পরিব্রাজক(প্রথম পর্ব),পরিব্রাজক (২য় পর্ব) পরিব্রাজক (৩য় পর্ব), পরিব্রাজক (৪র্থ পর্ব)
(চতুর্থ পর্ব)
স্বামী বিবেকানন্দ
কলকাতা বন্দর থেকে বাষ্পচালিত জাহাজ গোলকোন্ডায় তিন সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে বিবেকানন্দ চলেছেন পশ্চিমের উদ্দেশ্যে। জাহাজে বসে উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন—
আলাসিঙ্গার ‘সী-সিকনেস্’ হল না। তু-ভায়া প্রথমে একটু আধটু গোল করে সামলে বসে আছেন। চারদিন নানা বার্তালাপে ‘ইষ্ট-গোষ্ঠী’তে কাটল। সামনে কলম্বো। এই সিংহল, লঙ্কা। শ্রীরামচন্দ্র সেতু বেঁধে পার হয়ে লঙ্কার রাবণ-রাজাকে জয় করেছিলেন। সেতু তো দেখেছি সেতুপতি মহারাজার বাড়ীতে। যে পাথরখানির উপর ভগবান রামচন্দ্র তাঁর পূর্বপুরুষকে প্রথম সেতুপতি-রাজা করেন, তাও দেখেছি। কিন্তু এ পাপ বৌদ্ধ সিলোনি লোকগুলো তো মানতে চায় না! তারা বলে, আমাদের দেশে ও কিংবদন্তী নাই। তার ওপর ওরা নিজের দেশকে বলে—সিংহল। লঙ্কা বলবে না, বলবে কোত্থেকে? ওদের না কথায় ঝাল, না কাজে ঝাল, না প্রকৃতিতে ঝাল! রাম বল—ঘাগরা-পরা, খোঁপা-বাঁধা, আবার খোঁপায় মস্ত একখানা চিরুনী দেওয়া মেয়েমানষী চেহারা! আবার—রোগা-রোগা, বেঁটে-বেঁটে, নরম-নরম শরীর! এরা রাবণ-কুম্ভকর্ণের বাচ্চা? বলে, ওরা নাকি বাঙলা দেশ থেকে এসেছিল। ওই যে একদল দেশে উঠেছে, মেয়েমানুষের মত বেশভূষা, নরম-নরম বুলি কাটেন, এঁকে-বেঁকে চলেন, কারুর চোখের উপর চোখ রেখে কথা কইতে পারেন না, আর ভূমিষ্ঠ হয়েই পিরীতের কবিতা লেখেন, আর বিরহের জ্বালায় ‘হাঁসেন-হোঁসেন’ করেন—ওরা কেন যাক না বাপু সিলোনে।
একটা ছিল মহা দুষ্টু বাঙালি রাজার ছেলে—বিজয়সিংহ বলে! সেটা বাপের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে, নিজের মত আরও কতকগুলো সঙ্গী জুটিয়ে জাহাজে করে ভেসে ভেসে লঙ্কা নামক টাপুতে হাজির। তখন ওদেশে বুনো জাতের আবাস, যাদের বংশধরেরা এক্ষণে ‘বেদ্দা’ নামে বিখ্যাত। বুনো রাজা বড় খাতির করে রাখলে, মেয়ে বিয়ে দিলে। কিছুদিন ভাল মানুষের মত রইল, তারপর একদিন বউয়ের সঙ্গে যুক্তি করে হঠাৎ রাত্রে সদলবলে উঠে বুনো রাজাকে সর্দারগণ সহ কোতল করে ফেলল। তারপর বিজয়সিংহ হলেন রাজা। দুষ্টুমির এইখানেই বড় অন্ত হলেন না। তাঁর বুনোর-মেয়ে রাণী ভাল লাগল না। তখন ভারতবর্ষ থেকে আরও লোকজন, আরও অনেক মেয়ে আনলেন। অনুরাধা বলে এক মেয়েকে নিজে করলেন বিয়ে, আর সে বুনোর মেয়েকে জলাঞ্জলি দিলেন, জাতকে জাত নিপাত করতে লাগলেন। বেচারীরা প্রায় সব মারা গেল, কিছু অংশ ঝাড়-জঙ্গলে আজও বাস করছে। এই রকম করে লঙ্কার নাম হল সিংহল, আর হল বাঙালি বদমাশের উপনিবেশ!
ক্রমে অশোক মহারাজার আমলে, তাঁর ছেলে মহেন্দ্র আর মেয়ে সংঘমিত্রা সন্ন্যাস নিয়ে ধর্ম প্রচার করতে সিংহল টাপুতে উপস্থিত হলেন। এঁরা গিয়ে দেখলেন যে লোকগুলো বড়ই আদাড়ে হয়ে গিয়েছে। আজীবন পরিশ্রম করে, সেগুলোকে যথাসম্ভব সভ্য করলেন, উত্তম উত্তম নিয়ম করলেন, আর শাক্যমুনির সম্প্রদায়ে আনলেন। দেখতে দেখতে সিলোনিরা বেজায় গোঁড়া বৌদ্ধ হয়ে উঠল। লঙ্কাদ্বীপের মধ্যভাগে এক প্রকাণ্ড শহর বানালে, তার নাম দিলে অনুরাধাপুরম্। এখনও সে শহরের ভগ্নাবশেষ দেখলে আক্কেল হয়রান হয়ে যায়। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড স্তূপ, ক্রোশ ক্রোশ পাথরের ভাঙা বাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। আরও কত জঙ্গল হয়ে রয়েছে, এখনও সাফ হয়নি। সিলোনময় নেড়া মাথা, করোয়াধারী, হলদে চাদর মোড়া ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ছড়িয়ে পড়ল। জায়গায় জায়গায় বড় বড় মন্দির উঠল। মস্ত মস্ত ধ্যানমূর্তি, জ্ঞানমুদ্রা করে প্রচারমূর্তি, কাত হয়ে শুয়ে মহানির্বাণ মূর্তি, আর দেওয়ালের গায়ে সিলোনিরা দুষ্টুমি করলে নরকে তাদের কি হাল হয়— তাই আঁকা। কোনটাকে ভূতে ঠেঙাচ্ছে, কোনটাকে করাতে চিরছে, কোনটাকে পোড়াচ্ছে, কোনটাকে তপ্ত তেলে ভাজছে, কোনটার ছাল ছাড়িয়ে নিচ্ছে…সে মহা বীভৎস কারখানা! এ ‘অহিংসা পরমো ধর্মে’র ভেতরে যে এমন কারখানা কে জানে বাপু! চীনেও ওই হাল, জাপানেও।
এদিকে তো অহিংসা আর সাজার পরিপাটি দেখলে আত্মাপুরুষ শুকিয়ে যায়। এক ‘অহিংসা পরমো ধর্মে’র বাড়ীতে চোর ঢুকেছে। কর্তার ছেলেরা তাকে পাকড়া করে বেদম পিটছে। তখন কর্তা দোতলার বারান্দায় এসে, গোলমাল দেখে, খবর নিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, ‘ওরে মারিসনি, মারিসনি; অহিংসা পরমো ধর্ম’। বাচ্চা অহিংসারা মার থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তবে চোরকে কি করা যায়? ‘কর্তা আদেশ করলেন, ‘ওকে থলিতে পুরে জলে ফেলে দাও।’ চোর জোড় হাত করে আপ্যায়িত হয়ে বললে, ‘আহা, কর্তার কি দয়া!’
ক্রমে উত্তর দিক্ থেকে হিন্দু তামিলকুল ধীরে ধীরে লঙ্কায় প্রবেশ করলে। বৌদ্ধরা বেগতিক দেখে রাজধানী ছেড়ে, কান্দি নামক পার্বত্য শহর স্থাপন করলে। তামিলরা কিছুদিনে তাও ছিনিয়ে নিলে এবং হিন্দুরাজা খাড়া করলে। তারপর এল ফিরিঙ্গীর দল, স্পানিয়ার্ড, পোর্তুগীজ, ওলন্দাজ। শেষ ইংরেজ রাজা হয়েছে। কান্দির রাজবংশ তাঞ্জোরে প্রেরিত হয়েছেন, পেনশন আর মুড়গ্তন্নির ভাত খাচ্ছেন।
উত্তোর সিলোনে হিন্দুর ভাগ অনেক অধিক। দক্ষিণ ভাগে বৌদ্ধ আর রঙ-বেরঙের দোআঁশলা ফিরিঙ্গী। বৌদ্ধদের প্রধান স্থান—বর্তমান রাজধানী কলম্বো, আর হিন্দুদের জাফনা। জাতের গোলমাল ভারতবর্ষ হতে এখানে অনেক কম। চৈতন্যদেব যে নৃত্যকীর্তন বঙ্গদেশে প্রচার করেন, তার জন্মভূমি দাক্ষিণাত্য, এই তামিল জাতির মধ্যে। সিলোনের তামিল ভাষা খাঁটি তামিল।
কলম্বোর বন্ধুরা নামবার হুকুম আনিয়ে রেখেছিল, অতএব ডাঙায় নেমে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখাশুনা হল। স্যর কুমারস্বামী হিন্দুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁর স্ত্রী ইংরেজ, ছেলেটি শুধু-পায়ে, কপালে বিভূতি। শ্রীযুক্ত অরুণাচলম্ প্রমুখ বন্ধু-বান্ধবেরা এলেন। অনেক দিনের পর মুড়গ্তন্নি খাওয়া হল, আর কিং-কোকোনাট। ডাব কতকগুলো জাহাজে তুলে দিলে। মিসেস হিগিন্সের সঙ্গে দেখা হল, তাঁর বৌদ্ধ মেয়েদের বোর্ডিং স্কুল দেখলাম। কাউণ্টেসের বাড়ীটি মিসেস্ হিগিন্সের অপেক্ষা প্রশস্ত ও সাজান। কাউণ্টেস্ ঘর থেকে টাকা এনেছেন, আর মিসেস্ হিগিন্স ভিক্ষে করেছেন। কাউণ্টেস্ নিজে গেরুয়া কাপড় বাঙলার শাড়ীর মত পরেন। সিলোনের বৌদ্ধদের মধ্যে ঐ ঢঙ খুব ধরে গেছে দেখলাম।
বৌদ্ধদের প্রধান তীর্থ কান্দিতে দন্ত-মন্দির। ঐ মন্দিরে বুদ্ধ-ভগবানের একটি দাঁত আছে। সিলোনীরা বলে, ঐ দাঁত আগে পুরীতে জগন্নাথ-মন্দিরে ছিল, পরে নানা হাঙ্গামা হয়ে সিলোনে উপস্থিত হয়। সেখানেও হাঙ্গামা কম হয়নি। সিলোনীরা নিজেদের ইতিহাস উত্তমরূপে লিখে রেখেছে। আমাদের মত নয়—খালি আষাঢ়ে গল্প। আর বৌদ্ধদের শাস্ত্র নাকি প্রাচীন মাগধী ভাষায়, এই দেশেই সুরক্ষিত আছে। এ স্থান হতেই ব্রহ্ম শ্যাম প্রভৃতি দেশে ধর্ম গেছে। সিলোনী বৌদ্ধরা তাদের শাস্ত্রোক্ত এক শাক্যমুনিকেই মানে, আর তাঁর উপদেশ মেনে চলতে চেষ্টা করে। নেপালী, সিকিমি, ভুটানী, লাদাকী, চীনে, জাপানীদের মত শিবের পূজা করে না, আর ‘হ্রীং তারা’ ওসব জানে না। তবে ভূতটুত নামানো আছে। বৌদ্ধেরা এখন উত্তর আর দক্ষিণ দু-আম্নায় হয়ে গেছে। উত্তর আম্নায়েরা নিজেদের বলে ‘মহাযান’; আর দক্ষিণী অর্থাৎ সিংহলী ব্রহ্ম সায়ামি প্রভৃতিদের বলে ‘হীনযান’। মহাযানওয়ালারা বুদ্ধের পূজা নামমাত্র করে, আসল পূজা তারাদেবীর আর অবলোকিতেশ্বরের। টিবেটীগুলো আসল শিবের ভূত। ওরা সব হিঁদুর দেবতা মানে, ডমরু বাজায়, মড়ার খুলি রাখে, সাধুর হাড়ের ভেঁপু বাজায়, মদ-মাংসের যম। আর খালি মন্ত্র আওড়ে রোগ-ভূত-প্রেত তাড়াচ্ছে। চীন আর জাপানে সব মন্দিরের গায়ে ‘ওঁ হ্রীং ক্লীং’—সব বড় বড় সোনালী অক্ষরে লেখা দেখেছি। সে অক্ষর বাঙলার বেশ কাছাকাছি।
আলাসিঙ্গা কলম্বো থেকে মান্দ্রাজে ফিরে গেল। আমরাও কুমারস্বামীর বাগানের লেবু, কতকগুলো ডাবের রাজা (কিং-কোকোনাট), দু বোতল সরবৎ ইত্যাদি উপহার সহিত আবার জাহাজে উঠলাম।
ক্রমশ
কৃতজ্ঞতা: উদ্বোধন কার্যালয়, রামকৃষ্ণ মিশন