সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
ফ্ল্যাটটা এত কম দামে ভাড়ায় পেয়ে যাবেন ভাবতেই পারেননি ঝন্টুর বাবা। খাস কোলকাতার বুকে এমন ব্যস্ত পাড়ার মধ্যে বাড়ি, লিফট, জলের ব্যবস্থা সবকিছু,তার উপর ঘরদোর একদম ঝকঝকে করে দিয়েছে মালিক দেওয়াল মেঝে সব ঘষে মেজে রংটং করিয়ে। এডভান্স বুকিং দু’মাসের ভাড়া,আর প্রতিমাসে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। ফ্ল্যাটটা এমনিতে নির্ঝঞ্ঝাট। আশেপাশের ঘরগুলোতে সবগুলোতে লোক নেই, খালি এখনো অধিকাংশই। যে কটায় আছে তারাও কারো সাতে পাঁচে থাকে বলে মনে হয় না। লিফটে ওঠানামা করার সময় ক্বচিৎ কারো সাথে চোখাচুখি হয়ে গেলে ভদ্রতা করে হেসে চলে যায়, ব্যস ওটুকুই। এখান থেকে ঝন্টুর বাবার অফিস যেতেও অনেক কম সময় লাগবে, ঝন্টুকেও আগেভাগেই এদিককার ভাল একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। সব দিক থেকে সুবিধাই হল দুজনের ছোট্ট পরিবারের। ঝন্টুর মা গত হয়েছেন আজ পাঁচ বছর হল।
উপরি পাওনা হিসেবে জুটে গেছে একটা ফুটবল মাঠের মত ইয়াব্বড় ছাদ। ছ’তলার উপরে ছাদ। আশেপাশের বাড়িগুলো একটু নিচুই, কিছু বস্তি টস্তিও আছে, সে থাক, কিন্তু এর ফলে আকাশ দেখা যায় দারুণ। ঝন্টুর অবশ্য পড়তে একটুও ভালো লাগে না। খালি সুযোগ খোঁজে কিভাবে ফাঁকি দিয়ে পার করে দেওয়া যায় সময়টা। বিকেলে একটু পায়চারি করে সে একা একাই, বাবার তো ফিরতে রাত হয়। সেদিন এত ভাল লাগছিল দখিনা বাতাসটা যে সন্ধে গড়িয়ে যাবার পরেও নামতেই ইচ্ছে করছিল না তার। হঠাৎ ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচে অন্ধকারে তাকিয়ে আবিষ্কার করল বাড়ির কাছের ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছের মাথাটা কেমন একটু নড়েচড়ে উঠল। দেখতে দেখতেই লক্ষ করল একটা ধোঁয়া ধোঁয়া মত লিকলিকে শরীর সুড়ুৎ করে সেটার মগডালে চড়ে বসেই পা দোলাতে আরম্ভ করেছে। তেঁতুলগাছটা প্রায় তিনতলা সমান উঁচু। ফলে তার মাথাটা ছাদ থেকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। অন্য কেউ হলে এমন উদ্ভট দৃশ্য দেখে কী করত জানা নেই, তবে ছোট থেকেই ঝন্টু বিশেষ ভয়টয় পায় না, ডাকাবুকো টাইপ। সে হাঁক পাড়ল, “এই কে রে ওখানে? ওটা কি দোল খাওয়ার জায়গা? পড়ে গেলে কী হবে?”
ওমনি সেই ধোঁয়া মার্কা ব্যক্তি বা বস্তুটা লম্বা ঘাড়টা আরও লম্বা করে প্রায় পাঁচতলার কাছাকাছি উঠে এসে দাঁত বের করে বললে “কিছু হবে না, মরব না, বারবার কেউ মরে নাকি?”
বলেই বিশ্রীভাবে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল। ঝন্টু এবার কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিল কিন্তু সন্দেহটা পুরোপুরি না যাওয়ায় সে বলল, “ওহ তা তুমি বলছ যে তুমি ভূত? কিন্তু সেটার প্রমাণ দিতে পারবে?”
ভূত পড়ল ফাঁপরে। দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার মধ্যে এ ছোঁড়ার মত কিম্ভুত প্রশ্ন করে তাকে কেউ আজ অবধি বিব্রত করেনি।
“প্রমাণ দেব? আচ্ছা কি করতে হবে বল।”
ঝন্টু ঝুঁকে পড়ে রেলিং ধরে বলল, “উপরে উঠে এসো, এভাবে চেঁচিয়ে তো কথা বলা যায়না।”
ভূত বাবাজি তো আহ্লাদে সটান এক লাফে ছাদে। “এসেছি, এবার বল।”
ঝন্টু রকমসকম দেখে বেশ বিজ্ঞের মত গলায় বলে, “হুম দেখলাম, যা বলছ তা ঠিকই মনে হচ্ছে তবে। আচ্ছা তোমাদের তো অনেক ক্ষমতা, যা শুনি। সেগুলো কি সব সত্যি?”
ভূত রীতিমত জোরের সঙ্গে বলল, “আলবাৎ সত্যি ! কোনটা জানতে চাও বল।”
ঝন্টুর মাথায় আসলে তখন অন্য ফন্দী খেলছে। সে কথা ঘুরিয়ে বলল, “বুঝলে ভূত, আমার তেমন কোন বন্ধু নেই এ পাড়ায় এখনো, নতুন স্কুলেও তেমন কেউ পাত্তা দেয় না আমায়। তাতে অবশ্য আমার বয়েই গেছে। তুমি বন্ধু হতে পারবে আমার?”
ভূত এমন প্রস্তাবে যারপরনাই বিগলিত ও বিস্মিত। মানুষ হলে আনন্দে দু’ফোঁটা জলই চলে আসত হয়ত, কিন্তু দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হবার পর থেকে ওই পাঁচটা উপাদানের কোনটাই আর তার আয়ত্তে নেই। তাই মাড়িবিহীন বত্রিশ পাটি কঙ্কালসার দাঁত বের করেই বলল, “হ্যাঁ অ্যা অ্যা হব না কেন?”
ঝন্টু বলল, “আচ্ছা বেশ উই আর ফ্রেন্ডস। শেক হ্যান্ডস। উপস্ তোমার তো হাতই নেই দেখছি ধরার মত। যাই হোক বলছিলে না সব কিছুই করে দেখাতে পার? তা আমাকে সেই সব ক্ষমতা দিতে পার? আমার অনেক দিনের সাধ ছিল কয়েকটা, তুমি প্লিজ হেল্প কর।”
ভূত বলল, “আমি? হেল্প? না না ক্ষমতা তো ওভাবে দেওয়া যায় না মোটেও মানুষদের, আর একসাথে সবগুলো তো কখনই নয়, তবে তুমি আমার বন্ধু যখন, একটা করে চাহিদা আমি মেটাতে পারি যদি তুমি নিয়ম মেনে চল।”
“ওহ সে তো দারুণ কথা, ঠিক আছে একটা করেই চাইব। আচ্ছা ভূতেরা তো শুনেছি মুহূর্তে গায়েব হয়ে যেতে পারে। তা তুমি আমায় অদৃশ্য করে দিতে পারবে? কোন ভাবে?”
ভূত অতি উৎসাহে বলল, “হ্যাঁ এ আর এমন কী! এখুনি করে দিচ্ছি। একটা মন্ত্র তোমাকে বলতে হবে শুধু। কাছে এসো কানে কানে বলে দিচ্ছি, এটা চোখ বুজে মনে মনে উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি একদম যাকে বলে ভ্যানিশ।”
ঝন্টু উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে লাগল। মন্তর কানে যাওয়ামাত্রই উচ্চারণ এবং চোখ মেলেই… একী! এত অন্ধকার কিসের! ছাদটা কোথায় গেল? ভূতটাই বা কই? কিছু দেখা যাচ্ছে না কেন?
আতঙ্কে এবং ক্ষোভে চিৎকার করে ওঠে সে, “এই কোথায় তুমি? এটা কী হল? আরে আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? উহহহ! বাবা রে! গেলাম!”
চোখে না দেখতে পেলে যে পা’টাও এমন টলমল করে, আগে তা কোনদিন জানত না ঝন্টু। হঠাৎ কীসে একটা ঠোক্কর খেয়েই তার পা’টা শূন্যে লাফিয়ে উঠল, কপালটাও নিচু জায়গায় একটা ঠোকর খেয়ে যন্ত্রণায় আওয়াজ করে উঠল আর আরেকটা ব্যপার বুঝতে পেরে সে সত্যি একটু ভয় পেয়ে গেল। পায়ে যেটা লাগল ওটা ছাদের রেলিং না তো? তাহলে সে কি এখন… হ্যাঁ তাইতো মনে হচ্ছে! শরীরটা তো এখনো হাওয়াতেই ভাসছে। ভ্যানিশ হতে গিয়ে শেষে ধরাধাম থেকেই ভ্যানিশ হতে হবে নাকি? এসব ভাবতে ভাবতেই কানের কাছে আবার সেই বিশ্রী খ্যাঁক খ্যাঁক হাসি। রাগে গরগর করে ঝন্টু চেঁচিয়ে উঠল, “লজ্জা করে না হাসতে? বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে এই বিশ্বাসঘাতকতা ? এটা কী করলে তুমি?”
ভূত একটুক্ষণ চুপ। তারপর খানিক গম্ভীর গলায় সে বলল, “কী আর করলাম! তুমি যেভাবে হোঁচট খেলে আনাড়ির মত, তোমার ঠ্যাংটা খপ করে না ধরে ফেললে এতক্ষণে ছ’তলা থেকে তুমি হয়তো…” দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভূত। আর এটা শুনে ঝন্টু এবার একটু লজ্জাই পেয়ে গেল। সত্যি তো, এতক্ষণ যে সে শূন্যে ভেসে ভেসে কথা বলছে সেটা কীভাবে সম্ভব হত যদি ভূতটা সামলে না নিত! পরক্ষণেই আবার তার মনে হল, আরে, চোখে দেখতে পেলে তো আর এসব বিপত্তি ঘটার প্রশ্নই ছিল না। তাই সে চটপট বলে উঠল, “ওহ আচ্ছা আচ্ছা থ্যাংক্স, কিন্তু আমার অদৃশ্য হওয়াটার কী হল? অদৃশ্য মানে কি আমারই সামনে থেকে সব দৃশ্য চলে যাওয়া? হায় রে! এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি ভূত হয়েছ? এর চেয়ে আমাদের দেশের বাড়ির গরুগুলোরও মগজ ভাল ছিল।”
ভূত এবার তাকে ধরে ছাদের উপর এক ঝটকায় দাঁড় করিয়ে একটু ক্ষেপে গিয়েই বলল, “এই যে শোন, খালি তো আমাকেই দোষ দিয়ে যাচ্ছ, আমার কথাটা কি একটু শুনবে আগে মন দিয়ে? সব বলছি, কী হবার ছিল, আর কী হয়েছে এবং কেন।”
ঝন্টু একটু থম মেরে গিয়ে বলল “আচ্ছা বল শোনাই যাক কী সাফাই দাও।”
ভূত রাগ চেপে বলল, “আসলে ব্যপারটা খুব সহজ। মন্তরে তুমি যেমন ভ্যানিশ হয়ে গেলে, মানে অনেকটা বায়ুর মত স্বচ্ছ হয়ে গেলে আরকি, তোমার সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গও তাই হয়ে গেল। আর এই যে তোমরা মানুষরা চোখ দিয়ে দিব্যি সব কিছু দেখ, আসলে সব কিছুর ছবিটা তো পড়ে তোমাদের চোখের ভিতরে একটা পর্দায়। সেটাই দেখা। এখন তোমার চোখে ছবি পড়ার জন্য সেই পর্দা তো স্বচ্ছ হয়ে গেছে, ছবি আসবে কী করে?”
ঝন্টুর এমনিতেই মেজাজ খারাপ তার মধ্যে একটা ভূত কিনা এসব জ্ঞান দিচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি ওইসব কচকচি পাশ কাটানোর জন্য ঘ্যানঘেনে সুরে বলল “আমি কিছু জানতে চাইনা আমায় আগের মত করে দাও!”
আবার কানের কাছে আলাদা একটা মন্ত্রোচ্চারণ, সেটা একমনে বলল এবং চোখ মেলে সবার আগে ওই অপদার্থ ভূতটাকেই দেখল। একই রকম ক্যাবলার মত হাসছে। দেখেই গা জ্বলে গেল।
আর সবার আগে যে প্রশ্নটা মাথায় এল সেটাই করে বসল, “ আচ্ছা খুব তো নিয়মকানুন কপচালে, তা তোমরা ভূতেরা ভ্যানিশ হয়ে কীভাবে সব কিছু দেখতে পাও? আমায় খালি ফাঁকি দেওয়া অ্যাঁ?”
