ভ্রমণ হাতিপাওয়ের পথে জ্যোতির্ময় দালাল বসন্ত ২০১৯

হাতিপাওয়ের পথে

জ্যোতির্ময় দালাল

প্রবাসী বাঙালির কাছে পুজোর ছুটি হল অবাঙালিদের দশেরা-কেন্দ্রিক উইক-এন্ড আর পাওনা ছুটি-টুটির জোড়াতালি মারা হপ্তাখানেকের এক মূল্যবান অবকাশ, যা বেশ মেপেজুখে, অতি কৃপণতায় খরচা করতে হয়।তাই এ বছর প্রাথমিক পর্যায়ের কঠিন কাজটি ছিল মনস্থির করা – এবার পুজোতে কলকাতায় নাকি অন্য কোনোখানে? শেষমেশ হট্টমেলার রাজধানীটির প্রতি ক্রমঃক্ষয়িষ্ণু আকর্ষণটাকে এড়িয়েই আমাদের পুজোর সপ্তাহটা আরো কয়েক হাজার কলকাতা-পলাতক বাঙালির পদাঙ্ক অনুসরণ করাটাই সাব্যস্ত হল !

কর্মসূত্রে বাস বাদশাহী আংটির শহর লখনৌতে। সেখান থেকে গাড়োয়াল হিমালয় পৌঁছানোটাই সময় ও পকেট-বান্ধব! তাই গুগল ম্যাপে বিস্তর ডিজিটাল আঁকিবুঁকির পর ঠিক হল – মুসৌরীর দিকে যাওয়া যাক। এই মুসৌরীকেই একটু “কাল্টিভেট” করতে পাওয়া গেল বেশ একটা ইন্টারেস্টিং জায়গা, যেখানে দিন-কতক একেবারে প্রকৃতির কোলে অখন্ড অবসর যাপন করা যেতে পারে। জায়গার নামটা বেশ অদ্ভূত – “হাতিপাও”! মুসৌরীর বিখ্যাত লাইব্রেরী মোড় থেকে মাত্র ৪-৫ কিলোমিটার দূরে একটা “homestay”-ও পাওয়া গেল। “Tripadvisor”-এ ফাটাফাটি ছবি আর রিভিউ দেখে প্ল্যান ফাইনাল! এই হাতিপাও-তে বেড়ানোর গল্পই আজ করব জয়ঢাকী বন্ধুদের সাথে। বিখ্যাত পর্যটনস্থল গুলোর আশেপাশেই এমন কত না মনিমুক্তো ছড়িয়ে আছে – যা এখনও ফেসবুক-স্ট্যাটাস-আপডেট- আর মোটা-ওয়ালেট (ফিজিক্য়াল হোক বা ডিজিটাল)- সর্বস্ব তথাকথিত ট্যুরিস্টরা দূষিত করতে পারে নি !

এই লেখাটা যাতে কোনো হোটেল বা রিসর্টের বিজ্ঞাপন না হয়ে দাঁড়ায়, সেজন্য আমাদের দুদিনের একটু অন্যরকমের সেই ঠেকটাকে স্রেফ “লজ” বলে উল্লেখ করছি। কোনো উৎসাহী পাঠক নেট-ঘেঁটে অতি সহজেই  খুঁজে পেয়ে যাবেন – কারণ ঐ জায়গায় হোটেলের বাড়ন্ত।

অষ্টমীর সকালে হৃষীকেশের কাছাকাছি একটা রিসর্ট থেকে আমাদের গাড়ি চলল উত্তর-পশ্চিমে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরের গন্তব্যের উদ্দেশে – পাহাড়ের কোলে ছোট্ট জনপদ হাতিপাওয়ের পথে। রাস্তায় পড়ল দেরাদুন রামকৃষ্ণ আশ্রম। সেখানে আধঘন্টাটাক থেমে দুর্গাপ্রতিমা দর্শন ও প্রসাদ খেয়ে আমাদের আবার যাত্রা শুরু।

আরও প্রায় ৩৫ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। লজের তরফে পাঠানো ই-মেলে জরুরি দিকনির্দেশ ছিল। ভাট্টা নামে এক পাহাড়ী গ্রাম পেরিয়ে দেখা মিলল বহুপ্রতীক্ষিত এক সাইনবোর্ডের – ডানদিকে তীরচিহ্ন দিক নির্দেশ করছে মুসৌরীর আর বামদিকে আমাদের গন্তব্য হাতিপাও আর জর্জ এভারেস্ট হাউস। আরো ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে যাত্রা।

অবশেষে ঝিমঝিমে মাথা আর কোনোক্রমে বমি চেপেচুপে শেষ দুপুরে পৌঁছানো গেল গন্তব্যে। লজটার একতলায় রেস্তোঁরা আর দোতলায় তিনটে মাত্র গেস্টরুম। জায়গাটা বাইরে থেকে এতটাই ছোট লাগে যে সত্যিই ঠিক জায়গায় এলাম কিনা নিশ্চিত হতে প্রথমে একতলায় গিয়ে ঐ রেস্তোঁরায় গিয়ে জিগ্যেস করতে হল। দোতলায় গেস্টরুমে যাবার আগে কিঞ্চিত পেটপুজো করতে একতলাতেই বসলাম। বোঝা গেল ভিতরে বেশ পরিপাটি আয়োজন।

নজরকাড়া ডিজাইনের কাঠের আসবাবপত্রের সঙ্গে মানানসই লাইট আর ইন্টিরিয়র ডেকরেশন। এমনকি একটা খুদে লাইব্রেরি আর ফায়ারপ্লেসও আছে। আবার বাইরে বসার জন্য আছে চমৎকার পুরু কাঠের বেঞ্চ আর পিকনিক টেবিলের সেট। তার মাঝে রয়েছে বারবিকিউ করার ব্যবস্থাও।

এখানে বসে যেদিকে চোখ মেলবে, দেখা যাবে পাইন আর দেবদারুর জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ের ঘন সবুজ দেয়াল। মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি বা মোটর বাইক ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই।  শহুরে হট্টগোল থেকে দিন কতকের নিশ্ছিদ্র বিশ্রামের পক্ষে আদর্শ জায়গা। মুসৌরীর মাত্র ৪-৫ কিলোমিটার দূর এই ছোট্ট জনপদে টিভি, নিউজপেপার, মোবাইল টাওয়ার, ইন্টারনেট – এসব কোনো ঝুটঝামেলার বালাই নেই। রোদ্দুরে পিঠ করে ধোঁওয়া-ওঠা কফির পেয়ালা আর ফ্রায়েড চিকেনের স্বর্গীয় স্বাদ ভুলিয়ে দিল পথের ক্লান্তি। তারপরেই চমক – এক পেল্লাই কালো রোমশ ভুটিয়া কুকুর “তাম্বা” এল সঙ্গ দিতে। দেখতে একটু ভয়ানক হলেও আসলে ভারি শান্ত আর আদুরে। রাতেও ডিনারের সময় তাকে দেখলাম লজের অন্যান্য বাসিন্দাদের গায়ে পড়ে আদর খেতে।   

সন্ধে নামার একটু আগে বুঝলাম ভালোমতো হোমওয়ার্ক না করে আসার ফল। লখনৌতে বসে ৩৩ ডিগ্রী গরমে প্যাকিং করার সময় একটু “ওয়েদার-ইনফো” দেখে নেওয়া দরকার ছিল। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে রুমের বাইরের দেয়ালে ঝুলন্ত থার্মোমিটারে অলরেডি দেখাচ্ছে ১২ ডিগ্রী।  সবেধন নীলমণি “fleece jacket” ভেদ করে ঠাণ্ডা ঢুকতে শুরু করেছে। অগত্যা সন্ধে হতেই নিচের লাইব্রেরী থেকে আনা গল্পের বই নিয়ে ডবল কম্বলের নিচে আশ্রয় নেওয়া। রাত্রে হাতে সেঁকা গরমাগরম রুটি আর মাংসের ঝোল – তারপর ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসে জোড়া কম্বলের তলায় সুখনিদ্রা । পরদিন সকাল ৬টায়  এলার্মের  শব্দে ঘুম ভাঙল। কী ঠাণ্ডা রে বাবা! প্রবল  মানসিক  শক্তি  একত্রিত  করে  কম্বলমুক্ত  হয়ে  জর্জ   এভারেস্ট  পয়েণ্ট  দেখতে  যাবার প্রস্তুতি। গরম জামাকাপড় যেহেতু বিশেষ আনা হয়নি -তাই টি-শার্ট, ফুল-শার্ট, জ্যাকেট আর ট্র্যাকপ্যান্টের ওপর জিনস চড়িয়ে মোটামুটি ঠাণ্ডাকে বাগে আনা গেল।

এখানে সংক্ষেপে বলে রাখি  এই জর্জ এভারেস্টের বৃত্তান্ত ।  ইস্ট  ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলে  ১৮০২ সাল  থেকে সমস্ত ভারতীয়  উপমহাদেশ জুড়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে জরিপের কাজ শুরু হয়। এই বিশাল উদ্যোগের নাম দেওয়া হয় দি গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিকাল সার্ভে’।  এই প্রকল্পে উইলিয়াম ল্য়াম্বটন  সাহেবের সঙ্গে যোগ দেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভারতবর্ষে পাড়ি  দেওয়া জর্জ  এভারেস্ট। পরবর্তীকালে ১৮২৩ সালে তিনি এই   প্রকল্পের ভার গ্রহণ করেন এবং  ১৮৪১ সালপর্যন্ত এক সুবিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করে ১৮৪৩   সালে অবসর নিয়ে ইংল্যাণ্ডে ফিরে যান। তারপর ১৮৬৫ সালে রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটি তাঁর সম্মানে সেই সময়ে সদ্য-আবিষ্কৃত পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ ‘পিক-১৫’-এর নামকরণ করেন মাউন্ট এভারেস্ট । আমরা জানি, সেই ‘পিক-১৫’-এর উচ্চতা নির্ধারণ করেন বাঙালি গণিতজ্ঞ শ্রী রাধানাথ শিকদার। এভারেস্ট  প্রায় একদশকের ওপর বাস করেন মুসৌরী থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে ছবির মত সুন্দর এক পাহাড়চূড়ায়, যেখানে যেতে গেলে আমাদের এই হাতিপাও-এর লজের সামনের পথ ধরেই চলতে হবে আরো ২ কিলোমিটার । জায়গাটির অপর নাম ‘পার্ক এস্টেট’, যা বর্তমানে হেরিটেজ বিল্ডিং হিসাবে নথিভুক্ত।  সাইনবোর্ডে আঁকা তীরচিহ্ন ধরে হাঁটা শুরু হল ।

প্রথম খানিকটা রাস্তা ভালো, একেবারে কংক্রিট- বাঁধানো। সেই রাস্তা শেষ হয়ে যখন চড়াই আরম্ভ হল, তখন আর তাকে রাস্তা বলা চলে না।   অনভ্যস্ত পায়ে নড়বড় করতে  রতে তবু ক্য়ামেরা বাগিয়ে এগিয়ে চলা। এত সকালে জনমনিষ্যি নেই  কোনোখানে।  শুধু পাইন আর দেবদারুর ঘন বনের মধ্য়ে থেকে থেকে চোখে পড়ছিল  হরেক রকমের পাখি  আর হনুমানের দল ।

বেশ খানিকটা পথ চলে বেদম হয়ে পড়ার ঠিক আগে চোখে পড়ল রংবেরঙের ছোটো-ছোটো পতাকা – যেমনটা পাহাড়ের  বৌদ্ধ মঠগুলোতে দেখা যায় ।  আর তার সঙ্গে নাকে এল, কাঠের উনুনের ধোঁয়ার গন্ধ ।  বুঝলাম, গন্তব্যের কাছেই এসে গেছি। একটা বাঁক   ঘুরতে চোখে পড়ল ছোট্ট গুমটি, চা- বিস্কুট-চিপস্- ম্যাগির পসরা সাজিয়ে সবে সে ঝাঁপ তুলেছে ।  

কয়েক পা এগোতে চোখে পড়ল একটা সুন্দর গেট, তাতে হিন্দিতে লেখার মর্মার্থ: “পার্ক এস্টেট :  জর্জ  এভারেস্ট হাউসে আপনাকে স্বাগত”! সেই গেট পেরোতেই দেখা মিলল জর্জ  এভারেস্ট হাউসের – বেশ ভেঙে পড়া, আগাছার জঙ্গলে ঢেকে যাওয়া সাদা বাড়ি ।  হনুমান, গবাদি পশুর বিষ্ঠা আর বিকৃতরুচি মনুষ্য়পুঙ্গবের দেওয়াল লিখনে   জর্জ এভারেষ্ট হাউস রীতিমত জর্জরিত। চারিদিকে বিভিন্ন সতর্কবার্তা-সম্বলিত বোর্ডে পরিচ্ছন্নতা  বজায় রাখার  ব্যর্থ অনুরোধ ।  নিরাপত্তা ব্যবস্থার ছিটেফোঁটাও চোখে পড়ল না এই তথাকথিত হেরিটেজ বিল্ডিং-এর ! সেই সাতসকালেই দেখি   পাঞ্জাব-প্রদেশীয় বীরপুঙ্গবদের এক  বাইকবাহিনী, বোধ করি এভারেষ্ট জয়ের রোমাঞ্চ পেতেই সেই হেরিটেজ বিল্ডিং-এর ছাদে উঠে প্রবল লম্ফঝম্প-সহযোগে সেলফি-গ্রপফি ইত্যাদি অবশ্য-করণীয় কর্মোদ্যোগে রত । সঙ্গে মিউজিক সিস্টেমের “বজ্রনির্ঘোষ: “তেরা কালা চশমা … “

তা বিচিত্র এই দেশের সেই  বিচিত্র প্রাণীদের থেকে থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে এসে বসলাম ।  পার্ক এস্টেট থেকে চারদিকের ‘ভিউ’ জাস্ট অসাধারণ -ফোটো তুললাম অনেকগুলো ।  তারপর, সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে কাগজের কাপে চুমুক দিয়ে মুখ তুলতেই দেখি – সামনের সবুজ পাহাড়ের সারির  পেছনে – দূরে, আরো দূরে, সাদা মেঘের গায়ে প্রায় মিলেমিশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাদা তুষারশৃঙ্গের সারি! দিনটা সার্থক হল!

এই হাতিপাওয়ের কাছেই আছে আরো কিছু দারুণ বেড়ানোর জায়গা, কিন্তু সে গল্প আরেকদিন ।

ছবিঃ লেখক

জয়ঢাকের ভ্রমণ লাইব্রেরি

1 thought on “ভ্রমণ হাতিপাওয়ের পথে জ্যোতির্ময় দালাল বসন্ত ২০১৯

  1. ভিন্ন স্বাদের ভ্রমণ কাহিনী। অভিনব।বর্ণনা যেন লেখকের পায়ে পায়ে পায়ে হঁটা। সুন্দর
    ছবিগুলিতে
    লেখাটি আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে ও এরকম আরো নতুন লেখার আশা রাখি। ধন্যবাদ।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s