মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে
দূরবীক্ষণ যন্ত্রের ভিতর দিয়ে মহাকাশে তাকালে কোথাও কোথাও আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধূলিকণা, প্লাজমা এবং প্রচুর পরিমাণে অদৃশ্য বস্তুপুঞ্জের সমন্বয়ে বড়ো বড়ো দল গঠিত হয়েছে বলে মনে হয়। মহাকাশের এই জাতীয় উপকরণের সমষ্টিতে গঠিত বৃহৎ দলগুলিকে তারাজগৎ বা গ্যালাক্সি বলা হয়। বিশাল মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য তারাজগৎ। প্রতিটি তারাজগতে আছে কোটি কোটি নক্ষত্র, যেগুলি আকারে আয়তনে আমাদের সূর্যের মতো কিংবা সূর্যের চেয়ে বড়ো বা ছোটো যারা সবাই একটি সাধারণ মহাকর্ষীয় কেন্দ্রের চারদিকে ঘূর্ণায়মান। নক্ষত্রগুলি যেমন বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে তেমন তারাজগৎগুলিও নানা প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন কুণ্ডলিত তারাজগৎ, উপবৃত্তাকার তারাজগৎ, উভ-উত্তল তারাজগৎ, বামন বর্তুলাকার তারাজগৎ, অনিয়মিত তারাজগৎ ইত্যাদি।
কুণ্ডলিত তারাজগৎ
এধরনের তারাজগৎগুলিতে কুণ্ডলিত বাহু থাকে। বাহুগুলি কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে সরাসরি শাখাপ্রশাখার মতো বেরিয়ে আসে। এই তারাজগৎগুলি একশো কোটি থেকে এক লক্ষ কোটি তারার সমাহারে গঠিত হয়। এগুলির ব্যাস সাধারণত দশ হাজার থেকে দুই লক্ষ আলোকবর্ষ হয়ে থাকে। দণ্ডাকার কুণ্ডলিত (Barred Spiral) তারাজগৎগুলির কেন্দ্রে গ্যাস, ধুলো ও নক্ষত্র এক বা একাধিক সারিতে ঠাসাঠাসি করে অবস্থান করে। কুণ্ডলিত বাহুগুলি কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এসে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। কুণ্ডলিত তারাজগৎগুলির বাহুগুলিতে নতুন নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয় বলে এদের রঙ কিছুটা নীলাভ। তবে কেন্দ্রকের কাছাকাছি অঞ্চলে প্রাচীন নক্ষত্র বেশি থাকায় লাল দানবের সংখ্যাও বেশি। তাই ওই অঞ্চল সামান্য লাল দেখায়। বাহুগুলির তুলনায় কেন্দ্রাঞ্চলে নক্ষত্রের ঘনত্ব অনেকটাই বেশি। জ্যোতির্বিজ্ঞানে সাধারণ কুণ্ডলিত তারাজগৎগুলিকে ‘S’ দ্বারা এবং দণ্ডাকার কুণ্ডলিত তারাজগৎগুলিকে ‘SB’ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
উপবৃত্তাকার তারাজগৎ
উপবৃত্তের মতো দেখতে হয় বলে এই তারাজগৎগুলিকে উপবৃত্তাকার তারাজগৎ বলে। এদের কেন্দ্রাঞ্চল খুবই উজ্জ্বল হয়। এই ঔজ্জ্বল্য কেন্দ্রকের থেকে প্রান্তদেশের দিকে ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। কুণ্ডলিত তারাজগৎগুলির তুলনায় এই তারাজগৎগুলিতে উজ্জ্বল নক্ষত্র, আন্তর্নাক্ষত্রীয় গ্যাস ও ধূলিকণার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম থাকে বলে এদের দ্যুতি অনেকটাই কম হয়। এই তারাজগৎগুলিতে নবীন নক্ষত্রের পরিবর্তে প্রবীন নক্ষত্রপুঞ্জের সমাহার অনেক বেশি। উপবৃত্তাকার আকৃতি কতটা চ্যাটালো (Flat) বা চ্যাপ্টা তার উপর নির্ভর করে এদের শ্রেণিবিভাগ। E0 থেকে E7 এই আট রকমের শ্রেণিতে ভাগ করা হয় এধরনের তারাজগৎগুলিকে। E0 সবচেয়ে কম চ্যাপ্টা এবং E7 সবচেয়ে বেশি চ্যাপ্টা নির্দেশ করে।
উভ-উত্তল তারাজগৎ
কুণ্ডলিত ও উপবৃত্তাকার তারাজগৎগুলির মধ্যবর্তী তারাজগৎগুলিকে ‘উভ-উত্তল তারাজগৎ (Lenticular galaxy) বলে। এগুলি অতি চ্যাটালো বা চ্যাপ্টা হয়। এধরনের তারাজগৎগুলিতে কুণ্ডলিত বাহুরাশি খুব বেশি থাকে না। হাব্ল পদ্ধতি অনুযায়ী এদের ‘SO’ শ্রেণিভুক্ত তারাজগৎ বলা হয়। বিজ্ঞানীদের অনুমান এগুলি কুণ্ডলিত ও উপবৃত্তাকার তারাজগৎগুলির মাঝের প্রকৃত বিবর্তনকারী পর্যায়ের প্রতিরূপ দান করে, তবে এ ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত নন।
বামন বর্তুলাকার তারাজগৎ
কয়েক মিলিয়ন নক্ষত্র দ্বারা গঠিত এই ক্ষুদ্র তারাজগৎগুলি অনেকটা উপবৃত্তাকার তারাজগতের মতো দেখতে। ক্ষুদ্র হলেও এগুলি মহাবিশ্বের সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান শ্রেণির তারাজগৎ। এগুলি উপবৃত্তাকার ছাড়াও অন্যান্য আকৃতির হয়ে থাকে। আমাদের নিজেদের আঞ্চলিক গোষ্ঠীর তারাজগৎগুলির বেশিরভাগ সদস্যই বামন বর্তুলাকার তারাজগতের অন্তর্গত।
নিম্ন দীপ্তির তারাজগৎ
এধরনের তারাজগৎগুলিতে খুব কম সংখ্যক নক্ষত্র থাকে বলে এগুলি উপবৃত্তাকার তারাজগৎগুলির মতো উজ্জ্বল নয়। নক্ষত্রের পরিবর্তে এতে থাকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস। তাই মহাকাশে এদের খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টকর।
অনিয়মিত তারাজগৎ
এই তারাজগৎগুলির কোনো সুনির্দিষ্ট আকার বা গঠন নেই। এগুলি মহাকাশে ভাসমান কিছু নক্ষত্র ও ধুলোর অনিয়মিত সমাহার। এদের কুণ্ডলিত বা উপবৃত্তাকার কোনো দলেই ফেলা যায় না। তবে এগুলির মধ্যে অন্যান্য কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। যেমন আমাদের পড়শি ম্যাগেলানিক মেঘপুঞ্জতে স্পষ্ট দণ্ডাকার রূপ দেখতে পাওয়া যায়। তাই একে ‘দণ্ডাকার অনিয়মিত’ (Barred irregular) তারাজগৎ বলা যেতে পারে।
অনিয়মিত তারাজগৎগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়— সাধারণ (Ordinary) দণ্ডযুক্ত (Barred) এবং মিশ্র (Mixed)। কিছু কিছু অনিয়মিত তারাজগৎ ‘S’ আকৃতির হয়ে থাকে। এধরনের তারাজগতের সংখ্যা মোট তারাজগতের ২ – ৩ শতাংশের বেশি নয়। এদের নক্ষত্রগুলি বয়সে অত্যন্ত নবীন।
সক্রিয় কেন্দ্রবিশিষ্ট তারাজগৎ
শুধু আকাশগঙ্গাতেই নয়, মহাবিশ্বে যত তারাজগৎ আছে তার অধিকাংশের কেন্দ্রেই একটি করে কৃষ্ণগহ্বর আছে। চারপাশে গ্রাস করার মতো কোনো বস্তু না থাকলে সাধারণত এরা শান্তরূপে অবস্থান করে। কিন্তু যদি কোনো নক্ষত্র কাছাকাছি এসে যায় অর্থাৎ ঘটনা-দিগন্তে (even horizon) ঢুকে পড়ে তখন সেটা ধীরে ধীরে কৃষ্ণগহ্বরের গ্রাসে চলে যায়। সেই সময় এর চারপাশে বিপুল পরিমাণে তড়িৎ চুম্বকীয় বর্ণালির সৃষ্টি হয়। কৃষ্ণগহ্বরে পড়তে থাকা এই বস্তুর পরিমাণ যত বৃদ্ধি পেতে থাকে উৎপন্ন শক্তির পরিমাণও তত বাড়তে থাকে। এর ফলে তারাজগৎটি অত্যাধিক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তখন ওই তারাজগৎটিকে বলা হয় সক্রিয় কেন্দ্রবিশিষ্ট তারাজগৎ (Active Galactic Nucleus বা AGN)। এধরনের তারাজগৎগুলি আকারে প্রকাণ্ড হয়।
রেডিয়ো তারাজগৎ
বৃহৎ আকারের তারাজগৎগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘রেডিয়ো বা বেতার তারাজগৎ’। এগুলি থেকে নির্গত জেট-প্রবাহের সঙ্গে বেরিয়ে আসে বেতার তরঙ্গ। কেন্দ্র থেকে নির্গত এই জেট-প্রবাহ একটি বা দুটি হতে পারে। এগুলি মহাকাশে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এদের দু-প্রান্তে থাকা গ্যাসীয় মেঘ এরা গ্রাস করতে থাকে। পৃথিবী থেকে এই ধরনের তারাজগৎগুলির কেন্দ্রীয় অঞ্চল দেখতে পাওয়া যায় না, শুধুমাত্র প্রান্তিক দিকটাই দেখা যায়। তাই এগুলি দেখতে অনুজ্জ্বল হয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এধরনের তারাজগৎগুলির কেন্দ্রাঞ্চলে কোনো একসময় বিস্ফোরণ জাতীয় কোনো প্রক্রিয়া ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কন্যারাশিতে (Virgo) দৃশ্যমান ‘এম ৮৭’, সপ্তর্ষি মণ্ডলের (Ursa Major) ভিতর দিয়ে দৃশ্যমান ‘এম ৮২’, কিন্নর মণ্ডলে (Centaurus) ‘সেন্টেরাস এ’, রাজহংস মণ্ডলের (Cygnus) ‘সিগনাস এ’ প্রভৃতি।
তথ্য সূত্র
- মৃত্যুঞ্জয়প্রসাদ গুহ – আকাশ ও পৃথিবী ১৯৯৮, শৈব্যা প্রকাশন।
- রমাতোষ সরকার – মহাবিশ্ব ২০০৮, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি।
- John Scalzi – The Rough Guid to the Universe 2003, Rough Guides Ltd.
বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে