কিশোর ঘোষাল এর সমস্ত লেখা একত্রে
ঘড়ি চলে টিক টিক
কিশোর ঘোষাল
১
এই লেখাটা পড়ার সময় কী তোমাদের হবে? সকাল থেকে উঠে হোমটাস্ক, স্কুলে যাওয়া, স্কুল থেকে ফিরে ক্রিকেট কোচিং, নয়তো সাঁতার, নয়তো নাচ শেখা! সেটা সেরে আবার টিউশন যাওয়া! ফিরতে ফিরতে সেই রাত সাড়ে আটটা-নটা! সত্যি বলতে তোমাদের সকলের প্রতিটা দিন এবং রাত ঘন্টা-মিনিটের ঘড়ি ধরে হিসেব করা। সেখান থেকে একচুলও এদিক সেদিক হবার জো নেই। সময়কে এভাবে ঘন্টা মিনিটে যদি ভাগ করা না যেত, তাহলে কী হত, আমাদের প্রত্যেকদিনের কার্যপ্রণালী? যাকে ইংরিজিতে বলে ডেইলি শিডিউল!
আদিম মানুষের সময়ের হিসেব ছিল খুবই সহজ আর সাধারণ। দিন আর রাত। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত হল কাজের সময়। কাজ বলতে ছিল খাদ্যের সন্ধান আর খাওয়া। তারপর সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত রাত্রের কাজ ছিল অল্পস্বল্প গল্পগাছা, বিশ্রাম আর গভীর ঘুম। সময়ের এইটুকু অভিজ্ঞতা দিয়েই তাদের দিব্যি চলে গেছে হাজার হাজার বছর, অন্য কোন শিডিউল দরকারই হয়নি। প্রথমে আগুন জ্বালাতে শেখা, তারপর কৃষি এবং পশুপালন শিখে ফেলার পর, তাদের কাছে সময়ের একটা হিসেব মনের মধ্যে গড়ে উঠতে লাগল। কীভাবে গড়ে উঠল তাদের এই বোধ?
আদিম মানুষদের দলে কিছু বৃদ্ধ মানুষ থাকতেন, যাঁদের শিকার করতে যাওয়ার মতো কঠিন পরিশ্রমের সাধ্য হত না। তাঁরা গুহা কিংবা অস্থায়ী আশ্রয়েই থাকতেন, দলের শিশু, বালকদের দেখাশোনা করতেন, অসুস্থ কিংবা আহত সঙ্গীদের দেখভাল করতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ লক্ষ্য করলেন, সূর্য উঠলে দিন হয়, সূর্য অস্ত গেলে রাত আসে। কিন্তু সূর্যটা এক জায়গায় স্থির নেই। সূর্য যেদিক থেকে ওঠে, সেদিকের নাম যদি পূর্ব দেওয়া হয়, তাহলে সূর্য অস্ত যায় তার উল্টোদিকে, সে দিকটার নাম দেওয়া হল পশ্চিম। তাঁরা লক্ষ করলেন, সূর্যের আলোর উল্টোদিকে গাছপালা, খুঁটি এমনকি নিজেদেরও ছায়া পড়ে। সেই ছায়ার রকমসকম সারা দিনে একই থাকে না। ছোট হয়, লম্বা হয়, মানুষের সামনে অথবা পিছনে পড়ে থাকে। আর সূর্য যখন মধ্য আকাশে থাকে, তখন ছায়া পড়ে থাকে পায়ের নিচে – ছোট্ট হয়ে। তেমনই রাত্রের চাঁদটাও সব দিন সমান থাকে না। পুরো চাঁদ দেখা যায় যে রাতে, সেই রাতকে যদি পূর্ণিমা বলা যায়, তারপরের রাত থেকেই রোজই চাঁদের আকার কমতে থাকে। কমতে কমতে এমন হয়, এক রাত্রে চাঁদকে দেখাই যায় না, সে রাতের নাম দেওয়া হল অমাবস্যা।
এই বিষয়গুলো লক্ষ্য করতে করতে আদিম মানুষের বিজ্ঞ জনেরা নির্দিষ্ট একটা হিসেব পেতে শুরু করলেন। তাঁরা দেখলেন পনেরদিন অন্তর চাঁদটা একবার পূর্ণিমা হয়, পরের পনেরদিনে হয় অমাবস্যা! এক একটা পনেরদিনের তাঁরা নাম দিলেন পক্ষ। অমাবস্যার পরের পনেরদিন শুক্লপক্ষ, পূর্ণিমার পরের পনেরদিনের নাম দিলেন কৃষ্ণপক্ষ। শুক্ল মানে সাদা, অমাবস্যার পর চাঁদ রোজই বাড়ে, প্রতি রাত্রিতে বাড়ে চাঁদের উজ্জ্বলতাও, তাই নাম শুক্লপক্ষ। আর পূর্ণিমার পর চাঁদ যতো ছোট হতে থাকে, প্রতি রাত্রে চাঁদের উজ্জ্বলতা কমতে থাকে, অন্ধকার হতে থাকে রাত্রের আকাশ, তাই তার নাম কৃষ্ণপক্ষ!
