বিচিত্র দুনিয়া-ঘুড়ির টানে-অরিন্দম দেবনাথ-শরত ২০২১

 অরিন্দম দেবনাথ   এর সমস্ত লেখা

bichitraghuri01

ছোটবেলায় ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে অনেক বকা খেয়েছি। মাঞ্জায় হাত কেটেছে প্রচুর। এখনও আকাশে ঘুড়ি উড়তে দেখলে হাতটা নিশপিশ করে ওঠে। ঘুড়ির টান বড়ো সাংঘাতিক। ঘুড়ি আর শুধু আকাশে খেলার একচিলতে কাগজের টুকরো নয়। ঘুড়ি বা বাতাসের শক্তি বিপ্লব এনে দিয়েছে অ্যাডভেঞ্চার দুনিয়ায়। লিখেছেন অরিন্দম দেবনাথ

পোলার গাইড কার্ল অ্যালভে তাঁর দুই ক্ল্যায়েন্ট, এক ডাক্তার ও এক ব্যাঙ্কারকে নিয়ে যখন হেলিকপ্টার থেকে মেরু সাম্রাজ্যের আইস ক্যাপের ধূসর বরফের ওপর নামছেন, তখনও হেলিকপ্টারের ব্লেড তার ঘোরা বন্ধ করেনি। ঝিরঝির করে বরফ ঝরেই যাচ্ছে অবিরত, সঙ্গে চলছে জোরালো হাওয়া। ক্লপ-ক্লপ-ক্লপ শব্দ করে ধীরে ধীরে ঘুরেই চলেছে খুদে হেলিকপ্টারের ব্লেড তিনটে। পাইলট ঠান্ডার রাজ্যে কোনোভাবেই ইঞ্জিন বন্ধ করতে চান না। ইঞ্জিন বন্ধ করলে তা অনেক সময় আবার চালু করা কঠিন হয়ে পড়ে। হেলিকপ্টারের পেট থেকে মালপত্র নামাতেই হেলিকপ্টার উড়ে চলল নরসাক শহরের দিকে, যেখান থেকে অভিযাত্রীরা হেলিকপ্টারে চড়েছিলেন। আর অভিযাত্রীরা তাঁদের সঙ্গে আনা স্লেজে মালপত্র তুলতে শুরু করলেন। ২০২০-র রেকর্ড অনুসারে নরসাকের লোকসংখ্যা মাত্র ৬৬! এই রইল টেবিল। এতে দেখা যাচ্ছে ক্রমহ্রাসমান এই শহরের লোকসংখ্যা।

bichitraghuri02

আন্টার্টিকা মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপটি, উত্তর থেকে দক্ষিণে ১৬৬০ মাইল লম্বা। আর পুব থেকে পশ্চিমে ৬৫০ মাইল চওড়া। দ্বীপের তিন ভাগের দু-ভাগই রয়েছে মেরুবৃত্তের মাঝে। দ্বীপের উত্তর অংশের থেকে উত্তর মেরু মাত্র ৫০০ মাইল দূরে। দ্বীপের তটরেখা প্রায় ২৭০০০ মাইল লম্বা। দ্বীপের অধিকাংশ বাসিন্দাই ইনুইট – এস্কিমো, আর দ্বীপটির পাঁচ ভাগের চার ভাগ অংশ পাঁচ হাজার ফুট পুরু বরফের চাদরে ঢাকা। কোথাও কোথাও এই চাদরের ঘনত্ব দশ হাজার ফুটেরও বেশি। দ্বীপের বাকি অংশ মূলত তুন্দ্রা অঞ্চল। সামান্য কিছু গুল্ম আর ঘাসে ঢাকা। শুধু গ্রীষ্মকালে বরফমুক্ত থাকে এই তুন্দ্রা অঞ্চল, তখন জল গলে এই জায়গাগুলো জলে জলময় হয়ে ওঠে।
bichitraghuri03

