বিজোড় শীতে মানে দু’বছর বাদে বাদে আমরা রাঙা পিসিমার বাড়ি যেতুম। পিসিমার বাড়ি বিস্তর দূর, সেই সুন্দরবনের দ্বীপ অঞ্চলে। দু-দুটি নদী পেরোতে হয়। একটায় তবু ভটভটি চলে, আরেকটিতে আদ্যিকালের দাঁড়টানা নৌকা। তাই আপনজন হয়েও এই ন’পিসির বাড়ি যাওয়া বিশেষ হতোই না। শীতে নদী খানিক শান্ত থাকে, তাই এই সময়টাই বাছতে হত।
নৌকো থেকেই দেখতে পেতুম পিশে ঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন। অবশ্য ঘাট বলতে যেমনটি বুঝি সে-রকম নয়। থকথকে কাদার উপর দুখানা কাঠের পাটা পাতা থাকত কেবল। তারা নৌকার শরীর ছুঁতে পারত না। তাই নৌকার উপর থেকে আড়াআড়ি আরেকটা পাটা নামিয়ে দেয়া হত। তারপর প্যান্ট গুটিয়ে, জুতো বগলে, বাক্সপ্যাঁটরা মাথায় তুলে ব্যালান্স করতে করতে উঠতে হত ডাঙায়। একটু এপাশ-ওপাশ হলেই ধপাস। সে কাদাও তেমন, সোহাগে জড়িয়ে নিত।
জলযোগের পর্ব মিটলে মেজদার ( পিসির মেজ ছেলে) হাত ধরে গ্রাম দেখতে বের হতাম।
গ্রাম বলতে যেমনটি বোঝানো হয় ঠিক তেমনটা না। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বাড়ি ঘরদোর, পুকুর, দোকান দাকিন আর তারপর সেগুলো ছাড়িয়ে গেলেই লম্বা ইঁটের রাস্তা। দু’দিকে বোল্ডারের বাঁধুনি নিয়ে রাস্তাটা নদীর পাড় ধরে এঁকেবেঁকে হারিয়ে গেছে। দুপাশের ঝাউগাছগুলো পঙখাপুলারের কাজ করে যেত। সেখানে দাঁড়িয়ে দাদা গল্প বলত। ভূতের গল্প, ইতিহাসের গল্প আবার কখনো বা উল্টোদিকে ঘন জঙ্গলের কথা।
ঘন সে জঙ্গলের দিকে আঙুল দেখিয়ে দাদা বলতেন, “বড় বাবা ( বাঘ) পঞ্চাশ বছর ওই জঙ্গলের বাইরে পা দেননি। কিন্তু তা বলে ভেবো না যে উনি কখনও হানা দেবেন না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে স্পষ্ট শুনতে পাই থেকে উনার গম্ভীর আওয়াজ।”
কাদামাটির বুকে মাথা তুলে রাখা শূলি পোঁতা সে জঙ্গলের দিক থেকে আসা উত্তুরে হাওয়া আমায় কাঁপিয়ে দিত৷ দাদার হাত চেপে বলতুম, “বাড়ি চল না দাদা গুলি খেলা দেখব।”
দুপুরের খাওয়া হত জব্বর। সে-রকম খাওয়া আমরা সচরাচর এসব দিকে খাই না। শীতের কুয়াশামাখা টকসা লাউপাতার ভেতর ছাগুন জাল বেয়ে সদ্য ধরে আনা চিংড়ি দিয়ে ভাপা। লাউপাতার ঘ্রাণ, সরিষার ঝাঁঝ আর চিংড়ির গলে আসা ঘি সব মিশে গিয়ে সে যেন সাক্ষাত অমৃত। বেছে বেছে সেরা চিতি কাঁকড়া দিয়ে যেত জেলেরা বাড়ি বয়ে। হালদার বাড়ির সম্বন্ধী এসেছে বলে কথা। যাইহোক, তারপর সেইগুলো তেল, পিঁয়াজ আর শুকনো লঙ্কা বাটায় মেখে রসা হত কাঠের জ্বালে। কালচে লাল সেই এক হাতা ঝোলে ১০০গ্রাম চালের ভাত মাখা যায়।
তারপর লম্বা ঘুম। বিকালে পেতুম পেঁয়াজি। পেঁয়াজের রসেই মজানো হতো জাঁতাকলে ভাঙা ছোলার বেসন। এমনই মুচমুচে তারা যে কামড়ালে চারহাত দূরের মানুষও শুনতে পেত।
রাতের খাবারটি ছিল আরও চিত্তাকর্ষক। দেশি মোরগ আসত জাকির পাড়া থেকে। বিকাল বিকাল কেটেকুটে চাপানো হত লোহার কড়ায়৷ এ কিন্তু বাংলা কাট। ছাল থাকত কারণ ওতেই আসল স্বাদ। বাটা লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুন আর ধীমে আঁচে ঘন্টা আড়াই ধরে পাকতো রান্না….আহা, নিকুঞ্জ চালের ভাত আর ধোঁয়া ওঠা চর্বিওয়ালা মোরগের ঝোল। যেন অমৃত। স্বাদকোরকগুলি প্রাণভরে সোহাগ করত সে রাতে।
তারপর রাতে দাদার পাশে শুয়ে শুনতুম বড় বাবার সেই জলদগম্ভীর গর্জন। জড়িয়ে ধরতুম দাদার হাত। দাদা থাবা মেরে বুঝিয়ে দিত ভয় নেই আমি আছি।
আজও তিন চার বছরে দাদা এলে কখনো-সখনো একসঙ্গে বসা হয়। গুরুগম্ভীর আলোচনা হয় দামী তরল নিয়ে কিন্তু সেই সুরটা যেন কেটে গেছে। পল্লীগ্রামের সেই তেলসিক্ত, টেরি কাটা ছেলেটা হারিয়ে গেছে ভার্জিনিয়া প্রবাসী লোকটার আড়ালে।
আর পিসিরা….আকাশের তারা হয়ে কলকাতার টু বিএইচকে ফ্ল্যাট থেকে বিদায় নিয়েছেন সেই কবে…. হালদার ভিটের কথাও আর জানি না। মাঝেমধ্যে সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হয়- কে জানে, হয়তো সেই চুনোখালির হালদার ভিটের উপর পিসি- পিশে পাশাপাশি টিমটিম করে জ্বলছেন।
অলঙ্করণ: লেখক
Osadharon. Chokhe jol ese gelo. Eto sundor obhibyakti. Nomoshyo lekha sob. Korojore pronam janai.
LikeLike