তাঁরা আরও লক্ষ করলেন, বছরের সব সময় সূর্য পূর্ব দিকের একই জায়গা থেকে উদয় হয় না, আবার পশ্চিমের একই জায়গায় অস্তও যায় না, কিছুটা করে সরে যায়। যার ফলে, বছরের কিছুদিন সূর্যের তেজ প্রখর হয়, সেই সময়ের নাম দেওয়া হল গ্রীষ্ম (summer)। এই সময়ে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়তে বাড়তে দীর্ঘতম হয়ে ওঠে। আর যে সময়ে সূর্যের তেজ বেশ কম থাকে সেই সময়ের নাম দেওয়া হল শীত (winter)। এই সময়ে দিনের দৈর্ঘ্য কমতে কমতে হ্রস্বতম হয়ে ওঠে।
নির্মল রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁরা আরও লক্ষ করলেন, আকাশের অজস্র নক্ষত্র, কিছু কিছু গ্রহ। অজস্র সেই নক্ষত্রের মধ্যে তাঁরা কয়েকটি নক্ষত্র চিনে ফেললেন! কয়েকটি নক্ষত্রের সমষ্টিকে একত্রে এক একটা বিশেষ আকার কল্পনা করে তাদের নামও রাখতে শুরু করতে লাগলেন। যেমন কালপুরুষ (orion) এবং তার পায়ের কাছে থাকে একটি কুকুর এবং একটি শশক। এইভাবেই তাঁরা খুঁজে নিতে পারলেন, আরো বেশ কিছু নক্ষত্রমণ্ডলী, যেমন সপ্তর্ষিমণ্ডল (Great bear), তুলা (Libra), মেষ (Aries), বৃষ (Taurus), ধনু (Sagittarius) ইত্যাদি। তাঁরা আরো লক্ষ্য করলেন, এই নক্ষত্রমণ্ডলীগুলির কোনোটিই আকাশের এক জায়গায় স্থির থাকে না। এক এক সময় আকাশে কিছু কিছু নক্ষত্রমণ্ডলী দেখা যায়। তারা প্রতিদিন অল্প অল্প সরে সরে যায়, কিছুদিন পর তাদের আর দেখাই যায় না। তখন আকাশে উদয় হয় নতুন কিছু নক্ষত্রমণ্ডলী। আরো আশ্চর্য ব্যাপার বেশ কিছুদিন, মোটামুটি প্রতি ৩৬৫ দিনের পর পর, নির্দিষ্ট নক্ষত্রমণ্ডলীগুলিই আকাশের নির্দিষ্ট অবস্থানে বার বার ফিরে আসে।
দীর্ঘ দিন লক্ষ করতে করতে তাঁরা নির্দিষ্ট একটা হিসেব গড়ে তুলতে পারলেন। তাঁরা সেই নির্দিষ্ট সময়ের নাম রাখলেন বর্ষ বা বছর। আকাশে নির্দিষ্ট কিছু নক্ষত্রের নির্দিষ্ট উপস্থিতি অনুযায়ী, তাঁরা আরও একটা হিসাব করে ফেললেন, সেটির নাম দিলেন মাস। যেমন বিশাখা নক্ষত্র, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র, আষাঢ়, শ্রবণা, ভদ্রা, অশ্বিনী, কৃত্তিকা ইত্যাদি। নক্ষত্র অনুযায়ী মাসের নাম রাখলেন বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক। এরকমই পুষা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন, চিত্রা থেকে চৈত্র।
তাঁরা বুঝতে পারলেন, আমাদের এই ধরিত্রী এবং আকাশের ওই সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র সকলেই নির্দিষ্ট নিয়মের এক শৃঙ্খলে বাঁধা। সূর্য, গ্রহ-তারাদের নির্দিষ্ট অবস্থানের জন্যই পৃথিবীতে গ্রীষ্ম আসে। মাস দুয়েক সময় সূর্যের প্রখর তাপে জলাশয়ের জল শুকিয়ে যায়, জলের অভাবে কাতর হয়ে ওঠে সকল জীব, প্রাণী, গাছপালা প্রকৃতি। তারপরেই আকাশ জুড়ে ভেসে আসে ঘন মেঘ, প্রখরতাপে তপ্ত মাটি ভিজিয়ে নেমে আসে বৃষ্টি ধারা। দুই মাস ধরে চলা নিয়মিত বর্ষণে মাঠ ভরে ওঠে সবুজ শস্যে। গাছপালা প্রকৃতি পুষ্টি পায়, নদী নালা, খাল, বিল জলে ভরে ওঠে। এইভাবেই গড়ে উঠল ঋতুর ভাবনা। এক ঋতু থেকে অন্য ঋতুতে প্রকৃতির পরিবর্তনগুলোও তাঁদের চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল। তাঁরা বুঝতে শিখলেন বর্ষচক্র (Wheel of the year)। এই বর্ষচক্রর ধারণা থেকেই তাঁরা কৃষিকাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত, বীজ বপন থেকে ফসল তোলা – সমস্ত কাজের সঠিক সময় নির্দিষ্ট করে ফেললেন। তাঁরা নির্দিষ্ট করে ফেললেন মৃগয়া ও শিকার উৎসবের সময় শরৎ, ফসল ঘরে তোলার আনন্দ উৎসবের সময়!
সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্রদের পর্যবেক্ষণ করে, পক্ষ, মাস, ঋতু এবং বছরের হিসেব বুঝতে মানুষের কয়েক হাজার বছর লেগে গিয়েছিল। প্রাচীন যুগে খালি চোখে পর্যবেক্ষণের যে হিসেব, তার সঙ্গে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির হিসেবে কিছু কিছু ভুল ভ্রান্তি ধরা পড়েছে, কিন্তু সেগুলো খুব একটা মারাত্মক নয়। সে কথায় পরে আসবো।
২
প্রাচীন যুগের মানুষেরা দিন ও রাতের হিসেব, সূর্যোদয় – সূর্যাস্ত – সূর্যোদয়, এই নিয়মেই সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু কৃষি, ও বাণিজ্যের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নানান বৃত্তি ও পেশার সৃষ্টি হল, তার সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সামাজিক জটিলতা যতো বাড়তে লাগল, ততই সময়ের সূক্ষ্মতর পরিমাপ জরুরি হয়ে উঠতে লাগল। প্রথম দিকে দিনও রাতকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হত, এভাবে – ভোর, সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যে, মধ্যরাত্রি, শেষরাত্রি। প্রাচীন ভারতে দিন ও রাতকে ৬০ ভাগে ভাগ করা হত, প্রত্যেকটি ভাগকে বলা হত ঘড়ি। দিন ও রাত প্রত্যেককে আবার চারটি প্রহরেও ভাগ করা হত। আমাদের আধুনিক যে নিয়মে দিন ও রাতকে পরিমাপ করা হয়, সেই ২৪ ঘন্টার নিয়মের সূত্রপাত করেছিলেন ব্যবিলনের বাসিন্দারা – ১৯০০-১৬৫০ বিসিতে। ৬০ মিনিটে এক ঘন্টা এবং ৬০ সেকেণ্ডে এক মিনিট – এই নিয়মও তাঁরাই শুরু করেছিলেন।
সূর্যঘড়ি (Sun clock or Sun dial)
সব থেকে প্রাচীন ও সহজ যে সময় মাপার যন্ত্রের কথা জানা যায়, তার নাম সূর্য ঘড়ি। এই ঘড়ি সারা বিশ্বেই বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় ছিল। সমতল মাটিতে একটি লম্বা খুঁটি পুঁতে, দিনের বিভিন্ন সময়ে সূর্যের আলোয়, তার ছায়ার অবস্থান ও দৈর্ঘ থেকে সময়ের আন্দাজ পাওয়া যেত। তবে ঘড়ি হিসেবে সূর্যঘড়ির ব্যবহার সর্বপ্রথম মিশরে শুরু হয়েছিল বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন।
ওপরের ছবিতে ইংল্যাণ্ডের সেন্ট মাইকেল’স মাউন্ট পাহাড়ে অবস্থিত দুর্গের প্রাচীরে রাখা মধ্যযুগের উন্নত সূর্যঘড়ি। মাঝের কোনাকুনি খাড়া করা খুঁটির ছায়া দেখে সময় বুঝতে কোন অসুবিধে হত না।
সূর্য ঘড়ি পরিষ্কার রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের পরিমাপ করতে খুবই উপযোগী ছিল, কিন্তু সমস্যা হত মেঘলা দিনগুলিতে। কারণ সূর্যের আলোয় ছায়া না হলে, এই ঘড়ি অচল!
জলঘড়ি (Water Clock)
প্রাচীন মিশর সভ্যতায় প্রথম জলঘড়ির ব্যবহার শুরু হয়েছিল বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। এই ঘড়ি পরবর্তীকালে প্রাচীন গ্রীসেও বহুল ব্যবহৃত হত। নির্দিষ্ট আকারের একটি পাত্রের নিচের ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে, পাত্রে ভরা জল যতক্ষণে খালি হয়ে যেত, সেই সময়কে একঘন্টা ধরা হতো। চিনের ঝাউ রাজাদের আমলে (মোটামুটি ২০০০ বিসি) এই ধরনের ঘড়ি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আমাদের দেশে প্রাচীনতম যে জলঘড়ির নিদর্শন পাওয়া গেছে, তার নাম “ঘটিকা যন্ত্র”। ঘটিকা, ঘড়ি শব্দগুলির উৎপত্তি একই শব্দমূল থেকে। লক্ষ্য করে থাকবে আমরা আজও আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ পত্রে এবং পূজার নির্ঘন্টে “ঘটিকা” কথা ব্যবহার করে থাকি। প্রাচীন রাজাদের প্রাসাদে এই ঘটিকা যন্ত্রের প্রচলন ছিল। যে রাজকর্মচারীরা এই ঘড়ি ব্যবহার করে সময় ঘোষণা করত, তাদের বলা হত “ঘড়িয়ালি”। নিচের দিকে ছোট্ট ছিদ্রওয়ালা একটি খালি পাত্র, জলভরা একটি বড়ো পাত্রের মধ্যে রেখে দেওয়া হত। বড় পাত্রের জল, ছোট্ট ছিদ্রপথে ছোট পাত্রের ভেতরে ঢুকে, ছোট পাত্রটি জলে ভরে উঠে ডুবে গেলেই – নির্দিষ্ট সময়ের হিসেব পাওয়া যেত। পাত্রের আকার অনুযায়ী, সে সময়ের মাপ হত, কোথাও অর্ধ প্রহর, কোথাও পূর্ণ প্রহর। ঘড়িয়ালিরা ঘটিকা যন্ত্রের হিসেব অনুসারে, কাঠের হাতুড়ি দিয়ে উঁচুতে ঝোলানো কাঁসা বা পেতলের বড়ো ঘন্টা বাজিয়ে প্রাসাদের সকলকে প্রহর বা অর্ধপ্রহর সম্পর্কে অবহিত করত।
বালু ঘড়ি (Sand clock or Hour Clock)
বালু ঘড়িতে কিছু মিনিট অথবা ঘণ্টা খানেক সময়ের পরিমাপ করা চলত। এই ঘড়ির প্রথম কোথায় প্রচলন হয়েছিল বলা শক্ত, তবে মধ্য যুগের শুরুতে সারা বিশ্বেই এই ঘড়ির বহুল প্রচলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ছবিতে দেখানো দুটি কাচের ফানুস (Glass Bulbs), কাঠ বা সুদৃশ্য ধাতব ফ্রেমে বসানো থাকত। কাচের ফানুসদুটি মুখোমুখি জোড়া থাকত এবং তার মধ্যে থাকত খুব ছোট্ট একটি ছিদ্র। কাচের ফানুস বানানোর সময়েই তার মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণে শুকনো দানাদার বালু ভরে দেওয়া হত। এবার ওপরের ফানুস থেকে সমস্ত বালু নিচের ফানুসে ঝরে পড়তে যে সময় লাগত, সেই সময়কেই ঘন্টা বা কয়েক মিনিটে পরিমাপ করা যেত। ওপরের ফানুসের বালি নিঃশেষ হয়ে গেলে, যন্ত্রটিকে উলটে বসিয়ে দিলেই, আবার চালু হয়ে যেত পরবর্তী সময়ের পরিমাপের জন্যে!
বাতি ঘড়ি (Candle Clock)
চিনা কবি ইউ জিয়ানফুর (৫২০ এডি) কবিতায় প্রথম বাতি ঘড়ির বর্ণনা পাওয়া যায়। এই ঘড়ি বিশেষতঃ রাত্রের সময় পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হত। জাপানে এই ধরনের বাতি-ঘড়ির প্রচলন মোটামুটি দশম শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। এই ঘড়িতে সারাদিনের জন্য সাধারণতঃ ছটি উৎকৃষ্ট মোমের বাতি ব্যবহার করা হত এবং প্রত্যেকটি বাতি চার ঘন্টা করে জ্বলত। প্রত্যেকটি বাতির আকার নির্দিষ্ট হত এবং তাতে বারোটি করে সমান ভাগ করা থাকত। এক একটি ভাগ পুড়তে সময় লাগত মোটামুটি কুড়ি মিনিট। বাতি জ্বালানোর পর পুরো যন্ত্রটিকে কাঠের ফ্রেম দিয়ে বানানো কাচের বাক্সে রেখে দেওয়া হত, যাতে বাইরের হাওয়া লেগে, মোমবাতি তাড়াতাড়ি না জ্বলে যায়।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে নানা রকমের ঘড়ির প্রচলন ছিল। তার মধ্যে দীপ-ঘড়ি (Oil-lamp clock), গন্ধ-ঘড়ি (Incense clock) উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশেও প্রাচীন কালে এই দুই ঘড়ির বহুল প্রচলন ছিল। বাতি ঘড়ির মোমের পরিবর্তে, দীপ ঘড়িতে নির্দিষ্ট পরিমাণ তেল ব্যবহার করা হত এবং নির্দিষ্ট সলতে দিয়ে দীপ জ্বালানোর ফলে, তেলের পরিমাণ কমে যাওয়া অনুযায়ী সময়ের পরিমাপ করা হত!
গন্ধ ঘড়িকে সহজ ভাষায় ধূপ-ঘড়িও বলা যায়। চন্দন কাঠের গুঁড়ো, ধুনো, গুগ্গুল, রজন (Resin)-এর সঙ্গে মিশিয়ে লম্বা এবং মোটা কাঠি বানানো হত। সময়ের হিসেবের জন্যে সেই কাঠির গায়ে নির্দিষ্ট দাগ কেটে দেওয়া হত।
পরবর্তী সময়ে সেই দাগের ওপর সুতোয় বাঁধা ছোট্ট ছোট্ট ধাতুর বল ঝুলিয়ে দেওয়া হত। ধুপ পুড়তে পুড়তে এক একটি দাগে পৌঁছোলেই দাগের ওপর রাখা সুতো আগুনে পুড়ে যেত এবং ধাতব বলটি পড়ে যেত গন্ধ-ঘড়ির তলায় রাখা ধাতব থালায়। তাতে যে ঠং বা টুং শব্দ হতো তাতে ঘরের লোক সময় সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠত।
পণ্ডিতেরা বলেন, এই ধূপ-ঘড়ির প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল ভারতে এবং বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে এই ধুপ-ঘড়ির প্রযুক্তি তিব্বত ও চিনেও বহুল প্রচলিত হয়েছিল। বৌদ্ধ গুম্ফাতে আজও এই ধূপ-ঘড়ি ব্যবহার হয়ে থাকে, সময়ের পরিমাপ করার জন্যে ততটা নয়, বরং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপকরণ হিসেবে!
বাতি ঘড়ি কিংবা দীপ ঘড়ির থেকে ধূপ ঘড়ি অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল, তার কারণ ঘরের মধ্যে বাতি বা দীপের আগুনের তুলনায় ধূপের আগুন অনেক নিরাপদ। উপরন্তু ধূপের পবিত্র গন্ধ দীর্ঘ সময়ের জন্যে, ঘরের পরিবেশকেই বদলে দিতে পারে।
এতক্ষণ যে ঘড়িগুলির কথা বললাম, তার মধ্যে ধূপ-ঘড়িটিই আমার খুব পছন্দের! কিন্তু এই ঘড়ির ভরসায় শেয়ালদা থেকে সন্ধে ৭-৪২ এর বনগাঁ লোকাল, অথবা সকাল ৬-১৫-র দিল্লির ফ্লাইট ধরা যাবে কী? মনে হয় না, সেক্ষেত্রে অন্য রকম ঘড়ি দরকার, সে সব ঘড়ির কথা বলব পরের পর্বে।