“দীপ, এখনও অঙ্কটা শেষ করতে পারলি না?” বলতে-বলতেই রাতুল মজার ছলে দীপের মাথার চুলটা দিল ঘেঁটে।
“উফ্!” চুল ঠিক করতে লাগল দীপ। রাতুলের এই কথায় কথায় চুল ঘেঁটে দেওয়া আমাদের সক্কলের ভারি অপছন্দের। আচমকা এই কাজ করবে আর আমাদের মাথাগুলো একেকটা সজারু হয়ে উঠবে!
বেজায় ক্ষেপে গিয়ে দীপ বলল, “বিস্তর বকাঝকা খেয়েও তোর সুমতি ফেরেনি, না রে? জানিস না মাথায় হাত দিতে নেই, এতে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে?”
খিকখিক করে হাসতে হাসতে রাতুল বলল, “তোদের সবেতেই বাড়াবাড়ি। একটু হাসিঠাট্টা করার জো নেই!”
দীপকে ছেড়ে রাতুল এগিয়ে গেল পুষ্করের টেবিলে। সে তো ক্লাসের মধ্যেই টিফিন খুলে খেতে শুরু করে দিয়েছিল; রাতুল গিয়ে তাতে ভাগ বসাতে চাইতেই দুজনের মধ্যে হাঙ্গামা বেধে গেল। না তো পুষ্কর ওর ছোলা, বাদাম, ফলের ভাগ দেবে, আর না রাতুল ওকে ছাড়বে।
তখনই হেড-স্যারের সঙ্গে আমাদের ক্লাসে একজন নতুন শিক্ষক প্রবেশ করলেন। স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ইনি প্রবীর-স্যার। আজ থেকে তোমাদের জীবনবিজ্ঞানের ক্লাস নেবেন। সকলে মন দিয়ে পড়া করবে, কোনও নালিশ যেন কানে না আসে।”
এতটা বলে উনি রাতুল আর পুষ্করের দিকে কড়া দৃষ্টি হেনে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন হনহন করে। ভাবটা এই যে, ফের ক্লাসে হাঙ্গামা বাধালেই ওদের ডাক পড়ছে স্যারের অফিস ঘরে।
প্রবীর-স্যারকে দেখে মনে হল উনি ভারি হাসিখুশি মানুষ। ছাত্রদের ঝুটঝামেলার তোয়াক্কা না করে বললেন, “বাহ্, চমৎকার ক্লাস!” তারপর পুষ্করকে উদ্দেশ করে বললেন, “ও হে পালোয়ান, ওই যে খোলা টিফিন-বক্স থেকে বাদামগুলো খাচ্ছ, সেগুলোর একটুখানিও কি তোমার মগজে ঢুকছে?”
“হ্যাঁ? মগজে কেন স্যার, খাদ্য তো খাদ্যনালী দিয়ে পেটে যায় বলে জানতাম। ওপরেও ওঠে বুঝি?”
রাতুলের উত্তরে আমরা ত্রস্ত হয়ে উঠলাম। ছেলেটা করে কী, যেচে বকা খেতে চায়?
কিন্তু এ কী, প্রবীর-স্যার যে হাসছেন! রাগ করেননি তাহলে? রাতুলের মতন বিচ্ছুর ভারি বদনাম আছে এই স্কুলে। সব মাস্টারমশাই কোনো না কোনো সময়ে ওর মুখের ওপর তুখোড় উত্তর দেওয়ায় চটে গেছেন। কিন্তু প্রবীর-স্যার বললেন, “তোমাদের ক্লাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভালো মতন মানুষও করতে হবে দেখছি! চলো আজ বইয়ের পড়া নয়, ওই টিফিন-বক্সের গল্পই হোক।”
স্যারের কৌতূহলোদ্দীপক আলোচনার কথা শুনে আমরা সবাই সোজা হয়ে বসলাম।
“স্যার, সত্যিই কি বাদামগুলো মাথায় যায়?” কুন্তলের প্রশ্ন।
“যায় তো! আগে নিয়ম অনুসারে পেটে যায়, তারপর মাথায় যায়।” বললেন স্যার। তারপর বোর্ডে গিয়ে চক দিয়ে মানুষের ব্রেনের একটা স্কেচ এঁকে বললেন, “এই যে টিফিনবাবু, তোমার নাম কী হে?”
