মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে
প্রত্যেক মানুষই চায় তার একটা আশ্রয় হোক। আর সেই আশ্রয় হল আমাদের বাড়ি। সেটা কোনো শহরে বা গ্রামে হতে পারে। যেখানেই হোক, সেটা কোনো রাজ্যে থাকবে। আর একাধিক রাজ্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি দেশ। এরকম বহু দেশ আছে আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহে। পৃথিবীরও তো একটা আশ্রয় থাকা দরকার। সে আশ্রয় হল সৌরজগৎ। আর সৌরজগৎ যে আশ্রয়ে আছে তা হল একটি তারা-জগৎ বা গ্যালাক্সি। এরকম অসংখ্য তারা-জগৎ আছে সীমাহীন মহাবিশ্বে। আমাদের প্রত্যেকের যেমন একটা করে নাম আছে তেমন তারা-জগৎগুলোরও একটা করে নাম আছে। আমরা যে তারা-জগতে আছি তার নাম ‘মিল্কি ওয়ে’ (Milky way) যার বাংলা প্রতিশব্দ ‘ছায়াপথ’। ভারতীয় ঋষিরা ছায়াপথকে স্বর্গলোকের গঙ্গা কল্পনা করে এর নাম রেখেছিলেন ‘আকাশগঙ্গা’। এ নিয়ে ভারতীয় পুরাণে একটি উপকথা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, স্বর্গলোক থেকে গঙ্গা ভূমণ্ডলে নেমে আসার সময় মহাদেবের সুবিশাল জটার মধ্যে আটকে গিয়ে সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভগীরথ তাকে মুক্ত করলে সে ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে। সেই থেকে এই গঙ্গা স্বর্গলোক, অন্তরীক্ষলোক এবং পৃথিবীকে ভাসিয়ে চলেছে, তাই এর আরেক নাম ‘ত্রিপথগা’।
কীভাবে জানা গেল মহাবিশ্বে আকাশগঙ্গা একমাত্র তারা-জগৎ নয়?
মহাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য তারা-জগৎ। প্রতিটি তারা-জগতে রয়েছে লক্ষ কোটি নক্ষত্র, বিপুল পরিমাণ গ্যাসপুঞ্জ ও ধূলিমেঘ। অতীতে জ্যোতির্বিদরা মনে করতেন যে মহাবিশ্বে একটিমাত্রই তারা-জগৎ আছে। আর সেটা হল আকাশগঙ্গা। এই ভুল ধারণা ভাঙে দূরবীন আবিষ্কারের পর। আঠারো শতকে ডারবানের টমাস রাইট এবং দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট দূরবীনে চোখ রেখে দূর আকাশে কয়েকটি অতিক্ষুদ্র সর্পিল প্রভাময় কাঠামো দেখতে পান। ওগুলো যে অন্য কোনো তারা-জগৎ সেটা অনুমান করলেও স্পষ্টভাবে তাঁরা সে কথা বলতে পারেননি। অন্যান্য জ্যোতির্বিদরাও তাঁদের ধারণাকে সেভাবে গুরুত্ব দেননি। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, ওগুলো কোনো নীহারিকা যেখানে নতুন নক্ষত্র-জগৎ তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।
ততদিনে দূরবীন আরো উন্নত ও শক্তিশালী হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল ভাবলেন, আকাশে রাইট ও কান্ট-এর দেখা কাঠামোগুলো আরেকবার পরীক্ষা করে দেখলে হয় না? ১৯২৪ সালে তিনি দূরবীন তাক করলেন ওই দূরবর্তী কাঠামোগুলোর দিকে। ততদিনে ওই কাঠামোগুলোর নামকরণ করা হয়ে গিয়েছিল। বড়োটির নাম রাখা হয়েছিল ‘মেসিয়ার-৩১’ সংক্ষেপে ‘এম-৩১’ (Messier 31, M31)। হাবল এম-৩১-এর দূরত্ব মাপতে গিয়ে দেখলেন সেটা আকাশগঙ্গার সীমানা ছাড়িয়ে আরো অনেক দূরে রয়েছে। হিসাবে কোনো ভুল নেই তো? বার বার পরীক্ষা করে তিনি নিশ্চিত হলেন, সহস্র বা লক্ষ আলোকবর্ষ নয়, প্রায় ২২ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে এম-৩১ কাঠামোটি। তাই যদি হয়, তাহলে এম-৩১ নীহারিকা হতে পারে না, এটাকে অনেক বড়ো হতে হবে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, এম-৩১ একটি সুবিশাল তারা-জগৎ। অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত হওয়ায় এটি অ্যান্ড্রোমিডা তারা-জগৎ নামেও পরিচিত।
মহাবিশ্বে কতগুলো তারা-জগৎ আছে?
ব্যাপক গবেষণার উদ্দেশ্যে মাহাকাশে স্থাপন করা হল অতি শক্তিশালী একটি দূরবীন। নাম রাখা হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল-এর নামানুসারে ‘হাবল দূরবীন’। এরপরেই বিজ্ঞানীরা একের পর এক তারা-জগতের খোঁজ পেতে থাকেন। ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নাল’ (The Astrophysical Journal)-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে হাবল দূরবীন থেকে প্রাপ্ত ত্রিমাত্রিক ছবি থেকে যে মডেল বানানো হয়েছে তা থেকে বিজ্ঞানীদের অনুমান, দৃশ্যমান মহাবিশ্বে দু’লক্ষ কোটির (২ x ১০১২) মতো তারা-জগৎ রয়েছে।
কীভাবে সৃষ্টি হল তারা-জগৎগুলো?