প্রচলিত মত অনুযায়ী, এরিকসন নামে আইসল্যান্ডের এক ব্যক্তি খুনের অপরাধে দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে নৌকায় কিছু ভেড়া আর স্ত্রী-সন্তানদের চাপিয়ে ভাসতে ভাসতে এসে বহু বহু বছর আগে পৌঁছেছিলেন এই দ্বীপে। তখন ছিল গরমকাল। যেখানে এসে নেমেছিলেন সে জায়গাটা ছিল সবুজ গুল্মে ঢাকা। ভেবেছিলেন বরফের দেশ থেকে তিনি এসে পৌঁছেছেন সবুজের রাজ্যে। নতুন জায়গাটার নাম দিয়েছিলেন গ্রিনল্যান্ড। নরসাক গ্রিনল্যান্ডেরই একটি শহর।
এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত গ্রিনল্যান্ডে পৌঁছানোটাই ছিল একটা বিপজ্জনক অভিযান। এখনও সহজে গ্রিনল্যান্ডে যাওয়া যায় না। হয় জাহাজে যেতে হয়, না হয় ডেনমার্ক বা আইসল্যান্ড হয়ে বিমানে যেতে হয়। মাত্র ছ’টি বিমানবন্দর আছে গ্রিনল্যান্ডে।
অ্যাটলান্টিক ও আর্কটিক মহাসাগরের মাঝের এই দেশটাতে মাত্র হাজার ৫৭ (২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী) মানুষের বাস। এঁদের ৮৮ শতাংশই ইনুইট। আর বাকি ১২ শতাংশ মূলত আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ফিলিপাইন, সুইডেন, নরওয়ে ও ডেনমার্কের লোক। কিছু জার্মানও বাস করেন এই দেশে। দেশের ৯০ শতাংশ বাসিন্দা দেশের ১৬টি শহরে বাস করে আর ১০ শতাংশ মানুষ থাকে ঠিক পূর্বসূরিদের মতো বরফঘরের ইগলুতে, বলগা হরিণ আর কুকুরে টানা স্লেজে ভরসা করে। গ্রীষ্মকালে উপকূল অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও শীতকালে তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের বহু নীচে। মূলত মাছ আর মাংস খেয়েই বেঁচে থাকে এই বরফদেশের বাসিন্দারা।
প্রকৃতি কঠিন হলেও প্রাকৃতিক ধনসম্পদের দিক থেকে গ্রিনল্যান্ড অতি সমৃদ্ধ। চোখ ঝলসানো সাদা বরফের আস্তরণ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, ওই বরফের তলায় রয়েছে সোনা, হীরা, রুবি, নিকেল, কপার ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জলবায়ু পরিবর্তনে দ্বীপটি ঢেকে রাখা বেশিরভাগ হিমবাহ গলতে শুরু করে। আত্মপ্রকাশ করে গ্রিনল্যান্ডের রত্ন-পাথর সমৃদ্ধ ভূমি। ২০১০ সালে গ্রিনল্যান্ডের খনিজ কোম্পানি ‘অ্যাঞ্জেল মাইনিং’ প্রথম রত্ন-ভাণ্ডার নিয়ে কাজ শুরু করে। ২০১৭ সালে প্রায় ৫৬টি অনুসন্ধানকারী দলকে অনুসন্ধানের অনুমোদন দেয় দেশটির সরকার। সরকারি তথ্যমতে, দেশটির উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে অকিক (মূল্যবান মণিরাজি), দামি পাথর এবং অ্যালমেনডাইন। পশ্চিমে রয়েছে রুবি, হীরা, পান্না, নীলকান্ত মণি সহ অনেক নামিদামি পাথর। দক্ষিণ-পশ্চিমে পাওয়া যায় টাগটুপাইট, অ্যামাজোনাইট, নীলা, চন্দ্রকান্ত মণি, সোডা লাইট, ল্যাবরাডোরাইট খনিজ সম্পদ ও পূর্ব গ্রিনল্যান্ডের জমিন জুড়ে রয়েছে করান্ডাম, অকিক এবং দামি সব পাথর। বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ ইউরেনিয়াম খনি তৈরির পরিকল্পনা করা হয় এই দেশে ২০১৩ সালে। এর কিছুদিন আগে দেশটির সরকার সংসদীয় অধিবেশনে ইউরেনিয়াম খনির ওপর নিষেধাজ্ঞা অপসারণের পক্ষে ভোট দেয়। ‘ব্লুজে মাইনিং’ গ্রিনল্যান্ডের স্থানীয় কোম্পানি ‘ডুন্ডাস’কে সঙ্গে নিয়ে খনিজ সংগ্রহে আগ্রহ প্রকাশ করে। তিন বছর পর ২০১৮ সালে সরকার খনিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়। কিছু কোম্পানি ইতিমধ্যে তার সুফলও পায়। ড্যানিশ কোম্পানি হার্টম্যানস গ্রিনল্যান্ডিক রুবি-নীলকান্ত মণি ব্যবহার করে তাদের জুয়েলারি তৈরি করে।
মূল ভূমির পুরু বরফের আস্তরণের উপরিতলের তুলনায় পাহাড়ি তটভূমির বরফ অজস্র ফাটলে ভরা। গ্রিনল্যান্ডের অধিকাংশ জনবসতি গড়ে উঠেছে পশ্চিম উপকূলরেখা বরাবর। কারণ, এই অংশ তুলনায় উষ্ণ। আর এই পশ্চিম তটরেখাই হল অতি উৎসাহী অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য—যারা জীবনের একদম অন্য স্বাদ পেতে চান, মৃত্যুকে দেখতে চান হাতের মুঠোয়। প্রকৃতির কাঠিন্যের সঙ্গে যুঝে নিজের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার পরীক্ষা নিতে চান।
এই অ্যাডভেঞ্চার পরিচিত রোমাঞ্চযাত্রা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পরিচিত ট্রেকিং রুট বা কিছু পাহাড় চূড়ায় ওঠার মতো প্রচলিত অধুনা রুট এখনও নেই মেরু সাম্রাজ্যে। এখানে প্রতি পদে বিপদ লুকিয়ে। তাপমাত্রা প্রায় সবসময় থাকে হিমাঙ্কের ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে। যদিও আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বরফ-রাজ্যে পথ হারানোর সম্ভবনা কম, কিন্তু প্রকৃত অ্যাডভেঞ্চার তো আর হেলিকপ্টারে চড়ে মরু প্রদেশের ওপর আকাশ থেকে চক্কর কাটা নয়। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা এখানে আসেন বরফের মাঝে মাইলের পর মাইল দূরত্ব শারীরিক শক্তিতে অতিক্রম করতে। নিজের মালপত্র নিজেকেই স্লেজে চাপিয়ে টানতে হয়। বরফ গলিয়ে নিজের খাবার নিজেকেই বানাতে হয়। প্রতিমুহূর্তে তুষারক্ষত হবার ভয়। ভয় বরফের চোখ ধাঁধানো আলোর বিকিরণে দৃষ্টি হারানোর। খানিক চলার পর হাঁফ ধরা। তুমুল গতিতে বয়ে চলা হাওয়া। পদে পদে বরফ খাদ… অগুনতি প্রতিবন্ধকতা। শুধু প্রকৃতির থেকেই নয়, প্রকৃতির আরও বাসিন্দাদের থেকে। মেরু ভালুকের আস্তানা এই পশ্চিমতট।
বিংশ শতকের সাত দশক নাগাদ গ্রিনল্যান্ড, নরওয়ে এসব উত্তর গোলার্ধের দেশে শুরু হয় একের পর এক নিত্যনতুন রোমাঞ্চকর অভিযানমূলক তুষারদেশের খেলা। তার মধ্যে কুকুরে টানা স্লেজ বা স্কি করে নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করা সবচাইতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এগুলো একধারে যেমনি ছিল অজানা তুষার সাম্রাজ্যের রূপরস খুঁজে করার অভিযান, তেমনি অনেক তথ্য উঠে এসেছে এক-একটি অভিযান থেকে। বিশেষত্ব মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে। গ্রিনল্যান্ড এমনিতেই অতি আত্মহত্যাপ্রবণ দেশ। দিনের পর দিন চোখের সামনে শুধু সাদা আর সাদা। মাইলের পর মাইল ধু-ধু বরফের মরুভূমি। কোনও কথা বলার লোক নেই। একাকিত্ব এক কঠিন রোগ। গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নুকের স্কুলের দেওয়াল বা বাসস্টপগুলোতে বড়ো বড়ো করে লাগানো সরকারি পোস্টার দেখতে পাওয়া যায়। তাতে একটি বিশেষ ফোন নাম্বার দেওয়া আছে। পাশে লেখা ‘নিখরচায় ফোন করুন। আমারা কেউ একা নই। অন্ধকার চিন্তায় একা মগ্ন থাকবেন না। ফোন করুন, আমরা সবাই সবার পাশে আছি।’

bichitraghuri04

১৯৯৫ সালে গ্রিনল্যান্ড ও মেরুবৃত্তের অভিযানগুলোতে আমূল পরিবর্তন এল ঘুড়ির হাত ধরে। অভিযাত্রীরা স্লেজ-বোঝাই মালপত্র টানতে কুকুরের পরিবর্তে ঘুড়ির ব্যবহার শুরু করলেন।
অনেক প্রযুক্তিগত চিন্তাভাবনার ফসল এই ঘুড়ি প্রথম প্রথম ব্যবহৃত হত মূলত সমুদ্রে সার্ফিং করতে। হালকা অথচ শক্ত ফয়েল বা রিপস্টপ নাইলন কাপড়ের সঙ্গে হালকা কিন্তু ভীষণ শক্তিশালী নমনীয় কার্বন ফাইবারের ফ্রেমে জোড়া সাড়ে তিন থেকে পনেরো বর্গ মিটার আয়তনের ঘুড়ি একজন পূর্ণবয়স্ক সার্ফবোট পায়ে লাগানো মানুষকে জলের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম। ঢেউয়ের মাথায় চড়ে দক্ষ সার্ফার রীতিমতো আকাশে উড়েও থাকেন ঘুড়িতে চড়ে। মানুষের ওজনের ওপর নির্ভর করে কত বড়ো ঘুড়ি কে ব্যবহার করবেন।
ঘুড়ি ছোটো-বড়ো মাপের হলে বিপদ ডেকে আনতে পারে। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী একটি ঘুড়ির দাম কুড়ি হাজার টাকা থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা।

bichitraghuri05

ঘুড়ি দিয়ে একসময় গাড়ি চালাবার চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু ঘুড়ি বাতাসের গতির উপর নির্ভর করে বলে সে চেষ্টা সফল হয়নি। কিছু বছর আগে পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীতে ঘুড়িতে চাপিয়ে বাহিনীর কাউকে সমুদ্র-কিনারার আকাশে উঠিয়ে দেওয়া হত সমুদ্রে বিভিন্ন জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য। বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া দপ্তর আকাশে ঘুড়ির সাহায্যে যন্ত্রপাতি উড়িয়ে আবহাওয়া সংক্রান্ত নানা তথ্য সংগ্রহ করত।

bichitraghuri06স্লেজের আগে ঘুড়ি জুড়ে দীর্ঘ পথ বরফ সাম্রাজ্যে পাড়ি দেবার প্রথম অভিযান তথা পরীক্ষা চালান চার অভিযাত্রী রামন লারামেন্দি, জুয়ান ম্যানুয়েল নারানজো, জুয়ানিটো ওয়ার্জাবাল এবং জুয়ান ভাল্লেজো ২০০০ সালের আগস্ট মাসে। গ্রিনল্যান্ডের ২৮০০ মিটার উচ্চতার নরসারসুয়াক থেকে শুরু হয়ে ৬০০ কিলোমিটার পথ বরফ মরুতে পাড়ি দিয়ে অভিযান শেষ হয়েছিল কেঞ্জার্লুসুয়াকে। একটি টেলিভিশন কোম্পানির অর্থানুকূল্যে সেই অভিযানের নাম ছিল ‘অ্যাট দ্যা এজ অফ ইম্পসিবল।’ সঙ্গে টিভি ক্রুর দলও ছিল অন্য একটি স্লেজে।
এই অভিযানের স্লেজের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘পোলার ক্যাটামারেন্স’। ঠিক স্লেজ নয়, একটি স্লেজের বহর। পাঁচটা করে স্কি পাশাপাশি রেখে তার ওপর পাইন কাঠের টুকরো জুড়ে তৈরি হয়েছিল এক-একটি স্লেজ। এরকম চারটি স্লেজ জুড়ে তৈরি হয়েছিল একটি ভ্রাম্যমাণ ক্যারাভ্যান।
bichitraghuri07প্রথমটিতে চালক সহ এক সঙ্গী, দ্বিতীয় ও তৃতীয়টিতে অভিযানের মালপত্র সহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম আর চতুর্থ স্লেজে একটি খাটানো তাঁবু। যখন দুই আরোহী ঘুড়ির টানে স্লেজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তখন দলের বাকি দুজন পেছনের তাঁবুতে বিশ্রামে। চারটে স্লেজের ওপরই সোলার প্যানেল লাগানো হয়েছিল বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম চালানোর বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য। নিশীথ সূর্যের দেশে সূর্যের আলো প্রায় নিরবচ্ছিন্ন। কাজেই বিদ্যুৎ পাবার কোনও সমস্যা ছিল না। এক-একটি ক্যাটামারেনের মালপত্র সহ ওজন ছিল ৪৫০ কেজি।
প্রথমে হেলিকপ্টারে করে মালপত্র সহ অভিযাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল ২৮০০ মিটার উঁচু হিমবাহের মাঝে। হেলিকপ্টার থেকে নেমে স্লেজ সাজিয়ে ঘুড়ির পালে হাওয়া লাগিয়ে অভিযাত্রীরা চলা শুরু করেছিলেন মেরুদেশের বরফ প্রান্তরে। ঠিক পাল-টানা ভেলার মতো ঝড়ো বাতাস টেনে নিয়ে যাচ্ছিল দুটো ক্যাটামারেনকে। বরফের মাঝে এ ছিল যেন অন্য এক ‘কনটিকি’ অভিযান। ঝড়ো হওয়া মাঝে-মাঝেই তুলে আছাড় মারছিল স্লেজগুলোকে। প্রথমদিন অভিযাত্রীরা ঘণ্টায় প্রায় তিরিশ কিলোমিটার গতিতে স্লেজ ছুটিয়েছিলেন। কিন্তু লম্বা দড়ির মাথায় ঝড়ো বাতাসে উড়তে থাকা ঘুড়ির দিক ঠিক রাখা যে কতটা কঠিন তা যে-কোনো ঘুড়িবাজ জানেন। কিন্তু এই ঘুড়ি আবার একটা সুতোতে বাঁধা থাকে না, থাকে দুটো দড়িতে বাঁধা। দুটো দড়ি বাঁধা থাকে একটা পোক্ত লাঠির দু-প্রান্তে। সেই লাঠি আবার শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা ক্যাটামারেনের সঙ্গে। জাহাজ বা নৌকোর পালকেও এই দড়ির টানে এদিক ওদিক করে নির্দিষ্ট অভিমুখে এগিয়ে যেতে হয়।

প্রথমদিন মোটামুটি নির্বিঘ্নে কাটলেও দ্বিতীয়দিন থেকে সমস্যা দেখা দিল। না, প্রকৃতি থেকে নয়। ঘুড়ির কাপড় ছিঁড়তে শুরু করল। ঘুড়ির সঙ্গে লাগানো দড়িও পাক খেয়ে খেয়ে জটিল করে তুলল তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। তারপর আচমকা শুরু হওয়া তুষারঝড়ে দুই ক্যাটামারেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ঘুড়ি নামিয়ে, বরফে খুঁটি পুঁতে দড়ির বাঁধনে বেঁধে কোনোরকমে নিজেদেরকে নিরাপদে রাখলেও ঝড় থামলে দুই ক্যাটামারেনের যাত্রীদের নিজেদের খুঁজে বের করতে লেগে গেল বহু সময়। তিনদিন এক জায়গায় থেমে থাকতে হয়েছিল ঘুড়ির ছিদ্র আর দড়ির পাক ঠিক করতে। তিনটে একসঙ্গে জোড়া স্লেজকে নরম তুষারের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। অজানা সাম্রাজ্যে আরও বিপদ ও আবার বিচ্ছিন্ন হবার থেকে বাঁচতে অভিযাত্রীরা একটা ক্যাটামারেনে চেপেই এগোতে মনস্থির করলেন। কিছু মালপত্র নামিয়ে হালকা করা হল একটা ক্যাটামারেন।

bichitraghuri08

যারা ঘুড়ি ওড়ান, তাঁরা ভালোই জানেন তাপ্পি মেড়ে ঘুড়ি ওড়ানোর সমস্যা। অনেক সময় একদিকে হেলে থাকে ঘুড়ি। তখন অন্যদিকে খানিক ওজন চাপিয়ে ঘুড়িকে খানিক ঠিকঠাক করতে হয়। ঠিক একই সমস্যা দেখা দিচ্ছিল এই বিশাল নাইলন কাপড়ে তৈরি ঘুড়িগুলো মেরামত করার পর।

এরপর অভিযাত্রীরা দখিনা বাতাসে এক-একদিনে যথাক্রমে ৬০, ৭০ ও ৯০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিলেন ঘুড়ির টানে। ভাগ্য ভালো, প্রায় সমতল হিমবাহে কোনও বড়ো ফাটল বা অন্য কোনও বাধার সামনে পড়তে হয়নি অভিযাত্রীদের। শুধু খানিক পরপর থেমে ঘুড়ি মেরামত করে যেতে হয়েছিল। আর ছাড়াতে হয়েছিল দড়ির পাক। ঝড়ো হাওয়ায় দুর্বার গতিতে এগোতে থাকা ওই বিশাল ঘুড়ি নামানোটাও খুব একটা সহজ ছিল না। এছাড়া ছিল নানা বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহের কাজ। শেষের দিন ঘুড়ির টানে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে নির্দিষ্ট অভীষ্টে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন অভিযাত্রীরা। দশদিন লেগেছিল অভিযাত্রীদের গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ তটের কাঙ্গেরলুসুয়াকে পৌঁছতে। ওখান থেকে হেলিকপ্টার ফেরত নিয়ে এসেছিল অভিযাত্রীদের।

bichitraghuri09

এই অভিযান থেকে বোঝা গেছিল যে মেরু প্রদেশে, যেখানে প্রায় সবসময় হাওয়া বয় ঝড়ের গতিতে সেখানে ঘুড়ি হতে হবে আরও মজবুত যা সহজে ছিঁড়বে না। আর যিনি ঘুড়ির দড়ি ধরে স্লেজের অভিমুখ ঠিক করবেন তাঁর বসার আসনও আরও উন্নত হবার দরকার। না-হলে উথালপাতাল হাওয়ায় বরফ মরুতে নৌকা (স্লেজ) চালানো দুরূহ। প্রতিমুহূর্তে হাওয়ার টানে দুরন্ত গতিতে ছোটা ঘুড়ির ঝাঁকুনি চালকের কোমর ভেঙে দিতে পারে। কানাডা ও ইউরোপের অন্য বরফক্ষেত্রে এই ঘুড়ি নিয়ে পরীক্ষা চালানোর সময় এটা বোঝা যায়নি। কারণ, সেখানে সর্বক্ষণ এত গতিতে হাওয়া বয় না। এই পর্যবেক্ষণের পর অভিযাত্রীরা যতক্ষণ না ঘুড়ি ও অনান্য বিষয়গুলিকে আরও উন্নততর করা সম্ভব হচ্ছে ততক্ষণ তাঁদের পরবর্তী ও মূল অভিযান আন্টার্টিকায় ক্যাটামারেন নিয়ে যাত্রা ‘অ্যাট দ্যা এজ অফ দ্যা ইম্পসিবল’ বাতিল করেন।

ঘুড়ির টানে স্লেজ চেপে মাত্র ৩২ ঘণ্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার গতিতে ৬০০ কিলোমিটার অতিক্রম করে অভিযাত্রীরা দূষণহীন মেরুযাত্রায় এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেন। খুলে যায় মরু অভিযানের এক নতুন পথ। দেখা যায়, একজন যখন স্লেজ চালাচ্ছেন তখন দলের বাকি সদস্যরা পেছনের তাঁবুতে দিব্যি বিশ্রাম নিতে সক্ষম। সবসময় স্লেজ চালানো যায় না। হওয়ার গতিমুখের ওপর অনেকটাই নির্ভর করতে হয়। এই রইল সেই অভিযানের খানিক ভিডিও।

এই ঘুড়িযাত্রার পর থেকেই একটা আলোড়ন পড়ে যায় অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী-কুলে। ঘুড়িতে চেপে মেরুপ্রদেশে অভিযানে যেতে উৎসুক হয়ে ওঠেন বিশ্বের অসংখ্য মানুষ। ঘুড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থার প্রকৌশলীরা উঠে পড়ে লাগেন ঘুড়িকে হালকা রেখে আরও মজবুত করে তুলতে। ঘুড়ির কাপড় যেন সহসা না ছিঁড়ে যায়। ঘুড়ির কাপড় এমন হতে হবে যা কম করে ১২০ কিলোমিটার গতির হওয়ার টান সামলাতে সক্ষম। পরীক্ষা চলতেই থাকে। তৈরি হতে থাকে নানা মাপের নানা অভিযানের জন্য ঘুড়ি। বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে আসেন অভিযান পরিচালনায়। মেরু অঞ্চলে অ্যাডভেঞ্চার টুরিজমে খুলে যায় এক নতুন দিগন্ত।
সময় গড়াতে থাকে, পরীক্ষা চলতে থাকে নানা স্তরে। দক্ষ গাইড তৈরি হতে থাকে, আসতে থাকে নানা নতুন চিন্তাভাবনা। অন্যদিকে ভেঙে চলে মেরু-বৃত্তের হিমবাহ, একটু একটু করে বেড়ে ওঠে সমুদ্রের জলতল।

bichitraghuri10

চমকপ্রদভাবে সৃষ্টি হয় ঘুড়িতে টানা স্কি অভিযানের ভাবনা। মেরু অঞ্চলের অধিকাংশ অভিযানেই অভিযাত্রীকে মালপত্র স্লেজ চাপিয়ে তা কোমরে বেঁধে টানতে হয়। পিঠে রুকস্যাক নিয়ে মাইলের পর মাইল ঝড়ো হাওয়ায় বরফের ওপর দিয়ে হাঁটা দুরূহ। একটু বেখায়াল হলেই বরফ-খাদে তলিয়ে যাবার ভয়। ভয় শরীরের যে-কোনো অংশে তুষারক্ষত হওয়ার। কিংবা সাময়িক অন্ধত্ব। মেরু ভালুকের এক থাপ্পড়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া। তুষারঝড়ে পড়ে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া। যদিও বর্তমান উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে বিশেষত ‘গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম’-এর কল্যাণে ধু-ধু বরফের সাম্রাজ্যে উদ্ধারকারী দলের সাহায্য পাওয়া অনেক সহজ হয়ে পড়েছে। হেলিকপ্টারে করে দক্ষ পাইলট নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যান দ্রুত। কিন্তু কোনও অভিযাত্রীই রেসকিউ টিমের সাহায্য নিতে চান না।
নরসাক থেকে কার্ল এবং তাঁর দুই ক্লায়েন্ট লাক্সেমবার্গের সার্জন প্যাট্রিক এবং অস্ট্রেলিয়ার ব্যাঙ্কার ক্রিস, আইস ক্যাপটি পেরিয়ে ২,৩০০ কিলোমিটার স্কি করার পরিকল্পনা করেছিলেন ২০১৯-এর মে মাসে। তাঁদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নারসাকের উত্তর-পশ্চিমের একটি খুদে এস্কিমো আবাস কানাআক-এ। বরফ দিয়ে আসল লোকেদের থেকে ইগুলু বানানোর কৌশল ঝালাতে। কে জানে লম্বা যাত্রায় যদি ইগলু বানানোর প্রয়োজন পড়ে! অতি ঠান্ডায় বা আবহাওয়া বিগড়োলে বরফ খুঁড়ে ঘর না বানালে প্রাণসংশয় হতে পারে। এখানকার বাসিন্দারা সবাই পোলার এস্কিমো। মেরুর কঠোর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ঠিক সেই আদিকালের মতোই। গ্রীষ্মে সিলমাছের তাঁবুতে বাস আর শীতে বরফ-ঘর ইগলুতে।
ঘুড়ির টানে মেরু ভ্রমণ একটি ধৈর্যের খেলা। দীর্ঘ যাত্রার প্রায় দুশো কেজির বিশাল লটবহর স্লেজে চাপিয়ে তা কোমরে স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে, পায়ে স্কি লাগিয়ে, হাতে ঘুড়ি ধরে বরফের ওপর দিয়ে পিছলে এগোতে যেমনি মনের জোর দরকার, তেমনি দরকার পেশিশক্তি। একদিন দু-দিন নয়, দিনের পর দিন একই পদ্ধতিতে এগোতে হয়। চলার পথে গলা বরফের জলের ধারা এলে তাতে স্লেজ নৌকা ভাসিয়ে পার হওয়া, গ্রীষ্মে বরফ গলে পাথর বেরিয়ে গেলে তার ওপর দিয়ে কোমরে বাঁধা স্লেজ টেনে এগোনো যে কতটা কষ্টসাধ্য তা কল্পনা করা মুশকিল। শুধু মনের জোর আর পেশিশক্তি ভরসা বরফের মরুভূমিতে। একজন ভালো স্কিয়ার হওয়ার তেজ কম থাকলে আর মসৃণ বরফক্ষেত্র পেলে অনায়াসে ১০০ কিলোমিটার পথ পার হয়ে যান। হাওয়ার কম তেজ থাকলে কেন? প্রবল হাওয়া, মানে ঝড়ের মতো হাওয়া যা মেরু অঞ্চলের স্বাভাবিক চরিত্র, বিশাল ঘুড়িকে আকাশের এমন উচ্চতায় টেনে তুলতে পারে যা কাইট-স্কিয়ারের পক্ষে বিপদজনক। স্কিয়ারকে আকাশে উড়িয়ে ছিটকে নিয়ে আছড়ে ফেলতে পারে পাহাড়ের ঢালে। এ কারণেই কাইট স্কিইং-এ দীর্ঘযাত্রায় পরিকল্পনা খুব কম অভিযাত্রী করেন।
হাওয়াই হল এই ধরনের অভিযানের মুখ্য পরিচালক। অনুকূল হাওয়া আর মসৃণ বরফতল থাকলে ঘুড়ির শক্তি স্কিয়ারকে প্রায় গাড়ির মতো গতিতে কয়েকশো কিলোমিটার টেনে নিয়ে যেতে পারে একদিনে। কিন্তু হিসেবের সামান্য গোলমাল, ঘুড়ির দড়ির নিয়ন্ত্রণে সামান্য ভুল প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
গ্রিনল্যান্ডের আইসক্যাপে কার্ল ও তাঁর দুই সঙ্গী এগোনোর সময় এটা বার বার খেয়াল রাখছিলেন যাতে করে কেউ অন্যদের থেকে দূরে না সরে যায়। একবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেই বিপদ। তুষার সাম্রাজ্যে একবার কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া দুরূহ। তখন তাকে খুঁজে বের করতে হেলিকপ্টারের সাহায্য নেওয়া ছাড়া অন্য গতি থাকে না। সে কাজটাও সহজ নয়। আবহাওয়ার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। দিনের মধ্যে ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা স্কি করতেন অভিযাত্রীরা। বাকি সময় যেত খাওয়াদাওয়া, ঘুম আর ঘুড়ি মেরামতে। সঙ্গে চলত ডায়েরি লেখা, আগামী দিনের আবহাওয়ার খোঁজ নেওয়া। মেরু অভিযানে এই দুটোর গুরুত্ব অসীম।
এই অভিযানে ব্যবহৃত ঘুড়ি নিয়ে কার্ল খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন। কারণ, দিনের পর দিন মেরু অভিযানের উপযুক্ত ঘুড়ির গঠন নিয়ে গবেষণায় তিনিও জড়িত ছিলেন। নতুন নতুন গড়নের ঘুড়ি তিনি পরীক্ষা করতেন। আগের কয়েকটি অভিযানে তিনি একই কোম্পানির ঘুড়ি ‘ক্রোনো’ ব্যবহার করেছিলেন। দুর্দান্ত গতিতে ছুটলেও এই ঘুড়ি নামিয়ে আনা ভীষণ কঠিন কাজ ছিল। এমনকি আকাশে তোলাও জটিল ছিল। তিনি সমস্যাগুলো জানিয়েছিলেন প্রকৌশলীদের। এই অভিযানের আগেই ঘুড়ির সেই সমস্যাগুলো কাটিয়ে তৈরি হয়েছিল ক্রোনো-প্রো। পাঁচটি দড়ি লাগে এই ঘুড়ি ওড়াতে। অভিযানের আগে কার্ল তাঁর নরওয়ের হাগাস্তলের বাড়িতে শীতকালে এই ঘুড়ি নিয়ে অনুশীলন করে দেখেছিলেন তিনি যেরকম ঘুড়ি চাইছিলেন, এটি ঠিক সেই ঘুড়িই।

bichitraghuri11এই অভিযানের জন্য অভিযাত্রীদলের সদস্যরা বিভিন্ন মাপের ঘুড়ি নিয়েছিলেন। তাঁর দুই ক্লায়েন্ট নিয়েছিলেন ১২ বর্গ মিটার মাপের ঘুড়ি। একটু কম অভিজ্ঞ ঘুড়ি-স্কিয়ারদের জন্য এটি আদর্শ। এই ঘুড়ি অক্লেশে ও নিরাপদে ওড়ানো ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর কার্ল নিয়েছিলেন ১৫ বর্গ মিটার মাপের ঘুড়ি। এছাড়াও সঙ্গে নিয়েছিলেন ১৮ বর্গ মিটার মাপের ঘুড়ি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে। গ্রিনল্যান্ডে ঘুড়ি নিয়ে অভিযান চালাতে যেটি সবচাইতে বেশি প্রয়োজন, তা হল ঘুড়ির দড়ির হিসেব। ৫০ মিটার মাপের লম্বা দড়ি ব্যবহার করা হবে, না ২৫ মিটার। কারণ, দড়ির মাপের ওপর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পালটে যায়। ঘুড়ি বেশি ওপরে উঠলে তাতে টান অনেক বেশি থাকে ঠিকই, কিন্তু ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেই কী হবে কিছুই বলা যায় না। ঝড়ো হাওয়া চালককে কোথায় কীভাবে নিয়ে ফেলবে তা ভাবতেই গা শিউড়ে উঠবে দুঁদে অ্যাডভেঞ্চার প্রেমিকের। দলের দুজন ২৫ মিটার ঘুড়ির সেট-আপ পছন্দ করলেও কার্ল নিয়েছিলেন ৩৫ মিটার লম্বা দড়ির সেট-আপ। কার্ল তো শুধু একজন অভিযান-গাইড নন, একজন পোড়খাওয়া অভিযাত্রী।
না, চাইলেই গ্রিনল্যান্ডে গিয়ে কোমরে স্লেজ বেঁধে, পায়ে স্কি আটকে, হাতে ঘুড়ি নিয়ে অভিযান করা যায় না। তার আগে ট্রেনিং করতে হয় অনেক।
কাইটিং-স্কির ট্রেনিং নেবার সবচাইতে ভালো জায়গা হল নরওয়ের উত্তরের হার্ডডেনগারভিডা জাতীয় উদ্যান। তিন-চারটি ধাপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ঘুড়ি অভিযান মূলত বাতাস নির্ভর। শুধু ঘুড়ি নিয়ন্ত্রণই নয়, ঘুড়ি মেরামত থেকে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, হিমাঙ্কের বহু নীচের তাপমাত্রায় অসুস্থতা পরিচর্যা থেকে ইগলু বানানো, দীর্ঘযাত্রায় প্রাপ্ত রেকর্ড লিপিবদ্ধকরণের পদ্ধতি, ভালুকের মুখোমুখি হলে কী করণীয়, আধুনিক যন্ত্রপাতি—বিশেষ করে স্যাটেলাইট নির্ভর আবহাওয়া সংক্রান্ত যন্ত্রের পরিচয়, ভয়ংকর তুষার-খাদ পার হবার উপায় থেকে বরফের রাজ্যে তুষার-গলা জল টপকানোর উপায়, তুষার-ঝঞ্ঝায় পড়লে বরফ খুঁড়ে তাঁবু খাটানোর পদ্ধতি—সব শেখানো হয় এখানে। এককথায় এই তালিম থাকলে মেরু অঞ্চলে অভিযান চালানো অনেক সহজ হয়ে যায়। তিরিশ দিন লেগেছিল কার্ল আর তাঁর দলবলকে অভীষ্টে পৌঁছতে।
হেলিকপ্টারে এবার বেসে ফেরার পালা।

ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

বিচিত্র দুনিয়া সমস্ত লেখা একত্রে 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s