ভ্রমণ গুজরাট পর্ব ৪ বিতস্তা ঘোষাল বর্ষা ২০১৯

মন্দির প্রাঙ্গনটি একেবারেই সাদাসিধে। কোনও পাণ্ডা বা পুরোহিত এসে ছেঁকে ধরলেন না। প্রাঙ্গন পেরিয়ে মন্দিরের চত্বরে উঠলাম। বারান্দা দিয়ে ঘুরে একটা দরজা। সেখান থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। নেমে চোখ ও মন দুইই জুড়িয়ে গেল। ছোট্ট একটা গর্ভগৃহের ভিতর বিশাল শিবলিঙ্গ। দেওয়ালে পার্বতী, কাচ দিয়ে ঢাকা। মেঝেতে পাথরের নন্দী। খুব বেশি মানুষ একসঙ্গে ভেতরে ঢুকছে না। অন্যসব জায়গার মতো এখানে শিবলিঙ্গর গায়ে মাথায় গুচ্ছের পাতা ফুল-ফল কিচ্ছু নেই। একেকজন আসছেন, ফুল-বেলপাতা, আকন্দ বা ফুলের মালা, চন্দন, চিনি, মধু, ঘি, দুধ সব দিয়ে পুজো করছেন। তার পুজো শেষ হলেই পরিষ্কার করে দেওয়া হচ্ছে শিবলিঙ্গ ও আশপাশ। ফলে একেবারেই নোংরা বা পিচ্ছিল নয় প্রাঙ্গনটা।

আমাদের সঙ্গে পুরোহিত রাজেশজী। বাবার পূর্বপরিচিত। খুব যত্ন করে ভগবান সোমনাথ দর্শন ও অভিষেক করালেন। তিনি বললেন, “পাশুপত সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ এই মন্দিরের সেবক। দ্বিতীয় শতাব্দে লকুলীশ ছিলেন এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। নর্মদা তীরে তাঁর জন্ম। কিন্তু তিনি এখানে প্রচার করেছিলেন তাঁর দর্শন। এখানে তাঁর একটা ছোট্ট মূর্তি আছে। পাশুপত সূত্রের সংখ্যা হল একশো আটষট্টি। পাঁচ ভাগে বিভক্ত এই সূত্রগুলোতে ভগবানের আরাধনার প্রণালী বলা আছে।”

অভিষেক করতে করতে মনে পড়ছিল, আমার ঠাকুরদার স্বপ্নে পাওয়া গঙ্গা থেকে তুলে আনা শিবঠাকুরকে আমাদের স্নান করানোর কথা। গঙ্গামাটি আর গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করিয়ে চন্দন লেপতাম, বেলপাতা, জুঁই, বেলফুলের মালা পরিয়ে পুজো করতাম রোজ। ঠাকুরদা বলতেন, “গঙ্গা থেকেই তুলে এনেছি ওকে, আর কত স্নান করাবে মুনাই!”

ঠাম্মা জল ঢালতে ঢালতে বলতেন, “ওম্ শিবায় নম, নম শিবায়।”

সেগুলো মনে পড়ে চোখে জল এল। ভোর বলল, “মা, ইমোশনাল হবার কিছু নেই। সব ঠিক আছে।”

রাজেশজী পুজোর পর বসে শোনালেন সোমনাথের ইতিহাস।

“সোমনাথ মন্দিরের আরাধ্য দেবতা শিব সোমেশ্বর মহাদেব নামে পরিচিত। পুরাণ অনুসারে, সত্যযুগে সোমেশ্বর মহাদেব ভৈরবেশ্বর, ত্রেতাযুগে শ্রাবণীকেশ্বর ও দ্বাপরযুগে শ্রীগলেশ্বর নামে পরিচিত ছিলেন। চন্দ্র তাঁর স্ত্রী রোহিণীর প্রতি অত্যধিক আসক্তি বশত তাঁর অন্য ছাব্বিশ স্ত্রীকে উপেক্ষা করতে থাকেন। এই ছাব্বিশ জন ছিলেন দক্ষ প্রজাপতির কন্যা। এই কারণে দক্ষ তাঁকে ক্ষয়িত হওয়ার অভিশাপ দেন। প্রভাস তীর্থে চন্দ্র শিবের আরাধনা করলে শিব তাঁর অভিশাপ অংশত নির্মূল করেন। এরপর ব্রহ্মার উপদেশে কৃতজ্ঞতাবশত চন্দ্র সোমনাথে একটি স্বর্ণ-শিবমন্দির নির্মাণ করেন। পরে রাবণ রৌপ্য, কৃষ্ণ চন্দনকাষ্ঠে এবং রাজা ভীমদেব প্রস্তরে মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেছিলেন।”

একটু থেমে বললেন, “কথিত আছে, সোমনাথের প্রথম মন্দিরটি খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকে ছিল।”

“এত আগের মন্দির এটা?”

সনাতনের প্রশ্নের উত্তরে রাজেশজী বললেন, “তাই তো বলে সবাই। আমি তো চোখে দেখিনি। তবে সোমনাথ মন্দির অনেকবার ভাঙা আর গড়া হয়েছে। শোনা যায়, গুজরাটের বল্লভীর যাদব রাজারা দ্বিতীয় মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। সিন্ধের আরব শাসনকর্তা জুনায়েদ তাঁর সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে এই মন্দিরটি ধ্বংস করে দেন। তারপর গুজ্জর প্রতিহার রাজা দ্বিতীয় নাগভট্ট সোমনাথের তৃতীয় মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই মন্দিরটি ছিল লাল বেলেপাথরে নির্মিত সুবিশাল একটি মন্দির।” তিনি থামলেন।

“শোনা যায়, পুরো মন্দিরটায় এত সোনা-মণিমুক্তো-হীরা ছিল যে গজনীর সুলতান মামুদ লোভে পড়ে গেছিলেন। সতেরো বার আক্রমণ করে সব লুঠ করে নিয়ে যান। কথিত আছে, এ মন্দির থেকে তিনি দু’কোটিরও বেশি দিনার মূল্যের ধনসম্পদ লাভ করেন। শুনেছি, মন্দিরের গায়ে সব সোনা আগুন জ্বালিয়ে গলিয়ে নিয়ে যান। একবারে চোর ছিলেন লোকটা।

“শোনা যায় যে, সোমনাথের সেবাইতরা তাদের ধনের ভাণ্ডার খুলে দিয়ে বলেছিলেন, সব নিয়ে যাও তোমরা, কিন্তু ভগবানকে ধ্বংস কোরো না। সোমনাথের বিপুল ঐশ্বর্য আর মূর্তি দেখে মামুদ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেছিলেন। তিনি নাকি বলেছিলেন, আমি মূর্তি চোর বা বিক্রেতা হতে চাই না, তার চেয়ে লোকে আমায় বিগ্রহ ধ্বংসকারী রূপে জানুক। বলে নিজের হাতে বিগ্রহ ভেঙে দেন।

“আমি পড়েছিলাম, সোমনাথের এক সেবাইত নাকি এর প্রতিশোধ নেবার জন্য বিপুল ধনরত্ন নিয়ে মামুদ যখন দেশে ফিরছেন, তখন তার পথপ্রদর্শক হয়ে সেনাবাহিনীর আগে গিয়ে রাজপুতানার মরুভূমিতে নিয়ে গিয়ে তাদের চরম দুর্গতির মধ্যে ফেলেছিলেন। ভাগ্য সেবার রক্ষা করেছিল তাদের।

“এরপরেও একাধিক মুসলিম সুলতান সোমনাথ মন্দির ভেঙে দিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্য হল, কেউই মূর্তি পুরোপুরি বিনষ্ট করতে পারেননি। লোকে বলে স্ফটিকের শিব কীভাবে ঝুলে থাকত মাটি ছাড়া সেটাই নাকি রহস্যের।”

“এই মন্দিরটা তাহলে আসল নয়?” তনয় বলল।

“আসলই।” রাজেশজী বললেন, “এর কয়েক বছরের মধ্যেই সোমনাথের নতুন মন্দির তৈরি হয়ে গেল। অনহিলবাড়ার চালুক্য রাজাদের তখন দারুণ প্রতিপত্তি। হয়তো তারাই তৈরি করে দিলেন।”

আমি গাড়িতে আসার পথে সোমনাথ নিয়ে গুগলে পড়ছিলাম। সেগুলোই এখন মনে মনে ভাবছিলাম, জৈন উল আকবর আর আল বিরুনি এর সম্পর্কে লিখেছিলেন। পাল রাজা কুমারপালের দ্বারা এই মন্দির আবার নতুনভাবে গড়ে উঠেছিল। আবার আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি এসে ভেঙে দিল। মন্দির রক্ষার জন্য হিন্দু এমনকি অনেক মুসলিমও প্রাণ দেন। তবুও রক্ষা পেল না মন্দির। অল্পদিন বাদেই আবার জুনাগড়ের রাজা মহীপাল মন্দির গড়ে দেন। এই মন্দির টিকেছিল একশো বছরের বেশি। তারপর আবার মামুদ বেগদা মূর্তি সরিয়ে তাকে মসজিদে পরিণত করলেন। আবার সংস্কার। শোনা যায় আকবরও একবার মন্দির গড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব মন্দির ভেঙে মসজিদ করে দিয়েছিলেন। তারপর বহুদিন কোনও লোক এর খবর রাখেনি।

শেষপর্যন্ত ইন্দোরের রানি অহল্যাবাই স্বপ্ন পেয়েছিলেন সোমনাথ ভগবানের। তখন এই জায়গাটা জঙ্গল। অহল্যাবাই নতুনভাবে এটা তৈরি করেন। মসজিদের পাশে। সেটা ১৭৭৩ সাল।

“আর নতুন মন্দিরটা?”