বিজ্ঞানীদের অনুমান, তারা-জগতগুলোর সৃষ্টি বিগ ব্যাং-এর প্রায় কয়েকশো কোটি বছর পর। এ ব্যাপারে দ্বিমত না থাকলেও এগুলোর গঠন প্রকৃতি বা সৃষ্টি রহস্য নিয়ে মতবিরোধ আছে। একদল ‘মনোলিথিক ফরমেশন’ তত্ত্বের সমর্থক, আর অন্য দল মনে করেন তারা-জগৎগুলো গঠিত হয়েছে ‘হায়ারারকিকাল ফরমেশন’ তত্ত্ব অনুযায়ী।
মনোলিথিক ফরমেশন তত্ত্ব যারা মানেন তাঁরা মনে করেন তারা-জগৎগুলোর গঠন অনেকটা নক্ষত্রগুলো গঠনের মতো। অর্থাৎ, আদিতে মহাশূন্যে উপস্থিত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের মেঘরাশি ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে সৃষ্টি করেছে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড তারা-জগতের গঠনগুলো।
দ্বিতীয় তত্ত্ব, অর্থাৎ হায়ারারকিকাল ফরমেশন-এর সমর্থকরা মনে করেন, বৃহৎ তারা-জগৎগুলোর জন্ম বলে কিছু নেই। এগুলোর কেবলমাত্র উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটেছে। প্রথমে বিভিন্ন ক্ষুদ্র তারা-জগৎ গোষ্ঠী পরস্পর সংযুক্ত হয়েছে। তারপর অন্যান্য নানা গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এরা আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন আকাশগঙ্গা বর্তমানে পড়শি ধনুরাশির বামন তারা-জগৎটি থেকে বস্তুসামগ্রী গ্রাস করে নিজের কলেবরের বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।
তারা-জগৎগুলোর আঞ্চলিক গোষ্ঠী:
তারা-জগৎগুলো মহাকাশে বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে না। কয়েকটি বৃহৎ তারা-জগৎ এবং তাদের উপতারা-জগতৎগুলো নিয়ে তৈরি হয়েছে আঞ্চলিক গোষ্ঠী (local group)। আকাশগঙ্গা যে আঞ্চলিক গোষ্ঠীতে আছে সেখানে বৃহৎ তারা-জগৎ আছে তিনটি। সবচেয়ে বড়োটির নাম ‘অ্যান্ড্রোমিডা’ (এম-৩১)। আকাশগঙ্গার অবস্থান দ্বিতীয় স্থানে। আর তৃতীয় বৃহত্তম সদস্যটি হল ‘ট্রায়াঙ্গুলাম’ (এম-৩৩)। তিনটিই কুণ্ডলিত তারা-জগৎ। আমাদের নিকটবর্তী বড়ো তারা-জগৎ হল অ্যান্ড্রোমিডা। এর দূরত্ব ২৫ লক্ষ আলোকবর্ষের মতো। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ থেকে অ্যান্ড্রোমিডাকে খালি চোখেই দেখা যায়, তবে ট্রায়াঙ্গুলামকে দেখার জন্য অন্ধকার রাতে দূরবীন বা বাইনোকুলারের সাহায্য নিতে হবে। এই আঞ্চলিক গোষ্ঠীর অধিকাংশ তারা-জগৎই বৃহৎ ও ক্ষুদ্র ম্যাগেল্লানিক মেঘের (Large and Small Magellanic Cloud) মতো অনিয়মিত। গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণের ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুটি তারা-জগৎ সংযুক্ত হয়ে একটি নতুন ও বৃহৎ তারা-জগৎ সৃষ্টি হতে পারে। যেমন ভবিষ্যতে আকাশগঙ্গা ও অ্যান্ড্রোমিডা পরস্পর মিশে গিয়ে অতি বৃহৎ এক নতুন আকৃতির তারা-জগতের সৃষ্টি হবে, এমনই ধারণা বিজ্ঞানীদের। আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলো আবার একে অপরের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে গঠন করে একেকটি মহাতারা-জগৎ গোষ্ঠী বা মহাতারা-জগৎপুঞ্জ (Super cluster)।
নক্ষত্ররা যেমন বিভিন্ন প্রকারের হয়, তেমন তারা-জগৎগুলোও একটি প্রকারের না হয়ে বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে তারা-জগতৎগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়—(১) শঙ্খবৃত্তাকার বা কুণ্ডলিত তারা-জগৎ (Spiral Galaxy), (২) দণ্ডযুক্ত শঙ্খবৃত্তাকার বা দণ্ডাকার কুণ্ডলিত তারা-জগৎ (Barred Spiral Galaxy), (৩) উপবৃত্তাকার তারা-জগৎ (Elliptical Galaxy) এবং (৪) অনিয়মিত তারা-জগৎ (Irregular Galaxy)। এগুলো তারা-জগৎগুলোর মূল বিভাজন হলেও এদের প্রথম তিনটিকে আবার নানাভাগে ভাগ করা হয়। যেমন, তারা-জগৎগুলোর জ্যোতির উপর ভিত্তি করে একধরনের শ্রেণিবিভাগ, আবার বেতার তরঙ্গ বিকিরণের উপর ভিত্তি করেও আরেক ধরনের শ্রেণিবিভাগ করা হয়। এনিয়ে পরবর্তী কোনো এক সংখ্যায় বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রইল।
তথ্যসূত্র:
The Universe by Iain Nicolson; 1996 Horus Editions
The Firefly Encyclopedia of Astronomy edited by Paul Murdin & Margaret Penston.
The structure of the universe by J. V. Narlikar.
en.wikipedia.org › wiki › Galaxy
spaceplace.nasa.gov › galaxy
science.nasa.gov › focus-areas › what-are-galaxies
বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে