অরিন্দম দেবনাথ এর সমস্ত লেখা
১৩০০ বছর পরেও প্রাচীন এক কবরে টিকে ছিল খাবারযোগ্য কুকি – লিখেছেন অরিন্দম দেবনাথ
উত্তর-পশ্চিম চিনের পাহাড়ি মরুভূমির মাঝে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হল শিনজিয়াং (Xinjiang)। তিয়ান সাং, কুনলুন, পামির এবং আলতাই পর্বতশ্রেণি ছুঁয়ে রেখেছে শিনজিয়াংকে। আর এরই মাঝে ভয়ংকর মরুভূমি তাকলামাকান। যার নাম শুনলে অতি সাহসী অভিযাত্রীরও বুক কেঁপে ওঠে। খুব সামান্য কয়েক জায়গায় ঘাসের দেখা পাওয়া যায় এই মরুপ্রদেশে। আছে অল্প কয়েকটি মরূদ্যান।
হটান, তারপান, কাশগর হল এই মরুপ্রদেশের অন্যতম মরূদ্যান শহর। এই প্রদেশকে নানাদিক থেকে ছুঁয়ে রেখেছে বিভিন্ন দেশের সীমা। মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কাজাকিস্থান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারত। প্রায় ৬ লক্ষ ২০ হাজার বর্গ মাইল আয়তনের শিনজিয়াং প্রদেশের। চিন ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনকারী সুপ্রাচীন সিল্ক রোড গিয়েছে শিনজিয়াং-এর মধ্যে দিয়ে।
ইতিহাস বলে, কমপক্ষে ২৫০০ বছর ধরে একের পর এক নানা সম্রাট ও তাঁদের উত্তরাধিকারীবর্গ এই অঞ্চলে আধিপত্য বজায় রাখতে মরিয়া থেকেছে সবসময়। এর মুখ্য কারণ এর ভৌগলিক অবস্থান। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে এ মরু অঞ্চল। শুধু তো মরু নয়, দীর্ঘ উত্তুঙ্গ পর্বতশ্রেণি পাঁচিলের মতো আড়াল দিয়ে রেখেছে এই জায়গাকে।
বহু বছর আগে চিনের হান রাজবংশের অধীন এই অঞ্চলের পরিচয় ছিল জিয়ু (Xiyu ) নামে। যার অর্থ ‘পশ্চিম ভূমি’। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্ট পরবর্তী দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত হান সম্রাট এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে বর্হিবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনকারী একমাত্র পথ সিল্ক রোডের উপর ব্যবসায়িক আধিপত্য বজায় রাখার জন্য আলাদা করে গঠন করেছিলেন এই পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চল বা জিয়ু প্রোটেকটরেট। সাং (Tang) আমলে এই চিনদেশের এই অঞ্চলের পরিচিতি ছিল কিস্কি (Qixi ) নামে। ‘কিউই’ বলতে বোঝাত সুদূর উত্তরের গোবি মরুভূমি আর ‘সি’ বলতে পশ্চিমের তাকলামাকান। একের পর এক সাম্রাজ্যের হাতবদল হয়েছে। অঞ্চলের পরিচিতিরও বদল হয়েছে। কখনও নাম হয়েছে ঝুনবু, কখনও বা হুইজিয়াং – মুসলিম সীমান্ত। কিন্তু বদলায়নি এই অঞ্চলের গুরুত্ব। ১৯৪৯ সালে চিনে ঘটে যাওয়া গৃহযুদ্ধের পর রাজবংশের হাত থেকে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে চিন প্রজাতন্ত্রের হাতে। ১৯৫৪ সালে রাশিয়ার অগ্রাসন থেকে এই অঞ্চলকে রক্ষা করতে এখানে গড়ে ওঠে চিনা সামরিক বাহিনীর জোরদার ঘাঁটি। স্থানীয় অর্থনীতিকেও জোরদার করতে এই অঞ্চল একটি প্রদেশ থেকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক কালে এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে তেল ও খনিজের খোঁজ পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান। বর্তমানে এই অঞ্চল চিনের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী অঞ্চল। নাম বদলাতে বদলাতে সিল্ক রুট বয়ে চলা এই অঞ্চলের নাম বর্তমানে শিনজিয়াং।
শিনজিয়াং মূলত উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা। তুর্কি উইঘুর, কাজাখ এবং কিরগিজ, হান, তিব্বতি, হুই, তাজিক, মঙ্গোল, রাশিয়ান এবং সিবি সহ বেশ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর বাসস্থান শিনজিয়াং-এ। পুরোনো অনেক ইংরেজি রেফারেন্স বইতে এই অঞ্চলকে চাইনিজ তুর্কিস্তান বা পূর্ব তুর্কিস্তান নামেও চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এই বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের মাত্র ৯ শতাংশ মতো অঞ্চল মানুষের বাসের উপযোগী। বাকিটা হয় উষর মরু, না-হয় খাড়াই পার্বত্য এলাকা।
এই সমগ্র অঞ্চলের তাপমাত্রা ভীষণরকম ওঠানামা করে। শীতকালে তাপমাত্রা চলে যায় হিমাংকের ২৯ ডিগ্রি নীচে, আবার গ্রীষ্মে উঠে যায় ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
শিনজিয়াং-এর তারিম বেসিনের অন্তর্গত তারপান (Turpan) এই অঞ্চলের অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল।
২০১৫ সালের গণনা অনুযায়ী প্রায় ছ’লক্ষ লোকের বাস এখানে। এই অঞ্চলের বিশেষত্ব হল এর উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে নীচে। পৃথিবীর প্রাচীনতম জলবণ্টন ব্যবস্থা ‘কারেজ’ (karez) এর প্রাণশক্তি। কারেজের অর্থ কুয়ো।
অনুমান, দু-হাজারেরও বেশি বয়স মরুর মাঝে এর জল-সিঞ্চন পদ্ধতি। সেই সুদূর তিয়ানসান পর্বতমালার হিমবাহের বরফগলা জল মরুর শুকনো বালির তলা দিয়ে খাল বানিয়ে নিয়ে এসে বাণিজ্য পথ সিল্ক রোডের মাঝে ব্যবসায়িক কারণে মরূদ্যান গড়ে তোলা সহজ কাজ ছিল না। বালির অভ্যন্তরে বয়ে চলা খালের ওপর থেকে বহু জায়গায় কুয়ো খুঁড়ে সেই জল ওপরে তোলার ব্যবস্থাও আছে। একটি কুয়োর থেকে আর একটি কুয়োর দূরত্ব গড়ে ৩ কিলোমিটার। সবচাইতে কম দূরত্বের কুয়োর অবাস্থান ৩০ মিটার আর দীর্ঘ দূরত্বের কুয়োর অবস্থান ৩০ কিলোমিটার। মাটির তলা দিয়ে যাবার ফলে প্রচণ্ড তাপেও জলের বাষ্পীভবন কম হওয়ার দরুন জলের সরবরাহ থাকে বছরভর। কৃত্রিমভাবে তৈরি এই ভূগর্ভস্থ খাল থেকে সরাসরি জল তোলার জন্য বেশ কয়েক জায়গায় কয়েকটি প্রবেশপথও আছে।
