চন্দন ব্যানার্জী
অঘোরবাবু ঘোরতর বিস্মিত। এসব কী হচ্ছে তাঁর সঙ্গে? কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই তাঁর কাছে নেই। আর তিনি কোনও রকম অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্বাসই করেন না। তিনি কোনও কালেই ওঝা, ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। তাই সেরকম কারোর কাছে তিনি যানও নি। নিজেই নানা ভাবে ব্যাপারটার বিশ্লেষন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কিছুতেই অঙ্কটা মেলাতে পারেননি।
নাঃ, গোড়া থেকেই শুরু করা যাক্। অঘোরবাবু জীবনবিমা নিগমের একটা শাখায় বড়বাবু। রোজ দশটা-পাঁচটা অফিস করতে করতে মনে করেন দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছেন। আরও দশটা মাস কাটিয়ে দিলেই মুক্তি অর্থাৎ তাঁর রিটায়ারমেণ্ট। ঘটনাটার সূত্রপাত ছ’মাস আগে। স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের ঘটনা।
তাঁর হাতঘড়িটা খুব সমস্যার সৃষ্টি করছিল। যখন তখন তাঁর অজান্তেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তিনি টেরই পাচ্ছিলেন না। অফিস ছুটির নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও তিনি ফাইলে মগ্ন থাকতেন, কারণ তিনি তাঁর ঘড়ি অনুসারে মনে করতেন অফিস ছুটি হতে অনেক দেরি আছে। সম্বিত ভাঙ্গত দারোয়ান রামখিলাওনের ডাকে, যখন সে আলো নিভিয়ে দরজায় তালা দেওয়ার জন্য আসত। তখন অঘোরবাবু দেখতেন তাঁর হাতঘড়িটা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর রিটায়ারমেণ্ট পর্যন্ত এই ঘড়িটাতেই কাজ চলে যাবে। কিন্তু নাঃ, আজকেই একটা নতুন ঘড়ি কিনতে হবে।
অফিস থেকে দেরিতে বেরনোর ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই নির্ধারিত মেট্রোটা এবং পরবর্তী দুটো মেট্রো মিস করলেন। তার পরের মেট্রোটা ধরে অনেক দেরিতে গন্তব্য ষ্টেশনে নেমে অটোর লাইনের দিকে যাচ্ছিলেন। মনে মনে ভাবছিলেন, আজ দেরি হয়ে গেছে, তাই আজ আর হবে না। তবে কালই একটা নতুন হাতঘড়ি কিনে নেবেন। হঠাৎই দেখলেন একটা সাত আট বছরের ছেলে তিরবেগে দৌড়ে তাঁর প্রায় গা ঘেঁসে চলে গেল। অঘোরবাবু অনুভব করলেন যে ছেলেটা তাঁর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর হাতে কিছু একটা জিনিস গুঁজে দিয়ে গেল। তিনি হাতের মুঠো খুলে জিনিসটা দেখার আগেই দেখলেন কয়েকজন লোক ছুটতে ছুটতে আসছে। তারা হাঁপাতে হাঁপাতে বলছিল, “ধর্ ধর্, যাঃ পালিয়ে গেল। এত অল্পবয়সী ছেলের সঙ্গে কি আমরা দৌড়ে পারি?” ওরা হাল ছেড়ে দিল। ওদেরই একজন বলছিল, “যাক্ গে, আমরা তো জানিই না ও ছিনতাই করেছে কিনা।”
আর একজন তখন বলল, “ঐটুকু ছেলের হাতে অত দামি ঘড়ি দেখেই তো সন্দেহ হয়েছিল। জিগ্যেস করতেই কীরকম ছুট লাগাল দেখলেন না?”
প্রথম জন বলল, “এর থেকে প্রমাণ হয় না, ঘড়িটা ওর নয় আর সেটা ও ছিনতাই করেছে।”
আর একজন বলল, “ভালই হয়েছে। ওকে ধরতে পারলে আমরা হয়তো ঘড়িটা কেড়ে নিতাম। কিন্তু তারপর? ওর মালিককে কোথায় খুঁজতাম?
দ্বিতীয়জন বলল, “ওটা পুলিশের কাজ। আমরা পুলিশ ডাকতাম।”
“তাতে আমাদেরই ঝামেলা বাড়ত। বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যেত।”
এইসব বলতে বলতে লোকগুলো চলে গেল। অঘোরবাবু জিনিসটাকে মুঠোর মধ্যেই ধরে রেখেছিলেন। লোকগুলো চলে যাওয়ার পর তিনি মুঠো খুললেন। দেখলেন একটা হাতঘড়ি। তিনি নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলেন, একটু আগেই তিনি মনে মনে একটা হাতঘড়ি চাইছিলেন আর এখন তিনি একটা হাতঘড়ি পেয়ে গেলেন। তিনি নিজেকে বোঝালেন, তিনি তো চুরি ছিনতাই কিছু করেননি। কারোর কাছ থেকে দানও নেননি। ছেলেটা নিজের ইচ্ছেয় ঘড়িটা তার হাতে অযাচিতভাবে ধরিয়ে দিয়ে গেছে। যে লোকগুলো ছেলেটার পিছন পিছন আসছিল ঘড়িটা তাদেরও নয়। তাই তাদেরকেও দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। সুতরাং এটা স্বয়ং ঈশ্বরের দান। কৃতজ্ঞচিত্তে এই দান গ্রহন করা উচিত। তাড়াতাড়ি তিনি ঘড়িটা প্যাণ্টের পকেটে চালান করে দিলেন।
বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিজের ঘরে বসে ঘড়িটাকে বের করে ভাল করে লক্ষ করলেন। এরকম অদ্ভূত ঘড়ি তিনি আগে কখনও দেখেননি। ঘড়িতে তিনটের বদলে ছ’টা কাঁটা। সেকেণ্ড, মিনিট, ঘন্টার কাঁটা যেমন থাকার কথা তেমনই আছে। কিন্তু ঘন্টার কাঁটা বারোর পরিবর্তে চব্বিশ ঘর ঘুরছে। পরের দুটো কাঁটার জন্য আছে ৩১ এবং ১২ ঘর। শেষের কাঁটাটার জন্য রয়েছে ১০০ ঘর। একটু চিন্তা ভাবনা করে উনি বুঝতে পারলেন এই ঘড়িতে রেলের টাইমের মত করে ২৪ ঘন্টার সময় দেখা যাবে, অর্থাৎ বিকেল চারটের জায়গায় ষোলোটা দেখাবে। ২৪ ঘন্টা পেরোলে পরের কাঁটাটা এক ঘর সরবে। এইভাবে ওটা মাসের তারিখ দেখাবে এবং মাস শেষ হলে তার পরের কাঁটাটা এক ঘর সরবে। ঐ কাঁটাটা বারো ঘর সরতে এক বছর লাগিয়ে দেবে। এক বছর পর শেষ কাঁটাটা এক ঘর সরবে। ঘড়িতে একশ’ বছর পর্যন্ত সময় দেখাবার ব্যবস্থা আছে।
“ঘড়িটা তো দারুণ!” মনে মনে বললেন তিনি। এটাকেই তো কালচক্র বলে। চক্রাকার ডায়ালের মধ্যে কাল অর্থাৎ সময়কে দেখাবার যন্ত্রবিশেষ। কিন্তু ঘড়িটা তো চলছে না। দম দেওয়ার বা কাঁটা অ্যাডজাস্ট করার জন্য কোনও ব্যবস্থাই চোখে পড়ল না। ব্যাটারিতে চলে বলেও মনে হল না, কারণ, ব্যাটারি ঢোকাবার কোনও জায়গাই দেখা গেল না। তাহলে ঘড়িটা চলে কীভাবে? না চললে এতগুলো কাঁটা দিয়ে ঘড়িটা বানানোর অর্থই বা কী? অচল বলেই কি ছেলেটা তাকে ঘড়িটা দিয়ে গেল?
কিন্তু মন তো সায় দিচ্ছে না। যদি এখন অচলও হয়, তাহলেও কোনও সময় তো চলত। তাহলে কীভাবে চলত? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আনমনে ঘড়িটা বাঁহাতে পরেই ফেললেন। একী? ঘড়িটা যে চলতে শুরু করেছে! ভালভাবে তাকিয়ে দেখলেন। সত্যিই ঘড়িটা চলছে। সবকটা কাঁটা দ্রুত বেগে বনবন্ করে ঘুরছে।
একটু পরে সবক’টা কাঁটা থেমে গেল। কেবল সেকেণ্ডের কাঁটা ধীরে ধীরে চলতে লাগল। দেখা গেল ঘন্টা, মিনিট, সেকেণ্ডের কাঁটা সময় দেখাচ্ছে একুশটা তেতাল্লিশ মিনিট সতেরো সেকেণ্ড।
অঘোরবাবু বুঝলেন, ঘড়ি সঠিক সময়ই দেখাচ্ছে, কারণ হিসেবমতো তখন রাত প্রায় পৌনে দশটার কাছাকাছি হওয়ার কথা। কিন্তু অন্য তিনটে কাঁটা দেখাচ্ছে আটান্ন বছর আট মাস বারো দিন। কিন্তু সেদিনটা ছিল ২০১৬ সালের ছাব্বিশে অক্টোবর। তাই ষোলো বছর দশ মাস ছাব্বিশ দিন দেখানোর কথা।
কিন্তু কাঁটাগুলো তো আর ঘুরছে না! যদিও ঘন্টা, মিনিট, সেকেণ্ডের কাঁটা ঠিক চলছে বলে বোঝা যাচ্ছে। যাকগে, মনে হয় বছর, মাস, দিনের কাঁটাগুলো খারাপ আছে। কিন্তু একটু আগেই তো ঐ কাঁটাগুলো অন্য কাঁটাগুলোর সঙ্গেই বনবন করে ঘুরছিল! তাহলে নিশ্চয়ই সেটিংয়ে গণ্ডগোল। কিন্তু ঘন্টা, মিনিট, সেকেণ্ডের কাঁটা তো নিজে নিজেই সঠিক সময়ে সেট হয়ে গেল। তাহলে অন্য কাঁটাগুলো হবেনা কেন? তাঁর হাতের পাল্সের স্পর্শই তো ঘড়িটাকে চালু করেছে। তাহলে তাঁর শরীরের সঙ্গে ঘড়িটার একটা সংযোগ হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী ঘড়িটা চলছে। আটান্ন বছর আট মাস বারো দিন তাহলে কেন দেখাবে?
ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল, আজ তাঁর বয়স তো আটান্ন বছর আট মাস বারো দিনই বটে! নিজের আবিষ্কারে নিজেই পুলকিত হলেন অঘোরবাবু। যেহেতু তাঁর হাতের স্পর্শে ঘড়িটা চলছে তাই ওটা তাঁর বয়স দেখাচ্ছে। শেষ তিনটে কাঁটা বয়স দেখায় আর প্রথম তিনটে কাঁটা সাধারণ ঘড়ির মত সময় দেখায়। ঘড়িটা পরলে সবকিছু নিজে হতেই ‘সেট’ হয়ে যায়। ব্যাপারটা বোঝা গেল। তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে খাওয়া দাওয়া করে শুতে গেলেন।
পরদিন যথাসময়ে ঘড়িটা হাতে পরে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বাস ড্রাইভারটা খুব বিশ্রীভাবে চালাচ্ছিল। একই রুটের অন্য একটা বাসের সঙ্গে রেষারেষি করে চালাচ্ছিল। যাত্রীদের আপত্তি কানেই তুলছিল না। হঠাৎ খুব জোরে ব্রেক কষল, কিন্তু তা সত্বেও সামনের বাসটার পেছনে ঠুকে দিল। বিকট আওয়াজ হল। অঘোরবাবু হুমড়ি খেয়ে ড্রাইভারের পেছনের পার্টিশানে সজোরে আছড়ে পড়লেন।
বাঁহাত দিয়ে নিজেকে খানিক সামলাবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। সামলে নিলেনও, কিন্তু ঘড়িটা সজোরে পার্টিশানে আঘাত করল। অঘোরবাবুর হাতটা বেঁচে গেল, কিন্তু তিনি লক্ষ করলেন, ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। দুই বাসের যাত্রীরাই চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে বাস থেকে নেমে পড়ল। অঘোরবাবুও নেমে পড়লেন। কিন্তু অফিস যাবেন কী করে? ভাগ্য ভাল বলতে হবে। কয়েকজন বাসযাত্রী মিলে একটা ট্যাক্সি ডাকায় উনিও শেয়ারে যাওয়ার জন্য ঐ ট্যাক্সিতে জায়গা পেলেন।
মনটা খুঁতখুঁত করছিল অঘোরবাবুর। নিজে বেঁচে গেছেন, কিন্তু অত সুন্দর ঘড়িটা চলছে না। ঘড়িটা খুলে আর একবার পরে দেখলে হয় না? তাহলে হয়ত কালকের মত নিজে নিজেই সেট হয়ে যাবে। এই ভেবে ঘড়িটা খুলতে গেলেন। কিন্তু একী, ঘড়িটা তো খুলছে না! কেন খুলছে না? কাল রাত্রে শোবার আগে তো দি্ব্যি খোলা গিয়েছিল! তাহলে?
অনেক টানাটানি করেও কিছুতেই খুলতে না পেরে উনি ভাবতে লাগলেন এখন এই অচল ঘড়ি সারা জীবন পরে থাকতে হবে? ঠিক তখনই ঘড়িটার ডায়ালের দিকে চোখ পড়তে চমকে উঠলেন। সেকেণ্ডের কাঁটা চলছে। কিন্তু একী, কাঁটাটা উল্টো দিকে চলছে অর্থাৎ অ্যাণ্টিক্লক ওয়াইজ। অবাক বিস্ময়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন, কিন্তু তাঁর কিছুই করার ছিল না। তিনি না পারলেন ঘড়িটা খুলে ফেলতে, না পারলেন সেকেণ্ডের কাঁটাটার অভিমুখ বদলাতে অথবা ওটাকে থামাতে। ঐ ভাবেই ঘড়িটা উল্টো দিকেই চলতে থাকল। তিনি বুঝলেন, ঘড়িটা গেছে। ওটাকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আর লাভ নেই।
কিন্তু মাথা ঘামাতেই হল। পরের দিন অফিসে পৌঁছে অভ্যাসবশতই ঘড়িটার দিকে তাকালেন। সেকেণ্ডের কাঁটাটা যথারীতি উল্টোদিকে চলেছে। কিন্তু তিনি এটা কী দেখছেন? তাঁর বয়স দেখাচ্ছে আটান্ন বছর সাত মাস তেরো দিন। তাঁর স্পষ্ট মনে আছে, গতকাল বাড়ি থেকে বেরনোর সময় বয়স দেখেছিলেন আটান্ন বছর আট মাস তেরো দিন। মাঝে একটা দিন কেটেছে। কিন্তু ঘড়িটা একদিন না পিছিয়ে একমাস পিছিয়ে গেছে।
পরের পুরো সপ্তাহ তিনি ঘড়িটার দিকে নজর রাখলেন। দেখলেন, যা বুঝেছিলেন তাই ঘটছে। সাতদিন পর তাঁর বয়স দেখাচ্ছে আটান্ন বছর তেরো দিন। মাসের কাঁটা বারো অর্থাৎ শূন্য দেখাচ্ছে। সময় সাতদিনে সাতমাস পিছিয়ে গেছে।
কিন্তু সেই সঙ্গে আর একটা ব্যাপার লক্ষ করে যার-পর-নাই পুলকিত হলেন তিনি। গত ছয় মাস ধরে তাঁর হাঁটুতে একটা ব্যথা হচ্ছিল। ডাক্তার বলেছিল অস্টিও আর্থ্রাইটিস। হাঁটুর সন্ধিস্থলের হাড় ক্ষয়ে মধ্যবর্তী কার্টিলেজ শুকিয়ে গেছে। তাই ব্যথাটা মাঝে মাঝেই ভোগাবে। কিন্তু এই মুহুর্তে তাঁর কোনও রকম ব্যথা নেই। ঠিক সাতমাস আগের মত। তখন তাঁর ঐ ব্যথা ছিল না।
এটা তো অলৌকিক ব্যাপার মনে হচ্ছে! তাঁর শরীর কি সাতমাস আগের অবস্থায় ফিরে গেছে? তিনি কি টাইম মেশিনে পিছিয়ে যাচ্ছেন? ঘড়িটা কি টাইম মেশিন?
কিন্তু, তাহলে তো পারিপার্শ্বিক সবকিছুরই সাতমাস পিছিয়ে যাওয়ার কথা। তা যে হয়নি, সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। অফিসের সব চিঠিপত্র তো আজকের সঠিক তারিখেই লেখা হয়েছে। হাজিরা খাতায় তো ঠিক তারিখই লেখা আছে। মনতোষবাবু পাঁচমাস আগে অবসর নিয়েছেন, তাঁর জায়গায় অনিলবাবু বসেন। ঐ তো, ঐ চেয়ারে অনিলবাবুই বসে আছেন। তাহলে এটা টাইম মেশিনের ব্যাপার নয়। যাই হোক, আরও বেশ কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
***
গত ছ’মাস ধরে ঘড়িটাকে পর্যবেক্ষণই করেছেন অঘোরবাবু। চারমাস আগের ঘটনা। তখন শীতকাল। ঠাণ্ডাটাও জাঁকিয়ে পড়েছিল। মাঙ্কিক্যাপ পরেই অফিস করছিলেন তিনি। প্রায় সমবয়সী সুধীরবাবু পাশের টেবিলে বসেন। তিনি মাফলারটা দিয়ে মাথা, কান, গলা ভালভাবে জড়াতে জড়াতে বললেন, “জব্বর ঠাণ্ডা পড়েছে। কাগজে দেখলাম, আজ শীতলতম দিন।”
অঘোরবাবু বললেন, “এখন পরপর কদিনই কাগজে একই কথা লিখবে।”
“তার মানে রোজই ‘শীতলতম’র রেকর্ড ভাঙবে?”
“ঠিক তাই। প্রত্যেক বছরই তাই দেখি। আপনি তো মাঙ্কিক্যাপ পরেন। কিন্তু আদি আর অকৃত্রিম মাফলারই ভাল।”
“মাঙ্কিক্যাপ ভাল নয় কেন?”
“ওটা দিয়ে গলা ঢাকা যায় না। মাফলার দিয়ে একসঙ্গে গলা, কান, মাথা সবই ঢাকা যায়।”
“তা ঠিক। তবে মাথাটা বাঁচানোই হল আসল কাজ। কাজটা মাঙ্কিক্যাপ ভালভাবেই করে।”
“ঠিকই বলেছেন। বিশেষ করে আমাদের মত টেকো মানুষদের মাথার প্রোটেকশনের জন্য স্বাভাবিক আচ্ছাদনই যখন অনুপস্থিত।”
“স্বাভাবিক আচ্ছাদন?”
“হ্যাঁ, চুল। আপনার, আমার দুজনেরই তো ওটারই বড় অভাব।”
অন্য টেবিল থেকে পালবাবু বলে ওঠেন, “আজকাল তো টাকে চুল গজানোর অনেক উপায় বেরিয়েছে। কাগজের অ্যাডগুলো দেখেন না?”
সুধীরবাবু বললেন, “ওদের অনেক টাকার খাঁই। ওসব পাল্লায় না পড়াই ভাল।”
“কিন্তু অঘোরবাবু মনে হয় ওদের থেকে ট্রিটমেণ্ট নিচ্ছেন।”
অঘোরবাবু বললেন, “মানে?”
পালবাবু বললেন, “আমি লক্ষ করেছি, আপনার মাথায় অনেক চুল গজিয়েছে।”
“তাই নাকি? কিন্তু, আমি তো কোনও ট্রিটমেণ্ট করাচ্ছি না! তবে হ্যাঁ, বললেন বলে খেয়াল পড়ল, চুল সত্যিই একটু বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।”
“একটু নয়। অনেকটাই। আসলে নিজে বুঝতে পারা যায় না। অন্য লোকেরা কিন্তু বুঝতে পারে।”
কথাটা অঘোরবাবুর মনে একটা খটকা সৃষ্টি করল। কদিন ধরেই টাকে হাত দিলে হালকা পশমি ছোঁয়া লাগছিল বটে। কিন্তু সে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি তিনি। আয়নায় মুখ আর এ-বয়েসে কে-ই বা দেখে!
সবার সামনে মাঙ্কিক্যাপটা খুলে দেখতে পারলেন না তিনি। কে আবার কী ভাববে! তাই একটু পরে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। সেখানে মাঙ্কিক্যাপটা খুলে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখলেন। সত্যিই তো। তাঁর মাথাভর্তি সুন্দর কালো চুল।
নিজের চেয়ারে ফিরে এসে পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন অঘোরবাবু। ব্যাপারটার সঙ্গে যে ঘড়িটার যোগ আছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মনে মনে অঙ্কটা মেলাবার চেষ্টা করলেন।
ঘড়িটা প্রথম পরেছিলেন ২৬শে অক্টোবর, ২০১৬-র রাত্রে। পরদিন অর্থাৎ ২৭শে অক্টোবর থেকে ঘড়িটা উল্টো চলছে। আজ ২৬শে ডিসেম্বর। ঘড়িটা দুমাস উল্টো চলেছে। একদিনে ঘড়ির সময়টা একমাস পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই দুমাস অর্থাৎ ৬০ দিনে ৬০ মাস অর্থাৎ পাঁচ বছর পিছিয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে দেখলেন বয়স দেখাচ্ছে ৫৩ বছর ৮ মাস ১৩ দিন। অঙ্কটা মিলে গেল। পাঁচ বছর আগে তাঁর টাক পড়া শুরু হয়নি। তখন তাঁর মাথাভর্তি সুন্দর কালো চুল ছিল। এখন আয়নায় নিজের মুখ আর চুল দেখে নিজেকে ঠিক পাঁচ বছর আগের মতই লাগছে। অর্থাৎ ঘড়ির মতই তাঁর বয়সও পাঁচ বছর পিছিয়ে গিয়েছে।
এরপর প্রতিদিনই তাঁর বয়স একমাস করে কমতে লাগল। দেখতে দেখতে ঘড়িটা পাওয়ার পর ছ’টা মাস কেটে গেছে। আজ ২৭শে এপ্রিল, ২০১৭। ছ’মাসে ঘড়ি অনুযায়ী তাঁর বয়স পনেরো বছর কমে গেছে, প্রতি দু মাসে পাঁচ বছর করে। তিনি এখন ৪৩+ এবং তাঁর শরীরও ফিরে পেয়েছে চল্লিশোর্ধ এক যুবকের শারীরিক গঠন। মনে মনে তিনি খুবই খুশি। নিজেকে একজন তরতাজা যুবক মনে হচ্ছে। গিন্নির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তাঁর স্ত্রী চুয়ান্ন বছরের শ্যামলীকে কেমন যেন বুড়ি বুড়ি লাগছে। তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক বড় দিদিস্থানীয়া একজন মনে হচ্ছে। মনে মনে তিনি গেয়ে উঠলেন, “ইক্কেবারে মানাইছে না রে।”
গিন্নি বলেন, “কী মানাইছে না?”
“ও কিছু না। এমনি একটা গানের কথা মনে পড়ল।”
“আমি বুঝতে পারছি। তুমি দিন দিন কচি খোকাটি হয়ে যাচ্ছ, তাই আমার সঙ্গে তোমাকে আর মানাচ্ছে না, তাই তো।”
“আহা চটছো কেন? আমি তেমন কিছু ভেবে গানটা গাইনি।”
“সে যাই হোক। একটা সত্যি কথা বলবে?”
“কী কথা?”
“তুমি কি কোনও ওষুধ খাচ্ছ?”
“হঠাৎ এ কথা কেন?”
“দিন দিন তুমি ছোকরা হয়ে যাচ্ছ। কী করে হচ্ছ বল তো? আমি তো তাল রাখতে পারছি না।”
“তোমার ভাল লাগছে না?”
“ভাল তো লাগছেই। ঘোষ গিন্নির মুখে ঝামা ঘসে দেওয়া গেছে।”
“কীরকম, কীরকম?”
“তুমি তো জানই, ষাট বছরের বুড়ো ঘোষবাবুর দ্বিতীয় পক্ষের বউ ও। প্রায় কুড়ি বছরের ছোট। আমাদের গ্রুপে ওকে বলা হয় ‘বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’। বর ওকে চোখে হারায়।”
“তো?”
“এখন আমিও একটা উপাধি পেয়েছি।”
“তুমি আবার কী উপাধি পেলে?”
“তরুণস্য বৃ্দ্ধা ভার্যা।”
“তাতে ঘোষগিন্নির কী করে মুখে ঝামা ঘসে দেওয়া গেল?”
“প্রথম কথা, আগে ও-ই ছিল একমাত্র উপাধিধারী। এখন আমিও উপাধি পেয়েছি। তার চেয়েও বড় কথা, ওর বুড়ো বরের তুলনায় আমার বরটা কত ফিট! মনে হয় অল্পবয়সী কেউ। তাই মনে মনে ও আমাকে হিংসে করে।”
“তুমি কী করে বুঝলে? ও কেন তোমায় হিংসে করবে?”
