আরো নদীর গল্প- ———————————————————– পাহাড়ের কান্না-মেঘনা নদী ,পদ্মানদীর গল্প , দুরন্ত মেয়ে সুরমা ,
ব্রহ্মপুত্রের পৃথিবী ভ্রমণ
মীম নোশিন নাওয়াল খান
অনেক অনেকদিন আগের কথা। হিমালয় পর্বতমালার কাছে ছিল এক কাঠুরের বাড়ি। সেই কাঠুরের এক ছেলে ছিল। সে ছিল খুব চঞ্চল। একদিন কাঠুরের ছেলে বায়না করল, তাকে পাহাড় দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। সে ছোট্টবেলা থেকে এই পাহাড়ের কাছে থাকে, অথচ পাহাড়কে সে ঠিক করে দেখেইনি! কাঠুরে প্রথমে মোটেই রাজি হচ্ছিল না। ছোট্ট ছেলেটাকে পাহাড়ে নিয়ে যেতে সে খুব ভয় পেত। কিন্তু ছেলের কান্নাকাটি আর মনখারাপ দেখে সে শেষপর্যন্ত রাজি হল। একদিন খুব সকালে সে তার ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ল পাহাড় দেখাতে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হল, কাঠুরে আর তার ছোট্ট ছেলে পাহাড় বেয়ে উঠছে তো উঠছেই। ঠাণ্ডায় ছোট্ট ছেলেটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। কিন্তু কাঠুরে বারবার বাড়ি যাওয়ার কথা বললেও সে মোটেই রাজি হচ্ছিল না। সে বারবার বলছিল, “আরেকটু উপরে উঠি না বাবা! আরেকটু দেখি না!”
দুপুর যখন শেষ হয়ে বিকেল নামার উপক্রম হল, তখন কাঠুরে ও তার ছেলে ক্ষুধায় কাতর। কাঠুরের বৌ তাদের সঙ্গে কিছু খাবার দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু হিমালয়ের ঠাণ্ডায় সেগুলো জমে গিয়েছিল। কাঠুরে তার ছেলেকে বলল, “তুমি একটু এখানে থাক, আমি দেখি আগুন জ্বালানোর জন্য কিছু শুকনো পাতা বা কাঠ জোগাড় করতে পারি কি না। তারপর আগুন জ্বালিয়ে খাবারগুলো একটু গরম করে খাওয়া যাবে।”
ছোট্ট ছেলেটা সায় দিল।
কাঠুরে চলে যাওয়ার পর ছেলেটা ভাবল, সে একা একা বসে থেকে আর কী করবে? বরং জায়গাটা একটু ঘুরে দেখা যাক। এই ভেবে সে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল। ছোট্ট ছেলেটা ভাবল, এবার ফিরতে হবে। কিন্তু ফিরতে গিয়ে সে দেখল, সে পথ হারিয়ে ফেলেছে! অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সে আর ফেরার পথ খুঁজে পেল না। সে ওখানে বসে কাঁদতে শুরু করল।
কাঠুরের ছোট্ট ছেলেটা হাঁটতে হাঁটতে যেখানে এসে পৌঁছেছিল, সেটা ছিল তিব্বতের পশ্চিম অংশে হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের কাছে জিম ইয়ংজং হিমবাহ। সেখানে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ছেলেটা কাঁদতে লাগল।
স্বর্গ থেকে দেবতা ব্রহ্মা ছোট্ট ছেলেটাকে কাঁদতে দেখলেন। তার কান্নার কারণটাও জানতে পারলেন। তিনি একটা বুদ্ধি করলেন। স্বর্গ থেকে একটা নদীকে পাঠিয়ে দিলেন ছেলেটাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। সেই নদীটা জিম ইয়ংজং হিমবাহ থেকে নেমে এল। ছেলেটাকে ডেকে বলল, “তুমি আমার সঙ্গে এস। আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।”
ছোট্ট ছেলেটা নদীর সঙ্গে চলতে লাগল। নদীটা প্রথমে তিব্বতের মধ্যে দিয়ে চলল। সেই অঞ্চলের লোক তার নাম দিল জাংপো। এরপর সে ভারতে ঢুকে পড়ল। ভারতের অরুণাচলে ছিল কাঠুরের বাড়ি। এখানে এসে সে কাঠুরের ছোট্ট ছেলেকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিল।
ছেলেটাকে খুঁজে না পেয়ে কাঠুরে আর তার বৌ খুব কান্নাকাটি করছিল। তাকে খুঁজে পেয়ে কাঠুরে আর তার বৌ তো ভীষণ খুশি। তারা নদীটাকে অনেকবার ধন্যবাদ দিল। ছোট্ট ছেলেটাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পেরে নদীটাও ভীষণ খুশি। সে ভাবল, সে আর ফিরে গিয়ে কী করবে? সে বরং পৃথিবীটাকে ঘুরে ঘুরে দেখবে।
অরুণাচল থেকে সিয়ং নাম নিয়ে নদীটা চলতে লাগল। এরপর সে পৌঁছল আসামে। এখানকার লোকেরা তার নাম দিল দিহাঙ। আসামে এসে দিহাঙ নদীর সাথে দেখা হল দিবং এবং লোহিত নামের আর দুটো নদীর। এই নদী দুটোও ঘুরতে বেরিয়েছিল। তাই তারা তিনজন একসঙ্গে চলতে শুরু করল।
একসাথে চলতে চলতে আসামের সমভূমিতে তিনটা নদী একসাথে একটা বিশাল বড়ো নদ হয়ে গেল। যেহেতু ব্রহ্মা তাদের সবাইকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল বিভিন্ন কাজে, তাই তাদের তিনজনের একসাথে নাম হল ‘ব্রহ্মপুত্র নদ’।
আসাম উপত্যকায় অনুপ্রস্থভাবে ৭২০ কিলোমিটার লম্বা পথ পাড়ি দিল ব্রহ্মপুত্র। তারপর নদটা গারো পাহাড়কে ঘিরে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ল। ময়মনসিংহের দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরববাজারের দক্ষিণে মেঘনায় গিয়ে মিশল।
১৭৮৭ সালে একটা বড়সড় ভূমিকম্প হল, সেই সাথে বন্যা। তখন ব্রহ্মপুত্র নদ বেশ ভয় পেয়ে গেল। সে তার চলার পথ পরিবর্তন করে ফেলল। নতুন যেই পথে ব্রহ্মপুত্র চলতে শুরু করল, তার নাম দেয়া হল যমুনা নদী। গোয়ালন্দের কাছে গিয়ে যমুনা নদী মিশল পদ্মার সাথে। উৎপত্তিস্থল থেকে যমুনার দৈর্ঘ্য ২৪০ কিলোমিটার। নদীটার সর্বাধিক প্রস্থ ১২০০ মিটার। যমুনা মূলত ব্রহ্মপুত্রের শাখানদী। এই যমুনারও আবার উপনদী আছে। এগুলো হল – তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই, সুবর্ণশ্রী।
বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নদের চলার পথ খুব একটা বড়ো নয়। তবে এই নদে অনেক চর আছে। দেশের উত্তর-দক্ষিণ মুখে প্রবাহিত এই নদীপ্রণালী সবচেয়ে প্রশস্ত।
হিমালয়ে উৎপত্তির জায়গা থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ ২৮৫০ কিলোমিটার লম্বা হয়ে গেল। আর এর সর্বোচ্চ প্রস্থ ১০৪২৬ মিটার। বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্যে ব্রহ্মপুত্রই সবচেয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। ব্রহ্মপুত্রের প্রভাবিত এলাকা প্রায় ৫,৮৩,০০০ বর্গ কিমি, যার ৪৭,০০০ বর্গকিলোমিটারের অবস্থান বাংলাদেশ এলাকায়।
এভাবেই কাঠুরের ছোট্ট ছেলেকে বাড়ি পৌঁছে দিতে এসে পৃথিবী ঘুরে বেড়াল ব্রহ্মপুত্র নদ। শেষপর্যন্ত সে পদ্মার সঙ্গে মিশে একাকার হল। এখন তারা একসাথে হেসেখেলে, গল্প করে দিন কাটায়।