বৈজ্ঞানিকের দপ্তর ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক অঙ্কের যাদুকর- কার্ল ফ্রেড্রিক গস-অরূপ ব্যানার্জি-বসন্ত ২০২১

ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে 

তিন বছরের ছেলেটা নিবিষ্ট মনে একা বসে তার বাবার দৈনন্দিন কাজ দেখছিল। ইটভাটার ম্যানেজারবাবু, তার বাবা, তখন মজদুরদের কাজের হিসেব করে তাদের দিন মজুরি দিচ্ছিলেন। কে কত ঘণ্টা বেশি কাজ করেছে, তার হিসেবনিকেশ মুখে মুখে করতে করতে মজুরি বিলি করছিলেন। কাজের মাঝে বাচ্চাটা চেঁচিয়ে উঠে বাবাকে হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে বলল, “বাবা, হিসেবে একটা ভুল হচ্ছে। যাকে আটাত্তর পেনি দেবে বলছ, সে পাবে বিরাশি পেনি…”

ছেলেকে কথা শেষ না করতে দিয়ে বাবা ধমকে উঠলেন, “পুঁচকে ছোঁড়া, যাও বাড়ির ভিতর যাও, এখানে কী করছ? তুমি তো ইশকুলেই যাও না, হিসেবের তুমি কী বুঝবে?”

বড় বড় চোখ তুলে ছেলেটি বলে, “বাবা, আর একবার সব সংখ্যাগুলো জুড়ে দেখো, বিরাশি পেনিই হবে।”

আবার হিসেব করে তো বাবার চক্ষু চড়কগাছে ওঠার উপক্রম! একেবারে ঠিক বলেছে ছেলেটা! নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছেলেকে একবার পরীক্ষা করে দেখার জন্য তিনি কয়েকটা সংখ্যা ছেলেকে মুখে মুখে যোগ করতে বললেন। চকিতে উত্তর দিয়ে দিল সেই বাচ্চা। উত্তর যেন একবারে ছেলের ঠোঁটের ডগায়— নির্ভুল। নিজে নিজেই কী করে অঙ্ক কষতে শিখে গেল ছেলে— সেই ভেবে বাবা তো হয়রান! তিনি ঠিক করলেন, এবার তিনি ছেলের লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ দেবেন।  কিছুদিন পর তিনি লক্ষ করলেন, ছেলেকে যা শেখানো হয়, তাই সে বিদ্যুৎগতিতে শিখে ফেলার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে।

সেদিনের সেই বিস্ময় বালক জন্ম নিয়েছিল জার্মানির ঐতিহাসিক শহর ব্রান্সউইকে, ১৭৭৭ সালে। নাম— কার্ল ফ্রেড্রিক গস। গরিব পরিবারে জন্ম নেওয়া ফ্রেড্রিক যে একজন বিস্ময় বালক, সে-কথা কৃষ্টিসম্পন্ন শহর ব্রান্সউইকে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। তবে শুরু থেকেই উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা করা তার বাবা দিয়েত্রিচের পক্ষে যথেষ্ট মুশকিল ছিল। পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য তিনি নানারকম কাজে লেগে থাকতেন, কিন্তু কোনও স্থায়ী রোজগার তাঁর ছিল না। সাত বছর বয়সে ফ্রেড্রিক গস-কে তার বাবা শহরের এক স্কুলে ভর্তি করেন, যেখানে অঙ্ক আর ভাষা শিক্ষার তালিম নিতে থাকে ফ্রেড্রিক।

ফ্রেড্রিকের স্কুল সেন্ট ক্যাথারিন পাবলিক স্কুলে অঙ্কের মাস্টারমশাই বাটনার ছিলেন একটু কড়া প্রকৃতির। অঙ্ক না পারলে ছেলেদের কঠিন শাস্তি দিতেন। বিশাল লম্বা বেত হাতে নিয়ে নাচাতে নাচাতে প্রথম দিনই তিনি ক্লাসের ছেলেদের বললেন এক থেকে একশ পর্যন্ত সব সংখ্যা যোগ করে ফলাফল জানাতে। এক লহমা ভেবে নিয়ে ফ্রেড্রিক উত্তর দিল ৫০৫০।

বাটনার সাহেব চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, “এত তাড়াতাড়ি উত্তর দিলি কী করে। কই তোর খাতাটা একবার দেখা দিকি!”

ফ্রেড্রিক বলে, “উত্তর আমার মাথায়। খাতায় তো লিখিনি!”

বাটনার সাহেব বেজায় রেগে চেঁচিয়ে উঠলেন, “আরে, খাতায় কষে দেখা, নইলে বুঝব কী করে যে তোর জবাব সঠিক?”

 “খুব সহজ। ১ থেকে ১০০-এর মধ্যে আছে ৫০ জোড়া সংখ্যা। এদের মধ্যে যদি শেষের সংখ্যা আর শুরুর সংখ্যা যোগ করি, তবে পাই ১০১। যেমন ১+১০০, ২+৯৯, ৩+৯৯, …। এবার ৫০ কে ১০১ দিয়ে গুণ করলে পাব ৫০৫০।”

বিস্ময় বালক ফ্রেড্রিক গস-কে তারপর দিন থেকেই অন্যভাবে প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন অঙ্কের মাস্টারমশাই বাটনার। তিনি ফ্রেড্রিকের জন্য উঁচু ক্লাসের অঙ্কের বই আনান স্কুলে। তরতরিয়ে চলতে থাকে ফ্রেড্রিকের স্কুলের পড়াশুনো। যেমন অঙ্কে, তেমনি ভাষা শিক্ষায় তার বিস্ময়কর পারদর্শিতা। তবে সবচাইতে বেশি মন দেয় অঙ্ক কষায়। সে যেন এক সাধনা। কেউ আর তার তল খুঁজে পায় না।

একটু বড় হতেই স্কুলের মাস্টারমশাই আর ফ্রেড্রিকের বাবা-মায়ের ইচ্ছে হল পড়াশুনোয় এমন চৌখস ছেলেকে গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠাতে হবে। কিন্তু অসুবিধা হল— সে বড় খরচের ব্যাপার। অত অর্থ জোটাবে কে?

তবে কথায় আছে —চিনি জোগান চিন্তামণি। ফ্রেড্রিকের আশ্চর্য প্রতিভার কথা পাঁচকান হয়ে জেনে গিয়েছিলেন ব্রান্সউইক শহরের ডিউক। তিনি গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রেড্রিকের সমস্ত পড়ার খরচ সরকারি তহবিল থেকে দান করার নির্দেশ দিলেন। ব্যস, আর ফ্রেড্রিক-কে দেখে কে! বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্ম নিল ভবিষ্যতের পৃথিবীর এক তুখোড় অঙ্কবিদ ।

স্কেল আর কম্পাস দিয়ে সতের তল বিশিষ্ট এক বহুভুজ এঁকে কলেজে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন ফ্রেড্রিক গস (পরবর্তীকালে তিনি খাতায় কলমে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন বহুভুজ আঁকার পিছনে লুকিয়ে থাকা গাণিতিক কারণ) তিন বছরের মধ্যে অঙ্কে ব্যাচেলর ডিগ্রি পাওয়ার পর তিনি মাত্র আঠারো বছর বয়সে গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি — ডক্টরেট অফ ফিলসফি হাতে পান খুব অল্প বয়সে। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘ফান্ডামেন্টাল থিওরেম অফ এলজেব্রা’। এই কাজে তিনি দেখিয়েছিলেন একটি বহুমুলযুক্ত সমীকরণে ঠিক ততগুলো মূল থাকে, যতটা তার সর্বোচ্চ শক্তি (উদাহরণঃ x4+x3+x2+1=0 সমীকরণে সর্বোচ্চ শক্তি 4 , তাই এই সমীকরণে মোট চারটি মূল আছে)।

এরপর তার প্রথম অঙ্কের বই প্রকাশিত হয় – ‘ডিস্কুইজিশনস্‌ এরিথমেটিকা।’ এই বইতে তিনি চার মূল যুক্ত বীজগাণিতিক সমীকরণের সমাধান সুত্র লেখেন বিস্তারিতভাবে। বইটিতে তিনি অঙ্ক এবং জ্যামিতির পূর্ববর্তী অনেক আবিষ্কারের গাণিতিক ব্যাখ্যাও দেন। এই বইটির মাধ্যমে আধুনিক অঙ্কশাস্ত্রের ‘নাম্বার থিওরি’র জন্ম হয়। ফ্রেড্রিক-এর গুণমুগ্ধরা বলতে থাকেন, যদি ইউক্লিড জ্যামিতির জনক হয়ে থাকেন, তবে ফ্রেড্রিক গস হলেন নাম্বার থিওরির জনক।

ফ্রেড্রিক ছিলেন একনিষ্ঠ পড়ুয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি যত অঙ্কের বই লাইব্রেরি থেকে পড়ার জন্য নিয়ে আসতেন, তার চাইতে অনেক বেশি বই আনতেন অন্যান্য বিষয়ের উপর, যার সঙ্গে বিজ্ঞান বা অঙ্কের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না। অঙ্কে পারদর্শী ফ্রেড্রিক গস তাঁর অভাবনীয় ক্ষমতার চমৎকার প্রয়োগ করেন বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ে, যেমন জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং পদার্থবিদ্যা। সংখ্যাতত্ত্ব আর ভূগণিতেও তার সমান আগ্রহ দেখা যায়।

১৮০১ সালে মঙ্গল আর বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে প্রকাণ্ড এক গ্রহাণু আবিষ্কার করেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী গিউসেপি পিয়াজি।  গ্রহাণুটিকে গ্রহ ভেবে নাম দেওয়া হয়েছিল- সেরেস। অনেক আগে থেকেই রোমানরা শস্যের দেবতা সেরেসের আরাধনা করত (শস্যের ইংরেজি নাম ‘সিরিয়ালস্‌’ সেরেস শব্দ থেকে নেওয়া)। সেরেসের উপর পর্যবেক্ষণের তথ্য পিয়াজি বিজ্ঞানী মহলে জানিয়ে দিলেও হাতেনাতে তাঁর ফলাফল দেখাতে পারেননি।  ছয় সপ্তাহ সেরেসের উপর একটানা পর্যবেক্ষণ করে হঠাৎই পিয়াজি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেরে উঠে আর সেই গ্রহাণুকে খুঁজে তিনি লোককে দেখাতে পারেননি, কারণ সেরেস ততদিনে সূর্যের পিছনে ঢাকা পড়ে গেছে। এরপর তিনি মারা যান।

সেরেস বলে যে একটা গ্রহ বা গ্রহাণু আছে, সেটা বিজ্ঞানী মহল পিয়াজির কাজের মাধ্যমে জানতে পেরে অঙ্কবিদদের আশ্রয় নেয় তার কক্ষপথের সঠিক মাপজোক করতে। অঙ্ক বিশারদ অয়লার এই কাজে হাত লাগিয়েও কাজটি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি, কারণ তাঁর একটা চোখ অসুখে নষ্ট হয়ে যায়। এবার সবাই ফ্রেড্রিক গসের শরণাপন্ন হল।  তিনি একদিনের মধ্যেই অঙ্ক কষে বার করে ফেললেন সেরেসের কক্ষপথ। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৪। বিজ্ঞানীরা ধন্য ধন্য করে উঠলে ফ্রেড্রিক বললেন, “আরে এতে অবাক হবার কী আছে? তাড়াতাড়ি অঙ্কটা না কষতে পারলে অয়লারের মত যদি চোখ হারাই, সেই ভয়ে কাজটা সেরে ফেলেছি।”

ফ্রেড্রিক অঙ্ক কষে দেখান যে, সেরেসের কক্ষপথ বৃত্তাকার এবং সূর্যের থেকে তার অবস্থান ৪১৩০ কিলোমিটার দূরে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে ফ্রেড্রিকের দেখানো পথে কোনও গ্রহের কক্ষপথের সঠিক অবস্থান ও প্রকৃতি নির্ণয় এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই কাজ করতে গিয়ে ফ্রেড্রিক গস দুটি গুরুত্বপূর্ণ গাণিতিক সমাধানের পথ আবিষ্কার করে ফেলেন। একটি হল সংখ্যাতত্ত্বে ব্যবহৃত ‘লিস্ট স্কয়ার মেথড’ (অনেক আগেই তিনি এটি আবিষ্কার করেন, প্রয়োগ করেন এই কাজে) এবং আর একটি হল ‘ফুরিয়ার ট্রান্সফ্রমেশন মেথড’। প্রায় এক শতক পর অঙ্কশাস্ত্রে এই দুটি পদ্ধতি অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

সংখ্যাতত্ত্বে প্রবাবিলিটির উপর কাজ করতে গিয়ে ফ্রেড্রিক একটি অসাধারণ কাজ করে গেছেন, যা আজও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত সংখ্যাগুলো বিশ্লেষণে করে সঠিক ফলাফলে পৌঁছতে সাহায্য করে। সেটি হল- গসিয়ান ডিস্ট্রিবিউশন বা নর্মাল ডিস্ট্রিবিউশন। একটু খুলে বললে, অনেক সংখ্যক বৈজ্ঞানিক ডেটা বা ফলাফলকে যদি গ্রাফে দেখানো হয়, তবে তার বিস্তার বাম বা ডান দিক ঘেঁষা হতে পারে, আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে ঘণ্টার আকৃতির হতে পারে। এই শেষোক্ত বিস্তারকে ফ্রেড্রিক গস নাম দিলেন – নর্মাল ডিস্ট্রিবিউশন বা স্বাভবিক বিস্তার। এই ক্ষেত্রে কেবল কেন্দ্রিক সংখ্যাটি হল গড় সংখ্যা, যার বাম ও ডান দিকে অন্য সংখ্যাগুলো বিস্তৃত হয়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এবং অর্থনীতিতে ‘বেল ডিস্ট্রিবিউশন’ বা ‘গসিয়ান ডিস্ট্রিবিউশন’ বা নর্মাল ডিস্ট্রিবিউশন-এর কার্যকরী ব্যবহার ফ্রেড্রিক গসের নাম অমর করে রেখে গেছে।   

ফ্রেড্রিক গসের পড়াশুনো এবং গবেষণার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতেন ডিউক অফ ব্রান্সউইক। কিন্তু ফ্রেড্রিকের বয়স যখন তিরিশ বছর, তখন ডিউক মারা যান এবং ফ্রেড্রিকের মাসোহারা বন্ধ হয়ে যায়।  ফ্রেড্রিকের পড়াশোনার ব্যায়ভার বহন করার জন্য গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত করে। কিন্তু ছাত্র পড়াতে ফ্রেড্রিকের এতটুকু ভাল লাগত না। পড়ানো নিয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “একজন অঙ্কের অধ্যাপক তার ছাত্রদের শুধু বিজ্ঞানের অ আ ক খ শিখাতে পারে মাত্র, কিন্তু সেই ফাঁকে তার গবেষণার মূল্যবান সময় যায় হারিয়ে।”

ফ্রেড্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ানোর কাজ নিয়েছিলেন যাতে পড়ানোর জন্য কম সময় দিয়ে অঙ্কের গবেষণায় বেশি মনোনিবেশ করা যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময়েই তাঁর বিজ্ঞান গবেষণায় বহুমুখী প্রতিভা পুরোপুরি বিকশিত হয়। পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অসাধারণ সব কাজে তিনি মন দেন পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে।

          অধ্যাপনার কাজে যোগ দেবার তিন বছরের মাথায় ফ্রেড্রিক গস জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর অসাধারণ গবেষণার তথ্য প্রকাশ করেন Theory of Motion of the Celestial Bodies বইতে। দুই খণ্ডে বইটি প্রকাশিত হয়।

এরপর তিনি ভূগণিতের উপর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। জ্যামিতির স্রষ্টা ইউক্লিডের কাজ শুধু দ্বিমাত্রিক জগতে চলতে পারে, ত্রিমাত্রিক জগতে তাঁর তত্ত্ব তেমন খাটে না — একথা জোরের সঙ্গে সর্বপ্রথম ফ্রেড্রিক গস বলে চলেছিলেন, কিন্তু তাঁর কথার গুরুত্ব তেমন ভাবে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি।  তিনি বলেন, ইউক্লিডের জ্যামিতি খাটে কেবল একটা সমতলে। চোঙ বা সিলিন্ডার যেহেতু একপাশে লম্বালম্বি কেটে ফেলে মেলে ধরা যায়, তবে সেটা সমতলের আকৃতি নেয়। তাই চোঙাকৃতি তলে ইউক্লিডের জ্যামিতি খাটবে। কিন্তু যদি বস্তুর আকার গোলকাকার হয়; যেমন পৃথিবী বা অন্যান্য গ্রহ— সেখানে এই জ্যামিতি খাটবে না। আর এই ব্রহ্মাণ্ডে যেহেতু সব গ্রহ নক্ষত্র গোলকাকার, তাই সেখানে ইউক্লিডের জ্যামিতি ব্যবহার করা যাবে না।  বিশদে বোঝানোর জন্য তিনি চোঙ, গোলাকার এবং শঙ্কুকে ছোট ছোট তলে বিভাজিত করে দেখিয়ে দেন, প্রতিটি ছোট তল কীভাবে বেঁকে দুমড়ে যায়। আর যেখানেই তল বেঁকে যায়, সেখানেই ইউক্লিডের জ্যামিতি ব্যর্থ হয়। প্রায় এক শতক পর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর রিলেটিভিটি তত্ত্বে সেই একই কথা বলেন।

প্রায় এক দশকের উপর জমি জরিপের কাজে নিজের অঙ্কের মাথা কাজে লাগান ফ্রেড্রিক গস। তিনি ভূগণিতের উপর বহু তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা করেন এবং ফল স্বরূপ পরবর্তীকালে তিনি হেলিওট্রোপ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। হেলিওট্রোপ যন্ত্র ব্যবহার করে জমি জরিপের কাজে ত্রুটিমুক্ত ফলাফল পাওয়া যায় এবং এক্ষেত্রে সমস্ত মাপজোকে তিনি তাঁর আবিষ্কৃত ‘লিস্ট স্কয়ার মেথড’ ব্যবহার করেন সাফল্যের সঙ্গে। এই আবিষ্কারের ফলে পরবর্তী দেড়শ বছর জার্মানিতে হেলিওট্রোপ যন্ত্র জমি জরিপের কাজে নিয়মিত ব্যবহার হয়। ১৮৩১ সালে ভারতে ব্রিটিশ সরকার যে ‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক সারভে’ করে জমির মাপজোকের জন্য, সেই কাজেও এই যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। 

(হেলিওট্রোপ যন্ত্র)

গ্রিক ভাষায় হেলিও শব্দের অর্থ হল – সূর্য, আর ট্রোপ শব্দের অর্থ হল – ঘোরানো। যে জায়গার দূরত্ব মাপতে হত, সেখানে হেলিওট্রোপ রাখা হত, আর কয়েক মাইল দূরে বসানো হত একটা টেলিস্কোপ।  হেলিওট্রোপ যন্ত্রে তিনটি আয়না লাগিয়েছিলেন ফ্রেড্রিক গস, তাদের ব্যস ছিল ৪, ৬ ও ৮ইঞ্চি। এই আয়নাগুলো অনুভূমিক আর উল্লম্ব অক্ষে ঘোরানো যেত। সূর্যের আলো আয়নাগুলোতে পড়ে প্রতিফলিত হত দূরবর্তী টেলিস্কোপে। জার্মানির হ্যানওভার শহরে জমি জরিপের জন্য ফ্রেড্রিক গস তিনটে পাহাড় বেছে নেন। তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র আর টেলিস্কোপের মাধ্যমে তিনি সাধারণ ত্রিকোণমিতির সুত্র ব্যবহার করে পাহাড়ের মধ্যের দূরত্ব নির্ণয় করেন নির্ভুলভাবে।

জরিপের কাজ করতে ত্রিভুজের মাপজোক করতে হয়। কিন্তু প্রথাগত জ্যামিতি ব্যবহার করে সব হিসাবে ভুল হয়ে যায়। ফ্রেড্রিক সহকর্মীদের বোঝান যে, পৃথিবীর গোলাকার বাঁকা তলই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। সেখানে প্রচলিত ইউক্লিডের জ্যামিতি কাজে আসবে না। অঙ্কের সাহায্যে তিনি এই সমস্যার সমাধান করেন এবং বাল্যকাল থেকে মনের কোণে জমিয়ে রাখা বৈজ্ঞানিক ধারণা- পৃথিবীর পৃষ্ঠে ইউক্লিডের জ্যামিতি খাটে না, এই কথা এবার গবেষণা পত্রের মাধ্যমে গুছিয়ে লিখে জমা করেন।

ফ্রেড্রিক গস-এর বয়স যখন প্রায় পঞ্চাশ ছাড়ায়, তখন তাঁর বন্ধুত্ব হয় অর্ধেক বয়সের এক পদার্থবিদ অধ্যাপকের সঙ্গে। দুজনেই দুজনের ভক্ত হয়ে পড়েন, তাদের কাজের মাধ্যমে সেই বন্ধুত্ব সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। সেই পদার্থবিদ ছিলেন— উইলহেম ওয়েবার। ওয়েবার সেই সময় স্থির তড়িতের উপর গবেষণা করছিলেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা। ওয়েবারের কাজ দেখে ফ্রেড্রিকের ঝোঁক গেল স্থির তড়িতের উপর। আর কী অসাধারণ এক তত্ত্বই না তিনি পদার্থবিদদের দিয়ে গেলেন! এই তত্ত্ব Gausss Law of Electriostatics নামে বিখ্যাত।

দুই অসম বয়সী বন্ধু ওয়েবার আর ফ্রেড্রিক অনেক অসামান্য আবিষ্কার করে ফেলেন। কোনও একটি বিদ্যুৎ বর্তনীতে বহমান বিদ্যুৎ থেকে যে চুম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়, সে কথা জানিয়েছিলেন ওয়েবার। বিদ্যুৎ বর্তনীতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ  বিষয় হল— কারেন্ট ও ভোল্টেজ। দুই বৈজ্ঞানিক মিলে বিদ্যুৎক্ষেত্র আর চুম্বকক্ষেত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বুঝলেন, বিদ্যুৎ প্রবাহের পিছনে আছে তড়িতের সংরক্ষণ সুত্র, আর ভোল্টেজের পিছনে আছে শক্তির সংরক্ষণ সুত্র। দুর্ভাগ্যক্রমে এই আবিষ্কারের কথা অজ্ঞাতই থেকে যায়। প্রায় এক দশক পর এই বিষয়ে তত্ত্ব দিয়ে যিনি পদার্থবিদ্যায় নিজের নাম খোদাই করে রেখে গিয়েছিলেন, তিনি হলেন— রাশিয়ান পদার্থবিদ গুস্তভ কারচফ। স্বাধীন ভাবে গবেষণা করে তিনি একই সুত্র আবিষ্কার করে গেলেন, যা কারচফ-এর সুত্র বলে খ্যাত।

কাজপাগল ফ্রেড্রিক আর ওয়েবার দুই বন্ধু মিলে আরও একটা চিত্তাকর্ষক আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন এই সময়ে। ফ্রেড্রিকের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র আর ওয়েবারের পদার্থবিদ্যার গবেষণা কেন্দ্রের মধ্যে ব্যবধান ছিল প্রায় আড়াই কিলোমিটার। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য তারা এক অভিনব টেলিগ্রাম ব্যবস্থার পত্তন করে ফেলেন। এটিই হল পৃথিবীর সর্বপ্রথম টেলিগ্রাফ ব্যাবস্থা।

গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক অ্যালেক্সান্ডার ভন হ্যাম্বোল্ট, ফ্রেড্রিক গস-কে চুম্বক তত্ত্বের কাজে আকৃষ্ট করবার জন্য একটা বার ম্যাগনেট-এর উপর পরীক্ষা করে দেখান।  হ্যাম্বোল্ট, ওয়েবার ও অন্যান্য পদার্থবিদেরা আসলে চাইছিলেন, ফ্রেড্রিকের অঙ্কের জ্ঞান পদার্থবিদ্যার পরীক্ষিত ফলাফলের গাণিতিক প্রমাণ দিক।  কিন্তু ফ্রেড্রিক তাঁর কাজে একটু খামখেয়ালী ছিলেন। তাই সহজে তাঁকে দিয়ে কোনও কাজ করানো যেত না। তবে হ্যাম্বল্টের পরীক্ষা দেখে গস চুম্বকের ধর্ম নিয়ে কাজ করা শুরু করেন এবং অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পৃথিবীর চুম্বক ধর্ম নিয়ে গবেষণার কাজে মেতে ওঠেন। ভূ-চুম্বকের শক্তি গণনা করে বেশ কিছু গবেষণাপত্র রয়্যাল সোসাইটি অফ গটিঙ্গেন-এ জমা করে দেন ফ্রেড্রিক গস। এরপর তিনি স্থির তড়িচ্চুম্বকীয় শাস্ত্রে যুগান্তকারী দুটি সুত্র দেন, পরবর্তীকালে যা ‘গস ল অফ ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক্স’ ও ‘গস ল অফ ম্যাগ্নেটোস্ট্যাটিক্স’ বলে পদার্থবিদ্যার পাতায় জায়গা পায়।

‘গস ল’ এর প্রথম সুত্র অনুযায়ী, কোনও তড়িতায়িত বস্তু থেকে পাওয়া তড়িৎ-ক্ষেত্র তার মোট তড়িতের সঙ্গে সমানুপাতিক, বস্তুর আকার ও আয়তনের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।

E=  , ΦE = Electric field, Q= charge enclosed by the body, €o = permittivity of free space)

দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী, এই ব্রহ্মাণ্ডে কোথাও চুম্বকীয় অক্ষ স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না। অর্থাৎ চুম্বকীয় উত্তর বা দক্ষিণ মেরু আলাদা ভাবে থাকা সম্ভব নয়, মেরু দুটি একসঙ্গে থাকে, ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক তড়িতের মত তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব থাকে না (ΦB= 0)।

পরবর্তীকালে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল তাঁর  তড়িচ্চুম্বকীয় সমীকরণে দুটি সূত্রকে সর্বপ্রথমে রাখেন।

বিজ্ঞান গবেষণার পাশে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষায় ফ্রেড্রিক গস-এর বিশেষ আগ্রহ ছিল। নিজের মাতৃভাষা জার্মান ছাড়াও ড্যানিশ, ইংরেজি, ফরাসী, গ্রীক, ল্যাটিন এবং রাশিয়ান ভাষাতেও তিনি সচ্ছন্দ ছিলেন। দেশ বিদেশের সাহিত্য পড়তে ভালবাসতেন এই অঙ্ক পাগল মানুষটি। তাঁর নিজস্ব লাইব্রেরিতে ৬০০০ এর বেশি বই তাঁর সংগ্রহে ছিল। অঙ্ক ও বিজ্ঞানে তাঁর অনেক গবেষণাই লোক সমক্ষে আসেনি, তার কারণ ফ্রেড্রিক যে গবেষণাকে উচ্চমানের বলে মনে করতেন, শুধু তাই-ই প্রকাশ হতে দিতেন। হয়ত অপ্রকাশিত থেকে গেছে বলে তাঁর বহু মূল্যবান গবেষণা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বিজ্ঞানজগত।

ব্যক্তিগত জীবনে নিপাট ভালমানুষ এই অঙ্ক বিশারদ কারও সঙ্গে তর্ক করা পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন- “শত চেষ্টা করেও বোকাদের কিছু বোঝানো সম্ভব নয়। আমার গবেষণার কাজ বোঝা তাদের কম্ম নয়, বরং তাদের সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে আমার মহামূল্যবান সময় অপচয় হয়ে যাবে তর্কের ঝড়ে।”

সাতাত্তর বছর বয়সে পৃথিবী ও তাঁর কাজের জগত থেকে বিদায় নেন কার্ল ফ্রেড্রিক গস। গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরতত্ত্ব বিভাগে তাঁর মস্তিষ্ক সযত্নে রেখে দেওয়া হয়। ফ্রেড্রিক গস নিজেকে আর্কিমিডিস-এর ভাবশিষ্য বলে মনে করতেন। তাই তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল, যেমন আর্কিমিডিসের কবরের উপর চোঙের ভিতর গোলক রাখা হয় তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে, তেমনই তাঁর নিজের কবরের যেন উপর একটা সতের তল বিশিষ্ট বহুভুজ রেখে দেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যবশত ফ্রেড্রিকের মৃত্যুর পর গটিঙ্গেনে তার সমাধির উপর এই জটিল জ্যামিতিক বস্তু তৈরি করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ফ্রেড্রিকের জন্মস্থান ব্রান্সউইকে তাঁর স্মৃতিসৌধে এক স্থপতি পাথরের তৈরি বহুভুজ বানিয়ে দিয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র:

  1. Carl Friedrich Gauss, Titan of Science, by G. Waldo Dunnington, Hufner Publishing, New Work, 1955.
  2. The Prince of Mathematics, Carl Friedrich Gauss, by M B W Tent, A K Peters Ltd, 2006.

 জয়ঢাকের  বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s