হাতির চেয়ে বড়ো ডাঙার জন্তু অমিল কেন তার জবাব দিতে বসে প্রথমেই মনে পড়ল গ্যালিলিওর কথা। গ্যালিলিও বলেছিলেন, “একটি ছোটো কুকুর পিঠে একই আকৃতির দুই বা তিনটি কুকুর বইতে পারে। সন্দেহ জাগে, একটি ঘোড়া নিজের সাইজের মাত্র একটি ঘোড়াকেও বহন করতে পারে কিনা ।“
ভার বইবার ব্যাপারে কুকুরের তুলনায় ঘোড়াকে হেয় করার পেছনে গ্যালিলিওর সঙ্গত কারণ ছিল। আসলে, প্রাণীদের আকার বৃদ্ধির সাথে মাথা চাড়া দিতে থাকে কাঠামোগত দুর্বলতার সমস্যা । এজন্য অবশ্যই দায়ী স্কেলন।
নিশ্চয়ই ভাবছ, ‘স্কেলন’ আবার কী বস্তু — খায় না মাখে ! জবাব পেতে অভিধান কিংবা পরিভাষাকোষ হাঁটকে লাভ নেই, শব্দটা কোথাও খুঁজে পাবে না। সাসপেন্সে না রেখে রহস্য বরং ফাঁস করেই দিই। নেহাত দায়ে পড়ে শব্দটা এক্ষুনি তৈরি করলাম scaling-এর পরিভাষা হিসেবে। ইংরেজি scale (noun)-কে বাংলায়ও ‘স্কেল’ এবং scale (verb) কে ‘স্কেলিত’ বলা চলতে পারে। খটোমটো লাগছে? কী আর করা যাবে, বাংলায় কখনও চর্চা হয়নি এমন একটি বিষয়ে আলোচনা করতে হলে লেখক ও পড়ুয়া দু’জনকে কিঞ্চিৎ ঝক্কি তো পোহাতেই হবে !
যাই হোক, গ্যালিলিওর বক্তব্যের তাৎপর্য স্পষ্ট হবে পরের আলোচনা থেকে।
লম্বায় a ও চওড়ায় b হলে একটি আয়তাকার বারান্দার ক্ষেত্র (এরিয়া) হবে ab । লম্বা চওড়া দুটোই k গুণ করে বাড়ালে ক্ষেত্র বেড়ে হবে k2ab । কাজেই বলতে পারি, ক্ষেত্র স্কেলিত হয় দৈর্ঘ্যের বর্গ বা দ্বিতীয় ঘাতে (area scales as square of length)। অনুরূপে বলা যায়, আয়তন স্কেলিত হয় দৈর্ঘ্যের ঘন-তে বা তৃতীয় ঘাতে (volume scales as cube of length)।
প্রথমেই দু’টি কথা বলা দরকার। (এক) আকারের সাথে যেহেতু প্রাণীদেহের ঘনত্ব তেমন কিছু পাল্টায় না, তাই আয়তনের পরিবর্তে ‘ওজন স্কেলিত হয় দৈর্ঘ্যের ঘনকে’ লিখলেও ভুল হবে না। (দুই) হাড়ের সহন ক্ষমতা বা হাড়ের জোর (বোন স্ট্রেংথ) হাড়ের ক্ষেত্রের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় বলতে পারি ‘হাড়ের জোর স্কেলিত হয় দৈর্ঘ্যের বর্গে।’
মাপ (ডাইমেনশন) বাড়ার সাথে প্রাণীর ওজন এবং হাড়ের জোর দুই-ই বাড়ে । কিন্তু ওজন বাড়ার সাথে হাড়ের জোর সমান তালে তো বাড়েই না, বরং পিছিয়ে পড়তে থাকে অতি দ্রুত। কী বলতে চাইছি তা স্পষ্ট হবে উদাহরণ দিলে। মাপ দ্বিগুণ হলে ওজন 2x2x2 বা আটগুণ বৃদ্ধি পায় কিন্তু হাড়ের জোর বাড়ে মাত্র 2×2 বা চারগুণ। আবার মাপ তিনগুণ হলে ওজন যেখানে 27 গুণ বাড়ে সেখানে হাড়ের জোর বাড়ে মোটে 9 গুণ।
আলোচনা থেকে বোঝা গেল ছোটো প্রাণীর চেয়ে বড় প্রাণীর হাড় তুলনামূলকভাবে কমজোরী। স্পষ্ট হল কুকুর ও ঘোড়ার বহন ক্ষমতা নিয়ে গ্যালিলিওর মন্তব্যের কারণ।
বিপাকীয় ক্রিয়াকলাপজনিত তাপের উৎপাদন ও বর্জনও বিশালদেহীদের পক্ষে সমস্যার। তাপের উৎপাদন প্রতিটি কোষে (অর্থাৎ আয়তনে) আর তাপের বর্জন ত্বকে (তল বা সারফেসে)। অর্থাৎ, উৎপাদন স্কেলিত হয় দৈর্ঘ্যের ঘন-তে কিন্তু বর্জন স্কেলিত হয় দৈর্ঘ্যের বর্গে।এই স্কেলন তারতম্য তাপের উৎপাদন ও বর্জনের সামঞ্জস্য রক্ষায় বাধার সৃষ্টি করে।
বিপুল ওজন বইনোপযোগী হাড়ের অপ্রাপ্যতা এবং বিপাকীয় তাপ যথাযথভাবে বর্জনে অক্ষমতা — এই জোড়া সমস্যাই স্থলচর প্রাণীদের আকারের উর্দ্ধসীমা বেঁধে দিয়েছে। তাই হাতির চেয়ে বৃহদাকার স্থলচর প্রাণী অমিল।