“পুষ্কর, স্যার।”
“তো পুষ্কর, ক্লাসকে দেখাও দেখি তোমার না-খাওয়া আখরোটের একটা।” পুষ্করের কাঁচুমাচু মুখ দেখে স্যার ফের বললেন, “না না, এসবের ভাগ দিতে হবে না তোমায়। আমরা শুধু এর গঠন তুলনা করব আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে।”
পুষ্কর আশ্বস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে আখরোট দেখাতে লাগল।
“কী, কেমন দেখতে? বোর্ডে আঁকা ছবিটার সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য পাচ্ছ কি?”
“হ্যাঁ স্যার, খুব পাচ্ছি! একই ধরনের দেখতে যে!” বলল শশাঙ্ক।
“শুধু দেখতে এক সেটুকুই নয়, এই খাদ্য আমাদের ব্রেনের জন্য উপকারী। তাহলেই বোঝো, সৃষ্টির কী মহিমা!”
“তাই তো, তাই তো, মামাকে বলতে হবে কাশ্মীর থেকে আখরোট এনে দিতে। তবেই কিনা বুদ্ধিমান হওয়া যাবে!”
পুষ্করের এই কথায় আমরা হাসলেও, স্যার বললেন, “এর জন্য কষ্ট করে কাশ্মীরের আখরোট খেতে হবে তার কোনও মানে নেই। যে-কোনো আখরোট খেলে চলবে, যদিও কাশ্মীরের এই জিনিস সেরা। আর বুদ্ধি কিন্তু বাড়ানো যায় অনেক উপায়ে, শুধু আখরোট খেয়ে নয়, বুঝলে পুষ্কর?” তারপর ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই স্যার এগিয়ে চললেন, “এরকম আরও অনেক খাদ্য আছে, যা আমাদের শরীরের বিশেষ কোনও অঙ্গের মতন দেখতে আর তার জন্য খাওয়াও উপকারী। তোমরা কি কেউ রাখো তাদের হদিস?”
নির্মাল্য বলল, “আমি একটা জানি স্যার, রাজমা।”
আমাদের নির্মাল্য বরাবরই রাজমা-চাওয়লের ভক্ত। সপ্তাহে অন্তত একদিন ওর টিফিনে এই খাবারটা থাকবেই। আমি বিশেষ পছন্দ করি না পদটা, ক্ষ্যাপাই ওকে দস্তুরমতো। কিন্তু তাই বলে এটা ওর এত পছন্দের পদ যে তার গুণগান গাইবে জীববিজ্ঞানের ক্লাসে, সেটা কি ভাবা যায়?
কিন্তু আবারও স্যার আমাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, “খুব ভালো বলেছ। কীসের মতন দেখতে বলো দেখি।”
“স্যার, রাজমার দানা মানুষের শরীরে কিডনির মতন দেখতে। এটা খাওয়া কিডনির পক্ষে ভালো।”
“ঠিক। রাজমাকে ইংরেজিতে বলা হয় কিডনি বিনস। এতে অনেকরকম পুষ্টি পাওয়া যায়, সেটা কি জানো তোমরা? প্রোটিন ছাড়াও হরেকরকম মিনারেলস থাকে, যেমন কপার, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস। থাকে ভিটামিন বি১২, ফোলেট ইত্যাদি।”
“দেখেছিস চিন্ময়, এই জন্যই আমি খাই রাজমা। তুই আর তার কী বুঝিস? নিজে তো মোটা চশমা এঁটে জ্যাঠামো ফলাস শুধু।” নির্মাল্য দেখি সরাসরি আমায় তাক করেছে!
বড্ড রাগ হল আমার। কোনও মানে হয়, স্যারের সামনে এমন অপ্রস্তুতে ফেলা? না-হয় একটু আধটু মশকরা করে থাকি, তাই বলে বন্ধুত্বের দাম দিবি না? এ যে একপ্রকার নালিশ!
স্যার অবশ্য এসব ছুটকো নালিশ কানে তোলেন না। তবে ওঁর অব্যর্থ লক্ষ পড়ল আমার ওপরে। “এই বয়সেই চশমা পরতে হচ্ছে? পাওয়ার তো মনে হচ্ছে ভালোই আছে।”
“হ্যাঁ স্যার, অনেক ছোটবেলা থেকেই আমার এই সমস্যা। কাছের জিনিস ডবল দেখি আর দূরের জিনিসকে দেখি আলোর-ধূলোর মেঘ!” বললাম আমি। “তবে চোখে পাওয়ার অনেক হলেও ডাক্তার বলেছেন চোখ ভালোই আছে।”
“সে তো বেশ কথা। জানো কি, চোখ ভালো রাখার জন্য কোন খাদ্য উপকারী?” স্যারের প্রশ্ন।
“হ্যাঁ স্যার, গাজর সেই সবজি।”
“কীরকম বোঝাও দেখি।”
“স্যার, গাজর থেকে ভিটামিন-এ উৎপন্ন হয়, যেটা আলোকে বিশেষ একটা সংকেতে পরিবর্তিত করে মস্তিষ্কে পাঠাতে কাজে লাগে। স্বল্প আলোয় দেখতে সাহায্য করে এই ভিটামিন।” আমি বললাম। তারপর যোগ করলাম, “গাজরকে প্রস্থচ্ছেদ আকারে কাটলে চোখের মণির মতন দেখতে লাগে।”
উত্তর বলতে আর বিশ্লেষণ করতে আমার বেশ ভালো লাগছিল। আমাদের দিয়েই একটু একটু করে স্যার কেমন সহজভাবে নিজের প্রশ্নের উত্তরগুলো বলিয়ে নিচ্ছিলেন, যেন আমরা সবাই সবটাই জানি। খোলামেলা আলোচনায় ধীরে ধীরে আমরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে লাগলাম। ততক্ষণে বোর্ডে ব্রেন-আখরোট আর কিডনি-রাজমা চিত্রের পাশে চোখ-গাজরের প্রস্থচ্ছেদ আঁকা হয়ে গেছে স্যারের।
আমি সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম, “স্যার, চোখ তো হল, কিন্তু কানের মতন নিশ্চয়ই কিছু হয় না?”
“আলবাত হয়! আমরা যাকে ব্যাঙের ছাতা বলি, সেই মাশরুম লম্বালম্বি অর্ধেক কাটলে কেমন দেখতে হয়?”
স্যারের প্রশ্নে পুষ্কর বলল, “কানের মতন!”
“সাবাস!” বাহবা জানিয়ে স্যার মাশরুমের চিত্রটা বোর্ডে আঁকলেন। সত্যিই অনেক মিল আছে মানুষের কানের সঙ্গে।
“মাশরুমে ভিটামিন-ডি আছে, যেটা শ্রবণশক্তি ভালো রাখে।” জানালেন স্যার।
“এটার কথা কে জানো?” স্যার মাশরুমের পাশে দেখলাম আরেকটা ছবি আঁকলেন। তার মধ্যে লাল চক দিয়ে রঙ ভরলেন।
“এটা তো রাঙা আলু।” উত্তর দিল কুন্তল।
“ঠিক ধরেছ। কিন্তু এটার কীসের মতন দেখতে লাগছে ভেবে দেখো তো।”
“স্যার, মনে হচ্ছে অগ্ন্যাশয়ের সঙ্গে খানিকটা মিলছে আকারে।” বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তরটা দিল মৃদুল।
“একদম। এই রাঙা আলু আমাদের প্যাংক্রিয়াস, মানে অগ্ন্যাশয়ের কাজ করার ক্ষমতা বাড়ায়। হজমের জন্য অগ্ন্যাশয়ের সঠিকভাবে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি। আরও একটা গুণ আছে রাঙা আলুর—ডায়াবেটিস, মানে রক্তে চিনির মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটা দক্ষ।”
“বাহ্, বেশ তো! রাঙা আলুর সবরকম পদ আমার খেতে কী যে ভালো লাগে!” বলল রূপম।
“গবেষণা বলে, এই রাঙা আলু প্যাংক্রিয়াটিক ক্যান্সার, মানে অগ্ন্যাশয়ের কর্কটরোগ আটকাতে পারে।” বললেন স্যার। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা নিশ্চয়ই জানো কর্কটরোগ কী?”
