ভূতের আড্ডা-ভূতের বাড়ি-বেল উইচ গুহা ইন্দ্রশেখর শীত ২০১৬

bhuteraddabhuterbaari4

bhuteraddabhuterbaari5

১৮০৪ সালের কথা। জন বেল সে বছর টেনেসিতে রেড রিভারের পাশে ৩২০ একর কৃষিজমির একটা ফার্ম বানিয়ে এসে বসলেন স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে। দেখতে দেখতে মহা আনন্দে ১৩টা বছর কেটে গেল তাঁদের। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে।বুড় হচ্ছেন বেল। সমাজে সম্মান বাড়ছে। স্থানীয় চার্চের ডিকন হয়েছেন তিনি এখন।

১৮১৭ সালের গ্রীষ্মের শেষদিকে হঠাৎ সবকিছু কেমন বদলে যেতে শুরু করল গোটা পরিবারটার। ছেলেমেয়েরা  হঠাৎ করেই তাদের জমিজায়গার মধ্যে অদ্ভুতুড়ে সব জন্তু দেখতে শুরু করল। গভীর  রাতে কারা যেন দরজায় এসে ধাক্কা দেয়। শব্দ ওঠে বাড়ির দেয়ালেও। কিন্তু কাউকে চোখে পড়ে না। তারপর আস্তে আস্তে শব্দগুলো বন্ধ দরজা আর দেয়ালের বাধা পেরিয়ে তাঁদের ঘরের ভেতরে এসে ঢুকে পড়তে লাগল একসময়। খাটের পায়ার ভেতরে ইঁদুরের দাঁতের শব্দ, কাঠের মেঝেয় কেউ ছুঁড়ে ফেলে পাথরের টুকরোটাকরা, কেউ যেন কোথাও ঢকঢক করে জল খায়, কিংবা দম বন্ধ হয়ে হেঁচকি তোলে এদিকসেদিকে।

প্রায় বছরখানেক ধরে বেল-এর পরিবার ভয় পেলেও সে নিয়ে কাউকে কিছু বলেনি। কিন্তু শেষমেষ অবস্থা অসহ্য হয়ে উঠলে বেল একদিন প্রতিবেশী জেমস জনসনকে সব কথা খুলে বলে অনুরোধ করলেন তাঁদের বাড়িতে এসে রাত কাটিয়ে দেখতে।

কয়েকদিন তাঁদের বাড়িতে রাত কাটিয়ে জনসন দম্পতি বেজায় ভয় পেয়ে গেলেন। জন বেল মিথ্যে বলেননি। তাঁরা পরামর্শ দিলেন বিষয়টা এলাকার অন্য লোকজনদের জানানো হোক।

এলাকার লোকজন সব শোনবার পর ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখবার জন্যে একটা অনুসন্ধান কমিটি তৈরি করা হল। খবর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। দূরদুরান্ত থেকে লোকজন তখন আসে জন বেল-এর বাড়ির ভূতুড়ে ঘটনার সাক্ষি হতে। সে বাড়ির ভূতুড়ে শক্তি তখন আরো বেড়ে উঠেছে। অদৃশ্য শত্রু তখন কথা বলে একটু আধটু। এমনিভাবেই একসময় জানা গেল যে সে জন বেল-এর প্রতিবেশী কেট বেটস নামে এক বুড়ির ভূত। জন বেল তার জমি ঠকিয়ে নিয়েছিল, তার তার এমন রাগ তার ওপরে। তখন লোকজন তার নাম দিয়ে দিল কেট বা বেল-এর ডাইনি।

