ— এই তালিকা কখনই শেষ হওয়ার নয়।
তবে, মানুষের থেকে নৃশংস প্রাণী তো আর কেউ হয় না! তাদের লোভের শিকার এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের রোষে অনেক জন্তুজানোয়ারই আজ তাই প্রায় অবলুপ্তির পথে, যেমন বাঘের মতো ডোরাকাটা তসমানিয়ান শেয়াল, হাসিখুশি ভাল্লুকজাতীয় কুয়োক্কা, ক্যাসোওয়ারি পাখি, ডিম দেওয়া আদিম স্তন্যপায়ী প্রাণী একিডনা প্রভৃতি।
অস্ট্রেলিয়ার গাছপালার সম্ভারও বেশ ঈর্ষণীয়। বিশেষত বসন্তকালে চোখ ফেরানো দায় প্রকৃতির অনীর্বচনীয় রূপ থেকে। এইসময়, রাধাচূড়ার মতো হলুদ ফুল উপচে পড়ে ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে, আইসক্রিম কোণের আকারের ফুল ধরা ব্যাঙ্কসিয়া গাছ ভরে থাকে সমুদ্রতটের চারপাশ। এছাড়াও রয়েছে উইলো বটলব্রাশ, লালরঙের ঝাউ প্রকৃতির মোরেটন বে ফিগ, উজ্জ্বল পাপড়িহীন সাদা ফুলে ভরা গ্রেভিলিয়া,রঙচঙে লিলিপিলি যার থেকে উৎপাদন হয় মেরুন রঙের বেরিফল, ইলাওয়ারা আগুন গাছ (যখন লাল ফুল উপচে পড়ে এই গাছে, মনে হয়, আগুন লেগেছে— তাই থেকে এই নাম), মোটা খোলস ছাড়ানো পেপারবার্ক, বিশাল বড় দোহারা অ্যাণ্টার্কটিক গাছ যার সবুজাভ শিকড় মাটির উপর থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। এসব দেখলে মনকেমন করবেই— এত সমৃদ্ধশালী দেশ কি আর চট করে চোখে পড়ে সবসময়, ভারতবর্ষ ছাড়া?
ভারতবর্ষের কথা যখন উঠলই, বলে রাখি, এদেশে প্রায় ৬ লাখ ভারতীয়/ বংশোদ্ভূতর বাস। প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে এই সংখ্যা। পড়াশোনা বা চাকরিসূত্রে এখানে এসে এদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে অনেকেই। তার উপর রয়েছে বাংলাদেশী এবং পাকিস্তানবাসীদের ভিড়। এখানে অবশ্য ভারত পাকিস্তান বলে দূরে সরে থাকে না কেউ। পাশাপাশি বাস করাই শুধু নয়, পুজোপার্বণে একসুরে মেতে উঠতেও দেখা যায় সবাইকে। বাংলাদেশী পুজোয় গিয়ে জমিয়ে যেমন খিচুড়িভোগ খাওয়া যায়, পাকিস্তানি রেস্তোরাঁয় কাবাব চেখে দেখারও সুখ এদেশে সত্যিই আলাদা! দিওয়ালির বাজির রোশনাইয়ে বেজে ওঠে যখন আজানের সুর, সত্যি মনে হয়, এই তো ভালো ছিলাম— তবে কেন বড় বড় বেশ কিছু মাথা ক্ষমতার লোভে আমাদের দেশটাকে টুকরো টুকরো করে দিল?
যাক্, দূর দেশ অন্তত সে ব্যবধান কিছুটা হলেও ঘুচিয়ে দেয় বইকি— তাই বা কম কি?
এতক্ষণ যারা আমার সাথে সাথে অস্ট্রেলিয়ার পেটের ভিতরে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছ, তারা অনেকেই হয়তো ভাবছ, কই দেশটা তো ঘুরে দেখালাম না তোমাদের! সিডনি হারবার, অপেরা হাউজ, টরোঙ্গা চিড়িয়াখানা,মেলবোর্ন, অ্যাডিলেড, প্রশান্ত মহাসাগর, স্নো মাউণ্টেন, তসমানিয়া, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ— যাহঃ, কিচ্ছুটির কথাই তো বললাম না! সব কিছুই যে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেরিয়ে গেলাম!
কি করব বলো? সময়ের বাঁধনে কিছুটা হলেও আটকা পড়ে থাকি যে আমরা সবাই। আস্ত এই মহাদেশের প্রাকৃতিক বৈপরীত্য এতখানি, যে সবকিছুকে তুলে ধরা আমার সাধ্যের যে অনেকখানি বাইরে গো! তাছাড়া, ভেবে দেখলাম, অনেক ভ্রমণকাহিনীতেই সেসব গল্প তোমরা পেয়ে যাবে। চাও কি, টুক করে একবার ঘুরেও যেতে পারো এদেশ পরের স্কুলের ছুটিতে।
কিন্তু একটা দেশ মানেই তো শুধু আর কয়েকটা বেড়ানোর জায়গা নয়, সেখানকার প্রকৃতি, আবহাওয়া, সংস্কৃতি, মানুষজন — সব! ছোট ছোট করে এগুলোর যদি হদিশ দেওয়া যায়, তাহলে একবারেই অনেকটা ধরে ফেলা যায় নতুন অদেখা এক মানচিত্রকে। মেপলগাছের পাতায়, কাকাতুয়ার ডাকে, ক্যাঙ্গারুর লাফানোয়, নিকষ কালো আদিবাসী সম্প্রদায়ের নির্মল হাসির রেশে, ২০০ বছর ধরে বাস করা সাদা সাহেব আর আমাদের মতো গমরঙা এশীয় মানুষদের মিশেলে এ এক ভারী বিচিত্র দেশ— এক টুকরো বিশ্ব —আর এক পৃথিবী। এদের মাঝামাঝি বলে কিছু নেই, সবই চূড়ান্ত— কেউ মোটা তো এতটাই, যে হাঁটতে পারেনা—আবার কেউ রোগা তো এতটাই, তার পাঁজর বেড়িয়ে পড়ে। কোনো জন্তু বহন করে চলে আদিমতার উৎস, কেউ বা আবার আনকোরা নতুন— পরিযায়ী। দিনের বেলা যত হুল্লোড়, রাত পরতেই নিঃঝুম।কেউ একদম নাকউঁচু এশীয় বিদ্বেষী—অন্যজন সেখানেই অমায়িক, ভদ্র,পরের সংস্কৃতির দেখভালের দায় তুলে নেয়য়া সর্বংসহা। এই দিনের বেলা ছোট ছোট গ্রীষ্মকালীন পোষাক, সেখানেই রাতে কম্বলের ওম! আরও কত বলব?
তবুও সব পাশাপাশি রয়েছে তো কেমন মিলেমিশে! এই ঢের! একে অপরের ভালোয় মন্দয় হাত ধরাধরি করে,অসি(অস্ট্রেলিয়াবাসী) বলে পরিচয় দেয়, এটাই তো শেখার, এই নিয়েই তো পথচলা!