স্যারের জিজ্ঞাসায় নির্মাল্য বলল, “এটা একধরনের মারণ রোগ বলা যায়। যেখানে অস্বাভাবিক কিছু কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজিত হয়, পরের পর শরীরের টিস্যু ধ্বংস করতে থাকে। এই ব্যাপারে গবেষণার শেষ নেই।”
“ঠিক।” স্যারের মন্তব্য, “এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যায়, কিন্তু তাহলে আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় থেকে হারিয়ে যাব। আজকের জন্য আমরা আমাদের আলোচ্য প্রসঙ্গে মন দিই। এইখানে একটা তথ্য জানিয়ে রাখি,” বলে স্যার বোর্ডে খানিকটা গাছের মতন দেখতে একটা ছবি আঁকলেন। “অন্যান্য বিভিন্ন খাবার ছাড়াও, ব্রকলি কিছু কিছু কর্কটরোগ আটকাতে সাহায্য করে। আঁকাটা দেখছ কি তোমরা? ছবিতে এটা ব্রকলি। এর ভালোই সাদৃশ্য আছে বাড়তে থাকা একগুচ্ছ ক্যান্সার কোষের সঙ্গে।” তারপর কিছু সমকেন্দ্রিক বৃত্ত এঁকে বললেন, “কোষের কথা যখন উঠল, তখন ভেবে বলো তো এই যে কোষের নমুনা আঁকলাম, এরা কীসের মতন দেখতে লাগছে?”
“পেঁয়াজের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে মনে হচ্ছে?” অনুমান করার সুরে বলল কমলেশ।
“ঠিক ধরেছ। টুকরো করা গোল গোল পেঁয়াজ অনেকটা কোষের আকারে দেখতে হয়। এরা কোষের বর্জ্য জিনিস সরাতে সাহায্য করে। আরও কী জানো? পেঁয়াজ কাটতে গেলে চোখে জল আসে, সেটা কিন্তু একদিক থেকে ভালোই। কারণ সেটার মাধ্যমে চোখ পরিষ্কার হয়ে যায়।”
“স্যার, আমিও একটা বলতে চাই।” স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করতে চাইল রাতুল। আমরা সক্কলে অবাক, রাতুল তো সচরাচর কোনও স্যারের পড়ার উত্তর দিতে পারে না। সারাক্ষণ যে মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি ঘোরে! ও কিনা নিজে থেকে যেচে আলোচনায় ঢুকছে?
স্যারের সম্মতি পেয়ে এবার সে নিজে বোর্ডে গিয়ে একটা ছবি আঁকল। আমরা তো ভাবলাম বুঝি আবারও মশকরা করছে এইভাবে, কারণ বোর্ডে যা এঁকেছে সেটার কোনও নির্দিষ্ট আকার নেই। কিন্তু স্যারকে মিটিমিটি হাসতে দেখে আমরা উদগ্রীব হলাম ব্যাপারটা বোঝার।
“বোঝাই যাচ্ছে রাতুলের ভারি ক্ষিদে পেয়ে গেছে। তারই সংকেত দিচ্ছে আমাদের।”
তারপর রাতুলের আঁকাটাই আর একটু উন্নত করতে শশাঙ্ক বলে উঠল, “আরে এটা তো আদা! তুই আদাও খাস রে রাতুল?”
“আদা কে না খায়? আমরা বাঙালিরা তো হরেকরকম রান্নাতে আদা ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু তোমরা কি বুঝতে পারছ এটা আমাদের শরীরের কোন অঙ্গের মতন দেখতে?”
আমরা সবাই নিরুত্তর দেখে রাতুল বলে দিল, “আমাদের পাকস্থলীর সঙ্গে আদার আকারের সাদৃশ্য আছে। দেখো তো কেমন আজব আকার!”
“কিন্তু আদা কি পেটের জন্য উপকারী?” শশাঙ্ক ফের প্রশ্ন করে।
“নিশ্চয়ই। আদা সাহায্য করে গ্যাস্ট্রো-ইনটেস্টাইনাল নালী দিয়ে সহজে খাবারের চালনা করতে। তাছাড়া গ্যাস কি বদহজম হোক অথবা শরীরে টান ধরুক, বমি ভাব হোক কি পেট ফুলে উঠুক, এই আদা এইসব ক্ষেত্রে নিরাময় দিতে পটু। শুধু কি তাই? রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, হৃদরোগ আটকানো বা ফুসফুসকে সুস্থ রাখা—আদা অনেকভাবে কার্যকরী। তার কারণ, এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে যেগুলো অনেক প্রকার জীবাণু থেকে শরীরকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট মনে আছে তো কী?”
“হ্যাঁ স্যার,” কমলেশ বলল, “এরা শরীরে দরকারের বেশি অক্সিডেশন আটকায়, যাতে সমপ্রতিক্রিয়া ধারায় শরীরের কোষ নষ্ট না হয়।”
“এত জানতাম না স্যার, তবে পকেটে আমার কাঁচা আদা-কুচি রাখার অভ্যাস আছে বরাবরই। আমার বিটকেল খাওয়াদাওয়া এ দিব্যি হজম করিয়ে দেয়।”
“তাই বলে আনাড়ি যা খুশি খেয়েও পেট খারাপ বাধাস না রাতুল, এরপর আমাদের টিফিন খেয়ে বলবি আমাদের খাবারেই গণ্ডগোল ছিল। সব কিছুর দাওয়াই তো আর তোর কুচো আদা হতে পারে না!” ফিসফিস করে বলল পুষ্কর, শুনতে পেলাম। তবে রাতুল ওর কথা পাত্তাই দিল না।
পুষ্কর এতক্ষণে ওর টিফিন-বক্স খোলা পড়ে থাকার কথা ভুলেই গিয়েছিল। খেয়াল পড়ল রাতুলের কথায়, “কয়েকটা আঙুর দে তো।”
ব্যস্ত হয়ে পুষ্কর বন্ধ করতে গেল সেটা। “আমার সব ফল কি তুই খেয়ে নিবি? নিজের টিফিন খাস আবার ক্লাসে সবারটায় ভাগ বসাস। সবশেষে আদা খাস। আর এখন তো ক্লাস চলছে, নাকি?” বলল ঠিকই কিন্তু একটা ছোটো ডাল ধরিয়ে দিল রাতুলের হাতে। সে বেজায় খুশি হয়ে গেল, কিন্তু খাওয়ার চেষ্টা না করে উঠে দাঁড়াল।
“করিস কী? বকা খাওয়াবি নাকি আমাকেও? খাচ্ছিস খা, কিন্তু ক্লাসের পর। স্যারকে দেখানোর কী আছে? জানিস না ক্লাস চলাকালিন খেতে নেই?” পুষ্কর বিস্ফারিত চোখে দেখতে লাগল রাতুলকে আর অনবরত ওকে আটকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ওর হাত-পা ধরে টানাটানি করতে লাগল।
“আরে তুই তো বড্ড ভিতু! দেখ না কী করি।” বলেই স্যারকে ডাক দিল। পুষ্কর তো পারলে টেবিলের তলায় লুকোয়। একটু আগেই যে দীপের চুল লণ্ডভণ্ড করে ওর টিফিন নিয়ে গোল বাধিয়েছিল। তাকে যে কোন আক্কেলে বিশ্বাস করল সেটাই ও মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগল। নিশ্চয়ই বরাবরের মতন আবারও কোনও নতুন ফন্দি আঁটছে ছেলেটা। এদিকে ও পড়বে দুর্বিপাকে। হেড-স্যারের কটমট করে তাকানো রাতুল ভুলে গেলেও, ও তো ভোলেনি!
স্যার এদিকে রাতুলের ডাকে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিলেন, যেন ওদের ইশারায় বলা সব কথার সব কিছুই উনি জানেন। না-হলে উনি ইতিমধ্যে বোর্ডে আঙুরগুচ্ছের ছবি আঁকলেন কি এমনিই?
রাতুল বলল, “স্যার, এই ফলটা খেতেও ভালো, আবার উপকারী।”
“বলো তো কীসের মতন দেখতে লাগছে এটা?”
“ফুসফুস স্যার! হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট—নানান সমস্যায় স্বস্তি দেয়।” সাহস ফিরে পেয়ে টেবিলের তলা থেকে মুখ বের করে বলল পুষ্কর।
“বাহ্, ব্র্যাভো মাই বয়!” খুশি হলেন স্যার। “কিন্তু এত অল্পতেই এত দুরুদুরু বুকের অবস্থা কেন? হার্ট স্ট্রং রাখতে হবে তো, নাকি? এই তো সময়, দুঃসাহসী কাজ করার। অবশ্যই কোনও অন্যায় কাজ নয়। আচ্ছা, কে বলতে পারবে, কোন খাদ্যকে আমাদের হৃদযন্ত্রের মতন দেখতে?”
