ভ্রমণ জলেজঙ্গলে পর্ব ২ প্রদীপ্ত ভক্ত বর্ষা ২০১৮

প্রদীপ্ত ভক্তের আরো ভ্রমণঃ নীল-সবুজের মাঝেজলেজঙ্গলে-১

জলে জঙ্গলে পর্ব-২

প্রদীপ্ত ভক্ত

সাড়ে পাঁচটা শীতকালে মানে মাঝরাত। পানিবাবু ওই সময়টায় নদীর ঘাটে যেতে বলেছে!! কাল অনেক ধ্বস্তাধ্বস্তি করে সাড়ে চার হাজার প্লাস দেড়শো অটো ভাড়াতে রফা হয়েছে, শেয়ারিং এ অবশ্যই। দেবাশিসবাবু বলেছিলেন, সাড়ে তিন। চব্বিশ ঘন্টার বোট এবং অবশ্যই শেয়ারিং ছিল না। যাকগে কী আর করা।

কাল রাতে ওই অন্ধকার অন্ধকার রাস্তা, অচেনা মোটরবাইকে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় কুয়াশামাখা মাঠ আর হঠাৎ উদয় হওয়া ফাঁকা অটোর উত্তেজনা শেষে ফিরে সকাল পাঁচটায় ঠান্ডা স্নান করার সাহস নেওয়ার জায়গা ছিল না। সুতরাং ঝপাঝপ ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে দেখি লজের ছেলেটা থেকে রাস্তার নেড়িটা সব্বাই তখনো ঘুমে। একটা চায়ের দোকান খুলেছে, আর সেখানে ওই বদ বাবুনি বোটওলা দাঁড়িয়ে। এই হতভাগা কাল আমাদের দশ হাজারের রেট দিয়েছিল। ব্যাটাকে দেখেই ব্রাহ্মণীতে চোবানোর মন হয়েছিল। ক্রমে আকাশ ফরসা হল, ওড়িশা ট্যুরিজম এর হোটেল থেকে সেজেগুজে লোক আসতে লাগল।

এক মক্কেল তার মধ্যে দেখি লং কোট আর মাথায় লাল টুপি পরে, হাতে দস্তানা লাগিয়ে এসেছে। এবার ঘটনা হলো এরকম কার্টুন সকাল সকাল দেখলে মুখের মাসলগুলো এমনিই ব্যায়াম করা শুরু করে, কটকট করে তাকিয়ে পাশের বুড়োমতো লোকটাকে বললেন, ‘নিউ জেনারেশন ইজ হোপলেস’।

বোট এল, বোট ছাড়ল। এটা যাবে খোলা ঘাট, ওর সওয়ারি তোলার আছে, পানিবাবু এর সাথেই আমাদের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ওখানে আমাদের জন্য অটো থাকবে, সেই অটো নিয়ে যাবে ডাংমল। ডাং এবং মল দুটোকেই ঢুকিয়েছে কেন নামে? এটা কি ইয়ে করার জায়গা?

দুজন মাত্র নৌকায়, আর আছে দুই মাঝি। এখনো রোদ ওঠেনি, কুয়াশা কুয়াশা ভোর। এক পাড়ে দূরে তালগাছ, জেলেদের গ্রাম, খেজুর গাছ আর অন্য পাড়ে কিছু ঝোপজঙ্গল। দেখেই বোঝা যায় এদিকে মানুষের পা পড়ে না। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এড়িয়ে সেই না পুরোনো হওয়া ছবিটা দেখছি হাঁ করে, টুকটুকে লাল থেকে হলুদ হয়ে যাওয়া সুর্য, জলে ছায়া ফেলেছে। আমাদের নৌকা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে জল কেটে। সকালের ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে ডাঙায়, একজন লোক এক ঝুড়ি কাঠ না কী নিয়ে মাথায় হনহন করে এগিয়ে আসছে হনহন করে। একজন সাইকেল এর হ্যান্ডেলে কী সব জিনিস নিয়ে এগিয়ে চলেছে আল ধরে ধরে। একটা বাচ্চা তার মা-এর হাত ধরে এই সক্কাল সক্কাল কোথায় যাচ্ছে কে জানে?

একটা গোঁত খেয়ে ব্রাহ্মণী ছেড়ে বৈতরণীতে ঢুকলাম। এবার আর দু পাশে কোনো জনবসতি নেই। সকাল সকাল বৈতরণী পেরিয়ে যাচ্ছি, এই মাঝিই যমদূত নয় তো রে? নাহ কাল রাতে স্রেফ ছানা পোড়াটাই অন্তত আর শ খানেক মেরে আসা দরকার ছিলো। বৈতরণী পেরিয়ে গেলাম এদিকে ওপারেতে যদি দরদিয়া কেউ না পাই? যে কাবাব, মিষ্টির ব্যবস্থা রাখবে?

পানিবাবু ফোন করেছে, কোথায় আছি জানতে। সাড়ে সাতটা বাজে প্রায়। আমি প্রায় বলে ফেলতে যাচ্ছিলাম, জলের মধ্যে, সামলে নিয়ে মাঝিকে দিলাম। সে কী সব কথা বলে আমাদের যা বলল তাতে বুঝলাম ওর জয়নগরের ঘাটে লোক তোলার আছে, তাই আমাদের ওখানেই নামাবে, আমাদের এমনি নৌকা পেরিয়ে খোলা ঘাটে যেতে হবে।

পড়েছি যবনের হাতে যখন যা বলবে তাই সই। এতক্ষণ ছিলাম ফাঁকা নৌকায় দুজন। এবার একটা খেয়া নৌকায়। দলে দলে লোক উঠেই চলল, বাইক নিয়ে, বস্তা নিয়ে। আমি একজনের বাইকের উপর জুত করে বসে নিলাম। বেশ একটা গদির উপর তক্তপোশ ব্যাপার, নৌকার উপর বাইক, তার উপর আমি।

খোলা ঘাটে নামার আগে আগে দেখি লোকজন উত্তেজিত হয়ে দূরে কী দেখাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি এক কুমীর সকাল সকাল রোদ খেতে ভেসে উঠেছে। বেশ বেশ, কিন্তু আমাদের তো কুমীরের পিঠে যাওয়ার কথা না।

“তা কই হে লোক কই?” বলতে বলতে এক বাইক থেকে দেখি একজন ডাকছে। বাইকে নিয়ে যাবে? অটো নাকি আমাদের দেরি দেখে চলে গেছে। তাই ও এখন বাইকে করে পৌঁছে দেবে। বাইকে দুজন কোনো মতে বসেছি কি না বসেছি টের পেলাম এটা আসলে বাইক না, উড়ন্ত চাকি! হু হু করে বাইক তিনজন সওয়ারি আর দু’খানা ঝুলন্ত ব্যাগ (তিনজন বসে বলে ভুঁড়ি রাখার জায়গা নেই, ব্যাকপ্যাকগুলো নিয়ে বসতে পাবো এমন আশাটা বেশি হয়ে গেল না?) কে উড়িয়ে নিয়ে গেল।

ডাংমল আসলে রিসার্চ সেন্টার। কুমীর নিয়ে গবেষণাকেন্দ্র ইত্যাদি আছে। কাগজপাতি দেখিয়ে এন্ট্রি নিলাম। আমাদের গাইড ভবানী। না না ভীম টাইপ চেহারা না। রোগা পটকা লোক। আমাদের বলল মিউজিয়াম দেখ। আসছি।

মিউজিয়ামখানা খারাপ না, বাইশ ফুট লম্বা কুমিরের স্কেলিটন আছে, তাছাড়া বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের মাথার খুলি, সংরক্ষিত সরীসৃপের শরীর, ইত্যাদি যেমন থাকে। তবে আমার কাজের জিনিস যেটা ছিল সেটা হল পাখির ছবি। পাখি আমি চিনি না মোটেও। তাই যখনই পাখি দেখি খালি খাবি খাই কী পাখি কী পাখি করে।

মিউজিয়ামের ঠিক বাইরেই খাঁচার মধ্যে এক বিরাট পাইথন। শীতকালে ব্যাটা না ঘুমিয়ে নড়াচড়া করছে কেন কে জানে! একটা জ্যান্ত মুরগী এক কোণে বসে আছে, পাইথনের খাবার হবে বলে। চোখের সামনে মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে এ-জিনিস সইতে পারা বেশ চাপের বটে।