কেট এর কথাবার্তা  থেকে তার দুটো উদ্দেশ্য টের পাওয়া গেছিল। এক, সে জন বেলকে খুন করতে চায়। তার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল জন বেল এর মেয়ে  বেটসি আর প্রতিবেশী জোশুয়া গার্ডনারের বিয়েতে বাগড়া দেয়া।

bhuteraddabhuterbaariএরপর আরো তিন বছর ধরে কেট জনবেলের পরিবারে উপদ্রব চালিয়ে যায়। তার অত্যাচারের প্রধান শিকার হয়েছিল বেটসি। যখন তখন তার চুল টেনে, তাকে চিমটি কেটে, কিলচড় মেড়ে, তার গায়ে পিন ফুটিয়ে, আঁচড় কেটে অতিষ্ঠ করে দিয়েছিল কেট। ওদিকে জন বেলেরও অবস্থা তখন খারাপ হয়ে উঠেছে। গলা ফুলে যখনতখন ঢোল হয়ে ওঠে তার। তীব্র যন্ত্রণায় মনে হয় গলার ভেতর ধারালো ছুরি একটা চালিয়ে দিচ্ছে কেউ আড়াআড়িভাবে। কখনো আবার তার মুখের পেশিগুলো নিজেনিজেই বেঁকেচুরে উঠে বিভৎস সব মুখভঙ্গী তৈরি করে দিত। এইসব অত্যাচার চলবার সময় কেট আবার বেলকে বেজায় ভয়ংকর সব গালাগাল আর হুমকি দিয়ে চলত ক্রমাগত।  এর ফলে ক্রমশই  দুর্বল হয়ে পড়ছিল জন বেল।

জন বেল এর তিন ছেলে, জন বেল জুনিয়র, দ্রিউরি আর জেস বেল তখন সেনাবিভাগে জেনারেল অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের অধীনে কাজ করে। তাদের মুখে এহেন ভূতুড়ে কাণ্ডের খবর পেয়ে জেনারেল জ্যাকসন বললেন, তিনি নিজে যাবেন বেল-এর ডাইনি দেখতে। মুশকিলটা হল তাঁর দলবল এসে বেল-এর জমিতে ঢুকতেই। জ্যাকসনের গাড়ি হঠাৎ রাস্তার ওপর থেমে গেল। হাজার চেষ্টাতেও তার ঘোড়াগুলো সে গাড়ির চাকা ঘোরাতে পারে না। সে এক মহা বিপত্তি। খানিক বাদে জ্যাকসন নিজের মনেই যেই বলেছেন, “নাঃ  বেল এর ডাইনি সত্যিই আছে দেখছি!” অমনি বাতাস থেকে কে যেন বলে bhuteraddabhuterbaari3উঠল, “বেশ। তাহলে যাও। সন্ধেবেলা দেখা হবে।” আর সঙ্গেসঙ্গেই গাড়ির চাকাও ফের ঘুরতে শুরু করে দিল। বেল এর বাড়ি গিয়ে থানা গাড়ল জ্যাকসনের দলবল। কথাবার্তা চলতে চলতেই এক সেপাই একটা বন্দুক বের করে বলে, “এর মধ্যে ভূতনাশক রুপোর গুলি ভরেছি আমি। ট্রিগার টিপলেই ভূতপেত্নী জাহান্নমে চলে যাবে। আয় দেখি সামনে!”

যেই না বলা, সঙ্গেসঙ্গে কে যেন পেছন থেকে সপাটে লাথি কষাল সেপাইয়ের পেছনে। বন্দুকটন্দুক ছিটকে পড়ল তার । আর সে নিজে লাথি খেয়ে উড়ে গিয়ে পড়ল ঘরের বাইরে। সে রাত অ্যান্ড্রু আর তাঁর দলবল জন বেল এর বাড়িতেই রয়ে গেলেন। তবে রাগী ভূতটা রাত্রিবেলা কী করেছিল কে জানে, পরদিন ভোর না হতেই লোকজন দেখে জেনারেল অ্যান্ড্রু আর তার দলবল পালিয়ে চলেছে ন্যাশভিলের দিকে।