দীপ হাত তুলে বলল, “টমেটো, স্যার! আধাআধি কাটলে টমেটোকে দেখা যায় হার্টের মতনই বিভক্ত চার ভাগে, রঙটাও লাল।”
“হ্যাঁ, আমার বাবা তো হার্টের ডাক্তার, কার্ডিওলজিস্ট।” লাফিয়ে উঠল এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা মহিম। “আমি শুনেছি টমেটোতে লাইকোপিন নামের একটা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যেটা হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।”
“ঠিক বলেছ তোমরা।” ইতিবাচক ঘাড় নেড়ে বোর্ডের দিকে নতুন আঁকা ছবিটা দেখিয়ে স্যার ফের বললেন, “টমেটোর গঠন হার্টের মতন দেখতে হওয়ায় একে অনেক সময় হার্টের খাদ্য বলা হয়। পটাশিয়াম, ভিটামিন-সি, ফাইবার, ফোলেট প্রভৃতিতে ভরপুর এই টমেটো।”
আমাদের আলোচনায় ইতি টেনে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে ক্লাসের সমাপ্তি ঘোষণা হল।
“এখন তো লাঞ্চ ব্রেকের ঘণ্টা পড়ল, তাই না?” স্যার জিজ্ঞাসা করতে আমরা সবাই মাথা নাড়লাম।
“এখন কি করা হবে তাহলে? অঢেল দুষ্টুমি?”
“না স্যার, আমরা টিফিন খাওয়ার পর ফুটবল খেলি মাঠে।” আমি বললাম।
“বাহ্, ফুটবল আমারও ভীষণ পছন্দের খেলা। এককালে কত খেলতাম। আমার তো একসময় ইচ্ছে ছিল ফুটবল কোচ হওয়ার।”
“স্যার আমাদের শেখাবেন?” জিজ্ঞাসা করল শশাঙ্ক।
“কোনও একদিন নিশ্চয়ই মাঠে নামব তোমাদের সঙ্গে। তখন হয়তো আমাকেই শিখতে হবে তোমাদের থেকে কত কিছু। ঠিক যেমন আজ তোমরা ছাত্ররাই ক্লাস নিলে। ভেবে দেখো দেখি, কেমন লাগল।”
“দারুণ লাগল স্যার!” সমস্বরে বললাম আমরা।
“কিন্তু কী যে বলেন স্যার! আপনি তো দিব্যি কৌশলে আমাদেরকে দিয়ে কত কিছু বলিয়ে নিলেন।” বলল নির্মাল্য। “আমরা নিজেরাও জানতাম না যে সকলে মিলে এত কিছু জানি!”
“এই কারণেই তো ক্লাস! সকলে মিলি করি কাজ।” বললেন স্যার।
“তবে স্যার,” রাতুল উঠে দাঁড়াল আবার, “মজবুত পায়ের কোনও দাওয়াই কি জানা আছে?”
“মজবুত পা মানে সবার আগে মজবুত হাড়। ক্যালসিয়াম আছে এমন সব খাবারে হাড় মজবুত হয়।” স্যার বললেন। “তবে হাড়ের মতন দেখতে একধরনের শাক আছে, তোমরা কি কেউ জানো?”
আমরা সবাই চুপ দেখে স্যার বললেন, “একে সেলারি বলে। এই শাকের আঁটি অনেকটা মানুষের শরীরে হাড়ের মতন দেখতে। এতে ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম থাকে। মজবুত হাড়ের এই উপাদানগুলোই হল গুপ্ত চাবিকাঠি।” একটু থেমে স্যার এবার বললেন, “যেসব খাদ্যের কথা আজ বললাম, যেটুকু বললাম, তার থেকেও তাদের পুষ্টিসংক্রান্ত ক্ষমতা কিন্তু অনেক বেশি। একই পুষ্টি দিতে পারে অনুরূপ আরও খাদ্য আছে। সে-তালিকার শেষ নেই। তাই তো বলি, স্বাস্থ্যকর খাও, সুস্থ থাকো।”
স্যার বেরিয়ে গেলে আমরাও টিফিন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। নিজেদের আনা টিফিনে কোনও জিনিস কোনও অঙ্গের গড়নের সঙ্গে মিল আছে কি না, সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ ব্যতিব্যস্ত হয়ে রইলাম। মুখিয়ে রইলাম আমরা প্রবীর-স্যারের পরবর্তী ক্লাসের জন্য।
[তোমরা কি প্রবীর-স্যারের বোর্ড-ওয়ার্ক দেখেছ? আমি কিন্তু দেখেছি, অল্পস্বল্প নোটসও নিয়েছি। এমনি করে টুকটাক নোটস নিলে আমার মনে রাখতেও সুবিধা হয়। কী বললে? দেখবে? এই দেখো, আমার খাতা থেকে দিলাম তোমাদের জন্য।]
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর
দারুণ
LikeLike
ধন্যবাদ!
LikeLike