মুরগী তো অত পাত্তা দিচ্ছে না, দিব্যি এক কোণে বসে আছে, ছটফটানি নেই। পড়ব পড়ব ভয়, পড়লে কিছু নয় টাইপ কেস আর কি। অজগরটা এদিক সেদিক ঘুরছে আসতে আসতে, মাঝে মাঝে চেরা জিভ বের করে করে টের পেতে চাইছে আশেপাশের আওয়াজ। অজগরের গায়ের নকশাগুলো কিন্তু দেখার মত।

ভবানী এসেছে দেখে এগিয়ে গেলাম। ও বাবা, ওদিকে ওটা কী হচ্ছে? একটা টোটোয় পিছনের সিটে এক ভদ্রমহিলা আর তার ছানা, সামান্য মানে খুবই সামান্য দুটো বড় ট্রলি, একটা ব্যাকপ্যাক, একটা থলে ব্যাগ ওই পিছনেই ফিট করতে চাইছিলেন ভদ্রলোক। তা একটা ট্রলি থেকে ধূলোমাটি ছানার গায়ে লেগে গেছে এই হল অপরাধ।

“করছটা কী? হ্যাঁ? দেখ না ওর গায়ে মাটি লেগে যাচ্ছে?”

ভদ্রলোক দুর্বল গলায় কী একটা বলতে গেলেন, ভদ্রমহিলা থামিয়ে দিলেন।

“ওরে বাবা ওরে সৌরভ, ইনিই আমাদের সহযাত্রী হবেন রে।”

সৌরভ এমনিতেই শান্ত মানুষ। কাল থেকে এত গেছোদাদাপনায় ও যৎপরোনাস্তি আহত। তার ওপরে এই শক্তিশেল! বেচারা খুব মিয়োনো গলায় জবাব দিল, “হ্যাঁ ভাই!”

ডাংমল থেকে বোট ছাড়বে, হাওলাকোঠি যাবে, পরের দিন ফের আমাদের নিয়ে আসবে। বোট যাবে দুপাশের ম্যানগ্রোভ, কুমীর, হরিণ, বাঁদর, পাখিদের সঙ্গে নিয়ে। আমাদের হাওলাকুঠীতেই বুকিং আছে আর এই হাওলাকুঠী যেখানে সেই বিচটার নাম গহীরমাথা।

অলিভ টার্টলরা এইখানে আসে ফেব্রুয়ারিতে ডিম পাড়তে। তখন ওখানে ট্যুরিস্ট যাওয়া মানা। এই জীবজন্তুদের কান্ডকারখানা বেশ চমকে দেওয়ার মত। ভাবো কোথায় সেই সুদূর কোস্টারিকা বিচ সেখানে ডিম দেওয়া উপযুক্ত বোধ করল না, বাঁধো গাঁঠরি চলো মুসাফির করে ওঁরা প্রেগন্যান্ট কচ্ছপেরা মিলে চলে এলেন বঙ্গোপসাগরের কোলে। একবার এসে ভালো লাগল তো ব্যাস! বংশপরম্পরায় আঁতুরঘর বানিয়ে নিলেন। “কতটুকুই বা রাস্তা, সব রাস্তায় পাথর আছে”’ গাইতে গাইতে চললেন।

বোটে আরেকদল উঠল। জনা আষ্টেক লোক, তিনটে ফ্যামিলি। বোটের ছাদে জুত করে বসেছি দেখি সব কালিয়া কালিয়া করে চেঁচিয়ে উঠল। ব্যাপার বোঝা গেল, কালিয়া একটা কুমীর। আমাদের ভবানীর কথায় বয়স একশো। এবার লোনাজলের কুমীর খুব বেশি হলে সত্তর অব্দি বাঁচে। যাই হোক উনিশ ফুটের কুমীরটা কিন্তু সম্ভ্রম জাগায়।

ওই আটজনের দলে একটা লোকের এনার্জি পেল্লায়, আমার থেকেও হেঁড়ে বেসুরো গলায় গান গাইল আর নাচলো প্রায় সারা রাস্তা।

ডাংমল ঘাট থেকে একটু দূরেই একটা পাখি দেখার জায়গা আছে। বেসিক্যালি জঙ্গল দেখার ওয়াচ টাওয়ার। সিমেন্টের না, লোহার পাত দেওয়া, ফলে উপরে উঠে বেশ স্কাইওয়াক টাইপ ফিল হচ্ছিল বটে।

এইসব জায়গায় এতো ক্যালোরব্যালোর ভালো লাগে না, তাছাড়া সুন্দরী মহিলা জগঝম্প করলেও নিয়মমতে ছাড় দেওয়া যেত। কিন্তু তা যখন না, এই জঙ্গলে এসে নিয়ম না মানা লোকজন নেওয়া যায় না মশাই। পাশের বোটে এক দল তরুণী ও একটি তরুন পাশ করার সময় আমাদের থেকে জল চাইল।

“হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়, এই তো, আরে আস্তে করো বোটটা”, রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেল, আমরা গ্যালারিতে গ্যাঁট হয়ে বসে বসে দেখে নিলাম, সবাই জল দিল ও পেল কিনা।

বাঁক ঘুরতেই আরিব্বাস রে, কুমীর কুমীর! বেশ প্রমাণ সাইজের। তারপর থেকে কত অজস্র কুমীর যে দেখলাম, ছোট বড়, ন, মেজো, রাঙা। এরা খাল কেটে কুমীর এতো এনেছে না দেখলে বিশ্বাসই হয় না মশাই! একেকটা তো দেখে বড় ব্যঙাচি বোধ হয়। ক্রমে রোদ চড়া হতে থাকে, লোকজনের উৎসাহে ভাটা পড়ে। খালি দুই মাথা খারাপ ছেলে নৌকার ছাদে বসে থাকে, পাশ দিয়ে দিয়ে ছবির মতো শান্ত গ্রাম, জঙ্গল, কাদায় শুয়ে রোদ পোহানো কুমীর, গাছে ধ্যানী বক পেরিয়ে পেরিয়ে যায়। ছবির মতো শান্ত গ্রাম বললাম বটে কিন্তু সে কেবল দূর থেকেই। আসলে ঠিক জীবন যেমন আনপ্রেডিক্টেবল তেমনই আনপ্রেডিক্টেবল যাপন এখানে। ওইযে নদীর চড়ে একটা মস্ত কুমীর শুয়ে আছে, একটু দূরেই দুটো ছোট ছেলে মে এক পাল ছাগল চড়াতে এনেছে। ভয় এখানে বিলাসিতা।

হতভাগারা বোট করেছে এদিকে টয়লেটটা হাফ ঘেরা। খেয়াল না করে মেলা জল খেয়ে নেওয়ার ফল, নড়তে অব্দি পারছিনা। কী করব বোটে তিনটে বৌদি (রাগী ভদ্রমহিলাকে বৌদি বলার ভরসাও হচ্ছে না মশাই), তাদের সামনে ওই হাফ ইউরিনালে যাওয়াটা ঠিক ইয়ে মানে…

হাওলাকোঠীতে নামলাম যখন দুটোর কাঁটা পেরিয়ে গেছে, এখান থেকে দু-আড়াই কিলোমিটার হাঁটতে হবে। পুরো দলটাকে এগোতে দিয়ে, একটু হালকা হয়ে এগোনো যায়। কিন্তু আমার সঙ্গী ছোকরার মনের জোর নাকি প্রবল, তিনি বললেন আরে চল চলে যাবো ঠিক।

বেশ তবে তাই হোক। কিন্তু হাপ কিলোমিটার চলার পর বোঝা গেলো এ বোঝা বইবার শক্তি আমাদের দেন নাই প্রভু। ঝড়ের বেগে এগিয়েছি, পুরো পল্টন অনেক দূরে, তাই ম্যানগ্রোভদের একটু সমৃদ্ধ করার চান্স নিতেই হল। রাস্তাটা খুবই সুন্দর। নিঝুম, শান্ত। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে পাখির কিচমিচ ছাড়া বুনো নিঃশব্দতা টের পাওয়া যায়। পিছনের দল আমাদের দরা অব্দি আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম, বুকের মধ্যে পুরে নিলাম হারিয়ে যাওয়া শান্ত পৃথিবী।

(ক্রমশ)

সমস্ত জয়ঢাকি ভ্রমণ একসাথে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s