আবিষ্কারের খোঁজখবর আগের পর্বগুলো একত্রে
রাজীবকুমার সাহা
এই নীলগ্রহের জন্মলগ্ন থেকেই ঘটে চলেছে কতই না আজব কাণ্ডকীর্তি। বিশেষত মানুষ বা তার পূর্ব-প্রজাতির সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন আবিষ্কার। আদিযুগ থেকে বিভিন্ন খোঁজ আর আবিষ্কারের যথাসম্ভব তথ্য ক্রমানুসারে নথিভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে এই বিভাগে।
পর্ব – ৮
কীলক লিপি (Cuneiform) (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০)
বেঁচে থাকতে গেলে মূলত যা যা প্রয়োজন সবই তো হল। এবারে প্রয়োজন অধীত বিদ্যার লিখিত নথি। দরকার রেকর্ডের। পৃথিবীর প্রাচীনতম লিখনশৈলীগুলোর মধ্যে কীলক লিপি অন্যতম। এই শৈলী উদ্ভাবিত হয় প্রাচীন সুমেরীয় মেসোপটেমিয়ায় প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বে। কীলক লিপি চিত্রদ্বারা লিখন পদ্ধতিতে বর্ণস্বরূপ ব্যবহৃত এক বিশেষ উদ্ভাবন। যদিও এই পদ্ধতি ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে সারা পৃথিবীতে আজও কিছু কিছু দক্ষ কীলক লিপিকার বর্তমান আছেন যারা মূলত শখের বশবর্তী হয়ে এই প্রাচীনতম শিল্প বাঁচিয়ে রেখেছেন।
পৃথিবীর প্রাচীনতম তথা প্রথম সভ্যতায় বসবাসকারী সুমেরীয়রা খাদ্য ও বাসস্থানের সুসংস্থানের পরবর্তী পর্যায়ে অনুভব করল এবারে তাদের এমন এক পন্থার উদ্ভাবন প্রয়োজন যাতে তারা তাদের ব্যবসায়িক লেনদেন, গৃহপালিত পশুপাখির সংখ্যা সঠিক উপায়ে চিহ্নিত করা যায়। অচিরেই আবিষ্কৃত হল কাদামাটিতে সুনির্দিষ্ট কিছু চিহ্নের ছাপ এঁকে তা আগুনে পুড়িয়ে রেকর্ড রাখা। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে একেকটা বিশেষ চিহ্নের সুনির্দিষ্ট উচ্চারণ প্রথাও চালু হয়ে গেল। সভ্যতা পা রাখল নতুন এক দিগন্তে।
বাঁধ (Dam) (খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০)
পৃথিবীতে সর্বপ্রথম বাঁধ নির্মিত হয় মিশরীয়দের দ্বারা গারাওই উপত্যকায় প্রায় ২৮০০ খ্রিস্টপূর্বে। ৩৭০ ফুট (১১৩ মিটার) উঁচু পাথুরে ইট নির্মিত এই বাঁধ প্রথম প্রচেষ্টাতে মাঝখান থেকে জলের তোড়ে ভেসে গেল। পরে মিশরীয়রা নিজেদের প্রকৌশলে আরও কিছু উন্নতি ঘটিয়ে তা শেষপর্যন্ত তৈরি করতে সমর্থ হয়।
চেয়ার (Chair) (খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০)
বিখ্যাত এক আর্কিটেক্টের মতে চেয়ার তৈরি করা অনেকগুণ বেশি কঠিন যতটা সোজা একটা স্কাইস্ক্র্যাপার তৈরি করা। পৃথিবীর সরলতম চেয়ার আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে। কৃতিত্ব সেই প্রাচীন মিশরীয়দের। মূল কারিগরি অক্ষত রেখে আজও পৃথিবীতে বিভিন্ন ডিজাইনের চেয়ারের গরিমা অক্ষত রয়েছে।
সাবান (Soap) (খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০)
অনেক হল কাজকর্ম। এবারে স্নান সেরে ঘরে ফেরার পালা। দরকার কী? না, একটা সাবান। তো বানাও সাবান। দায়িত্ব নিল ব্যাবিলনিয়রা। বিভিন্ন পশুপাখির চর্বি সেদ্ধ করে তার সঙ্গে ছাই মিশিয়ে তৈরি হল পিচ্ছিল কাদার মতো একধরনের দলা। ব্যাবিলনে খননকার্যে সেরকমই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে। স্পেন থেকে উদ্ধারকৃত উপাদান পরীক্ষা করে বোঝা গেল, অলিভ ওয়েল এবং সাসোলাগাছের ছাই মিশিয়ে তৎকালে সাবান উৎপন্ন করা হত। শুধু তাই নয়, সুমেরীয় পুরোহিতেরা বিভিন্ন ধর্মীয় আচরণের মাধ্যমে সাবানকে নিজেদের শুদ্ধির কাজেও ব্যবহার করত।
খিলান সেতু (Arched Bridge) (খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০)
সরল সেতু থেকে খিলানযুক্ত সেতুর নির্মাণ বা উদ্ভাবন প্রথম ঠিক কবে এবং কোথায় হয়েছিল তা জানা দুষ্কর। তবে এটা বোঝা গেছে যে প্রাচীন মানুষ দ্বারা সেতুর উন্নতি সিন্ধুসভ্যতার আশেপাশে প্রায় ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বে শুরু হয়েছিল। মেসোপটেমীয়, মিশরীয়, সুমেরীয় এবং চিনেরা সহ রোমানরা এই বিদ্যায় পারদর্শী ছিল বলে অনুমান করা হয়। তারা প্রাচীরগাত্রে ভার রক্ষার্থে এক নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছিল যাকে ‘করবেল পদ্ধতি’ বলা হয়। যেমনটা আমরা বর্তমানে বিল্ডিংয়ের ক্যান্টিলিভার হিসেবে দেখি।
রাং-ঝালাই (Brazing and Soldering) (খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০)
প্রযুক্তিগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে যেসকল বিদ্যা প্রাচীন সভ্যতায় প্রভূত উন্নতি লাভ করেছিল সেগুলোর মধ্যে ধাতুবিদ্যা অন্যতম। পরবর্তীকালে একেকটা ধাতুর নামই একেক যুগের পরিচিতি হয়ে ওঠে। যেমন, ব্রোঞ্জযুগ, লৌহযুগ ইত্যাদি। মানুষ শিখল কীভাবে একটা ধাতু অন্যটার সঙ্গে জোড়া দিয়ে অপেক্ষাকৃত টেকসইভাবে ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করা যায়। উন্মোচিত হল ধাতুবিদ্যার এক নতুন দিক। তবে রাং-ঝালাই পদ্ধতির আগে মানুষ পিতল গলিয়ে মোটা রঙ লেপে বিভিন্ন ধাতু জোড়া দিতে শিখে গিয়েছিল। তার প্রমাণ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০-এর সময়কার বলে দাবি করা হয়।
কাঁচ (Glass) (খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০)
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বিশ্লেষণ অনুসারে প্রথম কাঁচ তৈরি হয় ব্রোঞ্জযুগে মধ্যপ্রাচ্যে। মিশরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে এমন কিছু কাঁচের পুঁতি পাওয়া যায় যেগুলো প্রায় ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বে তৈরি। কাঁচ তৈরির মূল উপাদান হচ্ছে সিলিকা, ক্যালসিয়াম অক্সাইড এবং ম্যাগনেসিয়াম যা ২৭৩০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ উৎপন্নকারী কোনও ফার্নেসে তৈরি করা সম্ভব। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০-এই মানব সভ্যতার কলাকৌশল কী হারে উন্নতির সোপান একেক পর এক অতিক্রম করে চলেছিল তা কাঁচ আবিষ্কার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ঢালাই (Welding) (খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০)
টুকরো টুকরো ধাতু নির্দিষ্ট তাপ এবং চাপের মাধ্যমে কোনও নির্দিষ্ট আকার দিতেও মানুষ ততদিনে সিদ্ধহস্ত হয়ে পড়ে। দক্ষিণ অ্যানাটলিয়ার হ্যাটিক সমাধিতে এধরনের প্রমাণ প্রত্নতাত্ত্বিকেরা খুঁজে পান যা ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বের নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়। সেগুলো ছিল কাঁচা লৌহ আকরিক এবং পেটানো লোহার সংমিশ্রণে তৈরি ঢালাই।
হাপর (Bellows) (খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০)
ধাতুবিদ্যায় প্রভূত উন্নতির প্রায় শুরুতেই ফার্নেস টেকনোলজিতে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হল। আবিষ্কৃত হল হাপর। এর আগে অবধি চোঙায় প্রাণপণে ফুঁ দিয়ে দিয়ে কামারদের বিভিন্ন ধাতুর কাজ করতে হত। কামারদের একদল ব্লো-পাইপে মাধ্যমে চারকোলে ফুঁ দিয়ে আগুনে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি করত যাতে তাপ নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছয়। হাপর আবিষ্কার সঙ্গে সঙ্গে এই অত্যন্ত আয়াসসাধ্য কাজের ইতি ঘটে। আর চুল্লির আকারেরও বৃদ্ধি ঘটিয়ে এরা কম সময়ে অনেক বেশি পরিমাণ ধাতুর কাজ করতে সমর্থ হল। মেসোপটেমিয়ার তাল্লাতে একটা চাটু আকৃতির বস্তু আবিষ্কৃত হয় যা থেকে বোঝা যায় মানুষ ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বের সময়েই ধাতুশিল্পে হাপরের ব্যবহার করত।
ফ্লাশ টয়লেট (Flush Toilet) (খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০)
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা প্রমাণ করেন যে প্রথম বাস্তব এবং আধুনিক পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা সিন্ধু উপত্যকাবাসীদের দ্বারা অর্জিত হয়েছিল। প্রত্যেক বাড়িতে শুকনো ইটের তৈরি পায়খানার ব্যবস্থা ছিল যা মলত্যাগের পর তা জলের স্রোতে অন্য প্রকোষ্ঠে পাঠানোর কৌশল দ্বারা নির্মিত। প্রাচীন মিশরীয়রা এবং রোমানরাও ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করে।