বৈজ্ঞানিকের দপ্তর-প্রতিবেশী গাছ-রুটিফল গাছ-পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়-শীত ২০২০

প্রতিবেশী গাছ সব পর্ব একত্রে

(Artocarpus altilis)

গাছে ঝোলে রুটিফল
কী বিশাল পাতা, আর
খাঁজকাটা ধারগুলো
কী বাহার! কী বাহার

একটা বাগানে প্রথম দেখা। ব্রেডফ্রুট নামটা লেখা ছিল গাছের গায়ে।পড়ে বেশ চমকে উঠেছিলাম আর খুব জানার ইচ্ছে হলো ব্যাপারটা  কী!

তার আগে অবশ্য এর সঙ্গে আমার আলাপ শুরু পাতা দিয়ে। বৃষ্টি ভেজা পথে মস্ত একটা পাতা একলা পড়ে ছিল।আমি ঝরা পাতা জমাই।তুলব ভেবে কাছে গিয়ে দেখি বিশাল সাইজ এর। কী করে খাতায় রাখব! তাই এক কাজ করি।ছবি এঁকে রাখি।যাকে বলে প্রথম দেখাতেই প্রেম, সেটাই হয়েছিল আমার।

গাছটায় খানিকটা কাঁঠালের মত দেখতে ফল হয়, সবুজ, প্রায় ১০-১২ সেমি বেড়। প্রায় দেড়শো দুশো ফল ধরে সিজনে। ভেতরে সাদা শাঁস। কাঁচা খাওয়া যায় না। আমরা যেমন বেগুন পোড়া করি, সেরকম করে সেঁকলে

পাউরুটি সেঁকার মত গন্ধ বের হয়,তাই এর নাম হয়েছে ব্রেডফ্রুট।

এই গাছ নিয়ে দুটো স্লোগান আছে:

‘Grow me, eat me’
‘Food for the future’

প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে এই গাছের রাজত্ব।পলিনেশিয়া র এই গাছের কথা প্রথম জানা গিয়েছিল ১৭৬৯ সালে নামকরা এক উদ্ভিদ বিজ্ঞানী জোসেফ ব্যাঙ্কের লেখা থেকে।উনি ছিলেন ক্যাপ্টেন কুক-এর প্রথম সমুদ্রসফর সঙ্গী। কতরকম খ্যাপাটে লোকই না ছিল,আছে এই দুনিয়ায়! আর তাই দুনিয়াটা এত রোমাঞ্চকর।

এরপর ১৭৮৭ সালে ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটি থেকে উইলিয়াম ব্লে/ব্লাই কে পাঠানো হয়েছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ কলোনীর অধীনস্থ মানুষগুলোর খাওয়ার জন্য সস্তায় পুষ্টিকর কিছু খাদ্য বের করা যায় কি না খুঁজতে। তিনি রুটিফল গাছের স্পেসিমেন নিয়ে আসেন। পলিনেশিয়ায় বসতি পেতেছিল যারা তাদের হাত ধরেই এইরকম অনেকগুলি প্রজাতির গাছের বিদেশযাত্রা। পরবর্তীকালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে ক্যারিবিয়ান, মেক্সিকোয় চলে আসে। এইসব গাছের নাম হল “canoe plant” কারণ ক্যানোয় করে আনা হয়েছিল।

১৯৭৯ সালে হর্টিকালচারিস্ট Mr.Ragoue (ন্যাশনাল ট্রপিকাল বোটানিকাল গার্ডেনের ডিরেক্টর) কাউয়াই দ্বীপে প্রথম এই গাছ আবিষ্কার করলেন। জায়গাটা হাওয়াই।

হাওয়াই দ্বীপে এই গাছের আদরের নাম “উলু।”

এখানে রয়েছে এক আস্ত প্রতিষ্ঠান উলুপুনো বা ব্রেডফ্রুট ইনস্টিট্যুট!

ভাবা যায়! একটা গাছকে নিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান! এই গাছের ফল নিয়ে কত রিসার্চ হয়, নানারকম আশ্চর্য খাবার বানানো হয় কারণ এই ফলে আছে ২০% কার্বোহাইড্রেট আর ৭০% জল। এছাড়া ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, মিনারেলে ভরপুর। পৃথিবীতে যদি কোনোদিন খাদ্যাভাব হয় তো এই একটা গাছ আমাদের বাঁচিয়ে দিতে পারবে।উলুব্রেড,প্যানকেক,ময়দা এইসব। গমের ময়দার যা ক্ষতি এই ময়দায় তা নেই,তাই মানুষকে নানাভাবে উৎসাহিত করা হয় এই খাবারে। যেমন ‘ পোই উলু’ নামে খাবার দঃপূর্ব এশিয়ায় খুব চালু।

গ্রীক শব্দ  ‘artos’ মানে bread আর ‘karpos’ মানে রুটি। বিজ্ঞানসম্মত নাম তাই Artocarpus altilis,মালবেরি প্রজাতির গাছ।

বাহারী পাতার জন্যে একে বাগানবিলাসীরা পছন্দ করে বাগানে রাখেন। ভারতে কেরালা, গোয়ায় গিয়ে দেখেছি বাড়ির সামনে সামনে এই রুটিফল গাছ। তবে বাণিজ্যিক ব্যবহার কতটা হয় জানা নেই। স্বল্পমাত্রায় হয় সম্ভবত।

এবার একটা গল্প বলি। আমার গল্প নয়, এটা হাওয়াই দেশের চালু এক উপকথা।

এই রুটিফল গাছের সৃষ্টি হয়েছিল ক্যু নামে এক যুদ্ধদেবতা র আত্মোৎসর্গের ফলে।

স্বর্গের আরাম ছেড়ে ক্যু ভেবেছিলেন মর্তের মানুষদের মত,রোদে পুড়ে, জলে ভিজে  সুখে দুখে একাকার হয়ে বাঁচবেন। তিনি চুপিচুপি এক কৃষক সেজে  মর্ত্যে চলে এলেন। বিয়ে করলেন।

বেশ ক’টি ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে দুখে কাটছিল। এমন সময় ভীষণ  দুর্ভিক্ষ এল পৃথিবীতে। মানুষ না খেতে পেয়ে আর বাঁচে না, জমি ফুটিফাটা। জল নেই। চাষ নেই। খাবার নেই।

ক্যু এর মন দুলে উঠল। তিনি সহ্য করতে পারলেন না ছেলেমেয়েদের উপোসের কষ্ট। ভাবলেন, আমার এত ক্ষমতা অথচ আমি চোখের সামনে এদের মৃত্যু দেখব,তা কি হয়? অথচ  দৈব ক্ষমতা দেখালে আর মানুষ হয়ে থাকবেন কিভাবে। সকলে বুঝে যাবে যে!

তিনি অনেক ভেবে এক উপায় বের করলেন। স্ত্রী  সন্তানদের ডেকে বললেন, আমি একটা উপায় জানি যাতে এই দুর্ভিক্ষ থেকে  সকলে মুক্তি পেতে পারে,তবে আমায় আর ফেরত পাবে না। বদলে, সকলেই বেঁচে যাবে।

এ কথা শুনে, তারা কি মানতে পারে,তবু একসময় সকলে অনিচ্ছায় একপ্রকার রাজি হল। সকলে মিলে মরে যাওয়ার চেয়ে যদি কোনো উপায় হয়।

ক্যু  তখন মাটি র ওপর নেমে দাঁড়ালেন, এবং স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ না পর্যন্ত তাঁর মাথার ওপরটুকু দেখা যায়। তারপর একসময় তাও অদৃশ্য হল। ক্যু এর পরিবার সেখানে দাঁড়িয়েই রইল আর কেঁদে কেঁদে মাটি ভিজিয়ে দিল। দিন গিয়ে রাত এলো,তাদের কান্না থামে না, তারা কেউ নড়েও না সেখান থেকে। এই করতে করতে একদিন সেই ভেজা মাটিতে দেখা গেলো সবুজ এক চারা। খুব তাড়াতাড়ি সে গাছ বেড়ে উঠেছিল আর তাতে যে ফল হয়েছিল তা দিয়ে সারা গ্রামের খাওয়ার সংস্থান হয়েছিল। কেউ আর না খেয়ে থাকেনি সে দেশে।

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s