কোয়ানাত (qanat) নামের একইধরনের জল সরবরাহ পদ্ধতি পারস্য দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত ছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ বছর আগে থেকেই। অনুমান, মধ্যপ্রাচ্য থেকেই এই ব্যবস্থা আমদানি হয়েছিল তারপান অঞ্চলে। মরুর তলা দিয়ে এই বিশাল খাল খনন করা হয়েছিল সে-সময় প্রচলিত সাধারণ যন্ত্রপাতি দিয়েই। প্রাচীনকালের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মিশেল এই সুবিশাল প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করেছিল। সম্ভবত হান সাম্রাজ্যকালীন সময়ে এই খাল খনন করা হয়েছিল আর ষোলোশো শতাব্দীতে চিং সম্রাটরা এর প্রভূত উন্নতিসাধন করেছিলেন।
এই জল-সিঞ্চন ব্যবস্থাই সিল্ক রোডের ধারের তারপেনকে করে তোলে মরুর মাঝে এক ব্যবসায়িক শহরে, বলতে গেলে ভয়ংকর তাকলামাকান মরুর মাঝে প্রবেশের আগে রসদ সংগ্রহের শেষ বিন্দু। কাফেলা, ব্যবসায়ী আর ঘোড়ার দল এখানেই চাঙ্গা করে নিত নিজেদের।
অবশ্যই যদি স্থানীয় মানুষজন এই জায়গাটাকে লালন করে সমৃদ্ধ না করে তুলত, তবে কবে এই শহরটা মরুর শুকনো উড়ে চলা বালির তলায় চাপা পড়ে যেত! এই তারপানেই চিনদেশের সবচাইতে বেশি মিষ্টি আঙুর ও কিশমিশ উৎপাদন হয়। প্রচুর তুলোও উৎপাদন হয় এখানে। এইখানের এক প্রত্নতত্ত্বশালায় এই জল-সিঞ্চন ব্যবস্থার সুন্দর মডেল রাখা রয়েছে ‘কারেজ’-এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বোঝাতে।
এক হাজারেরও বেশি কুয়ো সম্বলিত প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার লম্বা এই কারেজ ব্যবস্থা আজও সচল। তিনশোর বেশি কুয়ো থেকে নিয়মিত জল সংগ্রহ করেন মরুর মাঝের বসিন্দারা। অনেক সময় কুয়োর ভেতর দিয়ে খালপথে প্রবেশ করে মরুর তীব্র দাবদাহের হাত থেকে খানিক মুক্তি খোঁজেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু কোনোভাবেই এই খালকে কলুষিত হতে দেন না।
২০১৭ সাল থেকে তারপান দ্রুতগতির রেল পরিষেবা দ্বারা যুক্ত। সেই রেলপথ আবার গিয়েছে কিলিয়ান পর্বতমালার মধ্য দিয়ে। ১১,৮৩৪ ফুট উচ্চতা ছুঁয়ে যাওয়া এই রেলপথ বিশ্বের দ্রুতগতির সর্বোচ্চ রেলপথ। এই পথের অধিকাংশ জায়গায় রেলের গতি ২০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার। আছে বিমান যোগাযোগ। চায়নার ৩১২ নম্বর জাতীয় সড়কপথ গিয়েছে তারপানের মধ্য দিয়ে। কারণ, তারপান এখন আর শুধু এক মরূদ্যান শহর নয়, বিশেষ অর্থনৈতিক শহর।
