পশ্চিম হিমালয়ের পাদদেশে শিবালিক পর্বতাঞ্চল। সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ছোট ছোট পাহাড় চারিদিকে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। কোথাও শালের বন, কোথাও বা কাঁটাঝোপের জঙ্গল, মাঝে মধ্যে এক আধটা গ্রাম ও শহর। মার্চের শেষের দিকে এখানে শীত কাল প্রায় বিদায় লগ্নে। শীত ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে, উষ্ণতা ক্রমেই বাড়ছে। রূপ সিংহের মত একজন ভ্রাম্যমাণ মেষপালকের জন্য এই হল শিবালিক ত্যাগ করার সময়। ছাগল – ভেড়ার পাল নিয়ে তার যাত্রা শুরুর পালা। কারণ সেখানে ছাগল-ভেড়ার খাওয়ার মতো ঘাস কমে আসছে, শুকিয়ে যাচ্ছে।
এই সময়েই রূপ সিংহের সঙ্গে আমার ও আমার দুই সঙ্গীর দীর্ঘ যাত্রা শুরু হল। প্রথমে শিবালিকের, তারপর ধৌলধার পর্বতমালার বনাঞ্চল পার হয়ে। আমাদের যাত্রা এমন এক অঞ্চলের সন্ধানে, যেখানে তৃণক্ষেত্র অনেক বেশি সবুজ। পথে, রবি নদীর উপত্যকায়, রূপ সিংহের গ্রামের ঘরে অল্প কয়েকদিনের বিশ্রাম। সেখানে রূপ সিংহের অনেক কাজ। বাড়ির সকলের দেখভাল করা, আর কার কী প্রয়োজন সে সবের বন্দোবস্ত করা এবং আসন্ন চাষের মরসুমের জন্য পরিবারের সকলের সাথে মিলে জমি তৈরি করা।
জুন মাসের প্রথম দিকে আবার পথচলা শুরু। উপত্যকার বিভিন্ন গ্রামের মেষপালকেরা প্রায় একসাথেই রওনা হল। কেউ দু-এক দিন আগে, কেউ বা পরে। এই পথ চলা পাইন, মেপ্ল্, স্প্রুস, ওক্ ও সিলভার ফারের বন পেরিয়ে, সূর্যের আলোর সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে। তারপর ভোজপত্র (এই গাছের ছালে মহাভারত লেখা হয়েছে, ইংরেজিতে বলে বার্চ) এবং রোহ্ডোডেন্ড্রনের বন। তারও পরে বৃক্ষরেখা (পাহাড়ের যে উচ্চতার পর আর কোন গাছ জন্মায় না, সেই উচ্চতাকে বৃক্ষরেখা বা ট্রি লাইন বলে) পেরিয়ে আল্পাইন পাসচার বা তৃণভূমি। হিমালয়ের এইসব তৃণভূমি ফুলের দুনিয়া, যেখানে গ্রীষ্মের শুরুতে ফুটে থাকে প্রিমুলা, হরেক রকম রোহ্ডোডেন্ড্রন, জেরানিয়াম, অ্যাস্টার, পোটেন্টিল্লা, রোহ্ডিওলা, জেনশীয়ানা, অ্যানিমোন, মেকানোপ্সিস ও আরো কত প্রকারের রংবেরঙের ফুল। ক্যারেক্স, স্টাইপা, লীমাস্, ওরিজপ্সিস ঘাসের তাজা সবুজ রং চোখ ও পায়ের পাতা জুড়িয়ে দেয়।
“ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি, বনের পথে যেতে;
ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে…”
চলার পথে রূপ সিং ও তার দল রাত কাটায় আগের কোন বছরে বানানো অস্থায়ি আস্তানায় (থাচ্ / কোটা)। অবশেষে পীর পাঞ্জাল পর্বতমালার বরফে ঢাকা গিরিপথ পেরিয়ে তাদের সঙ্গে পৌঁছলাম হিমালয়ের আড়ালে, বৃষ্টিহীন অঞ্চলে, ট্রান্স – হিমালয়ে।
এই বৃষ্টি – বিরল, শীতল – মরুভূমির পাহাড়ে ছড়িয়ে আছে অনন্ত তৃণভূমি। এখানকার ঘাস ও অন্যান্য উদ্ভিদ, হিমালয়ের দক্ষিণ দিকের ঘাস – উদ্ভিদের চেয়ে অনেক বেশী পুষ্টিকর, কারণ এতে জলের পরিমাণ কম ও পরিপোষক পদার্থ বেশী। সুদীর্ঘ যাত্রার পর ছাগল – ভেড়ার পাল এই অঞ্চলে তৃণচারণ করে অচিরেই নধর হয়ে উঠবে। অগাস্ট পর্যন্ত, গ্রীষ্মকালীন এই সময়ে, রূপ সিং ও তার মত আরো কয়েকশ মেষপালকদের ছোট ছোট দল, ট্রান্স – হিমালয়ের তৃণক্ষেত্রগুলিতে লক্ষ লক্ষ ছাগল – ভেড়া চারণ করে। পাথরের ওপর পাথর রেখে বানানো অস্থায়ী আস্তানায় তারা রাত কাটায়। আমিও তাদের সেই আস্তানার পাশেই আমার তাঁবুতে রাত কাটাই। খাওয়া বলতে তাদের হাতে বানানো মোটা শক্ত রুটি বা মোটা চালের ভাত আর সঙ্গে ডাল। তারা রুটিতে মাখিয়ে নেয় ছাগলের দুধ থেকে তৈরি নির্ভেজাল ঘি। আর কয়েক লক্ষ ছাগল – ভেড়া ওই তৃণক্ষেত্রে চরতে চরতে পরম তৃপ্তির সঙ্গে ঘাস, গাছগাছড়া খেয়ে পুষ্ট হয়।
ট্রান্স – হিমালয়ে, অগাস্টের শেষে গ্রীষ্ম অন্তিম পর্যায়। ওই সময় উষ্ণতা ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। আর কনকনে শীতল হাওয়ার হাত ধরে শীত দিনে দিনে বাড়তে থাকে। এবার রূপ সিংদের আবার ছাগল – ভেড়া নিয়ে শিবালিক এর দিকে ফিরে চলার পালা। কারণ ট্রান্স – হিমালয়ে ঘাস তখন কমে আসছে, শুকিয়ে যাচ্ছে।
এবার দীর্ঘ পথের উল্টো যাত্রা শুরু – পীরপাঞ্জাল পর্বতমালার গিরিপথ পেরিয়ে, বৃক্ষরেখা অতিক্রম করে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, সবুজ সতেজ ঘাসের সন্ধানে। মাঝে গ্রামের বাড়িতে কিছুদিনের বিশ্রাম। বাড়ির সুখ সুবিধার দেখাশুনো করা, পরিপুষ্ট ভেড়ার বেড়ে ওঠা পশম কাটা ও বিক্রিবাটা, অর্থের প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু ছাগল – ভেড়া বিক্রি করা এবং পরিবারের সকলে মিলে ফসল তোলা।
নভেম্বরে আবার পথ চলা। ধৌলধার পর্বতমালার উপত্যকাগুলি পার হয়ে শিবালিক পর্বতাঞ্চলের উদ্দেশে, যেখানে তৃণক্ষেত্র তখনো অনেক সবুজ।
ভারতবর্ষের পশ্চিম হিমালয় অঞ্চলে ভ্রমণশীল বা ভ্রাম্যমাণ মেষ চারণের এই রীতি কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসছে। পশ্চিম হিমালয় ও ট্রান্স – হিমালয়ের উপজাতি সম্প্রদায়গুলি, যেমন উত্তরাখণ্ডের গুজ্জার, হিমাচলের গাদ্দি ও কিন্নৌরা, জম্মু – কাশ্মীরের বাক্কারওয়াল ও লাদাখের চাংপা, এভাবেই প্রকৃতির সংস্থানের সাময়িক এবং আঞ্চলিক রূপান্তর সুনিপুণভাবে ব্যবহার করে চলেছে। উত্তরাখণ্ডের মালারি – নিতি – লাপ্থাল থেকে গঙ্গোত্রী – যমুনোত্রী, হিমাচলের রুপিন – সুপিন থেকে তিরথান – স্যায়েঞ্জ, পিন ভ্যালি থেকে চন্দ্র – ভাগা উপত্যকা, হাদসার – কুগ্তি থেকে সাচ্ পাস, কাশ্মীরের কিশ্তোয়ার – কাজিনাগ থেকে লাদাখের চাংথাং, সুবিস্তীর্ণ এই পাহাড়ি অঞ্চলে চড়ে বেড়াচ্ছে ভ্রাম্যমাণ মেষপালকদের কয়েক কোটি ছাগল – ভেড়ার পাল।
এ তো হল ভ্রাম্যমাণ মেষপালকদের কথা, পশুপালনের কথা। কিন্তু ট্রান্স – হিমালয়ের নেটিভ্ বাসিন্দা, অর্থাৎ বন্যপ্রাণী, তাদের কী খবর?
মনে করুন কোন এক জটিল বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়ায় (evolutionary process) আপনি ৩,০০০ মিটার উচ্চতার ঊর্ধে এক অতি রুক্ষ – শুষ্ক অঞ্চলে চিরকালের জন্য আটকে পড়েছেন। গ্রীষ্মকালে এখানকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩০ – ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু চড়া রোদের সঙ্গে শুকনো ঝোড়ো হাওয়া আপনার ত্বক শুকিয়ে দেবে। আর শীতে তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাংকের নিচে – সর্বনিম্ন মাইনাস ৩৫ – ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তার সঙ্গে ভয়ঙ্কর হিমশীতল হাওয়া। আপনার ঘর বলতে পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে আসা পাথরের স্তর কিংবা খাড়া পাথরের দেওয়াল অথবা খাড়া পাহাড়ের ঢাল। আপনার খাদ্য বলতে প্রধানত ঘাস, যেমন স্টাইপা, লিমাস্, এলাইমাস্ ও অন্যান্য বিশেষ কয়েকটি গাছড়া (herb), যেমন সাইসার, ব্প্লিউরাম, নেপেটা, অ্যাস্ট্রাগ্যালাস। আপনার প্রজাতির গর্ভবতী স্ত্রীদের দীর্ঘ হাড় কাঁপানো শীতের মাসগুলি কাটাতে হয় খুব অল্প আহারে। বরফের ওপরে যেটুকু তৃণ দেখা যায় সেইটুকু খেয়ে, কিংবা, প্রয়োজনে এবং শরীরে যথেষ্ট ক্ষমতা থাকলে, বরফ খুঁড়ে তৃণ খুঁজতে হয় জীবনধারণের জন্য। তারপর শীতের শেষে, যখন নতুন সতেজ ঘাস – উদ্ভিদ গজায়, তখন সেই মায়েরা জন্ম দেয় শিশুদের। এই অনুকূল পরিবেশের মধ্যে যদি কখনো এতটুকু অন্যমনস্ক হয়ে ‘ক্লিফ্’ বা খাড়াই পাথুরে দেওয়ালের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নিরাপত্তা এক চুলও হারিয়েছেন, তবে আপনার জায়গা হতে পারে স্নো – লেপার্ড বা তুষার – চিতার পেটে। আপনি আসলে একজন আইবেক্স, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্তহীন দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের ছাগগোত্রিয় স্তন্যপায়ী প্রাণীবিশেষ এবং তুষার – চিতার এক প্রধান খাদ্য।
ট্রান্স – হিমালয়ে প্রাকৃতিকভাবেই তৃণ ও অন্যান্য উদ্ভিদ বৃদ্ধির মরশুম মাত্র দু – আড়াই মাস। সে জন্য বন্য তৃণভোজী প্রাণী, যেমন আইবেক্স ও ভরাল্, সংখ্যায় খুব কম এবং সীমিত জায়গায় পাওয়া যায়। সুদীর্ঘ শীতের পর, বসন্তের শেষে ঠিক যখন বরফ গলে গিয়ে নতুন ঘাস গজিয়ে ওঠে, তখনি উপস্থিত হয় মেষপালকেরা, ছাগল – ভেড়ার বিরাট বিরাট দল ও তাদের ভয়ঙ্কর কুকুর নিয়ে।
ছাগল – ভেড়ার দল অবাধে তৃণ –গাছগাছড়া নিঃশেষ করতে থাকে। একটি আইবেক্স সেই দৃশ্য নিঃশব্দে দেখছে ক্লিফের ওপর থেকে দাঁড়িয়ে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আইবেক্সটির বিশালকায় খাঁজ-কাটা শিং মাথার ওপর থেকে বেরিয়ে, ঘুরে, পিঠ ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায়। তার থুতনির ঝুলন্ত দাড়ি বাতাসে মৃদু কাঁপছে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তৃণক্ষেত্রের ওপর, সে এক ফালি জায়গা খুঁজছে যেখানে সে তার দলবল নিয়ে নিরাপদে তৃণচারণ করতে পারে। ঘাস খুঁজতে খুঁজতে সে পরের উপত্যকায় গেল, সেখানেও একই অবস্থা। আরো দূরে অন্য কোন উপত্যকায় সে চলে গেল, কিন্তু পরিস্থিতি এতটুকুও বদলাল না। পাগলের মত হন্যে হয়ে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে এমন একটি তৃণক্ষেত্র যেখানে তার দলের শিশু ও অন্যান্য আইবেক্সরা কিছু খেতে পায়। যেখানে গৃহপালিত ছাগল – ভেড়ার দল ঘাস – গাছড়া নিঃশেষ করে রাখেনি, যেখানে মেষপালক নেই, কুকুর নেই। কোথাও গিয়ে কোন সমাধান হল না। কিছু বয়স্ক আইবেক্স খিদের তাড়নায় ঘন ঘাস দেখে ছুটে গেল মেষপালকদের আস্তানার দিকে। তারা আর ফিরল না। চোখের সামনেই কয়েকটি শিশু আইবেক্স খিদের জ্বালায় অনাহারে প্রাণ হারাল।
সকলের জন্য যথেষ্ট খাদ্য নেই। ট্রান্স-হিমালয়ের এই শীতল মরুভূমি অঞ্চলে জুলাই – অগাস্ট এর পর তৃণ – গাছড়া নতুন করে বিশেষ গজায় না। তার ওপর ছাগল – ভেড়া ফিরে যাওয়ার পর যা তৃণ – গাছড়া পড়ে থাকে, তা বেশিরভাগ খাওয়ার অযোগ্য (unpalatable species)। এর ফলে আইবেক্স শিশুর সংখ্যা ক্রমে কমতে থাকে, কারণ খাদ্যাভাবের ঘা বড়দের চেয়ে শিশুদের আঘাত করে বেশী। ধীরে ধীরে আইবেক্সের সংখ্যা তলিয়ে যেতে থাকে। এ হল এক ধরনের বাঁচার লড়াই – বিজ্ঞানের ভাষায় কম্পিটিশন। এই লড়াইয়ে মেষপালকদের ছাগল – ভেড়ার দলের তুলনায়, আইবেক্স ভীষণ মাত্রায় সংখ্যালঘু। কাজেই, আইবেক্স এর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ও অব্যাহত, বিশেষত্ব ওই শিশুগুলি। ট্রান্স – হিমালয়ের তৃণক্ষেত্র আইবেক্সের কাছে আসলে যেন একপেশে এক রণক্ষেত্র, যেখানে এই পরস্থিতিতে তাদের তিলে তিলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই।
ছবিঃ লেখক