ভূত বলল, “উফ এই সবজান্তাকে নিয়ে তো মহা ঝামেলা। তারও কারণ আছে বাপু। এই আমরা পঞ্চভূতে বিলীন হবার পর যখন ভূতজন্ম লাভ করি, তখনি আমরা তোমাদের এই ত্রিমাত্রিক জগতের নিয়ম কানুনের বাইরে চলে যাই, আমাদের দুনিয়াটা ভাবলে বিশ্বাস করবে না ত্রিমাত্রিক দূরের কথা একেবারে মাত্রাবিহীন। ব্যপারটা মাত্রাতিরিক্ত ভাবলেও আমার কিছু করার নেই।”
ঝন্টুর মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে।
সে ভাবতে থাকে এরপর আর কী বলা যায় । হঠাৎ বলে ওঠে, “আচ্ছা এটা না হয় পারলাম না, টেকনিক্যাল ফল্ট-এর জন্য, আরেকটা জিনিস কি শিখিয়ে দেবে?”
“কী?”
“এই যে তোমরা দিব্যি উড়ে বেড়াতে পার, মাধ্যাকর্ষণের কোন এফেক্টই পড়ে না তোমাদের উপরে, এই ক্ষমতাটা একটু ধার দিতে পার? উড়ুক্কু মানুষ হবার বড় সাধ মনে।”
“হা হা! সে দিতে আপত্তি নেই আমার। কিন্তু কোন বিপত্তি ঘটলে আমায় আবার দোষ দিও না বাপু।”
ওড়ার কথা মাথায় আসতেই বাকি সব ভুলে ঝন্টু তড়িঘড়ি বলে বসল, “আরে না না তুমি বল শুধু কিভাবে পারব।”
ভূত কিছুই বলল না শুধু কীসব বিড়বিড় করে বলে আঙুল টাঙুল নেড়ে তারপর বলল, “ব্যাস, হয়ে গেছে। কিন্তু এই রাত্তিরে আর উড়তে যেও না। সকাল হলে ট্রাই করো।”
ঝন্টু বাধ্য ছেলের মত মাথা হেলিয়ে বলল, “আচ্ছা।”
ওমনি পিছন থেকে বাবার গলা, “এই ঝন্টু অন্ধকারে কী করছিস ওখানে? পড়াশোনা নেই নাকি? খালি ফাঁকিবাজি।”
চমকে পিছন ফিরে বাবাকে দেখেই, “এই না মানে খুব গরম লাগছিল তো নিচে, তাই…”, আমতা আমতা করে বলতে বলতে আবার ঘাড় ঘুরিয়েই দেখে ভূত ভ্যানিশ। অবশ্য খুশিই হল তা দেখে। নেমে এল সুড়সুড় করে নিচে আপাতত। ভাবল, ব্যপারটা সিক্রেটই থাক। কাল সকালে উড়ে বেড়ানো যাবে। ভাবতেই দারুণ আনন্দ হচ্ছে তার।
সকালে বাবার অফিস বেরিয়ে যাবার অপেক্ষা শুধু। ভাত খেয়েই সে চলে গেল ছাদে। স্কুল আজ কোন মতেই যাবে না। দুটো হাত দুপাশে ছড়িয়ে একটু নাড়াচাড়া করতেই অনুভব করল শরীরটা বেশ হালকা হালকা লাগছে। নিচে তাকিয়েই মাথা ঘুরে যাচ্ছিল বোঁ করে আরেকটু হলেই। ছাদটা অনেক নিচে এর মধ্যেই। নিচে কোলকাতার ব্যস্ত সকাল। হাওয়ায় ভাসিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলল সে বড় রাস্তার দিকে। দেখা যাক কেমন মজা হয়। কোন একটা ট্র্যাফিক সিগন্যাল নিচে। গাড়ির হর্নে মাথা খারাপ হবার জোগাড়। ট্র্যাফিক সার্জেন্ট হিমশিম খাচ্ছে রীতিমত। লাল বাতি সিগনাল পোস্টের আলো রঙ বদলাচ্ছে অনেক নিচে। ঝন্টু একটু রগড় করার আশায় খানিকটা নিচে নেমে এল, যাতে রাস্তার লোকগুলো তাকে দেখতে পায়। কিন্তু কী অদ্ভুত! বেশির ভাগ লোকই হয় মোবাইলে কথা বলতে নয় ওটার স্ক্রিনের উপরে ব্যস্ত আঙুল নিয়ে নাড়াচাড়ায় মগ্ন। দু একজন মাথা তুলে দেখেও তেমন আমলই দিল না তাকে। একটা আস্ত জলজ্যান্ত ছেলে এইভাবে চক্কর দিচ্ছে মাঝরাস্তার উপরে, এটা দেখেও কেউ কৌতূহলী হল না! নাঃ মানুষ অবাক হতে ভুলেই গেছে। রীতিমত অপমানিত বোধ হতে থাকল ঝন্টুর। আসলে উড়তে পারার আনন্দটা নিজস্ব হলেও যতক্ষণ না দুটো লোকে দেখছে, বাহবা দিচ্ছে বা সেটা নিয়ে চর্চা করছে ঠিক জমে না পুরোটা। এটাই আসলে ব্যপার।
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সবে একটু আনমনা হয়ে চক্কর দিতে দিতে অন্যদিকে সরছিল সে, হঠাৎ মাথায় জোর একটা তীক্ষ্ণ কিছুর আঘাত। বাপ রে! বলে বেসামাল হতে হতেই ফের আরেকটা। সঙ্গে ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। এই রে! এক গাদা কাক ওড়াউড়ি শুরু করেছে তাকে ঘিরে। ভাবছে এটা আবার কোন পাখি এত বড়? আত্মরক্ষার্থে একজোট হয়ে আক্রমণ করেছে তারা অতএব।
একে তো খানিক আগের ঐ অবহেলার জ্বালা তার উপর এই সত্যিকারের জ্বালা, ঝন্টু একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে কোন মতে নিজের বাড়ির ছাদটা খুঁজে পেয়ে একরকম লাফিয়েই নামল। নামার টেকনিকটা ঠিক আয়ত্ত না হওয়ায় হাঁটুতেও লাগল বেশ জোরে। ঘরে ফিরে মাথায়, হাঁটুতে একটু ওষুধ লাগিয়ে গুম হয়ে চুপচাপ বসে রইল।
ফাঁকা ঘর। মনে মনে ভূতটাকেই শাপশাপান্ত করতে ইচ্ছে করছে। ও নিশ্চয়ই জানত এসব কিছু হবে। তাই আগেই বলছিল বিপত্তির কথা। এদিকে কথা দিয়েছে এসবের জন্য তাকে আর দোষারোপ করা যাবে না। তাই নিজের রাগ নিজেই হজম করতে লাগল সে। ঠিক এই সময়ে কানের কাছে আবার সেই বিচ্ছিরি রকম খ্যাঁক খ্যাঁকে হাসিটা, “কী ঝন্টুবাবু, এটাও পারলে না? আমার কিন্তু দোষ নেই কোন, আগেই বলেছিলাম।”
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ঝন্টু বলল, “যাও তো বিরক্ত কোর না একদম। এত উড়েটুরে কি ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে। এদিকে সকালের ভাত কখন হজম হয়ে গেছে। জ্ঞান না দিয়ে পারলে কিছু খাওয়াও তো দেখি।”
“আচ্ছা আচ্ছা দাঁড়াও দেখছি কী পাওয়া যায়।” বলেই কানের পাশ দিয়ে শোঁ করে একটা আওয়াজ আর পরমুহূর্তেই তার কোলের কাছে একটা পাকা আম টুপ করে এসে পড়ল । ঝন্টু লাফিয়ে উঠে বলল, “আরিব্বাস এটা কী করে করলে? বল বল শিগগির।”
“এ আর এমন কী কথা। ঐ তো হাতটা লম্বা করে বাড়িয়ে রাস্তার ওপারে পাঁচিল ঘেরা আমবাগানটার একটা গাছ থেকে পেড়ে আনলাম তোমার জন্য। অনেকগুলো রয়েছে ওখানে।”
ঝন্টু বলল, “ওহ তাইতো তোমাদের তো আবার হাত পা সব ইলাস্টিকের মত, যখন ইচ্ছে টেনে লম্বা আবার গুটিয়ে ছোট করা যায়। তা এটা একটু শেখানো যাবে না আমায়?”
“তা যাবে, কিন্তু ওড়ার শখ মিটে গেছে কি একদম? একটার বদলে একটা ক্ষমতা শিখবে কিন্তু, আগেই বলেছি।”
“দূর দূর সে কথা বলে আর লজ্জা দিচ্ছ কেন ভাই। ওসব আমার জন্য নয়। তার চেয়ে এই ভাল, ঘরে বসে বসে এই গরমের দুপুরে দূরের গাছ থেকে আম পেড়ে খাওয়া, আহা। তোফা।”
“তথাস্তু।”
কিছু একটা হচ্ছে ভিতরে ভিতরে টের পেয়েই ঝন্টু জানলার দিকে তাকিয়ে ওপারের আমবাগানটার দিকে তাক করে হাতটা বাড়িয়ে দিল। অবাক হয়ে দেখল তার হাতটা একেবারে চুইং গামের মত লম্বা হতে হতে দিব্যি পৌঁছে গেল বাগানের একটা গাছের কাছে। একটা আম টুক করে পেড়েও নিল। কিন্তু তারপরেই হল বিপত্তি। বাগানের খোট্টা মালী কীভাবে যেন টের পেয়ে গেল গাছের মাথায় কিছু একটা চলছে। প্রথম বারে বুঝতে পারেনি, কিন্তু দ্বিতীয়বার একদম সজাগ ছিল। আম সহ হাতটা যেই গাছ থেকে ফিরতে উদ্যত, তখুনি সে দৃশ্য নজরে আসতেই “আই বাপ রে! ভূত বা…” বলেই চিৎকার করে পতন ও মূর্চ্ছা দশাসই দারোয়ানের। ঝন্টুও একটু যেন নার্ভাস হয়ে গেল।
ফলে হল বিপত্তি। সদ্য শেখা কৌশল ঠিকঠাক রপ্ত না হওয়ায় তাড়াহুড়োয় জড়িয়ে গিঁট পড়ে গেল তার নিজের হাতেই। কোনটা কনুই কোনটা কবজি কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই, এদিকে টানাপোড়েনে হাতের মুঠো আলগা হয়ে আমটাও গড়িয়ে পড়ল কোথায় যেন। গলিতে দুটো বাচ্চা ছেলে ক্রিকেট খেলছিল নিচে গাছের ডালের ব্যাট আর প্লাস্টিকের বল দিয়ে। তারা দৌড়ে গিয়ে আমটা কুড়িয়ে নিল। অনেক কষ্টে টেনেটুনে যখন হাত জানলা দিয়ে ফের ঘরে এনে ঢোকাল তখন সেটা আর নিজের হাত বলে মালুম হল না, এত ব্যথা। মনের দুঃখে ফুঁপিয়ে কেঁদেই উঠল একটু সে।
ভূতটারও বোধহয় মায়া হল এই দেখে, আহা রে বেচারা কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। একটা না একটা গোলমাল পাকাচ্ছেই। সে এবার নিজেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলল, “এই যে বন্ধু সবই তো হল এবার আমাদের সবচেয়ে মোক্ষম যে ক্ষমতাটা, সবচেয়ে প্রাচীন এবং সনাতন, সেই বিদ্যেটা শিখিয়ে দিই তোমায় এসো।”
“সেটা কি”?
“মানুষকে ভয় দেখানো!”
“আরে বাহ। সে তো বেশ ভাল ব্যপার। একদম গা ছমছমে কেস। উহ ভূতের গল্প পড়ে ভয় পেতে আমারও হেব্বি লাগে।”
ভূত একবার কটমট করে তাকিয়ে বলল, “হুঁ! ঐ গল্প এক জিনিস আর সত্যি সত্যি সামনে দেখলে আরেক। তুমি নয় বেয়াড়া আজব পাবলিক, কিন্তু এমন অনেক লোক আছে যারা ভূত দেখে এখনো ভয়ে কাঁপে থর থর করে।”
“আহা আহা রাগছ কেন, সেটা তো আমি বলিনি যে ভয় পাবে না। আচ্ছা শিখিয়ে দাও ভয় পাওয়ানোর কেরামতি।”
অতঃপর ঝন্টুর ভীতি প্রদর্শনের ক্ষমতাপ্রাপ্তি এবং সঙ্গে সঙ্গে মাথায় খেলে গেল কার উপরে এর প্রয়োগ সবার আগে করা উচিৎ।
স্কুলের ফিজিক্সের স্যার মাধববাবু। ঘোরতর নাস্তিক যুক্তিবাদী লোক। ভূত ভগবান কিছুতেই বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। তাঁর অকাট্য যুক্তির সামনে প্রমাণের অভাবে কোন তার্কিক টেঁকে না। দেখা যাক রাত দুপুরে একটা জলজ্যান্ত ভূতকে সামনে দেখে তাঁর কী প্রতিক্রিয়া হয়। এমন লোককে ভয় পাওয়াতে পারলে তবেই না মজা। যারা সত্যি ভীতু, তাদের ভয় দেখিয়ে হার্টফেল করিয়ে মারার কোন দরকার নেই, ইচ্ছেও নেই তার।
স্যারের বাড়ি অবধি ভূত ঝন্টুকে নিজেই নিয়ে গেল উড়িয়ে। তা ছাড়া আর উপায়ই বা কী! ছাদের উপর তাকে টুক করে নামিয়ে ভূত তো চলে গেল। রাত দশটা বেজে গেছে। মাধববাবু এ সময়ে নৈশ আহারের পর ছাদে একটু হাঁটাহাঁটি করেন। যথারীতি সিঁড়ির দরজাটা খুলে স্যার একটা চটি পায়ে দিয়ে ছাদে এসে পায়চারি করতে শুরু করলেন। ঝন্টু ওমনি ধপ করে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। স্যার কি একটু চমকালেন? কি জানি অন্ধকার ভাল বোঝা গেল না। শুধু বললেন, “কে রে”?
গলার আওয়াজে তো মনে হল না একটুও ভয় পেয়েছেন বলে।
ঝন্টু খানিক আগে শেখা খ্যানখেনে অট্টহাসিটা ঝেড়ে দিল বেশ স্টাইল করে। ওমা ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, চাঁদের মৃদু আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল স্যারের কপালে ভাঁজ পড়ল গভীর। আস্তে আস্তে বললেন, “কে? ঝন্টু না? এখানে কি করছিস এত রাতে? আর এসব কী?”
সেরেছে, ধরে ফেলেছে এই অন্ধকারেও। স্যারের চোখ যে কী! যাই হোক দমে গেলে চলবে না। একে একে প্রয়োগ করতে হবে সব। বলে উঠল খোনা গলায়, “স্যার আমি ভূত। আপনি তো ভূতে বিশ্বাস করেন না তাই না? এবার দেখুন কেমন লাগে।”
“চুপ কর! খালি আবোল তাবোল বকবক। বাড়ি যা শিগগির।”
“আপনি মানছেন না তো? এই দেখুন তবে।”
বলতে বলতেই ঝন্টু প্রয়োগ করে ফেলেছে তার মোক্ষম অস্ত্র, নিজের মুণ্ডুটাকে ধড় থেকে খুলে হাতে নিয়ে নাচাতে নাচাতে বলল, “এবার কেমন লাগছে স্যার? হি হি হি!”
স্যার আরও রেগে গিয়ে এবার জোরে ধমকালেন, “কী হচ্ছেটা কী? এটা কি সার্কাস পেয়েছিস? ভেলকি দেখানো হচ্ছে? মর্কট? নাকি হাড়গোড়ে কোন প্রবলেম আছে তোর সত্যি? এভাবে মাথা খুলে যাওয়া তো মোটেই ভাল লক্ষণ না।”
এবার ঝন্টু হতাশায় একেবারে ভেঙে পড়ল। স্যার দিব্যি ঐ কথা বলতে বলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে চলে গেলেন। আশ্চর্য। এই অপমান সহ্য হয়? একলা অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়ে মনে দুঃখে কী করবে বুঝতে না পেরে হাতে ধরা নিজের মুণ্ডুটাই ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে।
ফেলেই বুঝতে পারল বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। কারণ চোখ সমেত মুণ্ডুটা উড়ে এসে পড়েছে স্যার এর বাড়ির নিচে ময়লা আবর্জনা ফেলার স্তূপে। সে দৃশ্য দেখে আর গন্ধে ঝন্টুর প্রাণ সত্যি যায় যায় অবস্থা। ধড়টা ওদিকে ছাদে কবন্ধ হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে মাটিতে নেমে আসার জন্য, পারছে না, চোখ তো নেই, দেখবে কী করে!
আর ঠিক এই সময়েই আরও একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটল বা ঘটতে যাচ্ছিল। ডাস্টবিনের দিকে নতুন কিছু পড়ার ঝুপ করে শব্দ পেয়ে সেদিকে এগিয়ে এল একটা মিশকালো তাগড়াই নেড়ি কুকুর। এসেই ঝন্টুর কাটা মাথাটা চাটতে শুরু করল পরম উৎসাহে। একটু পরেই খাওয়া শুরু করবে মনে হল। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে ঝন্টুর, ঠিক এই সময়ে কুকুরের জিভের সুড়সুড়িতে প্রবল হাঁচি পেল তার। সর্বশক্তিতে চারদিক কাঁপিয়ে হাঁচিটা হতেই যেন বিস্ফোরণ। কুকুরটা তো ছিটকে পালালোই, আরও কিছু অভাবনীয় ‘সুগন্ধী’ বিষয়বস্তু তার মাথা মুখ বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকল। পরিত্রাহি স্বরে “বাঁচাও বাঁচাও” বলে ভূত বন্ধুকে ডাকতে থাকে ঝন্টু। ডাকলে সে আসে না এমনটা অবশ্য হয়নি কখনো। সে এল অতএব।
আসতেই কাঁদো কাঁদো স্বরে ঝন্টু কঁকিয়ে ওঠে, “আর কাজ নেই আমার এইসব ভূতুড়ে ক্ষমতা নিয়ে। তুমি আগে আমার ধড়টাকে এনে ফিট করে দাও আমার মাথার সাথে। তারপর বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে চল।”
অগত্যা ঝামেলার কাজটা ভূতকেই করতে হল আবার, মুণ্ডুহীন দিশেহারা দেহটাকে যথাস্থানে এনে মাথাটাকে ঠিক কৌটোর ছিপির মত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টাইট করে বসাল আগের মত। তারপর ঘাড়ে চাপিয়ে ঝন্টু কুমারকে নিয়ে চলল বাড়ি। সারা রাস্তা একটাও কথা বলল না ছেলেটা। আহা রে, বেচারা মনে বড় কষ্ট পেয়েছে।
ছাদের কাছাকাছি আসতেই ভূতটা কেমন যেন উশখুশ করতে লাগল। ঝন্টুকে বলল “এই যে বাড়ি এসে গেছে। এবার আমি যাই!”
“দাঁড়া ! কোথায় যাচ্ছিস?”
এই রে! এটা আবার কার গলা! মহিলাকন্ঠে এমন হুঙ্কার শুনে ঝন্টু বেশ চমকেই গেল। ভূত ততক্ষণে তাকে ছাদে নামিয়ে দিয়েছে বটে, কিন্তু তাঁর হাঁটু দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে। ভয়ে? অবাক হয়ে ঝন্টু দেখল, ছাদের আলো আঁধারিতে সাদা শাড়ি পরে বড় করে ঘোমটা টেনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছেন। এত রাতে এখানে কে? আর তাছাড়া ভূতটাই বা এমন ভয় পাচ্ছে কেন? এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই সেই মহিলা বলে উঠলেন, “কিরে ঝুনু, আমায় চিনতে পারলি না?”
ঝুনু! এই নামে তো একজনই ডাকত তাকে! কিন্তু সে তো… তবে কী…! জড়ানো গলায় অস্ফুটে ঝন্টু বলে ওঠে “মা!”
“হ্যাঁ রে ঝুনু। দেখছি ক’দিন ধরেই তোদের কীর্তিকলাপ। আজ আর না এসে পারলাম না। কী শুরু করেছিস বল তো? ভেবেছিস আমি কিছু দেখি না আর? পড়াশোনা ফেলে খালি এই সব দুর্বুদ্ধি! আর বলিহারি যাই বাপু ভেটকু তোমাকেও! ছেলেমানুষের কথায় তাল দিয়ে এমন নাচলে? ওর বন্ধুবান্ধব তেমন নেই বলে আমিই বলেছিলাম ছেলেটাকে একটু সঙ্গ দিও মাঝেমাঝে। তাই বলে এই?”
ভেটকু ভূত তখন রীতিমত ফুঁপিয়ে উঠে বলল, “ভুল হয়ে গেছে মা জননী! আমারও তো বন্ধু নেই তেমন, আপনি তো জানেন আজ্ঞে। তাই একটু…”
“ঠিক আছে ঠিক আছে। আর নাকি কাঁদতে হবে না। এখন থেকে আর নো দুষ্টুমি। বরং পড়াশুনোয় হেল্প করো ওকে। খেলাধুলা মাঝেমধ্যে চলতে পারে কিন্তু এসব বেয়াদপি আর নয়! আমি কিন্তু সব দেখছি!”
ভেটকু মাথা নিচু করে যেন তার সব দোষ স্বীকার করল আর তখুনি পূব দিগন্তে একটা লালচে আভা দেখা দিতেই দুটো অবয়বই অদৃশ্য হয়ে গেল নিমেষে। ভোর হয়ে আসা ফাঁকা ছাদে একলা দাঁড়িয়ে ঝন্টুর মনের মধ্যে কেমন যেন হল। মাকে এতদিন পর দেখে ভাল লাগল ঠিকই, কিন্তু এই প্রথম বোধহয় সে ভয় পেল। তবে সে ভয়ের মধ্যে আতঙ্ক নেই মোটে, রয়েছে মায়া জড়ানো ছেলেবেলার গন্ধ মেশা অদ্ভুত এক অনুভব।
সে স্বগতোক্তি করল, “আমি ভাল ছেলে হয়ে যাব, মা! তুমি চিন্তা কোর না আর।”
অলঙ্করণঃ মৌসুমী
খুব সুন্দর
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ।
LikeLike