“হাবেভাবে বোঝা যায়। তোমার মত একটা ছোকরা বর আমার কথায় উঠছে বসছে দেখেই ওর হিংসা হয়।” বলেই গিন্নি ফিক করে হেসে উঠে নিজের কাজে চলে গেলেন।
অঘোরবাবু খুব প্রীত হলেন। তাঁকে নিয়ে মহিলামহলে আলোচনা হয়। নিজেকে বেশ ‘উত্তমকুমার’ ‘উত্তমকুমার’ মনে হচ্ছে। ভাগ্যিস ওরকম একটা ঘড়ি পাওয়া গেছে! মনের আনন্দে তিনি টিভি দেখতে বসে গেলেন। টিভিতে সিরিয়াল হচ্ছিল, “ইণ্ডিয়া’জ মোস্ট ওয়ান্টেড”। অনেককাল আগে দেখানো জনপ্রিয় সিরিয়াল আবার দেখানো হচ্ছে। ফুরফুরে মেজাজে তিনি সিরিয়াল দেখতে লাগলেন।
সেই রাতে তাঁর খুব ভাল ঘুম হল। এত নিশ্চিন্তের সুখনিদ্রা অনেকদিন পর তিনি উপভোগ করলেন। ভোরের দিকে তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। পুলিশ তাঁকে খুঁজছে। একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং সিসিটিভির ফুটেজে তাঁকে দেখা গিয়েছে। সর্বত্র তাঁর ফোটোসহ পোস্টার দিয়ে পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে তিনি ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ক্রিমিনাল। তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু তিন মাস পর ধরা পড়ে গেলেন। তার তিন মাস পর পুলিশ চার্জশিট দিল। আরও চারমাস পর কোর্টে তাঁর বিচার শুরু হল।
পুলিশের তরফ থেকে আদালতের কাছে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য পেশ করা হল। সাক্ষী কিন্তু অঘোরবাবুকে চিহ্নিত করতে পারল না। সাক্ষী বলে উঠল, “এ তো একটা বাচ্চা ছেলে। আমি যাকে দেখেছিলাম সে তো একটা বছর চল্লিশ বিয়াল্লিশের লোক।”
তাকে সিসিটিভির ফুটেজ দেখাতে সে বলল, “হ্যাঁ ঐ লোকটাকেই আমি দেখেছিলাম। কিন্তু আসামী তো অনেক ছোট।”
বিচারক নিজে সিসিটিভির ফুটেজ খুঁটিয়ে দেখে বললেন, “ঠিকই তো। আসামী তো ফুটেজের লোকটার চাইতে অন্তত কুড়ি বছরের ছোট।” এই বলে পুলিশকে তিরষ্কার করে অঘোরবাবুকে বেকসুর খালাস করে দিলেন। অঘোরবাবু অঙ্কটা মেলাতে লাগলেন। ৪৩+বয়সে তিনি ডাকাতি করেছিলেন। দশমাস পরে তাঁর বিচার হচ্ছিল। এই দশমাসে তাঁর বয়স পঁচিশ বছর কমে গেছে। তিনি আজ আঠারো বছরের একটা ছেলে। কোনও পুলিশ বা বিচারকের সাধ্য নেই তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করা।
ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। তখনই দেওয়াল ঘড়িতে ঢংঢং করে চারটে ঘন্টা পড়ল। ভোর হয়ে আসছে। স্বপ্নটার কথা তাঁর মনে পড়ল। ভোরের স্বপ্ন তো সত্যি হয়। কী আশ্চর্য! তিনি কিনা ব্যাঙ্ক ডাকাতির আসামী! এ-রকম স্বপ্নের মানে কী? ব্যাপারটা অবশ্য তাঁর দিক থেকে ভালই। যে কোনও ক্রাইম করেই তিনি বেকসুর খালাস পেয়ে যাবেন, কারণ, যতদিনে বিচার শুরু হবে ততদিনে তঁর বয়স অনেক কমে যাবে। তিনি অতীব আত্মতুষ্টিতে মগ্ন হয়ে পড়লেন।
ঘন্টাখানেক পর তিনি রোজকার অভ্যাস মত জগিং করতে বেরিয়ে পড়লেন। পার্কে প্রতিবেশি মনমোহনবাবু মর্নিং ওয়াক করছিলেন। উনি অঘোরবাবুর থেকে বছর দুয়েকের ছোট। কিন্তু জগিং করেন না। অঘোরবাবু তাঁর পাশ দিয়ে অতিক্রম করে বললেন, “একটু দৌড়ন। খালি হাঁটলে চলবে?”
মনমোহনবাবু বললেন, “আমি আপনার মত ডোপ করি না।”
হাঃহাঃ করে হাসতে হাসতে অঘোরবাবু বললেন, “আমি ডোপ করি?”
“পাড়ায় তো সবাই সের’মই বলাবলি করে। তাই তো আপনি দিনদিন ইয়াং হয়ে যাচ্ছেন। আমি তো আর ডোপ করছি না, তাই ইয়াংও হচ্ছি না। সেইজন্য আমার পক্ষে ওয়াকিংই ভাল।”
“আপনারা পাড়ায় এইসব আলোচনা করেন? আমি মোটেই ডোপ করি না।”
“না করলেই ভাল। করলে আয়ু কমে যায়।”
শুনে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে অঘোরবাবু এগিয়ে গেলেন।
পরে যথাসময়ে অফিস গেলেন। অফিসে কাজের ফাঁকে তিনি ঘড়িটার কথাই ভাবছিলেন। ঘড়িটা সত্যিই ঈশ্বরের আশীর্বাদ। ঘড়িটা তাঁকে কতরকম সুবিধা দিচ্ছে তার একটা নমুনা তো তিনি আজ ভোরের স্বপ্নেই দেখেছেন। আরও হরেক রকম সুবিধা তিনি পেতে পারেন। এমনকি খুনের মত কোনও বড় অপরাধ করেও তিনি পার পেয়ে যাবেন, যদি ধরা পড়ার সময় দেখা যায় যে তিনি একজন বালক মাত্র। তখন জুভেনাইল কোর্টে তাঁর বিচার হবে, যেক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ সর্বোচ্চ তিন বছর মাত্র। তবে তিনি খুন করার মত কোনও অপরাধ করতে যাবেন না, তাই তিনি সেরকম কোনও সুবিধাও ভোগ করবেন না।
যাই হোক, ঘড়িটার দৌলতে তাঁর যে কত রকম সুবিধা হবে, আর ভাবতেই পারছেন না তিনি। সবই কি সুবিধা? কোনও অসুবিধাই কি হবে না? ভাবতে গিয়ে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠল তাঁর মুখে। ছ’মাসে তিনি ৫৮ থেকে ১৫ বছর কমে ৪৩ হয়েছেন। আর বছরখানেকের মধ্যে তাঁর বয়স আরও ৩০ বছর কমে যাবে এবং তিনি বছর তেরোর এক বালকে পরিণত হবেন। তখন তিনি প্রা্প্তবয়স্কর অধিকার ভোগ করতে পারবেন না। অর্থাৎ ভোটাধিকার, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি।
তবে হ্যাঁ, ওই অধিকারগুলো না থাকলেও তাঁর আপাতত চলে যাবে। অর্থাৎ অসুবিধাগুলো সবই তাত্ত্বিক মাত্র, কোনও ব্যবহারিক অসুবিধা নেই।
কিন্তু… কিছু ব্যবহারিক অসুবিধা তো হবেই। যেমন, কুড়ি পঁচিশ বয়সের পাড়ার যে মেয়েরা তাঁকে ‘জেঠু’ বলে সম্বোধন করে, তারা তাঁর সঙ্গে ‘তুই-তোকারি’ করে কথা বলবে। সেটাও না হয় মেনে নেওয়া যাবে। কিছু পেতে গেলে তো কিছু ছাড়তেও হয়। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কর অধিকার না থাকলে তাঁর তো ব্যাঙ্কে লেনদেন করার অধিকারও থাকবে না।
দশমাস পর ১৮ বছরের তরুণ রূপে তিনি রিটায়ার করবেন। তাঁর পিএফ, গ্র্যাচুইটির মোটা অঙ্কের টাকাটা পেতে পেতে আরও দুমাস লেগে যাবে। ততদিনে তিনি ১৩ বছরের এক বালক হয়ে যাবেন। ঐ টাকাটা তিনি কীভাবে ব্যাঙ্কে ফিক্স্ড ডিপোজিট করবেন? কোনও তেরো বছরের বালককে তো ব্যাঙ্ক এণ্টারটেনই করবেনা। আর পেনশনের কী হবে? সাম্প্রতিক তোলা ফোটো বলতে একটা আঠারো বছরের ছেলের ফোটো জমা দেওয়া হবে। ব্যাপারটা প্রসেস হতে ষদি চরমাস লাগে তাহলে তো একটা আট বছরের ছেলে ঐ টাকা তুলতে যাবে। তাকে কি ব্যাঙ্ক এণ্টারটেন করবে? যদিও বা করে, তার তিনমাস পর তিনি তো হবেন ছ’মাসের বাচ্চা। একটা ছ’মাসের বাচ্চা কী করে পেনশন তুলতে যাবে? সুতরাং এখন সময়িক সুবিধা পেলেও ভবিষ্যতে অসুবিধার পাল্লাটাই ভারি হবে। মনমোহনবাবুর মত অনেকেই ভাবছেন তিনি ডোপ করছেন। মনমোহনবাবুর কথা মনে পড়তেই তাঁর বলা শেষ কথাটা মনে পড়ল, “না করলেই ভাল। করলে আয়ু কমে যায়।”মনে পড়তেই একটা দুশ্চিন্তা তাঁকে গ্রাস করল। তাঁর বয়স তো ক্রমাগত কমতেই থাকবে। কমতে কমতে শূণ্যয় আসতে কতটুকুই বা সময় লাগবে? প্রতি দুমাসে পাঁচ বছর হিসাবে বয়স কমতে থাকলে দশমাস পর রিটায়ারমেণ্টের সময় তাঁর বয়স হবে ১৮। রিটায়ারমেণ্টের ছ’মাস পরে তিনি হবেন তিন বছরের এক শিশু আর একমাস পরেই তিনি হবেন ছ’মাসের বাচ্চা। এখন, সব চেয়ে বড় প্রশ্ন আর এক মাস পর ঐ ছ’মাসের বাচ্চাটা কোথায় যাবে? তখন বয়স হিসেব মত শূন্যের নীচে নেমে যাবে। তার মানে তাঁর মৃতদেহটাও পাওয়া যাবে না! স্রেফ অদৃশ্য হয়ে যাবে। কুলকুল করে ঘামতে থাকলেন অঘোরবাবু। তাঁর আয়ু তাহলে আর দেড় বছরও নেই?
অফিসের সকলের দিকে তাকালেন অঘোরবাবু। সকলে কাজের ফাঁকে কী নিশ্চিন্তে গল্পগুজব হাসি-মশকরা করছে। করবেই তো। কারণ, কেউই জানে না তাদের কতদিনের আয়ু। সকলেই জানে যে একদিন তাদের আয়ু শেষ হবে। কিন্তু কেউই জানে না, কবে। তাই সকলেই নিশ্চিন্ত। ইংরাজিতে একটা কথা পড়েছিলেন, “হোয়্যার ইগনোরেন্স ইজ আ ব্লিস, ইট’জ ফলি টু বি ওয়াইজ।” সত্যিই তাই। অজ্ঞতার জন্যই সকলে এত হাসিখুশি। একমাত্র ব্যাতিক্রম অঘোরবাবু। তিনি জানেন, তাঁর আয়ু বড়জোর আর মাত্র দেড় বছর। তাঁর এই জ্ঞান তাঁর মুখমণ্ডল থেকে সব হাসিখুশির চিহ্ন যেন ব্লটিং পেপারের মত শুষে নিল। আবার একটা ইংরাজি কথা তাঁর মনে হল। তিনি মনে মনে বললেন, “মাই ডেজ আর নাম্বার্ড।” হায়, তিনিও যদি অজ্ঞ হতে পারতেন!
***
অফিস ছুটির পর আনমনা হয়ে হাঁটছিলেন। মেট্রো বন্ধ। লাইনে কেউ একজন আত্মহত্যা করেছে বলে মেট্রো চলছে না। অগত্যা বাস ধরতে হবে। বাসস্টপে প্রচণ্ড ভিড়ের চাপ। একটা বাস একটু ডানদিক চেপে প্রায় মাঝ রাস্তায় এসে দাঁড়াল। দৌড়ে ঠেলাঠেলি করে উঠতে গেলেন অঘোরবাবু। ডানহাতে বাসের হ্যণ্ডেল ধরে ডান পাটা বাসের পাদানিতে দিয়ে তিনি তখন ঝুলছিলেন। ঠিক তখনই একটা মিনিবাস দ্রুতগতিতে এসে বাঁপাশে এসে সজোরে ব্রেক কষল। বোঝা গেল মিনিবাসটা রেষারেষি করে যাত্রী তুলতে চাইছে এবং সেটা করতে তাকে বাধা দেওয়ার জন্যই বড় বাসটা ডানদিক চেপে দাঁড়িয়েছে। মিনিবাসটা তাই জোর করেই বাঁদিক দিয়ে ঢুকতে চাইছে। অঘোরবাবুর বাঁ হাতটা সজোরে মিনিবাসটার গায়ে ধাক্কা খেল। পথচারীরা হইহই করে ওঠায় মিনিবাসটা সজোরে ব্রেক কষে থেমে গেল। অঘোরবাবু বেঁচে গেলেন। ঘড়িটা থাকায় তাঁর বাঁ হাতটাও বেঁচে গেল। পুরো আঘাতটা ঘড়িটাতে লেগেছে বলেই তাঁর বাঁ হাতটা বেঁচে গেল। অঘোরবাবু ঘড়িটাকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করে মনেমনে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানালেন। তিনি ঐ বাসটাকে ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ফুটপাথে উঠে এলেন। একটা বড় ফাঁড়া কেটে গেল। পরের বাসে যাবেন।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে তিনি ঘড়িটার দিকে তাকালেন। অত জোর ধাক্কা খেয়েও ঘড়িটা ভাঙেনি। ঘড়িটা চলছে কিনা দেখতে গিয়ে অঘোরবাবু চমকে উঠলেন। ঘড়িটা চলছে, তবে উল্টো দিকে নয়, সোজা দিকে। ক্লকওয়াইজ। সবকটা কাঁটাই বন্ বন্ করে ঘুরেই চলেছে। তিনি ঘড়ি অনুযায়ী তাঁর বয়সের দিকে নজর রাখছিলেন। ৪৩ থেকে বাড়তে বাড়তে তাঁর বয়স ৫০ ছাড়িয়ে গেল। ৫১, ৫২ হতে হতে ৫৯ য়ে এসে কাঁটাটা স্থির হল। মাসের কাঁটাটা ২য়ে এবং দিনের কাঁটাটা ১৩য় এসে থেমে গেল। অর্থাৎ বয়স দেখাচ্ছে ৫৯ বছর ২ মাস ১৩ দিন। এটাই তাঁর সঠিক বয়স। তিনি হাতে কোনও চোট লেগেছে কিনা পরীক্ষা করার জন্য ঘড়িটা খোলবার চেষ্টা করলেন। কী আশ্চর্য, ঘড়িটা খুলে গেল। অর্থাৎ বয়স সঠিক হলে তবেই ঘড়িটা সহজেই পরা বা খোলা যায়। অনেকদিন হাতে শক্ত করে ঘড়িটা চেপে বসায় কব্জিতে দাগ হয়ে গেছে। তাই অঘোরবাবু ঘড়িটাকে না পরে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন।
পরের বাসে চড়ে অবশেষে তিনি বাড়ি পৌঁছলেন। বাড়িতে গিয়ে পোশাক পাল্টাতে গিয়ে দেখলেন প্যান্টের পকেটে ঘড়িটা নেই। চকচকে টাকে হাত বোলাতে বোলাতে তিনি ভাবছিলেন ঘড়িটা গেল কোথায়। উঃ। হাঁটুর ব্যথাটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠল।
ওদিকে বাস থেকে নেমে ঝন্টু পকেটমার ভাবছিল, টাকলা বুড়োটা মানিব্যাগের বদলে পকেটে ঘড়ি রেখে আমার কাজ বাড়িয়ে দিল! যত্তসব উটকো ঝামেলা। এটাকে এখন বেচতে হবে।
অলঙ্করণঃ মৌসুমী