অরিন্দম দেবনাথ এর সমস্ত লেখা
শুধুমাত্র জাদুকরদের উপদ্রবে ব্রিটিশরা বন্ধ করে দিয়েছিল আফ্রিকার একটি অংশে বহিরাগতদের প্রবেশ। নিষিদ্ধ হয়েছিল সে অঞ্চল বহুদিন। অধুনা সবার জন্য সেই অঞ্চল উন্মুক্ত হলেও সেই অঞ্চলের মানুষজন এখনও বিশ্বাস করেন জাদুটোনায়। লিখেছেন অরিন্দম দেবনাথ।
চিয়েঙ্গি (Chiengi) চার্লি ছিল একটা লেজকাটা সিংহ। কী করে যে ওর লেজটা কেটেছিল কেউ জানে না। সিংহটা ছিল অ্যালবিনো। ওর গায়ের হালকা ধুসর রঙের জন্য ওকে সাদা সিংহ বলে ডাকত। ১৯০০ সাল থেকে সে হয়ে উঠেছিল চিয়েঙ্গির ত্রাস। এই সাদা সিংহটা চার্লি নামে পরিচিত ছিল। শুধু তাই নয়, দু-দুটো সাগরেদ জুটিয়ে নিয়েছিল সে। ১৯০৯ সালে এই সিংহটাকে গুলি করে মারার আগে সে ১০০-র বেশি মানুষকে মেরে খেয়ে ফেলেছিল।
চার্লির কথা বলার আগে খানিক চিয়েঙ্গির কথা বলা যাক।
চিয়েঙ্গি জাম্বিয়ার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে লেক মাওয়েরুর ধারে একটি জেলা। চিয়েঙ্গি জাম্বিয়া-কঙ্গো দেশের সীমানাও বটে। মূলত বিউইলি (Bwile) উপজাতির মানুষের বাস এখানে। জাম্বিয়ার আগের নাম ছিল রোডেশিয়া। রোডেশিয়ার লুয়াপুলা আর উত্তরের প্রদেশগুলো, যেমন চিয়েঙ্গি আর মুনুঙ্গার কুখ্যাতি ছিল শক্তিশালী ডাইনি ও জাদুকরী বিদ্যার জন্য। এদেরই রাজ চলত এখানে। একসময় এই অঞ্চলে নাকি বাস করত উটুইয়াবেলা আর উটুম্বুমা নামের ভয়ংকর দুই শয়তান জাদুকর। এই অঞ্চলের মানুষদের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই দুইজন। মুনুঙ্গা আর চিয়েঙ্গির জাদুকর এই দেশের সবচাইতে শক্তিশালী বলে বিবেচিত হত। কথিত যে চিয়েঙ্গির সীমানায় ঢুকলেই নাকি ভয়ংকর একটি সাপের পেছন দেখা যেত। বুঝিয়ে দিত যে প্রবেশ করেছ নিষিদ্ধ অঞ্চলে।
এই জাদুকররা নাকি মাদুরে চেপে উড়ে বেড়াত। বা এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় যেত বিশাল কুলোয় চেপে, ঝাঁটার দু-পাশে পা ঝুলিয়ে কিংবা বাদুড় বা প্যাঁচার পিঠে চেপে। বা হঠাৎ করেই শূন্য থেকে উপস্থিত হত। এই জাদুকররা ঘুরে বেড়াত এক গ্রাম থেকে এক গ্রামে। কেউ তার কোনও শত্রু নিধন করতে চাইলে এদের কাছ থেকে বজ্রপাত ঘটানোর পাত্র কিনতে পারত বা শত্রুকে মারার জন্য মারণ মৌমাছি কিনে সেটাকে একটা খামে ভরে পাঠিয়ে দিত শত্রুর কাছে। অথবা বাদুড়, প্যাঁচা বা বেড়াল কিনত শত্রুর ওপর নজরদারি করার জন্য। মহিলাদের কাছে জনপ্রিয় ছিল মন্ত্রপড়া বিশেষ মাদুলি। এই মাদুলি গলায় পরলে কোনও শত্রুই নাকি কিছু করতে পারত না। চোর-ডাকাতরা এই জাদুকরদের কাছ থেকে হামেশাই অদৃশ্য হয়ে থাকার মাদুলি কিনত। ওরা বিশ্বাস করত, মন্ত্রপূত মাদুলি পরলে গৃহস্থ এবং পুলিশ ওদের দেখতে পাবে না। আর এই মাদুলি ওদের পুলিশের গুলি থেকেও বাঁচাবে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা এরকম বহু ঘটনা নথিভুক্তও করেছেন। এই বিশ্বাসগুলো যে সত্য ছিল তার প্রমাণ পুলিশ বহুবার পেয়েছে। ধরা পড়া বা পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া ডাকাত বা চোরদের গলায় এই মন্ত্রপূত মাদুলি আর বিশেষ ধরনের ট্যাটুর চিহ্ন দেখা যেত।