          এহেন জয়ের পর বেল এর ডাইনি প্রতিশোধ নিতে দেরি করেনি আর। ১৮২০ সালের ২০ ডিসেম্বর কেটের উদ্দেশ্য পূর্ণ হল। অত্যাচারে কাহিল হয়ে মারা গেল জন বেল। কেটের অদৃশ্য কন্ঠস্বর লোকজনকে জানিয়ে দিল  সে-ই বিষ দিয়ে মেরেছে জন বেলকে। এবারে চূড়ান্ত অত্যাচার শুরু হল বেটসিরোপরে। পরের মার্চে বেটসি বেচারা জোশুয়ার সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধটকে ভেঙেই দিল শেষমেষ।

এইবার কেটের গলা জানাল, সে চলে যাচ্ছে। বছর সাতেক পর ফের একবার ফিরে  আসবে। কথা রেখেছিল কেট। সাত বছর পর ফিরে এসে ফের একবার বেল পরিবারকে বেজায় জ্বালিয়ে সে ফিরে যায়।

কিন্তু গেল কোথায় কেট? সে খবর পেতে হল আসতে হবে জন বেলের সম্পত্তির মধ্যে থাকা একটা বিটকেল গুহাতে। তার নাম বেল উইচ গুহা। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস , ওই গুহাতেই বেল-এর ডাইনির বাসা। কেউ কেউ এ-ও বলেন যে ওর মধ্যে দিয়েই পরলোক থেকে সে বারবার ফিরে আসে মানুষের দুনিয়ায়।

সে গুহা যে কতটা লম্বা তা কেউ জানে না।তার পেহনদিকটা ক্রমশ সরু হতে হতে অজানার দিকে হারিয়ে গেছে। সেখানে গিয়ে ঢোকবার কোন রাস্তা নেই। বর্ষায় তার ভেতর দিয়ে ধেয়ে আসে জলের স্রোত।

বেলদের পরে সম্পত্তিটার মালিক হন বিল ইডেন। এ গুহার মধ্যে খানিকদূর অবধি ইলেকট্রিক আলো জ্বালিয়েছিলেন তিনি। দিনের পর দিন গুহার ভেতরে ঘুএ ঘুরে বিচিত্র সব অলৌকিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর।

একবার এক ভদ্রমহিলা এসে ইডেনকে বললেন তিনি আর তাঁর জনাপনেরো বন্ধু গুহার ভেতরে ঘুরতে যেতে চান। জটিল, দুর্গম একটা বিপজ্জনক রাস্তা বেয়ে তাঁরা তো ইডেনের নেতৃত্বে একটা খাড়া উৎরাই বেয়ে বেয়ে এসে পৌঁছোলেন গুহার মুখে। কিন্তু মুখে পৌঁছেইভদ্রমহিলা হঠাৎ ধুপ করে বসে পড়োলেন মাটিতে। সেইসঙ্গে চিৎকার, তাঁর কাঁধে কেউ চেপে আছে। বহুকষ্টে সেদিন তাঁকে মাটি থেকে টেনে তুলে গাড়ি অবধি নিয়ে যেতে পেরেছিলেন তাঁর পনেরোজন সঙ্গী।

একা একা গুহায় ঘোরবার সময় দু একবার ইডেন দেখেছেন ঘন কুয়াশায় গড়া একটা মানুষের মূর্তিকে। তার পা মাটি ছোঁয় না।

আর একবার ইডেন সন্ধের মুখমুখ একদল ছেলেমেয়েকে নিয়ে  গিয়েছেন গুহা দেখাতে। ঘন্টাখানেক গুহার ভেতর ঘুরে গল্পটল্প করে যখন তাঁরা বের হতে যাবেন তখন দলের একটা মেয়ে ঠোঁট উলটে বলে, “ধুস্‌! যত বাজে গল্প!”

এই নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে  দলটা ফিরছে। ইডেন তাঁদের আগে আগে। খানিক দূর এসে হঠাৎ মেয়েটা কেঁপে উঠে দু পা পিছিয়ে গেল। সেইসঙ্গে চিৎকার, “কে আমায় মারল!” তার মুখে আলো ফেলে ইডেন দেখেন গালে পাঁচটা আঙুলের দাগ ফুটে আছে তার। বেল গুহার ডাইনি অবিশ্বাসের শাস্তি দিয়েছে তাকে। আর একবার গুহা দেখতে আসা একদল সৈনিকের মধ্যে এক ছোকরা বেশি অবিশ্বাস দেখানোর দু মিনিটের মধ্যে বুক চেপে ধরে বসে পড়েছিল গুহার মেঝেতে। কউ তাকে টেনে তুলতে পারে না। ছোকরা খালি হাঁসফাঁস করে আর বলে কে যেন তার বুকটাকে দু হাতে চেপে ধরে চিপটে দিচ্ছে। অনেক কষ্টে সেবার তাকে বাঁচানো হয়েছিল।

ইডেনের মৃত্যুর পর ১৯৯৩ সালে সম্পত্তি এল  ক্রিস আর ওয়াল্টার কার্বির হাতে। ওয়াল্টার তামাকচাষী আর ক্রিস গুহা টুরিজমটা দেখেন। অনেক উন্নতি করেছেন তাঁরা গুহাটার। অনেক আলো, কঠিন জায়গাগুলো পেরোবার জন্যে কাঠের সেতু এইসব। কিন্তু দখল নেবার কিছুদিনের মধ্যেই কার্বিরা টের পেল, গতিক সুবিধের নয়। গুহায় এবং তাদের বাড়িতে অদ্ভুত সব শব্দ ওঠে যখনতখন। যাত্রীদের গুহায় ঘুরতে নিয়ে গিয়ে ক্রিস মাঝেমধ্যেই উদ্ভট সব সমস্যায় পড়েন। সঙ্গের কুকুরটা ভয়ে কেঁউকেঁউ করে ওঠে, যখনতখন নিভে যায় ক্রিসের ফ্ল্যাশলাইট, অকেজো হয়ে যায় টুরিস্টদের ভিডিও ক্যামেরা।

কেট ডাইনির আরো একটা গুণ আছে। গুহা থেকে কেউ কুটোটিও যদি হাতে করে নিয়ে যায় তাহলে তার আর রক্ষে নেই। স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের এক মহিলা মারা যক্সাবার পর গুহার মুখের খানিক ভেতরে তাকে কবর দেয়া হয়েছিল। কিছুদিন বাদে কবর খুঁড়ে কঙ্কাল চোরের দল তার হাড়পগোড়গুলো নিয়ে যায়। তারপর সে এক সাংঘাতিক কাণ্ড। যার যার বাড়িতে সে হাড় আছে তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে এমন ভূতুড়ে উপদ্রব শুরু হল যে নিজে এসে, পার্সেলে, সেইসব হাড় ফের ডাইনির গুহায় ফিরিয়ে দিয়ে তারা প্রাণ বাঁচায়।

টেনেসির এই বেল উইচ গুহা এখনো স্বমহিমায় বর্তমান। যারা ওদেশে থাকো বা বেড়াতে যাচ্ছ তাদের বলি, টেনেসির ক্লার্কসভিল-এর কাছের ২৪ নম্বর ইন্টারস্টেট ধরে যাবে। তারপর ৭৬ নম্বর হাইওয়ে ধরে অ্যাডামস পৌঁছোবে। সেখানে অ্যামোকো স্টেশান থেকে বাঁদিকে ঘুরে কে’স বুর্গ রোডে গিয়ে ঢুকলেই গুহাটার বোর্ড দেখবে। টিকিট সাত ডলার। তবে হ্যাঁ কেউ যেন ও থেকে কুটোটিও নিয় এসো না সঙ্গে করে। আনলেই—–

জয়ঢাকি ভূতসাইক্লোপিডিয়া এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s