ভূতের আড্ডা দেশবিদেশেরভূত-আবার ভানগড়–রহস্যমৃত্যু অমিতাভ সাহা বসন্ত ২০১৮

আবার ভানগড়

অমিতাভ সাহা

bhuteraddabhangarh (Large)

যে ঘটনার কথা বলব সেটা গল্প নয়, বাস্তব সত্য। খুব বেশি দিন আগের কথাও নয়, মোটামুটি বছর দেড়েক আগেকার ঘটনা।

ভূতসন্ধানী গৌরব তিওয়ারির নাম হয়ত অনেকেই শুনে থাকবেন। তাঁর নেশা ছিল ভূতের পেছনে ছুটে বেড়ানো। কোন জায়গায় কোন অলৌকিকতার আভাস পেলেই তিনি ছুটে যেতেন সেই রহস্যের সমাধান করতে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও তাঁর নাম ছড়িয়েছিল একজন ভূত বিশেষজ্ঞ হিসেবে। দিল্লির বাসিন্দা গৌরব পেশাগতভাবে পাইলট ছিলেন। তিনি যে বরাবরই ভূতবিশ্বাসী ছিলেন, এমনটা নয়। ২০০৩ সালে তাঁর প্রথম ভৌতিক অভিজ্ঞতা ঘটে। ঐ সময় ট্রেনিং প্রোগ্রামের জন্য ফ্লোরিডায় একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকাকালীন গৌরব এক অশরীরীর ফিসফিস শব্দ শুনতে পান ও একটি শিশুকন্যার ছায়ামূর্তি দেখতে পান। তিনি তখন ঐ অ্যাপার্টমেন্টে চারজন সহকর্মীর সঙ্গে ছিলেন। এরপর থেকেই ভৌতিক বিষয়ের প্রতি গৌরবের বিশ্বাস ও আগ্রহ জন্মে। তিনি আমেরিকার Para Nexus Association থেকে কোর্স করে একজন সার্টিফায়েড প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর হয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং ২০০৯ সালে Indian Paranormal Society নামে একটি সংস্থা গঠন করেন যার উদ্দেশ্য ছিল হন্টেড হাউস বলে পরিচিত জায়গাগুলিতে ঠিক কি ঘটে, সে বিষয়ে মানুষের কাছে সঠিক তথ্য পেশ করা। লক্ষ্য ছিল, মানুষের মন থেকে ভূতের ভয়কে নির্মূল করা। কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না। এই কাজ করতে প্রসিদ্ধ সব ভুতুড়ে বাড়িতে কন্ডাকটেড ট্যুরের আয়োজন করতে হত গৌরবের ওই সংস্থাকে। সংস্থার অধীনে একটি রিসার্চ টিম আছে যারা দেশ জুড়ে ঘটতে থাকা ভৌতিক ঘটনাবলীর অনুসন্ধান চালাত।

গৌরব প্রথম লাইমলাইটে এসেছিলেন “এম টিভি গার্লস নাইট আউট” নামে একটি শো’এর বিচারক হিসেবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ভূতুড়ে বাড়িগুলিতে হানা দিত গৌরব ও তাঁর টিম। তবে বিস্তর লোকলস্কর নিয়ে নয়। মাত্র তিনজন সাহসিনীকে ভূতুড়ে বাড়িতে পাঠানো হত। সেই মেয়েদের মাথার হেলমেটে ও পিঠব্যাগে ক্যমেরা লাগানো থাকত, তাঁর সঙ্গে স্পিকার ও রেকর্ডার। গৌরব ক্যামেরা ফুটেজ মনিটর করতেন। রাত্রি ন’টা থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত ভূতুড়ে বাড়িতে অভিযান চলত। সাত ঘন্টা ধরে পরিত্যক্ত স্থানে কি কি ঘটনা ঘটল, সবকিছু বিচার করত গৌরব ও তাঁর টিম এবং সাহসিকতার ভিত্তিতে মেয়েদের পুরস্কৃত করা হত।

গৌরবের সংগ্রহে ছিল বেশ কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্র। যেমন, ঘোস্ট বক্স। এটি একধরনের রেডিও যা চালিয়ে রাখলে ক্রমাগত কিছু এলোমেলো শব্দের টুকরো ও নানা রেডিও স্টেশনের ব্রডকাস্টের টুকরো শব্দ স্পিকারে আসতে থাকে। ভৌতিক স্থানে এটি চালিয়ে রেখে গৌরব ও তাঁর টিম অশরীরীদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করত। আরেকটি ছিল, কে-২ মিটার ডিভাইস, যা ক্রমাগত পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা হ্রাসবৃদ্ধি হিসেব করে থার্মাল ইমেজ তৈরি করতে পারে। আর ছিল, কমশক্তির লেজার আলো। ইসিজি রিপোর্ট পড়ার মত এইসব যন্ত্রের রিডিং দেখে বিশেষজ্ঞ গৌরব বুঝতে পারতেন, কোন জায়গা সত্যিই ভূতুড়ে কিনা বা সেখানে কোন আত্মার অস্তিস্ত্ব আছে কিনা। বিভিন্ন টিভি শো’তেও গৌরবকে এধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করতে দেখা গেছে। “আজ তক” নিউজ চ্যানেলের একটি শো’তে নিউজ অ্যাঙ্কার ও গৌরবের টিম মিলে ভারতের সবচেয়ে রহস্যময় ও ভৌতিক স্থান বলে পরিচিত ভানগড় কেল্লায় রাত্রিবেলা অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন, যা টিভিতেও দেখিয়েছে। এই স্থানটি এতটাই ভূতুড়ে, যে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ দ্বারা সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের পরে এই কেল্লায় ঢোকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। লাইভ শো’তে এটাও দেখা গেছিলো, একবার মিটারের কাঁটা আচমকা প্রচণ্ড নড়ে উঠল ও তারপর স্তব্ধ হয়ে গেল। ম্যাগনেটিক ফিল্ডের তারতম্য হলে এই মিটারে সহজেই ধরা পড়ে। অনুসন্ধানের পর গৌরব ও তাঁর টিম এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, ঐ কেল্লায় নেগেটিভ এনারজি আছে, যদিও সেখানে ভূতপ্রেতের অস্তিত্ব নেই বলে দাবি করেছিলেন গৌরব।

এহেন ভূত-সন্ধানীর আকস্মিক মৃত্যু অবাক করে দিয়েছে সবাইকে। ২০১৬ সালের ৭ ই জুলাই মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে দিল্লিতে নিজের ফ্ল্যাটেই রহস্যজনকভাবে গৌরবের মৃত্যু হয়। পুলিশি তদন্তের পরেও আজও তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যায়নি।

ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গিয়েছে, তাঁর ঘাড়ের ঠিক নীচে সরু একটা কালো দাগ রয়েছে। প্রাথমিক ভাবে মৃত্যুর কারণ হিসেবে শ্বাসরোধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেদিন সকালে ঘটনাটি ঘটে, সেদিন গৌরব নিজের বাড়িতেই ছিলেন। দোতলায় নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলেন আর বাবা-মা-স্ত্রী ছিলেন নীচতলায়। বাড়িতে আর কেউ ছিল না। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, গৌরব আত্মহত্যা করেছেন। যদিও, সেই তত্ত্ব মানতে নারাজ তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা। তাঁদের মতে, গৌরব ভীষণই হাসিখুশি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাঁর এভাবে আত্মহত্যা করার কোনও কারণ নেই।ওনার মধ্যে কোন মানসিক অবসাদ বা হতাশা ছিল না।

ওই দিন সকাল ১১টা নাগাদ হঠাত্ই বাথরুম থেকে গৌরবের অস্বাভাবিক গলায় চিৎকার শোনা যায়। এর পরেই দরজা ভেঙে বাথরুমে ঢুকে বাড়ির লোকেরা দেখেন, মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন গৌরব। সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু, বাঁচানো যায়নি তাঁকে। বেশ কিছু দিন ধরেই গৌরব নাকি তাঁর স্ত্রীকে বলতেন, একটা অশুভ শক্তি তাঁকে পিছন থেকে টেনে ধরছে। তিনি সর্বশক্তি দিয়েও তা রুখতে পারছেন না। কিন্তু, গৌরবের কথা তাঁর স্ত্রী উড়িয়ে দিয়েছেন। ভেবেছেন, কাজের চাপেই তিনি ওই সব বলছেন।

মৃত্যুর আগের দিন রাতেও গৌরব দিল্লির জনকপুরীতে একটা হন্টেড কেস ইনভেস্টিগেট করতে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে অনেক রাত করে বাড়ি ফেরেন। ফেরার পর স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয়। কারণ, গৌরবের এই ভুতপ্রেত নিয়ে মেতে থাকাটা স্ত্রীর খুব একটা পছন্দ ছিল না। বেশির ভাগ সময় উনি নিজের জগতে গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়েই থাকতেন। মাস ছয়েক আগেই বিয়ে করেছিলেন গৌরব ৷

তাঁর পরিবারের লোকেরা মনে করছেন, গৌরবের মৃত্যুর পেছনে হাত রয়েছে কোনও অলৌকিক শক্তির। বিশিষ্ট সাইকিক ইনভেস্টিগেটর ও লেখিকা দীপ্তা রায় চক্রবর্তী গৌরবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই ইন্ডিয়ান ভ্যারাইটি নামক একটি অনলাইন পাবলিশিং ফোরামে একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন, যেখানে গৌরবের মৃত্যুর পেছনে কোন দুষ্ট আত্মা বা অশরীরী শক্তির প্রভাব আছে বলে আশঙ্কা করেছেন। গৌরব যে ভৌতিক স্থানগুলিতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই কোন দুষ্ট আত্মা হয়ত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গৌরবের পিছু নিয়েছিল। তিনি গৌরবে চিনতেন না কিন্তু যখন জেনেছিলেন গৌরব প্রায় ছয় হাজার ভূতুড়ে জায়গায় রাত কাটিয়েছেন, তখন আশ্চর্য হয়েছিলেন। আরও আশ্চর্য হয়েছিলেন এটা জেনে যে, গৌরব বলেছিল ভানগড় কেল্লা ভূতুড়ে নয়। কেননা, লেখিকা নিজে সেখানে দু’তিনবার গিয়েছেন এবং প্রত্যেকবারই কোন অদ্ভুত শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করেছেন। এইসব অশরীরীরা বিশেষ পরিবেশে এনার্জি ট্রান্সফার করতে সক্ষম। গৌরব মৃত্যুর মাসখানেক আগে বাড়িতে বলেছিল, কোন অশুভ শক্তি ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। হয়ত ভানগড় থেকে কোন নেগেটিভ এনার্জি গৌরবের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছিল, যা মানুষকে বিষাদ ও অবসন্নতার দিকে ঠেলে দেয় এবং আত্মহত্যার জন্য প্ররোচিত করে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেছেন জাপানের মাউন্ট ফুজির পাদদেশে অবস্থিত একটি জঙ্গলের কথা, আওকিঘরা ফরেস্ট। বলা হয়, এই জঙ্গলটি মানুষকে আত্মহত্যার জন্য প্রভাবিত করে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে অনেক গাছ থেকে মৃতদেহ ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। এখনও পর্যন্ত এধরনের প্রায় পাঁচশো ঘটনা ঘটেছে।

শুধু পরিবেশই নয়, তিনি এও বলেছেন, অশরীরী শক্তি এক শরীর থেকে অন্য শরীরে প্রবেশ করতে পারে। একথা বলার কারণ, মৃত্যুর আগেরদিন রাতেই গৌরব দিল্লির জনকপুরীতে ভূতেধরা সন্দেহে একটি মেয়ের খবর পেয়ে অনুসন্ধানে গিয়েছিলেন।

তাহলে কি অশরীরীদের প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ করাই কাল হল গৌরবের? সত্যিই কি কোন প্রেতাত্মা ভর করে মায়াজালে জড়িয়েছিল গৌরবকে? তা না হলে মাত্র ৩২ বছর বয়সে অজস্র ভূত অভিযানে সফল তরুণ ভূত-সন্ধানীকে নিজেই “ভূত” বনে যেতে হয়!

ভবিষ্যৎ এর কোন উত্তর দিতে পারবে কিনা কে জানে!

জয়ঢাকের ভূতের আড্ডা

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s