বিচিত্র জীবজগত- সব লেখা একত্রে
ক্যাঙারু কে, কেমন দেখতে, কোথায় থাকে এসব নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না? ওই যে যারা পেটের থলেতে ছানাকে রেখে থপথপিয়ে পেছনের দু-পায়ে লাফিয়ে চলেন। যাদের মুখখানা ইঁদুরের মতো, সামনের পা দু-খানা ছোট্টো। যাদের অ্যায়সা মোটা ল্যাজ! তারাই হলেন ক্যাঙারু। ইনি প্রাণীজগতের সেলিব্রিটি বললেও চলে। ক্যাঙ্গারুমশাই নিজের গিন্নি, ছানাপোনা, গুচ্ছের বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজন সমেত অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন।
এখনো পর্যন্ত প্রায় চার ধরনের ক্যাঙারু পাওয়া গিয়েছে। লাল ক্যাঙারু, অ্যান্টিলোপ ক্যাঙারু, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ান ধূসর ক্যাঙারু এবং পূর্ব অস্ট্রেলিয়ান ধূসর ক্যাঙারু। এরা খোলামেলা জায়গায় থাকতে ভালোবাসে এবং ঘাস, ফুল, গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। মরুভূমির জায়গায় বসবাস করে বলে ক্যাঙারুকুল বেশ কষ্টসহিষ্ণু হয়। বেশ কয়েকদিন জল না খেয়েও এরা বেঁচে থাকতে পারে।
ক্যাঙারু পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের থেকে অনেকটাই আলাদা। সে পেছনের দুটো পা এবং লেজের ওপর ভর দিয়ে থপথপিয়ে লাফিয়ে চলাই হোক আর পেটের থলেতে বাচ্চা নিয়ে ঘোরাই হোক। তারা ইউনিকর্নের মতোই ইউনিক।
এদের লাফিয়ে চলার ব্যাপারেই প্রথমে বলি। ক্যাঙারু লাফিয়ে চলে কারণ এরা শুধুমাত্র পেছনের দু-পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারে না। এদের পেছনের দুটি পায়ের হাড়ের গঠন ভারি অদ্ভুত। অনেকটা স্প্রিং-এর মতো কাজ করে এদের পা দু-খানা। কাজেই হাঁটার জন্য স্বাধীনভাবে পা নাড়ানো এদের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব দ্রুত চলাফেরা করতে হলে লাফানো ছাড়া উপায় নেই। অবশ্য বেশ ঠান্ডা মেজাজে থাকলে এরা চার পায়ে ধীরে ধীরে হাঁটাচলা করে।
আগেই বলেছি এরা দলবদ্ধভাবে থাকতে ভালোবাসে। স্ত্রী ক্যাঙারু বেশ শান্ত স্বভাবের হলেও পুরুষ প্রাণী কিন্তু সামান্য প্রতিযোগিতার আভাসেও বেশ হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার গ্রাসল্যান্ডে পুরুষ ক্যাঙারুদের মধ্যে ‘বক্সিং যখন তখন দেখতে পাওয়া যায়।
পেছনের দুই পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে সামনের দু-পায়ে মারামারি দেখতে বেশ মজার হলেও রাগী ক্যাঙারুর ধারে কাছে না যাওয়াই ভালো। অস্ট্রেলিয়ান ক্যাঙারু সম্রাট রজার ভালো বক্সার হিসেবেও যথেষ্ট পরিচিত ছিল।
বক্সিং-এর কারণ অনেক কিছু হতে পারে, যেমন খাদ্য, সঙ্গিনী নির্বাচন ইত্যাদি ইত্যাদি।
আবার পেটের থলেতে ছানাকে নিয়ে ঘোরার কথাই ধরা যাক।
ক্যাঙারুই শুধু একলা নয় সেখানে। বরং এটা হল মারসুপিয়াল গোত্রের অন্তর্গত প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য। ক্যাঙারু ছাড়াও কোয়ালা, ওমব্যাটস এবং ওপোসামের মতো প্রাণীরাও পেটের থলেতে শিশুসন্তানকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
‘পৈটিক’ পাউচের ব্যাপারটা আর একটু বুঝিয়ে বলি। ক্যাঙারু পাউচকে কিন্তু মাতৃগর্ভের ডিফারেন্ট ভার্শনও বলা যেতে পারে। নর্মালি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে ভ্রূণ মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠে। মায়ের শরীরের ভেতরে শিশুর সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন হয় প্ল্যাসেন্টা বা গর্ভ-ফুলের মাধ্যমে। নির্দিষ্ট সময় পরে ভ্রূণ পরিণত হলে সে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে। মারসুপিয়ালদের আবার ব্যাপার-স্যাপার অন্যরকম। জন্মের সময় তাদের অপরিণত সন্তানের আকার হয় এইটুকুনি। সদ্যোজাত মারসুপিয়াল শিশু বহুকষ্টে আঁকড়ে-মাকড়ে কোনোরকমে মায়ের পেটের থলেতে এসে ঢুকে পড়ে। এখানে বলে রাখি যে পাউচে এসে ঢুকে পড়াটা যত সহজে বললুম, তত সহজ আদতে সেটা হয় না।
ক্যাঙারু নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে তখন ক্যাঙারুর ছানার কথাই বলি। পরিণত স্ত্রী ক্যাঙারুর শরীরের ওজন প্রায় ৩৫ কিলোগ্রাম। অথচ সদ্যোজাত ছানা ক্যাঙারু অর্থাৎ জোয়ির ওজন হয় মোটে দুই গ্রাম।
আকৃতিতে যেন একটি রাজমা বীজের মতো ছোট্টো। তখনো তাদের চোখ, কান, নাক কিচ্ছু ফোটেনি। ওই অবস্থায় মায়ের জননাঙ্গ থেকে পেটের থলের দূরত্বটা তাদের কাছে নেহাত কম নয়। তবে এটাও ঠিক যে কষ্ট-মষ্ট করে একবার পাউচে চলে গেলেই একদম নিশ্চিন্ত। সেখানে মায়ের মিনি আছে, যত ইচ্ছে দুদু খাও; মায়ের শরীরের ওম রয়েছে, আরামে চোখ বুজে ঘুমোনো যায় যখন তখন।
ক্যাঙারুদের ব্যাপারে আরো একটা মজার কথা বলি। এক্ষেত্রে স্ত্রী প্রাণীরা সন্তানের জন্মের সময় ইচ্ছেমতো নির্ধারণ করতে পারে। মারসুপিয়াল গোত্রের বেশিরভাগ মায়েরা দুজন সন্তানের মধ্যে অতি অবশ্যই বয়সের পার্থক্য রাখে নয় থেকে বারো মাস। এই সময়ের মধ্যে তারা গর্ভবতী হলেও জরায়ুর মধ্যে ভ্রূণের বেড়ে ওঠা তারা থামিয়ে রাখতে পারে। প্রথম সন্তান নিজে নিজে হাঁটাচলার মতো বড়ো হলে তবেই দ্বিতীয়টির জন্ম হয়। আবার দেখো, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের আবহাওয়া বেশ শুকনো। তাই কখনো কখনো খরার সময়ও তারা ভ্রূণের বৃদ্ধি আটকে রাখে। সোজা হিসেব বাপু, খরার সময় মা-বাবারা নিজেরাই খাবার বা জল কিছু খেতে পায় না, সেখানে ছানা ক্যাঙারু এলে তাদের খাওয়াবে কী?
ক্যাঙারু ছানার মিনি খাওয়া নিয়েও বেশ কিছু মজার তথ্য রয়েছে। যেমন মনে করো, পেটের থলের ভেতরে মা ক্যাঙারুর চারটি স্তনবৃন্ত থাকে। এই চারটি বৃন্তের মধ্যে একটির আকার হয় বেশ বড়ো এবং বাকি তিনটি ছোটো। ছোটো বৃন্তগুলি একদম খুদে ছানাদের জন্য এবং বড়ো বৃন্তটি থেকে মিনি খায় একটু বড়ো বয়সের দাদা বা দিদি।
সন্তানের বয়স অনুযায়ী দুধের উপাদানও বদলে যায়। যেমন সদ্যোজাত জোয়ির জন্য তৈরি হয় একটু জোলো ধরনের দুধ। ফ্যাটশূন্য এই দুধে অল্প প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট এবং অ্যান্টিবডি থাকে প্রচুর পরিমাণে। জোয়ি যত বড়ো হয় তত দুধের মধ্যে অ্যান্টিবডি কমে যায় এবং প্রোটিন ও ফ্যাটের মাত্রাও বাড়তে থাকে সমান হারে। মা ক্যাঙারু তার শরীরে একই সঙ্গে দু-রকমের দুধ তৈরি করতে সক্ষম। বড়ো স্তনবৃন্তটি থেকে বড়ো ছানা পেট ভরায় এবং থলেতে থাকা ছোট্ট ছানা ব্যবহার করে অন্যগুলি।
বহু প্রাণীবিজ্ঞানীদের মতে মা ক্যাঙারু ইচ্ছেমতো সন্তানদের লিঙ্গ নির্ধারণ করতেও সক্ষম। অল্প বয়সে এরা স্ত্রী সন্তানের জন্ম দেয় এবং বেশি বয়সের দিকে বেশি সংখ্যক পুরুষ সন্তান জন্মানোর সম্ভবনা বেশি থাকে। তবে এই ব্যাপারে গবেষণা চলছে এবং খুব স্পষ্ট করে এখনো কিছু জানা যায়নি।
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর