বিচিত্র জীবজগত সব পর্ব একত্রে
পাফার ফিশ
সবর্না চট্টোপাধ্যায়
সমুদ্র একটি বিস্ময়। আর সমুদ্রের নীচে বসবাসকারী অজানা প্রাণীরা চিরকালই আমাদের মনে বিস্ময় ও কৌতূহল জাগিয়ে রেখেছে। সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে এমনই এক অদ্ভুত ও বিস্ময় সৃষ্টিকারী প্রাণী হল পাফার ফিশ। ট্রেটাওডনটিডি পরিবারভুক্ত এই ধরনের মাছকে বেলুনফিশ, বাল্বফিশ, ব্লোফিশ ইত্যাদিও বলা হয়। ত্বকে কাঁটা থাকার জন্য পরকিউপাইন ফিশ বা সজারুমাছের সমগোত্রীয়ও মনে করা হয়।
জীববিজ্ঞানীদের মতে আত্মরক্ষার স্বার্থে এরা অত্যন্ত মন্থর ও অদ্ভুত সাঁতার প্রণালীর মাধ্যমে একটি বলের আকার ধারণ করে। এই পদ্ধতিটিকে ‘ইনফ্ল্যাটাবিলিটি’ বলে। বিপদের মুহূর্তে পালাবার সময় অত্যন্ত স্থিতিস্থাপক পাকস্থালীতে প্রচুর পরিমাণে জল ও বায়ু ভরে দেহটিকে অত্যাধিকমাত্রায় বেলুনের মত ফুলিয়ে বা বলের আকার গঠন করে। যেটি সাধারণ আকারের তুলনায় বেশ খানিকটা বড় হয়। কোনকোন প্রজাতির পাফারফিশে চামড়ার গায়ে আবার কাঁটা থাকে এবং আত্মরক্ষার তাগিদে বলের আকার নেওয়ার সময় কাঁটাগুলি শক্ত হয়ে যায়।
পাফারদের দৃষ্টিশক্তি বেশ তীব্র হয়। কিছু প্রজাতির পাফার আবার আত্মরক্ষার তাগিদে চারপাশের পরিবেশ অনুযায়ী নিজেদের রঙ পরিবর্তন করতে পারে,খানিকটা গিরগিটির মতই। আবার অপরদিকে বেশিরভাগ পাফার ম্যাটম্যাটে রঙের হয়। কেউবা উজ্জ্বল বর্ণের ও বেশকিছু বৈশিষ্ট্যময় চিহ্নযুক্তও হয়ে থাকে এবং এরা বিপদের সময় আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য লুকানোর চেষ্টা পর্যন্ত করে না,খানিকটা নিরীহভাবেই আত্মসমর্পণ করে।
মোটামুটি ৩৫ প্রজাতির পাফার স্বাদুজলেই সাধারণত তাদের জীবনচক্র সম্পূর্ণ করে।সাধারণত দক্ষিণ আমেরিকা,আফ্রিকা ও এশিয়ার দক্ষিণাংশে এই স্বাদুজলের পাফারদের সন্ধান পাওয়া যায়।সারা বিশ্বে মোটামুটি ১২০টি প্রজাতির পাফার ছড়িয়ে আছে। সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডল ও প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সমুদ্রে এদের দেখা যায়।তবে কিছু প্রজাতি আছে যারা ঈষৎ লবণাক্ত জলে ও পরিষ্কার স্বাদুজলেও বসবাস করে। ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়া দেহের অগ্রভাগে মাথাটি খানিকটা কন্দাকৃতি হয়ে থাকে।
সাধারণভাবে পাফারফিশ অতিক্ষুদ্রাকার হয়। প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা। আবার মিষ্টিজলের পাফাররা দৈত্যাকার হতে পারে,লম্বায় প্রায় দুফুটেরও বেশি। এদের দেহ আঁশমুক্ত হয় ও ত্বক সূচাগ্র হয়ে থাকে। যেকোন ধরনের পাফারফিশেই চারটি করে দাঁত একত্রে ঠোঁটের মত আকার গঠন করে।
সাধারণতভাবে এরা বিভিন্ন ধরনের শ্যাওলা ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। বড় প্রজাতির পাফাররা শক্তখোলাযুক্ত মাছ যেমন ওয়েসটারফিশ, কিংবা কাঁকড়া, অর্চিন, ঝিনুকদেরও শক্ত ঠোঁট থাকার জন্য খাবার হিসাবে গ্রহণ করতে পারে।
পৃথিবীর দ্বিতীয় বিষাক্ত মেরুদন্ডী প্রাণী হল এই পাফারফিশ। বিষাক্ততার দিক দিয়ে গোল্ডেনটার্ট ফিশের পরেই এর অবস্থান। তবে এটি খেতে খুবই সুস্বাদু।
জাপানে এটি পরিচিত ‘ফুগু’ নামে আর কোরিয়ানরা একে বলে ‘বুক-উহ’। সমস্যা হল এর কিছু প্রত্যঙ্গ ও চামড়া খুবই বিষাক্ত।
পাফারফিশের দেহে আসলে ট্রেটাডোটোক্সিন নামক এক পদার্থের উপস্থিতির জন্য এই মাছ অত্যাধিক মাত্রায় বিষাক্ত হয়। মানুষের দেহে এই বিষ সায়ানাইডের চেয়েও ১২০০ গুণ বেশি ক্ষতিকারক। একটি পাফারের শরীরে প্রায় তিরিশজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ মারার মত বিষ বর্তমান থাকে, যার কোন অ্যান্টিডোট নেই।
তবে এটি সত্যিই বিস্ময়কর যে, অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ার জন্যই কিছু প্রজাতির পাফারফিশের মাংস বিশ্বের বাজারে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
বিশেষত জাপানে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই খাদ্যবস্তুটি যেকোন রেস্তোরায় ফুগু নামে পরিচিত। একমাত্র বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত ও লাইসেন্সযুক্ত শেফরাই একে বিষমুক্তভাবে কাটতে পারেন। কারণ একটু ভুলেই ক্রেতার মৃত্যু একেবারে নিশ্চিত। এমনকি বছরে এইরকম কিছু মৃত্যু খবরও উঠে আসে খবরের কাগজের পাতায়।
ফুগু শেফরা এদের কাটার সময় হাতে মোটা দস্তানা ব্যবহার করেন। এই ভয়ানক বিষ ডায়াফ্রামকে প্যারালাইজড করে সাফোকেশন বা বায়ুরোধ ঘটিয়ে তোলে।
ট্রেটাডোটোক্সিন সাধারণভাবে মানুষের শরীরে গেলে প্রথমে ঝিমুনির সঙ্গে সঙ্গে হার্টরেট বেড়ে যায়, রক্তচাপ হঠাৎ কমে যায়, পেশী শিথিল হতে হতে প্যারালাইজড হয়ে পড়ে। ডায়াফ্রামের সাথে যুক্ত পেশীতে বায়ুরোধ ঘটে। ফলে এই পক্ষ্মাঘাতগ্রস্থ শরীর খুব কম সময়ের মধ্যেই মারা যায় অ্যাফাইজিয়াথন রোগে।
পাফারদের দেহে এই নিউরোটক্সিন প্রাথমিকভাবে ডিম্বাশয়,যকৃত,অল্প পরিমাণে অন্ত্রে,ত্বকে ও পেশীতে অবস্থান করতে পারে। হাঙর জাতীয় বৃহৎ শিকারী প্রাণীর শরীরে এই বিষ তেমন কাজ না করলেও মানুষের শরীরে প্রবেশমাত্রই মৃত্যু ঘটে। এই কারণে বেশকিছু বৃহৎ সামুদ্রিক প্রাণী যেমন টাইগার শার্ক, লিজার্ড ফিশ পাফারকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে।
অতীব সুস্বাদু হওয়ার দরুণ এর বাণিজ্যিক মূল্যও বেশ বেশি। পাফারের মাংসের চাহিদা বেশি হওয়ায় জাপানে মাছচাষীরা বিষমুক্ত পাফার চাষ করেন তাদের খাদ্যাভাসে কিছু রদবদল ঘটিয়ে।
পাফারের দেহে এই বিষের উপস্থিতি নিয়ে মতভেদ থাকলেও এটাই মনে করা হয় যে এদের অন্ত্রে উপস্থিত কোন ব্যাকটিরিয়াই এই বিষের প্রধান উৎস।
কিছু প্রজাতির পাফার ফিশের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে মানুষের ক্রমাগত শিকার ও আবাস-স্থল হারানোর কারণে। তবুও বেশকিছু পাফার ফিশের এখনও স্থায়ী সন্ধান পাওয়া যায়। পাফার ফিশ বিশেষত দেখা যায় ফ্রোরিডা,বাহামা, ব্রাজিলের দক্ষিণাংশসহ বিশ্বের প্রায় সব সাগরেই। স্থানভেদে এদের নামও পরিবর্তিত হয়। কোন স্থানে একে টেপা ফিনাও বলা হয়।
বিস্ময় লুকিয়ে আছে প্রকৃতির প্রতিটা পাতায়। শুধু অপেক্ষা খুঁজে নেওয়ার।নিজের কৌতূহলকে চারদেওয়ালের বাইরে এনে অজানাকে জানার একটু চেষ্টা আমাদের কত কী-ই না শেখাতে পারে। জানতে পারি এমনই সব না জানা তথ্য।
বাঃচমৎকার
LikeLike