চিয়েঙ্গি প্রদেশের জাদুবিদ্যা, কুসংস্কার আর অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলোর জন্য ব্রিটিশ অফিসারদের কেউই এখানে পোস্টিং নিতে চাইত না। থাকতে চাইত না গাছের মোটা মোটা গোড়া দিয়ে বানানো পাঁচিল আর তার ওপর তারকাঁটা জড়ানো উঁচু ‘বোমা’-র ঘেরটোপের ভেতরও। এখানে কেউ গেলে নাকি আর বেঁচে ফিরে আসত না। এই অঞ্চলে বহিরাগত অসংখ্য ব্যক্তি মারা গেছেন—প্রতি মৃত্যুর পিছনেই নাকি ছিল ডাইনি ও জাদুকরদের হাত।
নথিভুক্ত প্রথম মৃত ব্যক্তির নাম পর্তুগিজ অভিযাত্রী তথা চিকিৎসক ফ্রান্সিসকো দে লাসারদা। ১৭৯৮ সালে চিয়েঙ্গির দক্ষিণে কাজেম্বেতে রহস্যজনকভাবে মারা যাবার আগে তিনি নাকি চিয়েঙ্গির মুনুঙ্গার এক গ্রামে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিংবদন্তি এই গ্রামটি চিয়েঙ্গির ডাকিনি ও জাদুবিদ্যার মূল কেন্দ্র। আর এই গ্রামে বছরে একবার ডাকিনি ও জাদুকরদের বাৎসরিক সম্মেলন হয়। তখন এই গ্রাম হয়ে যায় পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সেইদিন নাকি ফ্রান্সিসকো দে লাসারদা ওই গ্রামে গিয়েছিলেন।
১৮৯৫ সালে বেলজিয়ানদের হটিয়ে রোডেশিয়াতে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি স্যার হ্যারি জনস্টোন দুজন এজেন্ট কিড আর বেইনব্রিজকে চিয়েঙ্গির মাওয়েরু লেকের ধারে পাঠান দুর্গ বানানোর ব্যবস্থা করতে যাতে সেখানে সৈন্য পাঠানো যায়। দুজনেই অচিরে মারা গিয়েছিল। সম্ভবত বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছিল ওই দুজনকে। যদিও গুজব ছড়িয়েছিল, জাদুকরদের অভিশাপে মারা গেছিল দুজন। এদের কবর ঘিরে কালুংবিশিতে একটি বোমা তৈরি করা হয়েছিল।
এরপর একের পর এক অভিশপ্ত রহস্যজনক মৃত্যু আর অসুস্থতার ঘটনা ঘটতে থাকে। ফলস্বরূপ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ চিয়েঙ্গি প্রদেশের বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের পর আবার চিয়েঙ্গির ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ‘বোমা’ গুলো খোলা হতে থাকে। কিন্তু একের পর এক ঔপনিবেশিককারী ‘বাওয়ানা ভিকটিম’-এর শিকার হতে শুরু করে। এক নবনিযুক্ত জেলা কমিশনার রিয়ারডন ও তাঁর স্ত্রী পাগল হয়ে যান। পরে এঁদের ঠাঁই হয়েছিল ইংল্যান্ডের এক মানসিক আশ্রমে। শোনা গিয়েছিল, স্থানীয় এক প্রধানের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে তাঁদের জাদু করা হয়েছিল। ১৯২৭ সালে অন্য এক জেলা কমিশনার জি.এইচ. মর্টন ভূত দেখেছেন বলে রিপোর্ট করেছিলান। ইনিও উন্মাদ হয়ে গেছিলেন। এঁকে পাঠানো হয়েছিল কেপ টাউনের এক মানসিক হাসপাতালে। ১৯২৯ সালে মর্টনের পদে আসা জি.এইচ. হোয়ারে ভূতের চিৎকারে সাংঘাতিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর চিয়েঙ্গির সব ঔপনিবেশিক বোমা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মূল কারণ স্নায়বিক ও মানসিক ভাঙন হলেও, বোমা বন্ধ করার অফিসিয়ালি কারণ হিসেবে ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরজনিত মৃত্যু ও অসুস্থতা দেখানো হয়। ১৯৭৩ সাল থেকে চিয়েঙ্গির আংশিক জায়গায় যাবার অনুমতি মেলে। ১৯৯৬ সালে চিয়েঙ্গি পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয় সবার জন্য।
আসা যাক চিয়েঙ্গির সিংহের কথায়।
লেজকাটা সিংহের নামে ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছিল চিয়াঙ্গি আর লেক মাওয়েরুর আশেপাশের জনগণ। ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দারা ধরে নিয়েছিল, এই সিংহ কোনও সাধারণ সিংহ নয়, কোনও অশুভ আত্মা ভর করেছে সিংহটাকে। কারণ, এত ধূর্ত আর বুদ্ধিমান কোনও জন্তু হতে পারে না। অভিজ্ঞ সাদা চামড়ার শিকারিরা পর্যন্ত টিকি ছুঁতে পারেনি পারেনি সিংহটার। বন্দুক হাতে সাদা চামড়ার শিকারিদের বুদ্ধু বানানো সোজা নয়! চার্লি নামের সিংহটাকে হত্যা করার একের পর এক অভিযান ব্যর্থ হচ্ছিল, আর সে মহানন্দে মানুষ মেরে খেয়ে চলছিল। একবার তো ডিসট্রিক্ট অফিসার সিলির বাড়ির উঠোনে লাফিয়ে নেমেছিল; সিলি গুলি করার আগেই সে অবশ্য পালিয়ে যায়। চার্লির ত্রাস থেকে বাঁচতে গ্রামবাসীরা চারপাশে আগুন জ্বেলে ঘুমিয়ে থাকত; সারারাত জেগে পাহারা দিত, তবুও তার মধ্যে থেকে মানুষ তুলে নিয়ে চলে যেত চার্লি। চৌকস সিংহটা ছিল ভয়ডরহীন, আর অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে কাজ সারত। মাটির দেওয়াল ভেঙে, খড়ের চালা ফুঁড়ে দিনের বেলা ঘরের ভেতর থেকে শিকার মুখে তুলে নিত।
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো গ্রামবাসীর আতঙ্ক বাড়াতে দুটো সিংহ যোগ দিয়েছিল চার্লির সঙ্গে। সিংহের দৌরাত্ম্যে স্থানীয় মাছের ব্যাবসা প্রায় ধ্বংস হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছিল। বহু গ্রামবাসী এই অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে গেছিল। তিন সিংহ মিলে নাকি নয় বছরে একশোর বেশি (নথিভুক্ত নয়) মানুষ মেরে ফেলেছিল। সবচাইতে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছিল এক সাদা শিকারির ভাগ্যে। শিকারিকে আঘাতে জর্জরিত করে তার বন্দুকধারী চাকরটাকে পর্যন্ত মেরে ফেলেছিল চার্লি।
শুধু একজনের সাহসিকতার কাছে হার মেনেছিল চার্লি। এক ঘুমন্ত মহিলার ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েছিল চার্লি। মহিলা চোখের সামনে মূর্তিমান যমকে দেখে ভয় না পেয়ে ঘরের কোণে আগুনে জ্বলতে থাকা একখণ্ড কাঠ তুলে ঠুসে দিয়েছিলেন চার্লির মুখের ভেতর। আধখানা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল সবরকম ফাঁদ এড়িয়ে যাওয়া, বাঘা বাঘা মার্কসম্যানদের বোকা বানিয়ে যাওয়া চিয়েঙ্গির ত্রাস।
এরপর গ্রামবাসীদের একজোট করে সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশ এবং বেলজিয়ানদের একটি পেশাদার শিকারি দল আহত সিংহটাকে কোণঠাসা করে হত্যা করে। চার্লি বধের পর ওর দুই সাগরেদ সিংহ দুটোর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। শিকারিরা গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে, যাকে তারা এতদিন চার্লি বলে ডাকত, আসলে তার নাম হবে চালি। ব্রিটিশ প্রশাসকরা ওর নাম ভুল উচ্চারণ করছিল। চালি ছিল এক দুষ্টু জাদুকর, যার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গ্রামবাসীরা অনেক আগেই ওকে মেরে ফেলেছিল। আর সেই ধূর্ত শয়তান চালির আত্মাই নাকি ভর করেছিল সিংহটার ওপর। হত্যার প্রতিশোধ নিতে সিংহের রূপে একের পর এক মানুষ খুন করে গেছে।
আবার ফিরে আসা যাক চিয়েঙ্গির প্রসঙ্গে।
২০১৯ সালে পাঁচজন ফুটবল খেলোয়াড় যুবক মিলে চিয়েঙ্গির এক মাঠ পরিষ্কার করছিল ফুটবল খেলবে বলে। আচমকা এক বজ্রপাতে পাঁচজনেরই মৃত্যু হয়। রটে যায়, ওই যুবকরা এক জাদুকরের কবরস্থলে ফুটবল খেলার মাঠ তৈরির চেষ্টা করছিল। বিশ্রামে আঘাত ঘটাতে জাদুকর রুষ্ট হয়ে পাঁচজনকে মেরে ফেলেছে। কোনও অনভিপ্রেত মৃত্যু হলেই তার পেছনে জাদুবিদ্যার হাত বলে রটনা শুরু হতে শুরু করল।
মওয়ানসাবোম্বেতে (Mwansabombwe) একটি জাদুকরী যাদুঘর রয়েছে। যারা এই যাদুঘর পরিদর্শন করেছেন, তারাও কিছু অদ্ভুত ঘটনার কথা বলেছেন। যেমন, একজন সাংবাদিক দাবি করেছেন যে যাদুঘরের ভিতরে তাঁর তোলা সমস্ত ছবি সাদা এসেছে। কিছুই ওঠেনি।
জাদুবিদ্যার বেশিরভাগ গল্পই অন্ধবিশ্বাস। অতিকথার মোড়কে মোড়ানো। বর্তমান চিয়েঙ্গি মাওয়েরু লেককে ঘিরে গড়ে ওঠা আজ এক সুন্দর গ্রামীণ জেলা। বেশিরভাগ অধিবাসীই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত। এরা সকালে চার্চে যায়, বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নিয়ে যায়, জাদুবিদ্যা নিয়ে প্রায় কথাই বলে না। কিন্তু রাতের আঁধার ঘনালেই লুকিয়ে ছোটে গুণিনদের কাছে। এখানকার আদি বাসিন্দাদের ডাকিনিবিদ্যার প্রতি বিশ্বাস প্রায় অবিচল আছে। এরা এখনও ভরসা রাখে ঘাতক মৌমাছিতে, গুপ্তচর পেঁচা ও বেড়ালে; মাদুলি কিংবা বজ্রপাত ঘটানোর পাত্রে।
ছবি – ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত