ঋতা বসুর আগের গল্পঃ শিকার ও শিকারী
মিষ্টিবুড়ির কাণ্ড
ঋতা বসু
এক যে ছিল বুড়ি। বুড়ির মুখে সবসময়ে মিষ্টি হাসি মিষ্টি কথা। তার তিনকূলে কেউ ছিল না এক আদরের ছোট ভাই ছাড়া। হঠাৎ দু’দিনের জ্বরে সেই ভাই পাড়ি দিল সে দেশে যেখানে গেলে কেউ ফেরে না। মিষ্টিবুড়ি সেই থেকে একদম চুপ। কারো সঙ্গে কথা বলে না। কারও বাড়ি যায় না। নিজের বাড়ির বাগানে বসে থাকে তো বসেই থাকে। সামনে পড়ে থাকা চা ঠাণ্ডা হয়। মুড়ি বিস্কুট নেতিয়ে যায়। খাবার কথা তার মনেই পড়ে না।
ওরকম পাথরের মত নট নড়ন চড়ন হয়ে বসে থাকলে যা হয়, দু একটা পাখি পায়ের কাছে গায়ের কাছে উড়ে এসে বসতে লাগল। আস্তে আস্তে অন্যদেরও সাহস বাড়ল। পায়রা চড়াইয়ের পর এলো কাঠবেড়ালি। একেবারে চোখের সামনে বলে বুড়ি বাধ্য হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্রমশ ওদের খেলাধুলো ও খুনসুটি দেখতে দেখতে বুড়ির মনে হল আরে আমি তো ওদের সমস্ত কথা বুঝতে পারছি। সে এরপর ওদের সঙ্গে কথা বলাও শুরু করে দিল। আর তারপর একদিন রাজপুত্রের মত দেখতে কালো মখমলের মত লোমে ঢাকা এক কুকুর এসে যখন বুড়ির পায়ে মুখ ঘসে ভাইয়ের খালি চেয়ারটায় উঠে বসল সেদিন মিষ্টিবুড়ির মুখে আগেকার মিষ্টি হাসিটা আবার ফিরে এল। সন্ধে হলে পর বুড়ি ডাকল আয় কালু খাবি আয়।
পাখপাখালির মত শুকনো চিঁড়ে মুড়িতে যে কালুর হবে না এত জানা কথা। বুড়ি তার জন্য মোটা মোটা রুটি করে দুধ দিয়ে ভিজিয়ে দিল। সকালে বাজারে গিয়ে মাংস এনে চালে ডালে ফুটিয়ে খেতে দিল এক গামলা। বুড়ির যত্নে কালুর চেহারায় আরো চেকনাই হল আর কালুর সঙ্গে ছোটাছুটি করে বুড়িরও যেন বয়স কমে গেল দশ বছর।
কালুর জন্য মাংস কিনতে হাটে যেতে হল মিষ্টিবুড়িকে। একদিন ফেরার পথে দেখল জাল ঢাকা এক মস্ত ধামা করে কি যেন বিক্রি হচ্ছে। ভীড় করে দেখছে যত হাটের মানুষ। কাছে গিয়ে বুড়ি দেখে আট দশটা নানা রঙের পায়রা। বুড়ি একনজর দেখেই বুঝে গেল ব্যাপারটা। পুরো ধামাটাই কিনে রিক্সা চাপিয়ে নিয়ে এল নিজের বাড়ি। নেতিয়ে পরা পাখিগুলোকে গম জল খেতে দিয়ে বলল-খেয়ে দেয়ে তাড়াতাড়ি চাঙ্গা হয়ে ওঠ দেখি। কাল সকালে দুষ্টু পাখিধরাদের চোখে ধুলো দিয়ে অনেক দূর চলে যাস।
সকালবেলা জাল সরিয়ে ধামা থেকে সবকটাকে বাইরে বার করে বুড়ি দেখে নীল পায়রাটা বেশি নেতিয়ে গেছে। দুপা হেটেই ধপ করে পরে যাচ্ছে। বুড়ি ওর জন্য একটা ছোট ঝুড়ি আনতে গেল ভেতরে। কালু ভাবল সেই বা অকর্মার মত বসে থাকে কেন? বাড়িতে হঠাৎ এতগুলো অতিথি। কাজ কি কম?
তাই কাজ এগিয়ে রাখার জন্যই নীল পায়রাকে মুখে করে সে বারান্দায় নিয়ে এল। বুড়ি এসে দেখল ঝুড়ির আর দরকারই হবে না। কালুর ধারালো দাঁত নীল পায়রার ঘাড় ফুটো করে দিয়েছে। কালু চোর চোর মুখ করে একধারে বসে রইল। পায়রার ঘাড় যে এত ন্যাতপ্যাতে নরম সেটা ও জানতই না। ভালো করতে এসে তো পায়রারটাকে সে শেষই করে ফেলল।
বুড়ি দেখল ছেড়ে দেওয়া সত্ত্বেও পায়রারা কেউ উড়ছে না। কি ব্যাপার?ডানা সরাতেই দেখা গেল ওরা যাতে উড়তে না পারে সেইজন্য ভেতর থেকে পালক ছেটে কমজোরি করে দিয়েছে দুষ্টু লোকটা। বাইরে থেকে বোঝাই যাচ্ছে না।
সেই থেকে ওরা এখানেই আছে। রাতের বেলা বুড়ির পাশে বালিশে মাথা রেখে কালু আর ঘরের কোনে বড় ঝুড়ির ভেতর ন’টা পায়রা ঘুমোয়। মিষ্টিবুড়িকে নিয়ে এগারোজনের সংসার।
সকাল বেলা পায়রাদের জন্য গম ছড়িয়ে দেয় বুড়ি। সাদা পায়রারা খেয়ে গেলে পর আসে দুটো সবুজ পায়রা। ছাই পায়রা তিনটে আসে সবার শেষে। কেন যে ওরা একসঙ্গে আসে না কে জানে? কিন্তু সবাই যে ভারি ভদ্র সভ্য এটা মানতেই হবে। ঠিক যতটুকুতে পেট ভরে ততটাই খেয়ে অন্যদের জন্য রেখে যায়। বুড়ির কড়া নজর থাকার জন্য কালুও প্রথম দিনের পর থেকে আর সাহায্য করার চেষ্টা করেনি। তবে দূর থেকে নেচেকুঁদে বেশ গল্পগাছা করে সবাই মিলে। বেজায় ভাব।
পোষ্যদের নিয়ে বেশ আছে মিষ্টিবুড়ি। তার আর কারোকে দরকারই হয় না।
কতরকম কাণ্ড যে ওরা করে। কালুর ভিটামিন খেতে খুব আপত্তি। বুড়ি ওষুধ আনতে গেলেই পায়রারা বকম বকম করে কালুকে জানান দেয় আর কালু ছুটে পালায়। তাকে তখন বহুকষ্টে ধরে বেঁধে আনতে হয়। বুড়ির ছোট বোন ফোন করে বিদেশ থেকে। তাদের সকাল মানে এখানে রাত। মোবাইল ফোন বাজা মাত্র কালু বিছানা থেকে উঠে বাইরে গিয়ে বসে থাকে। যতক্ষণ কথা হয় সে আসে না। বুড়ি সেজন্য তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দেয় বলে বোন খুব বিরক্ত। বলে-বেশি বেশি।
আরও অনেকেই বিরক্ত। বুড়ির বাড়ির কাছে যত কুকুর বেড়াল কাক পশুপাখির ভিড়। পাশের বাড়ির কুঁজিবুড়ি, সামনের বাড়ির ঢ্যাঙ্গা বুড়ো একদিন খুব রাগ করে বলল জন্তু জানোয়ারকে এত আশকারা দেন কেন। সকাল থেকে সবাই ভিড় করে আসে। প্রতিদিনই যেন বিয়েবাড়ি।
বুড়ি বলে- ওদের কেউ নেই। অবোলা জীব। কি বা করতে পারি দুটো খেতে দেওয়া ছাড়া।
একদিন বুড়ির ছোটবেলার এক বন্ধু এল। দুই বন্ধু মিলে গাড়িভাড়া করে বেড়াতে গেল পাখিচরা মাঠে। বন্ধুবুড়ি বলল-শুনেছি এখন বক আসা কমে গেছে।
বুড়ি বলল-অনেকদিন তো যাইনি। বলতে পারব না।
কি আশ্চর্য ব্যাপার!যেন তারা আসবে বলেই পাখিচরা বিলে বেশ কতগুলো বক বসে আছে। মাঠ জুড়ে ঘাসের জঙ্গল। সবুজ ঘাস আর নীল আকাশের মাঝে সাদা ধবধবে বকেদের যে কি সুন্দর লাগছে। হঠাৎ চারদিক থেকে বকের ডাক ভেসে এল। খানিকটা বাদে আকাশ থেকে এক ঝাঁক বক এসে নামল পাখিচরার ঘেসো মাঠে ছোট ব্যাং ঘাস ফড়িংয়ের লোভে। স্বজাতি দেখে তাদের পাশেই এগিয়ে এল এক পা এক পা করে। তারপরেই ঘটল সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড। নতুন আসা বকের দলের থেকে কয়েকজন ছটফট করে উড়ে যেতে চাইল কিন্তু কিসে যেন তাদের পা জড়িয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঝোপের আড়াল থাকে বেড়িয়ে এল দুটো লোক। ফাঁদে পড়া তিন চারটে পাখি নিয়ে চলে গেল মনের আনন্দে। অবস্থা দেখে বাকি বক গুলো ডানা ঝাপটে উড়ে চলে গেল কোথায় কোন দূরে।
আর কি আশ্চর্য এত হট্টগোল হওয়া সত্ত্বেও কয়েকটা বক চুপচাপ দাঁড়িয়েই রইল।
গাড়ি থেকে নেমে দুই বুড়ি এগোল আরো কাছে। মিষ্টিবুড়ি বলল-দেখ আমরা এত কাছে তবু ওরা উড়ে যাচ্ছে না। আমরা যে ওদেরই দেখতে এসেছি বুঝেছে নিশ্চয়ই।
বন্ধুবুড়ি বলল-তোর মাথা। এগুলো আসল বকই নয়।
ওরা কাছে গিয়ে দেখে সত্যি -সাদা রিবন বকের পালকের মাপে কেটে একদম আসল বক বানিয়ে কিছুদূর অন্তর বসিয়ে রেখেছে। রাগে দুঃখে মিষ্টিবুড়ির চোখে জল এল। বলল-আমরাই এত কাছে থেকে যদি এমন ঠকে যাই তাহলে আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া বকের ঝাঁক তো এদের স্বজাতি বলে ভুল করে নেমে আসবেই। আর এভাবে ধরা পড়বে সঙ্গে সঙ্গে।
বন্ধু বুড়ি বলল-রোগা রোগা বকের গায়ে কতটুকুই বা মাংস?সেই একটুখানি মাংসের লোভে কত মাথা খাটিয়েছে লোভী মানুষ। ফাঁদগুলো দেখেছিস?তাল গাছের খসে পড়া ডালের নরম জাল দিয়ে বানানো কি ভয়ঙ্কর ফাঁদ। এর মধ্যে পা পড়লে এমন এঁটে বসবে যে ওরা আর পালাতেই পারবে না।
-হাট থেকে বন্দী পায়রা কিনে কিনে উড়িয়ে দিচ্ছি। মাত্র কয়েকটাকে হয়ত বাঁচাতে পেরেছি। কিন্তু এই লোকগুলো খাবার জন্য বক মারছে। আমাদের কথা শুনবে কেন? এদের কি করে বাঁচানো যায় বল তো? মিষ্টিবুড়ি জিজ্ঞেস করল বন্ধুকে।
-কত বড় মাঠটা দেখেছিস?এ কি সহজ কাজ?
-কিন্তু কিছু তো একটা করতেই হবে। এত সহজে ছেড়ে দেব না-মিষ্টি বুড়ি বলল শক্ত গলায়।
তারপর দুই বন্ধু সারাদিন ধরে সব কাজের মধ্যে ভাবতে লাগল কি করে নিরীহ পাখিগুলোকে বাঁচানো যায়। একজন একটা ভাবে অন্যজন সেটা নাকচ করে দেয়।
কালু ভারি বিরক্ত। কেউ খেলছে না কথা বলছে না। সে ঘেউ ঘেউ করে বাড়ী মাথায় তুলল। পায়রারা ভয়ের চোটে ধামার মধ্যে গিয়ে লুকোলো। তাই দেখে দুই বুড়ি মুচকি হাসল। এত সহজ বলেই আগে মাথায় আসেনি। পরদিন কালুকে নিয়ে তারা গেল পাখিচরা মাঠে। মস্ত মাঠে কালুর ভারি ফুর্তি। সে এদিক থেকে ওদিক ছুটোছুটি করে বেড়ায়। নকল পাখিগুলোর চারপাশে পাক খেতেই তার বেশি মজা। তার দাপাদাপিতে পাখি ধরা ফাঁদগুলোর লণ্ডভণ্ড অবস্থা। চেঁচামেচির চোটে আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া বকের দল মাঠ পেরিয়ে চলে গেল। কালু সঙ্গে দৌড়ল যতক্ষণ তাদের দেখা যায়।
খানিকটা বাদে আলের আড়াল থেকে হতাশ মুখে সেই লোক দুটো বেড়িয়ে এল। কালুকে বিচ্ছিরি গাল দিল। দুই বুড়ির দিকে তাকালো কটমট করে তারপর তারা চলে গেল অন্য দিকে।
মিষ্টিবুড়ির মুখের হাসিটা চওড়া হল আস্তে আস্তে। তার কালু যতক্ষণ আছে পাখিচরা মাঠে বকেদের বোকা বানানো যাবে না সেটা সবাই বুঝে গেছে।
ছবিঃ জয়ন্ত বিশ্বাস
গল্প ও ছবিটির উচ্চমানে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
আমি সামান্য একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি।
এই মন্তব্যের মাধমে আমি বাংলা ভাষার সকল সাহিত্যিক ও প্রকাশকের কাছে এই আবেদন রাখতে চাই যে প্রবীণ ও বয়স্ক মানুষদের বুড়ো-বুড়ি সম্বোধন এবার বন্ধ হোক।
আশা করি এ বিষয়ে আপনারা ভাববেন।
LikeLike
গল্পটি যে ভারী মিষ্টি তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
আমি বরং এই সুযোগে একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই।
বাংলা ভাষার সকল সাহিত্যিক ও প্রকাশকদের কাছে একান্ত আবেদন এই যে, প্রবীণ ও বৃদ্ধ মানুষদের বুড়ো-বুড়ি বলে সম্বোধন করা এবার বন্ধ হোক।
LikeLike