“ওটা তো স্বাধীনতার পর বল্লভ ভাই প্যাটেল তৈরি করেন। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন। তবে ওই মূর্তি ছুঁয়ে পুজো দেওয়া যায় না। দূর থেকে দেখা।”

“তাহলে আর আমি ওখানে যাব না।” সনাতন বলল।

আমি বললাম, “না গেলে না যেও। আমি ‘সন এট লুমিরি’ দেখবই।”

“সেটা আবার কী?” তনয়, রাজেশজী দু’জনেই জিজ্ঞেস করল।

“বাবা, ওটা লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। আসল শব্দটা হল ‘সন এ লুমিয়ের’। এটা ফরাসি নাম। ঐতিহাসিক মনুমেন্ট, প্রাচীন ভাস্কর্যের গায়ে আলো আর শব্দের উৎক্ষেপণে যে অডিও ভিজুয়্যাল এফেক্ট তৈরি করা হয় তাকে এই নামে ডাকা হয়।”

“ও। আচ্ছা যেও।” বলে তনয় হোটেলে ফিরল।

রাজেশজী এই শব্দটা কোনওদিন শোনেননি জানালেন। বললেন, “জীবনে প্রথমবার এমন শব্দ শুনলাম। এখানে কেউ এটা জানে না আমি নিশ্চিত। তুমি কি ফরাসি জানো?”

“বেশি না, তবে অল্পবিস্তর।” বলে ভোর হাসল। “আঙ্কেল, নেট সার্চ করলে তুমিও শিখে যাবে এমন দুয়েকটা শব্দ। এটা বিশাল কোনও বিষয় না।”

রাত আটটায় শুরু হল ‘সন এ লুমিয়ের’। অমিতাভ বচ্চনের গলায় শুনলাম রাজেশজীরই কথার প্রতিধ্বনি। সমুদ্র যেন যুগের অতীত থেকে বর্তমানে দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছে ইতিহাস। মন্দিরের মাথার উপর পরিপূর্ণ চাঁদ, পাশে সমুদ্র, মন্দিরের গায়ের প্রতিটি ভাঁজে নানান রঙের আলোর খেলা। বিভিন্ন চরিত্র আসছে, তাদের সংগীত-নৃত্যের মূর্চ্ছনায় সোমনাথের কাহিনি জীবন্ত রূপ নিচ্ছে। অদ্ভুত মায়াময় এক পরিবেশ। জানলাম শঙ্করাচার্য, স্বামী বিবেকানন্দ এসেছিলেন এই সোমনাথ দর্শনে প্রভাস তীর্থে। তবে ন্যারেশনগুলো শুনে ঠিক মন ভরল না। ইতিহাসের নানান আখ্যান না শুনলে অপূর্ণতা থেকে যায়।

একঘন্টা বাদে এই নতুন মন্দিরের সোমনাথ লিঙ্গ দর্শন করে হোটেলে ফিরলাম। মন এখন শান্ত। প্রতিটা তীর্থস্থানেরই একেকটা মাহাত্ম্য থাকে। কিছু সত্য, কিছু অলৌকিক কাহিনি মিশিয়ে এক মিথ গড়ে ওঠে। ক্রমশ সেটাই মানুষের মনে গাঁথা হয়ে যায়, তারপর সেগুলো জোড়বিজোড় ক্যালকুলেশন পারমুটেশন করে গড়ে ওঠে নতুন এক ইতিহাস। ইতিহাসের সাক্ষী কোথাও সমুদ্র, কোথাও নদী, কোথাও গাছ বা কারাগার যা রয়ে গেছে অনন্তকাল ধরে। তারপর বহু বছর বাদে এমনই কোনও স্থাপত্য বা বিল্ডিংয়ের উপর আলো-আঁধারে বলে যায় সেদিনের কথা। আর মানুষ অবাক হয়ে ভাবতে বসে, এমন ছিল! তৈরি হয় নতুন করে রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ-যন্ত্রণার পাশাপাশি ভালোবাসা। সেই মুহূর্তে দেশপ্রেম ঈশ্বরপ্রেম সব একাকার হয়ে যায়।

***

সকাল থেকে দারুণ উৎকন্ঠায় ছিলাম। ভোরের উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবে। তার চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তার কোনও রেজাল্ট বেরোবার দিনই আমার কখনও চিন্তা হয় না। আমি বা তনয় কোনওদিনই ভাবিনি ভোর প্রথম হবে, কিংবা ৯০ শতাংশের উপর পাবে। ছোটো থেকে তাকে এটাই বলেছি, যেটুকু পড়বে ভালো করে পড়বে। পাশফেলের জন্য নয়, নিজে যাতে সেই বিষয়ে সবটা জানো এমনভাবে পড়লেই হবে। আসলে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পড়াশোনাটা দরকার চাকরির জন্য। চাকরিতে ঢুকে যাওয়ার পর সেই পড়ার কোনও মূল্য নেই। প্রথম, দ্বিতীয় বিষয়গুলোরও একটা বয়সের পর আর মানে থাকে না। বরং আমরা বরাবরই জোর দিয়েছি ভোরাই মানুষ হিসেবে ভালো হোক, সহানুভূতিশীল, স্নেহময়, মানবিক গুণসম্পন্ন হোক। জীবন এক দীর্ঘ পরিক্রমা। সেখানে সবকিছু চলে যাবে, যায়। কিন্তু শেষ অবধি মানুষ টিকে থাকে মনুষ্যত্বের জোরেই।

অবশেষে অনলাইনে ভোর রেজাল্ট দেখল সোমনাথ মন্দিরের সাগর দর্শনে। ভালো রেজাল্ট হওয়ায় সব উৎকন্ঠা মুক্ত হয়ে ভোরের ইচ্ছানুযায়ী আবার ভগবান সোমনাথের পুজো, স্নান ও অভিষেকপর্ব করা হল।

মন্দির থেকে বেরিয়ে ত্রিবেণী সঙ্গম দেখতে যাব ভেবে চলে গেলাম দিউ। দিউ বলতে জানি গোয়া দমন দিউ। ভাবতাম সেগুলো বুঝি কাছাকাছি পাশাপাশি, এ-পাড়া ও-পাড়া। তাই সোমনাথ বা প্রভাস ক্ষেত্র থেকে দিউ মাত্র ৮০ কিমি দূরে শুনে অবাক হলাম।

দিউ যাবার রাস্তার দু’পাশে প্রচুর গাছ। যেতে যেতে ড্রাইভার ভাই বললেন, “দিউ লোকে যায় শরাব খেতে। পুরা গুজরাতে কোথাও দারু মেলে না, দিউ গিয়ে জোয়ান ছেলেপুলে শখ মেটায়। আর দিউতেই একমাত্র সমুদ্রে নেমে স্নান করা যায়, রাইডিং আছে—সেগুলো এনজয় করা যায়।”

ড্রাইভার ভাইয়ের দেখলাম ইতিহাস নিয়ে খুব উৎসাহ। “এটা তো পর্তুগিজরা নিয়ে নিয়েছিল। ভারতীয় রাজাদের সঙ্গে বারবার যুদ্ধ করে। গুজরাতের রাজাকেও শেষ অবধি পরাজিত করে তারা। ইংরেজরাও নিতে পারেনি তিনটে জায়গা। গোয়া দমন দিউ। আর বাংলায় একটা জায়গা আছে চন্দননগর। ওটাও ইংরেজ নিতে পারেনি।”

আমি বললাম, “চন্দননগর ফরাসিদের ছিল।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই একই।”

কিছুক্ষণ আগেই তিনি বলছিলেন, “মহম্মদ মামুদ গজনী আর মহম্মদ বেহেরা একই লোক ছিলেন। বে অর্থ গুজরাতিতে দুই। মামুদ দুটো দুর্গ জয় করে তবে সোমনাথ নিতে পেরেছিলেন। তাই তার নাম হয় মহম্মদ বেহেরা।”

আমি তৎক্ষণাৎ গুগল সার্চ করলাম। দেখলাম, সোমনাথ মন্দির সত্যিই মহম্মদ বেহেরা বহুবার আক্রমণ করে ধ্বংস করেছেন। কিন্তু ইনিই যে মহম্মদ মামুদ গজনী সেটা পেলাম না।

যা হোক, ড্রাইভার সাহেবের গল্প শুনতে ভালোই লাগছিল। উনি বলে যাচ্ছেন নিজের খেয়ালে। তিনি বলছেন, “গুজরাতের এই দ্বীপের উপর পর্তুগিজদের নজর ছিল প্রায় ১৫১৩ সাল থেকে। কিন্তু তারা ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হয় ১৫৩৫ সালে। মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তৎকালীন গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ পর্তুগিজদের শরণাপন্ন হন। শর্তস্বরূপ দিউ চলে যায় পর্তুগিজদের অধীনে। এরপর এই সেদিন পর্যন্ত তাদের সৈন্য মোতায়েন ছিল এই দ্বীপ রাজ্যে।”

তাঁর কথা শুনতে শুনতে আমি ভাবছিলাম, এ সময়ে সেন্ট পল’স চার্চ-সহ আরও দুটি চার্চ নির্মাণ করে তারা। বারোক স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন পর্তুগিজদের এই গির্জা। ১৫৩৫ সালে তৈরি হয় দুর্গটি। পরবর্তীকালে অনেক বারের চেষ্টা সত্ত্বেও পর্তুগিজদের উৎখাত করা যায়নি। অবশেষে স্বাধীনতার প্রায় ১৪ বছর পর ১৯৬১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সৈন্য দখল নেয় এই দ্বীপের।

রাস্তাগুলোর সঙ্গে গোয়ার রাস্তার মিল চোখে পড়ল। প্রায় দেড় ঘন্টা যাবার পর সমুদ্র। নাগোয়ার সমুদ্রসৈকতে নেমে পড়লাম। সমুদ্র-স্নান বা সফরের জন্য প্রস্তুত না থাকায় পাড়েই খানিকক্ষণ পা ভিজিয়ে ছবি তুলে ঘোরাঘুরি করলাম। তারপরেই সূর্য ডুবে গেল ঝুপ করে আরব সাগরের কালো জলে। আমরা আবার ফিরে চললাম সোমনাথ।

রাস্তার খেয়ে নিয়ে সাগর দর্শন গেস্ট হাউসে যখন ঢুকলাম রাত তখন সাড়ে এগারোটা। ঝটিকা সফরে দেখা হল না দিউয়ের দুর্গ, চার্চ কোনওটাই। তবুও এই যে পথ, এই দু’পাশে বট-অশ্বত্থের ঝুড়ি বেয়ে নেমে আসা অন্ধকার, লাল মাটি, নোনা বাতাস আর সমুদ্রের কালো বালি মনের মধ্যে ফিসফিস করে বলল, আসবে আরেকবার।

ফেরার পথে রজ্জাক ভাই বললেন, “ভাবী, আপনি কমলাবতীর কাহিনি জানেন?”

“কমলাবতী, মানে গুর্জর রাজকন্যা?”

“হ্যাঁ, আসলে তিনি দেবী ছিলেন। মানুষের রূপ নিয়ে রাজার ঘরে এসেছিলেন।”

“তাই?” বলে আমি গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।

ভোর বলল, “মা, রজ্জাক আঙ্কেল অনেক কিছু জানেন। আমাদের তাই গাইড লাগছে না, বলো?”

“হুম।” বলে আমি ভাবছিলাম গুর্জর রাজকন্যার কথা। এত সুন্দরী ভূ-ভারতে ছিল না। গুর্জর রাজের ছেলে ছিল না। তিনি মেয়েকেই রাজ্য শাসনের শিক্ষা দিয়েছেন। সেই মেয়ে রাজ্যের তরুণ সেনাপতি কুমার সিংহের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁকেই বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেছেন।

আমার ভাবনার রেশ ধরেই যেন রজ্জাক ভাই বলতে শুরু করলেন, “সোমনাথে নিশ্চয়ই লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোতে দেখেছেন, এক পূর্ণিমার রাতে সোমনাথের সন্ধ্যা আরতি সেরে কমলাবতী তাঁর প্রাসাদে ফিরছেন একা। পরনে সন্ন্যাসীর পোশাক। সাহসী রাজকন্যা, একা, দৃষ্টি সতর্ক। খানিকদূরে দেখলেন, কাশ্মীরী হিন্দু পণ্ডিতের বেশে দুই বিদেশি। তাদের কিছু কথোপকথনও কানে এল। বুঝলেন, এরা আদৌ হিন্দু নয়। এদের একজন সুলতান মামুদের ভাইয়ের ছেলে শাহজামাল, আরেকজন সেনাপতি রোস্তম।

“শাহজামাল এই সুন্দর দেশ দেখে মুদ্ধ। তিনি চান না এই দেশ ধ্বংস করতে। অন্যদিকে রোস্তম সুলতানের নির্দেশ মেনে তাঁকে সুলতানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে মানা করলেন। শাহজামাল এতে অপমানিত হয়ে রোস্তমকে মেরে ফেলতে উদ্যত হলে কমলাবতী পিছন থেকে তাকে বাধা দিয়ে রোস্তমকে বাঁচালেন। এটা একটা সংস্কার। ভগবানের আশ্রয়ে প্রভাস তীর্থে কাউকে হত্যা করা মহাপাপ। রোস্তমকে রক্ষা করে তিনি সেই সংস্কার বজায় রাখলেন। কিন্তু তিনি দেশের কল্যাণের চিন্তা করলেন না। উলটে তাঁদের অতিথি হবার অনুরোধ জানালেন। তাঁরা রাজি হলেন না।”

ভোর অবাক হয়ে গল্প শুনছিল। হঠাৎ বলল, “কী বোকা রে বাবা! শত্রুকে কেউ ঘর চেনায়!”

রজ্জাক ভাই হাসলেন। “একদম ঠিক বলেছ।”

আমি বললাম, “পুরোটা শোনো, ভোর।”

রজ্জাক ভাই আবার শুরু করলেন। কমলাবতীর বুকের মধ্যে একটা শঙ্খ ছিল। সেই শঙ্খ বাজিয়ে তিনি সোমনাথের রক্ষীদের ডাকলেন, আর তাদের বাধ্য করলেন আতিথেয়তা গ্রহণ করতে। তিনি অবশ্য ভেবেছিলেন অতিথি নারায়ণ।”

“তারপর? ভোরের জিজ্ঞাসা।

“পরদিন সকালে তাদের নৌকায় তুলে দেওয়া হল। কিন্তু যে শাহজামাল এত সুন্দর দেশ লুঠ করতে চাননি সেই রাজকন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে গুর্জর আক্রমণ করলেন। সোমনাথের ধনরত্ন তাঁর লক্ষ্য ছিল না, তাঁর লক্ষ্য ছিল রাজকন্যা। এদিকে মামুদ তখন ভারত লুঠের আশায় করাচির কাছে মামুদাবাদে আস্তানা গেড়েছেন। তাঁর কাছেও রাজকন্যার রূপের খ্যাতি পৌঁছে গেছে। তিনি শাহকে নির্দেশ দিলেন রাজকন্যাকে হরণ করে আনতে, তাকে বেগম করবে বলে।

“শাহজামাল গুর্জরকে শ্মশানে পরিণত করলেন, কিন্তু কমলাবতীকে পেলেন না। সন্ধ্যাবেলায় কমলা যখন কুমার সিংহের মৃতদেহ খুঁজছেন মশাল হাতে, তখন শাহজামাল তাঁকে প্রেম নিবেদন করলেন। এদিকে সুলতান মামুদ ছদ্মবেশে শাহজামালকে অনুসরণ করছিলেন। তিনি গুলি করে তাঁকে হত্যা করলেন।”

“মা, তখন গুলি ছিল?”

“জানি না।” বললাম।

রজ্জাকভাই বললেন, “কুমার কিন্তু মারা যাননি, শত্রু শিবিরে বন্দী ছিলেন। কমলাবতী মশাল নিভিয়ে পালিয়ে গেছিলেন তখন। শাহজামাল তাঁকে মৃত্যুর আগে জানিয়েছিলেন কুমার কোথায় আছে। কমলা সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন।”

“মা, কী সুন্দর হ্যাপি এন্ডিং লাভ স্টোরি!”

“হুম।” বললাম বটে, কিন্তু মনের মধ্যে এমন নানা প্রেমের গল্প ভিড় করে এল। বাবার কথা মনে পড়ল। পৃথিবীতে আজ অবধি যা হয়েছে, ভালো খারাপ – সব প্রেমের জন্য, ভালোবাসার জন্য হয়েছে। একমাত্র ভালোবাসাই পারে পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে।

***

পরদিন সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে স্নান সেরে আমি রেডি হয়ে নিলেও ভোর আর তনয়ের ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে বেরোতে বেরোতে সেই সাড়ে দশটা হয়ে গেল। সোমনাথ থেকে আমাদের ফিরতে হবে আমেদাবাদ। ৪৩০ কিমি রাস্তা। রজ্জাক ভাই বলেছেন, পাঁচ ঘন্টা লাগবে। ১০০ কিমি প্রতি ঘন্টা। আর চা খাবার জন্য আধঘন্টা। কিন্তু আমি জানি, শেষ অবধি সাত-আট ঘন্টা লাগবেই।

১০০ কিমি বেগে গাড়ি ছুটবে ভেবেই আমার অস্বস্তি শুরু হল। খুব দ্রুত গাড়ির দৌড় আমি সহ্য করতে পারি না। গাড়ি চড়ছি, না লাফাচ্ছি বুঝতে পারি না। আর সত্যি বলতে কী, জীবনের চলার পথে আমি খরগোশ নই, কচ্ছপ হতেই বেশি পছন্দ করি। আস্তে যাও, কিন্তু লক্ষ্য বজায় রেখে যাও।

কাল রাতেই ঠিক করে রেখেছিলাম, ত্রিবেণী সঙ্গম দেখে সোমনাথ ছাড়ব। রম্যাণী বারবার বলে দিয়েছে, “দিদি, অতি অবশ্যই এটা দেখবি। তিনটে নদী হিরণ্য, কপিলা আর সরস্বতী এক সাথে মিশেছে এখানে। পাশেই শশ্মানঘাটের কাছে মহাকালিকা মন্দির।”

ত্রিবেণীর ধারে পৌঁছে ভালো লাগল। যদিও চড়া রোদ, তবুও একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল। তিনটে নদী আলাদা করে বুঝতে পারছিলাম না। একজন বললেন, “প্রতিটা নদীর পরেই চরা। দেখলেই বুঝতে পারবেন। এখানে কৃষ্ণের দেহের সৎকার করা হয়েছিল।”

দেখলাম বোর্ডে লেখা এই ঘাট দৈর্ঘে ৭০০ ফিট। করসেবকরা এটা তৈরি করেছিল স্বশ্রমে ও নিজেদের অর্থে। পরে সোমনাথ ট্রাস্ট এর দায়িত্ব নেয়।

গাড়ি এখন জুনাগড়ের পাশ দিয়ে। রজ্জাক ভাই বলতে শুরু করলেন, “সাব, জুনাগড় কথার মানে হল পুরনো গড় বা জীর্ণ গড়। তার থেকেই জুনাগড়। এগুলো সব হিন্দু রাজাদের তৈরি গড়। নাম উপরকোট। ওদিকেই গির্ণার পাহাড়। পাহাড়ের উপর অনেক সাধু থাকেন। তারা শাওন মাসে, কী বলেন আপনারা শিবরাত্রির দিন নিচে নেমে এসে দামোদর কুণ্ডে ঝাঁপ দেন। তারপর কুণ্ডের মধ্যে দিয়েই আবার উপরে ফিরে যান।”

তনয় ফেসবুকে ছবি পোস্ট করছিল। বলল, “সে আমি জানি।” পরমুহূর্তেই বলল, “কোথায় সাধুরা! আমি দেখতে চাই।”

“এখন না, সাব। তারা গভীর জঙ্গলে গুহায় থাকেন। বছরে একবারই নামেন। তখনই কেবল দেখা যায়।”

আমি জানতে চাইলাম, “আপনি দেখেছেন?”

“হ্যাঁ, একবার। তাদের বয়স হাজার ছাড়িয়ে গেছে। চোখমুখ কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সারা গা মাটির মতো। মাথার চুল মাটি ছাড়িয়ে চলে গেছে। আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তারা নদী-কুণ্ডতে ঝাঁপ দিল। আর উঠল না।”

তনয় আইপডে চোখ রেখেই বলল, “কোথায় গেল?”

“সাব, বললাম যে তারা কোথায় থাকে কেউ জানে না। কেউ তাদের দেখতে পায় না। ভারতের সেরা তীর্থ এই দামোদর কুণ্ড।”

“গঙ্গার থেকেও পবিত্র?”

“গঙ্গা পবিত্র নদী মানি। কিন্তু সেখানে মানুষের অস্থি ফেললে কাই হয়ে যায়। গোমতীতে ফেলো, দেখবে চক্রাকারে ঘুরতেই থাকবে। আর এখানে ফেল, দেখবে পুরো গলে মিলিয়ে যাবে।”

“কেন?” তনয় জানতে চাইল।

“কেন হবে না?” যেন রজ্জাক ভাই এই প্রশ্নের উত্তর দেবার অপেক্ষাতেই ছিলেন। “স্বয়ং ব্রহ্মা এখানে যজ্ঞ করেছিলেন। ঋষি আর দেবতাদের স্নানের জন্য তিনিই এই কুণ্ড বানান। এতে সমস্ত তীর্থের জল, এমনকি গঙ্গার জলও ঢেলেছিলেন নিজের কমণ্ডলু থেকে। যজ্ঞ শেষে সবাই ফিরে গেলেন কৈলাসে। খালি বিষ্ণু থেকে গেলেন প্রার্থনা পূরণের জন্য। তাই এই তীর্থের নাম দামোদর তীর্থ। দামোদর তো বিষ্ণুরই নাম, তাই না?”

আমার জানা না থাকায় চুপ রইলাম।

রজ্জাক ভাই আবার বললেন, “আচ্ছা বলো, এত বছর সাধুরা কীভাবে বেঁচে?”

তনয় এবার তার দিকে তাকিয়ে বলল, “যোগবলে। আমাদের ভারতবর্ষে অনেক সাধুসন্ন্যাসী হিমালয়ের গুহার লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সাধনা করছে, তারা অমর।”

“সে তো আমিও জানি। এ সাধুরা হাজার বছর ধরে সাধনা করছে শিবের। শিব এদের অমরত্বের বরদান করেছে। পাহাড়ের উপর একসাথে জৈনমন্দির, হিন্দুদের মহাকালী মন্দির আর মসজিদ আছে। যদি ওইদিকের রাস্তাটা দিয়ে ঘুরে যেতাম একটা জিনিস দেখাতাম।”

“কী?”

“গির্ণার রোডের পাশে প্রাচীন এক শিলালিপি আছে। একটা বিশাল কালো পাথরের উপর চোদ্দটা শিলালিপি খোদাই করা। জানো, সেটা খ্রিস্টের জন্মের আগে পালি ভাষায় লেখা! কার বলো তো?” উত্তরের প্রত্যাশা না করেই বললেন, “সম্রাট অশোকের। প্রজাদের উদ্দেশ্যে লেখা অশোকের নির্দেশ লিপি। তার পাশে সংস্কৃত ভাষায় লেখা রুদ্রদমন আর স্কন্দগুপ্তের শিলালিপি। অশোকের চেয়ে চারশো আর সাতশো বছর পরে লেখা সেগুলো। বেটা, তুমি ইতিহাসে এগুলো পড়েছ তো! ইতিহাস না জানলে দেশকে চেনা যায় না বুঝলে! ইতিহাস পড়বে, সব পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, কোরান, বাইবেল সব ধর্মগ্রন্থ পড়বে। আর সবচেয়ে বেশি পড়বে ইতিহাস।”

ভোর হেসে বলল, “আমার মা আমাকে ইতিহাস পড়ায়। আর তার সাথে যা যা আছে সব।”

“বাহ্‌, খুব ভালো।” তারপরেই বলল, “আচ্ছা ভাবী, মহাকালী তোমাদের ওখানে প্রথম এসেছিল, নাকি এখানে?”

তনয় বলল, “আমাদের ওখানে।”

“তাহলে এখানে কী করে এল?”

“তোমাদের এখানে তাহলে পরে এসেছে ঘুরতে ঘুরতে,” বলে তনয় বলল, “আমি শিবরাত্রির সাতদিন আগে এসে যাব।”

“সাতদিন আগে এসে কী করবে? এখানে তিনদিন আগে ক্যাম্পে টেন্ট তৈরি হয়। তুমি ভিতর অবধি গাড়ি নিয়ে যেতে পারবে। আম-আদমি হাই রোডে গাড়ি পার্ক করে হেঁটে যাবে।” সে আবার বলল, “মহাকালী শিবের উপর পা দিয়ে কেন?”

ভোর তাকে এবার সতী হবার কাহিনি, কালীর জিভ বের করার কাহিনি শোনাল।

সব শুনে সে বলল, “অব সমঝ মে আয়ি। আমি ভাবতাম, পশ্চিমবাংলার কালী কীভাবে এখানে এল।”

আমার এদের গল্প শুনতে শুনতে পুরাণের একটা গল্প মনে পড়ে গেল। সম্ভবত স্কন্দ পুরাণের প্রভাস খণ্ডে এই গল্প পড়েছিলাম। গির্ণারের নাম ছিল উজ্জয়ন্ত পাহাড়। তার কাছেই রৈবতক ও বস্ত্রাপথ। ভোরকে বললাম, “গল্প শুনবি?”

সে তৎক্ষণাৎ কান থেকে হেডফোন খুলে নিল। রজ্জাক ভাই এই ক’দিন আমাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বাংলা ভাষা কিছুটা বুঝতে পারছে বোধহয়। বললেন, “ভাবী, ধীরে বোলো। আমিও শুনব।”

হেসে শুরু করলাম বলা। “একদিন কৈলাসে পার্বতী শিবকে প্রশ্ন করলেন, তোমার তুষ্টি কীসে হয়? শিব বললেন, সত্যি কথা, সৎ কাজ, অহিংসা আর যুদ্ধক্ষেত্রে নির্ভয় থাকতে পারলেই আমি সন্তুষ্ট। তাদের কথা চলাকালীন বিষ্ণু, ব্রহ্মা এলেন সেখানে। সাথে সব দেবতা। বিষ্ণু করুণভাবে বললেন, আপনি সব দৈত্যদের বর দিয়ে রেখেছেন। সেই বরে তারা শক্তিশালী হয়ে আমাদের উপর চড়াও হচ্ছে বারবার। এভাবে কী করে শান্তি রক্ষা করব আমি? শিব বললেন, ঠিক। কিন্তু আমি এখন কী করি! আচ্ছা, আমি বরং এখান থেকে সরে যাই। বলেই তিনি অন্তর্ধান করলেন। শিব তো উধাও হলেন, কিন্তু পার্বতী শিবকে ছেড়ে থাকতে পারেন না। তিনি তখন সব দেবতাদের নিয়ে শিবের খোঁজে বেরোলেন। শিব এদিকে কৈলাস থেকে এসেছেন বস্ত্রাপথে। পোশাক ছেড়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে তপস্যা করছেন। খুঁজতে খুঁজতে দেবতারা এখানে এলেন। বিষ্ণু উঠলেন রৈবতকে আর পার্বতী উজ্জয়ন্ত পাহাড়ে। শিবকে না পেয়ে পার্বতী শিবের স্তোত্র গাইতে শুরু করলেন। তখন শিব তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন। দেবতারা তখন বললেন, এবার কৈলাশে ফিরে চলুন। শিব বললেন, যাব। কিন্তু বাকিদের এখানে থাকতে হবে। তখন বিষ্ণু থাকলেন রৈবতকে পাহাড়ে আর পার্বতী অম্বা রূপে উজ্জয়ন্ত পাহাড়ে।”

এতদূর শুনে রজ্জাক ভাই বললেন, “ওহি তো বলছিলাম। দশ হাজার সিঁড়ি উঠলে অম্বা মাইকীর দেখা মেলে। দুই হাজার ফুট উঁচু।”

খানিকক্ষণ নীরবতা। ভোর বলল, “মা, কী অদ্ভুত বলো! একই পাহাড়ে পাশাপাশি তিন ধর্মের সহাবস্থান। দেবতাদের নিজেদের মধ্যে কোনও ঝগড়া নেই। আর মানুষ ধর্ম নিয়ে লড়াই করে মরছে।”

“মানুষই ধর্ম তৈরি করে ভেদাভেদ করে, ভোর। নইলে শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করবে কী করে!” আমি বললাম।

রজ্জাক ভাই পুরনো দিনের প্রেমের গান টেপে বাজিয়ে শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে নিজেও গুনগুন করছিল। আমি একটা গান শুনে বললাম, “কতদিন আগের গান এটা! আমি তখন বেশ ছোটো।”

“কী সিনেমার গান?”

আমি মনে করতে পারলাম না। সে বলল, “এটা সাগর ফিল্মের গান। আমার খুব প্রিয়। সাব জানো, একটা ফিল্ম এসেছিল, এক দুজে কে লিয়ে। সে ফিল্মে দু’জনেই শেষে মরে যাবে। তো জানো, যে়খানে এর শুটিং হয়েছিল সেখানে এত ছেলেমেয়ে এই ফিল্ম দেখে সুইসাইড করেছিল যে সেটা লাভার পয়েন্ট হয়ে গেল। আর তখন পুলিশ ওই জায়গাটায় যাওয়া বন্ধ করে দিল।”

“ও! তা ভালো। কিছু মানুষ মরে শান্তি পেল।” বলে তনয় আবার আইপডে সিনেমা দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

রাস্তা চলেছে নিজের মতো। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে অজগর সাপ তার বিশাল শরীর নিয়ে রাস্তায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। রুপোলি পাতে মোড়া সেই রাস্তায় গাড়ি চলেছে ৯০ কিমি স্পিডে। অথচ মনে হচ্ছে না। রাস্তা ও চালক উভয়ের গুণে।

২৮০ কিমি বাদে রাস্তার ধারে এক ধাবায় রুটি, চানা মশলা আর দই খেলাম। তনয় যথারীতি ফল। এসে থেকে সে কেবল ফলের উপরেই আছে। দীর্ঘদিন দিল্লিতে একা থাকার কারণে রান্না না করে ফল খাওয়া অভ্যাস করেছে। আমাকে বলল, “ফল খাও সারাদিন, শরীর সুস্থ রাখতে চাইলে।”

এরপর আগামী সংখ্যায়

 জয়ঢাকের ভ্রমণ লাইব্রেরি

1 thought on “ভ্রমণ গুজরাট পর্ব ৪ বিতস্তা ঘোষাল বর্ষা ২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s