তারপান-এর ছ’কিলোমিটার দূরের একটি অঞ্চলের নাম আস্তানা (Astana)। আস্তানাকে সমাধিপুরী বললেও কম হয়। কারণ, এখানে আছে হাজারেও বেশি চাইনিজ মাজার ও সমাধি। এখানে পাওয়া গেছে প্রাকৃতিক মমি ও অসাধারণ সব শিল্পকলা। বর্তমানে আস্তানার প্রায় পুরো অঞ্চলটাই একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল।
হান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই এখানে ছিল বড়ো জনগোষ্ঠীর বাস। সিল্ক রোডের কল্যাণে গড়ে ওঠা মরূদ্যান জনপদে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এসে এখানে বসবাস শুরু করেছিল। অনুমান, সে-সময় কেউ মারা গেলে এখানেই তাঁদেরকে সমাধিস্থ করা হত। মিশরীয়দের মতো চাইনিজরাও বিশ্বাস করত যে মৃত্যুর পরেও জীবন থেকে যায়। আর সে-জীবনের চাহিদা থাকে পার্থিব জীবনের মতোই।
মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে যাতে কোনও অসুবিধা না হয় তাই কবরে রেখে দেওয়া হত খাবার, পোশাক, অর্থ, ধন-সামগ্রী, জুতো ইত্যাদি। অনেক সময় এইসব বস্তুর মূর্তিও রেখে দেওয়া হত। এছাড়াও থাকত বিভিন্ন লেখনী, মৃত ব্যক্তির প্রশস্তি, শয্যা দ্রব্য, নানা ধরনের মূর্তি। চাইনিজ দ্রব্য ছাড়াও ফরাসি সজ্জাও পাওয়া গেছে এইসব কবরে। মূলত চিনাদের কবরস্থান হলেও অন্য বর্ণের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বহুমূল্য কবরের উপস্থিতিও আছে এই আস্তানাতে।
প্রায় দশ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই কবরস্থান থেকে প্রাপ্ত অনেক বস্তু পৃথিবীর নানা দেশের জাদুঘরে সংরক্ষিত। সমাধিগুলোতে ছিল অসাধারণ সব ছবি ও মূর্তি। মূর্তিগুলোতে মূলত মঙ্গোলয়েড এবং ককেশীয় ধাঁচের। এখানে যাঁদের সমাধি দেওয়া হত, তাঁরা মূলত ছিলেন সমাজের উচ্চস্তরের ধনী ব্যক্তি। তাঁদের পারিবারিক সমাধিও হত এখানে। প্রায় প্রতিটি সমাধির গঠনশৈলী একইধরনের। চার থেকে দশ মিটার লম্বা সিঁড়ি ঢালু হয়ে নেমে গেছে মাটির নীচে। মূল সমাধি গৃহের মুখে মিটার খানেক লম্বা চওড়া পাথরে খোদাই দরজা। সেই দরজা পেরিয়ে ইটের দেওয়াল দেওয়া ঘর। চৌকোণ বা আয়তকার ঘরগুলো তিন থেকে চার মিটার লম্বা ও উচ্চতায় মিটার দুয়েক। কোনও কোনও সমাধি কক্ষে আবার লাগোয়া ঘরও তৈরি হত। সেই ঘরে থাকত অনেক কুলুঙ্গি। আর সেই কুলুঙ্গি ঠাসা হত নানা জীবজন্তুর প্রতিমূর্তি দিয়ে। ঠাসা হত মানুষের মুখের অনেক আদল বা মূর্তি, যা সাধারণত বৌদ্ধ মঠের প্রবেশদ্বারে দেখা যায়।
কাঠের বাক্সের মাঝে, বোঝা বোঝা কাগজের ওপর মৃতদেহগুলো কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হত। পাশাপাশি সিল্কের তৈরি পোশাক, জুতো, টুপি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস রেখে দেওয়া হত মৃতের পাশে। রাখা হত গানবাজনার সরঞ্জাম। কিছু মৃতদেহের চোখের ওপর মুদ্রা রেখে দেওয়া হত। হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি ও অনেক পুঁথিপত্রও পাওয়া গেছে এই সমাধিগুলো থেকে। পাওয়া গেছে মৃতের পাশে রাখা নৌকা বা নৌকার আকারের পাত্র। লাল দাগের মাঝে সাদা ফুটকিতে সাজানো কাঠের নৌকা বা নৌকার আকারের পাত্রে রাখা থাকত নানা সামগ্রী। কী জানি হিন্দু মতের ‘বৈতরণী পার’-এর ধারণা সেখানে চালু ছিল কি না। কিছু সমাধিসৌধে পাওয়া গেছে নানা ফল, যেমন আঙুর, নাশপাতি, গম, খেজুর এইসব। পাওয়া গেছে মাংসের টুকরো। পাওয়া গেছে ওষুধ। যাই রাখা হোক না কেন সবকিছুর একটা লিখিত তালিকা রেখে দেওয়া হত সমাধির ভেতর।
সমাধিসৌধগুলো সাধারণত পারিবারিক প্রজন্ম অনুসারে সাজানো হত। প্রচুর প্রাকৃতিকভাবে শুকনো মমি পাওয়া গেছে এই সমাধিস্থল থেকে। নুওয়া এবং ফুক্সি – যারা বিশ্ব সৃষ্টি করেছিল বলে বিশ্বাস, তাদের নিয়ে চিত্রিত নানা পতাকা পাওয়া গেছে এখান থেকে। এই সমাধিস্থলের ঠিক বাইরে নুওয়া এবং ফুক্সির দুই বিশাল মূর্তি আছে।
হাজারেরও বেশি সৌধের মধ্যে আপাতত মাত্র তিনটে খুলে রাখা হয়েছে পর্যটকদের দেখার জন্য। অনুমান, সপ্তদশ শতাব্দীর পর এই সমাধিক্ষেত্র আর ব্যবহৃত হয়নি। সে-সময় তিব্বত সম্রাট এই অঞ্চলের আধিপত্য দখল করে নেন ও সিল্ক রোড ধরে চাইনিজদের আনাগোনা বন্ধ করে দেন। ফলস্বরূপ বন্ধ হয়ে যায় এই সমাধিক্ষেত্র। নবম শতাব্দীর মাঝমাঝি যখন তুর্কি উইঘুররা এই অঞ্চলে পদার্পণ করে ততক্ষণে এই সমাধিক্ষেত্র পরিত্যক্ত হয়ে গেছে।
উনিশ শতকের প্রথমদিকে পাশ্চাত্য জগতের মানুষ এই অঞ্চলে আসা শুরু করল। তারা হারিয়ে যাওয়া শহরে, প্রাক সভ্যতার প্রমাণ দেখে চমকে গেছিল। এই অঞ্চল আক্ষরিক অর্থেই নানা কারণে বিপদজনক ছিল। শুধুমাত্র প্রকৃতিই নয়, মানুষজনও। বিশেষত লুটেরাদের ভয় ছিল মারাত্মক। কোনও কিছুতে পিছপা না হয়ে পাশ্চাত্যের কিছু অনুসন্ধিৎসু মানুষ এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু করল।
তাকলামাকান অভিযানকালে ১৯০৭ ও ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ অরেল স্টেইন এই সমাধিসৌধ থেকে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ব্রিটিশ জাদুঘরে পাঠান। তিনি যখন এখানে আসেন তখন প্রায় পুরো এলাকাটাই বালিতে চাপা অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ছিল। উইঘুর জনজাতির লোকেদের নিয়ে তিনি একের পর এক চাপা পড়া ইতিহাস খুঁড়ে বের করেন।
১৯১৫ সালে তিনি নানা ভাষায় লেখা প্রচুর নথি ও সামগ্রী ব্রিটিশ জাদুঘরে পাঠান নানা গবেষণার জন্য। তারপান অববাহিকার শুকনো উত্তাপে প্রাচীন এক সমৃদ্ধ শহরের গল্প বালির তলায় সংরক্ষিত ছিল প্রায় অক্ষত অবস্থায়। যদিও চোর-ডাকাতের দল অধিকাংশ সমাধির দ্রব্যসামগ্রী হাতিয়ে নিয়েছিল আগেই।
একটি সমাধিসৌধ খনন করে পাওয়া গেছিল জ্যাম টার্ট, টুইস্ট এবং বান সহ বিভিন্ন ধরনের প্যাস্ট্রি। ব্রিটিশ জাদুঘরে রাখা সেই খাদ্যসামগ্রী পরীক্ষা করে দেখা গেছিল, নেই নেই করেও সেই খাবারের বয়স ১৩০০ বছর। এখনও পর্যন্ত পাওয়া এগুলোই বিশ্বের প্রাচীনতম জ্যাম টার্ট।
কুকিজ যদি না খেয়ে কয়েক সপ্তাহ রেখে দেওয়া হয়, তবে সেগুলো আর খাবারযোগ্য থাকে না। প্রথমে নরম হয়ে যায়, তারপর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে যায়।
অরেল স্টেইন কুকিজের আকৃতি দেখে হতবাক হয়ে গেছিলেন। নান আকারের, সূক্ষ্ম ফুলের মতো পাপড়ির নকশা, ভেতরে ভরা জ্যাম বা ওইধরনের পুর। কবরের শুষ্ক হাওয়ায় মিষ্টি বিস্কুটগুলো টিকে ছিল সদ্য তৈরি খাবারের মতো।
১৯২৫ সালে ওরেলের সংগৃহীত প্রত্নসামগ্রী নিয়ে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক প্রদর্শনীতে সবচাইতে নজর কেড়েছিল এই কুকিজ আর পেস্ট্রি। টাইমস অফ মুম্বই লিখেছিল, ‘সমস্ত বস্তুর মধ্যে সর্বাধিক লক্ষণীয় মৃতদেহের সঙ্গে সমাধিত খাদ্যসামগ্রীর মধ্যের পেস্ট্রি। ঠিক বর্তমান সময়ের কেক-পেস্ট্রির দোকানের শো-কেসে রাখা নজর কেড়ে নেওয়া ডিজাইন।’
এগুলোকে কি সত্যিই কুকিজ বলা উচিত? কেননা মাত্র শ-তিনেক আগে কুকিজ শব্দটির জন্ম। কেক, বান, মিষ্টি বিস্কুট এসব বোঝানো হয় এই শব্দটি দিয়ে। কিন্তু ১৩০০ বছরের পুরোনো কুকিজের আকৃতি ঠিক বর্তমান কুকিজের মতো। এই খাদ্যসামগ্রী দেখে ওরেল স্টেইনের প্রথমেই মনে এসেছিল কুকিজের কথা। তাই একে কুকিজ না বলার কারণ নেই। বর্তমানে এই কুকিজ আর প্রদর্শিত হয় না, কারণ এগুলো অন্য আবহাওয়ার সংস্পর্শে এসে ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে। খাবারে দেওয়া কোনও সংরক্ষণকারী বস্তু, না আবহাওয়ার গুণে এগুলো টিকে ছিল তা নিয়ে গবেষণা চলছে।
কুকিজই একমাত্র মৃতদেহের সঙ্গে সমাধিস্থ হত না। হত পোরিজ, নানের মতো রুটি, নুডুলস এসবও। যা যা ভালো খাবার তা মৃত ব্যক্তির চূড়ান্ত ভ্রমণ বা পরজন্মের সাথী হিসেবে দিয়ে দেওয়া হত কবরে। এই খাবারগুলো তৈরির জন্য ওই কবরস্থানে আলাদা বিশেষ রান্নাঘরও ছিল।
অনান্য কবরেরও পাওয়া গেছিল কিছু অনুরূপ খাবার। পরীক্ষা করে দেখে হয়েছে, এই কুকিজগুলো তৈরি হয়েছিল আটা দিয়ে। আটায় তৈরি খাস্তা বিস্কুটে মিশেল দেওয়া হয়েছিল আঙুরের। তারাপান অঞ্চলের অসাধারণ জল-সিঞ্চন ব্যবস্থার জন্য প্রাচীন সময় থেকেই এখানে গম ও আঙুর চাষের সহাবস্থান ছিল। তাই সে-সময় কুকিজের প্রচলন ছিল ভালো বেকারির হাত ধরেই। আর এই বেকারি শুধু খাবার প্রস্তুত করেই ক্ষান্ত ছিল না। সেগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করে উপস্থাপনা করতে তুলতে সিদ্ধহস্ত ছিল।
টুইটারে এইসব ছবি দেখে জানার পর নাদিম আহমেদ নামের একজন এই খাবারগুলো তৈরি করতে উদ্যোগী হন। নাদিম আহমেদ একটি ইতিহাস সম্পর্কিত সংস্থা ‘ইরান-উদ-তুরান’-এর প্রতিষ্ঠাতা। এই সংস্থা বিগত দিনের ইতিহাসকে জীবন্ত রূপ দিতে বা পুনরুদ্ধার করতে চেষ্টা করে। এরা কাজ করে বিশেষ করে প্রাচীন শিল্পকর্ম, পোশাক-আশাক এসব নিয়ে। মূলত মধ্যযুগীয় সময়, বিশেষ করে সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীকাল এদের মূল বিচার্য।
নাদিম আহমেদ তুরপানে গিয়ে অনেক খোঁজখবর নিয়ে, কুকিজ খেয়ে খানিক তুরপানি আঙুর সঙ্গে নিয়ে ফিরেছিলেন। তারপর বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় তৈরি করেছিলেন তুরপানি ধাঁচের কুকিজ। নীচে রইল তুরপানি কুকিজ তৈরির রেসিপি। যা লাগবে (দু-ডজন কুকি তৈরি করতে)
১ কাপ মাখন, ১ কাপ চিনি, ১টা ডিম, ২ কাপ আটা, ১২টা বেগুনিরঙা আঁটি ছাড়া বড়ো আঙুর অথবা ২৪টা ছোটো আঙুর, ২ চা চামচ খুবানি (অ্যাপ্রিকট) জ্যাম।
বানানোর পদ্ধতি
১) মাখন আর চিনি মেশান। নাড়াতে থাকুন যতক্ষণ না চিনির প্রতিটি দানা গলে মাখনের সঙ্গে মিশে যায়। এবার এই মিশ্রণে একটা ডিম ফাটিয়ে ভালোভাবে মেশান।
২) এবার এই মিশ্রণ দিয়ে আটাকে মাখুন যতক্ষণ না হলদেটে ভাব ফুটে ওঠে। তারপর একে রেফ্রিজারেটারে আধঘণ্টা রেখে দিন।
৩) ভালো করে আঙুরগুলো ধুয়ে আধাআধি কেটে ফেলুন লম্বা ও বড়ো হলে। আর ছোটো হলে গোটা রেখে দিন। তারপর খুবানি জ্যাম দিয়ে আঙুরগুলো মুড়ে এক-একটা বল বানিয়ে রাখুন।
৪) রেফ্রিজারেটার থেকে আটার মিশ্রণ বের করে চব্বিশটা দলা বানিয়ে তার ভেতর একটা করে আঙুরের বল ভরে গোল্লা পাকান। দেখবেন যেন এক-একটা গোল্লা ইঞ্চি খানেক পুরু হয়।
৫) এবার ওভেনকে ৩৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় গরম করুন।
৬) মাখন লাগানো বেকিং নেট বা সিলিকন প্যাডের ওপর কুকির বলগুলো রেখে সেগুলোর ওপর চারকোনা দাগ কেটে, কুকিগুলোকে আঙুলের সাহায্যে তারা বা আপনার ইচ্ছেমতো আকৃতি দিন। তারপর কুকির মাঝখানে বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিন যাতে করে ময়দার দলা বাইরের দিকে ফুলে থাকে।
৭) তারপর প্রতিটি কুকির ওপর আঙুরের টুকরো রেখে খানিক খুবানি জ্যাম ছড়িয়ে দিন।
৮) এরপর ১২ থেকে ১৫ মিনিট বেক করুন যতক্ষণ না কুকিগুলোর রঙ সোনালি হয়।
তাহলে আর দেরি কেন, বানিয়ে জয়ঢাকে পাঠিয়ে দিন আপনার তৈরি কুকিজের ছবি!
ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
বিচিত্র দুনিয়া সমস্ত লেখা একত্রে