FUNবিজ্ঞান-ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক -রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন-অরূপ ব্যানার্জি-শরৎ২০২২

ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে 

bigganrosalind (1)

১৯৪২ সাল। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রোজ সন্ধেয় দেখা যেত রোগাপাতলা একটা মেয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে দেখছে কোনও বাড়ি বা ছাত্রাবাসে আলো জ্বলছে কি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। জার্মান নাজি বাহিনী লন্ডন শহরে আকাশ থেকে বোমা ফেলছে। মেয়েটা ‘ওয়ার ওয়ার্ডেন’, যার কাজ হল নাগরিকদের আসন্ন বোমার আঘাত থেকে বাঁচানো। অন্ধকার রাতে নীচে আলো দেখতে পেলেই বোমারু বিমান থেকে ছুটে আসবে প্রাণঘাতী বোমা। মুহূর্তে গুঁড়িয়ে যাবে বাড়ি, মানুষের রক্তে লাল হবে মাটি। তাই মেয়েটি দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছে আলো নিভিয়ে রাখতে। রাত বেশি হলেই আবার সে ফিরে যাবে তার ল্যাবে।

আসলে সেই মেয়েটি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত এক ছাত্রী। কেমব্রিজের অধীনে নিউনহ্যাম কলেজ থেকে সদ্য সে ব্যাচেলর ডিগ্রি পেয়েছে বিজ্ঞানে। তার প্রিয় বিষয় রসায়ন। অঙ্কে বেজায় আগ্রহ। বিজ্ঞানের সব রহস্য সমাধানের আসল চাবিকাঠি যে আঙ্কের মধ্যে লুকিয়ে, স্কুল থেকেই এ-ব্যাপারে তার দৃঢ় বিশ্বাস। আর দশটা মেয়ে যখন দর্শন নিয়ে পড়ে, সেলাই-ফোঁড়াই শিখে নিয়ে সংসারে ঢুকে পড়ছে, এই মেয়ের কেবল আরও পড়াশুনো করতে ইচ্ছে করে। কোনও পদার্থের উপর আলো পড়লে তার মধ্যে কী জাতীয় বিক্রিয়া হয়, সেই নিয়ে চলছে তার কাজ। বাড়ির লোকেরা বলছে, ‘অনেক হয়েছে পড়াশুনো। এবার একটা বিয়ে দিই তোমার। সংসারধর্ম আর কবে পালন করবে?’ সেই শুনে মেয়ে বাবা-মাকে পাত্তাই দেয় না। তাকে যে অনেক দূর যেতে হবে। একে একে খুলতে হবে বিজ্ঞানের রহস্যের দরজা।

মেয়েটার নাম রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন। ১৯২০ সালে এই লন্ডন শহরেই তার জন্ম এক সচ্ছল ইহুদি পরিবারে। পরিবারের অনেকে রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। তাই রোজালিন্ডের নিজের রাজনৈতিক মতবাদও বেশ জোরালো। তবে তার আগ্রহ বেশি লেখাপড়ায় আর খেলাধুলোয়। পাহাড়ে চড়া তার শখ। ছোটবেলা থেকেই সে অন্যরকম। বন্ধুর সংখ্যা হাতে গোনা। চারপাশে তাকে নিয়ে নানা কথা, নানা বক্রোক্তি। সে যে আর পাঁচটা মেয়ের থেকে আলাদা। তাই সে নিজেকে গুটিয়ে সহপাঠীদের বৃত্তের বাইরে রাখতেই পছন্দ করে।

তার ডাক নাম এলসি। এই নামে তার মাসির এক মেয়ে ছিল, রোজালিন্ডের জন্মের দু-বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুতে সে মারা যায়। মৃতার নাম স্মরণীয় রাখতে রোজালিন্ডের নাম রাখা হয় এলসি। তারা কেউ জানত না, এই মেয়ের হাত ধরে একদিন ঘাতক স্প্যানিশ ফ্লুয়ের রহস্যময় রোগের পিছনে লুকিয়ে থাকা ভাইরাসের গবেষণার কারণে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এলসির নাম।

ভাগ্যক্রমে রোজালিন্ড লন্ডনের সেন্ট পলস গার্লস স্কুলে ভর্তি হয়। ভাগ্য এই কারণে যে, সেখানে মেয়েদের বিশেষভাবে বিজ্ঞানের তালিম দেওয়া হত। শুধু তাই নয়, সেই স্কুলে মেয়েদের শেখানো হত সমাজে তাদের অনেক কিছু ছাপ রেখে যাওয়ার আছে, শুধু সংসার সামলানোই তাদের একমাত্র করণীয় নয়। তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাপটের মাঝে এ ছিল একেবারে নজিরবিহীন শিক্ষা।

অসাধারণ নম্বর পাওয়ায় অনেক পুরস্কার রোজালিন্ডের ঝুলিতে আসে। একবার পুরস্কার হিসাবে তাকে বেছে নিতে বলা হল একটা বই। রোজালিন্ড যে বইটা নিল সেটি ছিল স্বনামধন্য পদার্থবিদ আর্থার এডিংটনের লেখা বই ‘দ্য নিউ পাথওয়ে ইন সায়েন্স’, যাতে সবে জন্ম নেওয়া বিষয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নানাদিকের কথা আলোচনা করা হয় সরল ভাষায়। মাত্র বারো বছর বয়সে রোজালিন্ডের পরিচয় হল পারমাণবিক দুনিয়ার নানা অদেখা জগতের সঙ্গে।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানে স্নাতক হবার জন্য ভর্তির পরীক্ষা দিল রোজালিন্ড। সেই ভর্তি হওয়া কিছু সহজ কাজ ছিল না। পরীক্ষা বেশ কঠিন ছিল, পদার্থবিদ্যায় ও রসায়নে পাশ করলে তবেই মিলত প্রবেশাধিকার। রোজালিন্ড দুটি বিষয়েই ভালো নম্বর পেল তাই নয়, রসায়নে তার নম্বর ছিল সবচাইতে বেশি।

নিউনহ্যাম কলেজ তখন বিজ্ঞান পাঠের সবচাইতে উপযুক্ত পীঠস্থান। সেখানে যেমন সব প্রতিভাধর মাস্টারমশাইরা ক্লাস নেন, তেমনি সেখানে দুর্দান্ত সব গবেষণাগার। কিন্তু ভর্তি হয়ে সেখানে রোজালিন্ডের জীবনে আসতে লাগল বাধা। ব্রিটেনেও তখন ইহুদিদের খুব উঁচু নজরে দেখত না মানুষ, যদিও জার্মানির নাজি বাহিনীর মতো প্রাণে মেরে ফেলতে চাইত না তারা। হিটলার তখন ইহুদি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, যার ঢেউ উঠছে অন্য দেশেও।

রোজালিন্ড এখানে বিজ্ঞান পাঠের পাশাপাশি হকি, টেনিস তো খেলেই, মাঝে মাঝে চলে যায় সাইকেল চালিয়ে বহুদূর। ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি তার প্রিয় বিষয়। অণু-পরমাণুর খেলার সাথী হয়ে সেই বিষয়ে তার আগ্রহ বাড়তেই থাকে। বন্ধুত্ব হয় আরেক ইহুদি মেয়ে এড্রিয়েনের সঙ্গে; সে তখন ধাতুর রাসায়নিক গঠনের উপর গবেষণা করছে। বয়সে বড়ো গবেষকের সান্নিধ্যে তার রসায়নে গবেষণা করার ইচ্ছে বেড়ে যায়।

নিউনহ্যাম কলেজে শুধু মেয়েরাই পড়ত। কিন্তু তাদের ব্যাচেলার ডিগ্রি দেওয়া হত না। ডিগ্রি জুটত শুধু ছেলেদের কপালে। কিন্তু এই কলেজে রোজালিন্ডের উন্নতি হল আকাশছোঁয়া। তাকে অবজ্ঞা করে কার সাধ্য! তাই সসম্মানে কলেজ উত্তীর্ণ হলেন রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। এখন তিনি আর কিশোরী নন। উচ্চশিক্ষা নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। পি.এইচ.ডি করতে ভর্তি হলেন নিজের কলেজ নিউনহ্যামে।

রোজালিন্ডের গাইড হলেন অধ্যাপক রোনাল্ড নরিস। তিনি তখন স্পেক্ট্রোমেট্রির বিধাতা পুরুষ। নিত্যনতুন বস্তুর উপর নানারকম আলো ফেলে তাদের কেলাস গঠনের তারতম্য, অর্থাৎ রাসায়নিক ধর্মের উপর আলোর প্রভাব নিয়ে অনেক কাজ করছেন। বেশ নামডাক তার। বছর খানেক রোজালিন্ড অধ্যাপক নরিসের সঙ্গে কাজ করে অনেক কিছু শিখলেন, কিন্তু যেই গবেষণায় রোজালিন্ড তাঁর নিজস্বতা দেখাতে চাইলেন, নরিস মেনে নিতে পারলেন না। ছাত্রীর কোনও নতুন কাজ তিনি একেবারেই নাকচ করে দিতে লাগলেন। রোজালিন্ড তাঁর নিজের পথে চলতে ভালোবাসতেন আর নরিসের অনেক কাজের মধ্যে ত্রুটিবিচ্যুতি দেখতে পেতেন। কাজেই সেই কাজ থেকে তাঁকে বাধ্য হয়েই ইস্তফা দিতে হল।

এবার রোজালিন্ড কাজ জোটালেন ব্রিটিশ কোল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনে। সেখানে কয়লার প্রকৃতির উপর গবেষণা শুরু করলেন। কয়লার কেলাসের মধ্যে অনেক ছিদ্র এবং ফাঁকা জায়গা থাকে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘পোরস’। সেই ফাঁকা জায়গার বা পোরের মধ্যে দিয়ে কোনও গ্যাস পাঠালে কতটা গ্যাস কয়লার মধ্যে দিয়ে চলে যেতে পারে, তার উপর ভিত্তি করে কয়লার গুণমান বার করার পদ্ধতি বার করে ফেললেন রোজালিন্ড। এই কাজে তিনি নিষ্ক্রিয় হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করে সাফল্য পেলেন। রোজালিন্ড কয়লার কেলাসের আভ্যন্তরীণ গঠনের মাপজোক করেন এই পদ্ধতিতে। তিনি লক্ষ করেন, যত কয়লার তাপমান বাড়ে, ততই তার ভিতর দিয়ে গ্যাস চলাচল করে কম। আণবিক মাত্রায় কয়লার উপর এমন কাজ তখন একেবারে নতুন এবং তিনিই এই কাজের প্রথম কৃতিত্বের অধিকারী। পরবর্তীকালে কার্বন ফাইবার তৈরিতে তাঁর এই গবেষণা বিশেষভাবে কাজে আসে।

সেই সময়ে ভালো কয়লা কাজে লাগত বাষ্পচালিত জাহাজে। সামরিক বাহিনীর কাজে এল এই আবিষ্কার। কারণ, তখন যুদ্ধ চলছে আর যুদ্ধে লাগছে অনেক কয়লা। রোজালিন্ড তাঁর আবিষ্কারের জন্য বেশ নাম করে ফেললেন।

১৯৪৫ সালে রোজালিন্ড পি.এইচ.ডি ডিগ্রি পান। সেই বছরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। রোজালিন্ডের ডাক আসে প্যারিসের ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্স রিসার্চ থেকে। সেখানে রসায়ন গবেষণাগারে যুদ্ধের সময় নানাধরনের উন্নতমানের বারুদ তৈরির প্রক্রিয়া চলত। যুদ্ধ থেমে যেতে সেখানে আধুনিক বাণিজ্যিক দ্রব্য তৈরি হওয়া শুরু হল। রোজালিন্ড সেখানে কাজের অনেক স্বাধীনতা পেলেন। স্কুলে পড়ার সময় তিনি ফরাসি ভাষা শিখে নিয়েছিলেন। কাজেই প্যারিসে কাজ করতে তাঁর একটুও অসুবিধা হল না।

প্যারিসের গবেষণাগারে রোজালিন্ড কাজ করতেন বিজ্ঞানী জ্যাকুইস মেরিংয়ের অধীনে। মেরিং এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। রোজালিন্ড তাঁর কাছ থেকে অনেক কাজ শিখলেন। একেবারে নতুন ধরনের কাজ শিখতে গিয়ে রোজালিন্ড দিনের বেশিরভাগ সময় ল্যাবেই কাটাতেন। এখানে তাঁর বন্ধুবৃত্ত বেশ বড়ো হয়। কিন্তু তাঁর থাকার জায়গাটা বিশেষ সুবিধের ছিল না আর তাঁকে অনেক কম মাইনের চাকরিতে রাখা হয়েছিল। কাজ-পাগল রোজালিন্ড তাঁর কাজকে এতই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে অন্য বাধাগুলোকে তুচ্ছ করতে দ্বিধা করতেন না।

(এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি অতি ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে কোনও পদার্থের অণুদের গঠন এবং সজ্জা অতি সংবেদনশীল মাইক্রোস্কোপে ধরা পড়ে না, নেওয়া যায় না তার ছবি। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে এই গঠন ধরা পড়ে। আরেকটি উপায় হল এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি। এই পদ্ধতিতে পদার্থের এক নমুনার উপর ফেলা হয় এক্স-রে। এই রশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য খুব ছোটো। নমুনার উপর এক্স-রে পড়লে তার বিচ্ছুরণ হয়। বিচ্ছুরিত রশ্মি একটা ফটোগ্রাফির পর্দায় ফেলে ছবি তোলা যায়। ছবির অন্ধকার দাগগুলো বোঝায় অণুর অস্তিত্ব। দাগগুলো কতটা গভীর, তা দিয়ে বোঝা যায় অণুদের অবস্থানের ঘনত্ব। দাগগুলোর মধ্যে দূরত্ব মেপে কেলাসিত নমুনার গঠন বোঝা যায়। কেলাসিত না হলে অণুরা নড়াচড়া করে এবং ছবি তোলা মুশকিল হয়ে যায়। ডি.এন.এ একটি সজীব পদার্থ। কিন্তু সজীব পদার্থকে কেলাসিত করার উপায় আছে বিজ্ঞানীদের হাতে।)

তিন বছর এই গবেষণাগারে কাজ করার পর রোজালিন্ড লন্ডনে ফিরে যেতে চাইলেন। তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে আবেদন করেন গবেষক পদের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আবেদন মঞ্জুর হয়, কারণ তাঁর কাজের সুখ্যাতি বিজ্ঞান-মহলে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল। কিংস কলেজে তাঁকে প্রোটিনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার উপর কাজ করতে দেওয়া হল। আবার এক নতুন কাজ, তবে অনেকটা জীবতত্ত্ব ঘেঁষা কাজ, যাতে রোজালিন্ড কোনোদিন উৎসাহ পাননি। কিন্তু নতুন কাজকে প্রত্যাখ্যান না করে সেই কাজ শিখে ও নিজের অধীত বিদ্যাকে যথাসাধ্য কাজে লাগিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করতে লাগলেন রোজালিন্ড।

খুব শিগগির কিংস কলেজে নিউক্লিক অ্যাসিডের এক বিশেষ নির্যাস পরীক্ষা করতে পাঠানো হয় অন্য এক পরীক্ষাগার থেকে। নিউক্লিক অ্যাসিড, অর্থাৎ প্রাণের আসল স্পন্দন ডি.এন.এ-এর উপর পরীক্ষা করার দায়িত্ব পড়ল রোজালিন্ডের উপর। কারণ, তাঁর এক্স-রে স্পেক্ট্রোস্কোপির অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইছিল কর্তৃপক্ষ। সেই সময়ে কিংস কলেজের পরীক্ষাগারের প্রধান ছিলেন জন র‍্যান্ডাল। এই জ্ঞানী ব্যক্তিটিকে ‘চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া’ বলে ডাকত গবেষকরা। রোজালিন্ড র‍্যান্ডালের খুব কাছ থেকে কাজ করতে করতে নানা নতুন বিষয় জানতে পারলেন। চটজলদি নতুন পাঠ বুঝে নিতে তাঁর সময় লাগত না বলে খুব কম সময়েই ডি.এন.এ ফাইবারের উপর দারুণ কাজ করতে লাগলেন রোজালিন্ড।

কিংস কলেজে ছিল অত্যাধুনিক গবেষণার যন্ত্রপাতি আর রোজালিন্ড একেবারে বাজারে আসা নতুন যন্ত্র কিনে ফেলার স্বাধীনতাও পেলেন। তাই আধুনিক এক্স-রে টিউব আর একটা মাইক্রো-ক্যামেরা কিনে ডি.এন.এ অণুকে বড়ো করে দেখতে চেষ্টা করতে লাগলেন। রোজালিন্ডের কাজে র‍্যান্ডাল হস্তক্ষেপ করতেন না, তাই রোজালিন্ড ডি.এন.এ-এর উপর তাঁর কাজ সম্বন্ধে প্রচুর গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ফেললেন। র‍্যান্ডাল রোজালিন্ডকে একজন গবেষণাগার সহায়ক দিলেন কাজের সুবিধের জন্য, তার নাম গসলিন। এই সহায়কটি রোজালিন্ডের কাজের দক্ষতা আর জ্ঞান দেখে এবং তাঁর ভিতরে বাস করা এক অন্য নরম মনের মানুষ বুঝে, তাঁর সঙ্গে কাজে নিজের জান লাগিয়ে দিল।

কিংস কলেজে রোজালিন্ডের সহকর্মী ছিলেন পদার্থবিদ মরিস উইলকিন্স। প্রথমদিকে রোজালিন্ডকে তাঁর সাহায্য নিতে হত এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফিতে। কিন্তু নিজের দক্ষতায় রোজালিন্ড কিছুদিনের মধ্যেই উইলকিন্সকে নিজের কাজে দখলদারি করতে দিতে অস্বীকার করতে লাগলেন। গসলিন আগে উইলকিন্সের সহায়ক হয়ে গবেষণা করছিল। রোজালিন্ডের কাছে সে চলে যাওয়ায় রেগে গিয়ে উইলকিন্স রোজালিন্ড-গসলিন জুটির সব কাজে বিরোধিতা করতে লাগলেন। কিংস কলেজের গবেষণাগারের প্রধান র‍্যান্ডাল এই ব্যাপারে উদাসীন হয়ে থাকলেন। রোজালিন্ড আর উইলকিন্সের ঝগড়া চলতে থাকল। এই বিরোধিতা চরমে উঠল একটি কনফারেন্সে। উইলকিন্স তাঁর এক বক্তৃতায় উল্লেখ করলেন যে, ডি.এন.এ খুব সম্ভব দুটি নিউক্লিক অ্যাসিডের প্যাঁচানো এক শৃঙ্খল। আসলে এই রহস্যের হদিস পেয়েছিলেন রোজালিন্ড, কিন্তু তাঁর নাম উল্লেখ না করে উইলকিন্স এমন ভাব দেখালেন যেন এই আবিষ্কারের সব কৃতিত্ব তাঁরই। আর যায় কোথা! রোজালিন্ড কনফারেন্স হলে সর্বসমক্ষে উইলকিন্সকে নিন্দেমন্দ করা শুরু করলেন। এবার ঝগড়ার সব বাঁধ ভেঙে গেল। উইলকিন্সের আসল সমস্যা ছিল একজন রসায়নবিদ কেন ডি.এন.এ-র ব্যাপারে নাক গলাবে।

সব বাধা কাটিয়ে রোজালিন্ড ডি.এন.এ-র নমুনার উপর এক্স-রে ফেলে এক্স-রে ডিফ্রাকশন পদ্ধতিতে ক্যামেরায় ডি.এন.এ-র ছবি তুলে ফেললেন। মইয়ের মতো প্যাঁচানো দুটি নিউক্লিক অ্যাসিডের মালা ধরা পড়ল ছবিতে। কিন্তু এই ছবি খুব পরিষ্কার ছিল না। ডি.এন.এ-র এই রূপের সঠিক প্রমাণ তখনও এল না। কিংস কলেজে আরও অনেক বিজ্ঞানী ডি.এন.এ-র উপর কাজ করছিলেন। তাঁরা জেনেছিলেন যে ডি.এন.এ কেলাস অবস্থায় থাকতে পারে। রোজালিন্ড আবিষ্কার করেছিলেন একবারে শুকনো অবস্থায় ডি.এন.এ কেলাসিত হয়। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘এ টাইপ ডি.এন.এ’। যেই তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বাড়ানো হয়, তখন ডি.এন.এ জলের অণুর সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটায়। রোজালিন্ড ডি.এন.এ-র এই রূপের নাম দিলেন ‘টাইপ বি ডি.এন.এ’। কিন্তু আবার সেই এক সমস্যা—আর্দ্র অবস্থায় ডি.এন.এ-র ছবি আর পরিষ্কার আসে না। রোজালিন্ড ও গসলিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকলেন আর্দ্রতা আর তাপমাত্রা বাড়িয়ে-কমিয়ে যদি কোনও উপায়ে পরিষ্কার ছবি তোলা যায়। আর সেই কাজে সাফল্য এল। এক নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় পরিষ্কার ছবি উঠল ডি.এন.এ-র। সাপের মতো উঠে গেছে জড়াজড়ি করে নিউক্লিক অ্যাসিডের দুই শিকল, প্রাণের স্পন্দন, বংশগতির ধারা যার মধ্যে ধরা থাকে সযত্নে। প্রকৃতির এই অনবদ্য রহস্যের জগৎ উন্মোচিত হল। পরবর্তীকালে এই ছবি বিখ্যাত হয় ফটো-৫১ নামে, কারণ ১৯৫১ সালে রোজালিন্ড এই ছবি তুলেছিলেন।

bigganrosalind (2)

এই যুগান্তকারী ছবি তোলার পর রোজালিন্ড অঙ্ক কষে ডি.এন.এ-র মডেল বানাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। আর সেই খবর পেয়ে উইলকিন্স উলটো পথে অঙ্ক এড়িয়ে ত্রিমাত্রিক মডেল গড়ার রাস্তা খুঁজতে লাগলেন। রোজালিন্ড গেলেন ক্ষেপে। এবার তিনি আর গসলিন দুজনে গোপন রাখতে লাগলেন তাদের সব বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম। ডি.এন.এ রোজালিন্ডের কাছে ধরা দিল। তিনি দেখলেন বি-টাইপ ডি.এন.এ ফসফেট অণুর সঙ্গে সেতুবন্ধন করে। ডি.এন.এ অণুতে ফসফেট থাকে, তিনি সেই কথা জেনে ফেলেছিলেন। পরবর্তী একটি সেমিনারে রোজালিন্ড তাঁর গবেষণার কথা সবার সামনে তুলে ধরলেন। সেই সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন জেমস ওয়াটসন, যিনি ডি.এন.এ-র গঠন আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান পরবর্তীতে।

রোজালিন্ডের বক্তৃতা ওয়াটসনকে প্রভাবিত করেছিল নিঃসন্দেহে। এই সেমিনারের পরেই তিনি ফ্রান্সিস ক্রিককে ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে তাঁর সঙ্গে ডি.এন.এ অণুর গবেষণায় ডেকে নেন। ক্রিক আদতে ছিলেন একজন পদার্থবিজ্ঞানী, কিন্তু তিনি ডি.এন.এ-র গঠনের অনুসন্ধানে উৎসাহী ছিলেন। দুই বিজ্ঞানী যে ত্রিমাত্রিক মডেল বানালেন, সেটি ছিল কার্ড-বোর্ড আর তার দিয়ে তৈরি। রোজালিন্ডের প্রস্তাবিত ডি.এন.এ অণুর গঠনের আধারেই সেই মডেল গড়া হল। ওয়াটসন এবার পরামর্শের জন্য রোজালিন্ডকে ডাকলেন। রোজালিন্ড প্রবল আপত্তি তুললেন মডেল দেখে। ক্রিক-ওয়াটসন মডেলে ডি.এন.এ-র তিনটি শিকল দেখানো হয়েছিল এবং তারা ফসফেট দেখান ঋণাত্মক তড়িৎযুক্ত আয়ন হিসাবে। রোজালিন্ড বললেন, ফসফেট আয়ন ধনাত্মক না হলে ডি.এন.এ-র অণু ভেঙে পড়ত। তাই এই মডেল চলবে না।

জেমস ক্রিক আড়ালে রোজালিন্ডকে ডাকতেন ‘দ্য ডার্ক লেডি’ বলে। সেই কথা জানাজানি হয়ে যায়। রোজালিন্ড খুবই ক্ষুব্ধ হন এই কথা শুনে। শেক্সপিয়ারের সনেটে ‘ডার্ক লেডি’ বলে একটি চরিত্র ছিল। কিন্তু ক্রিকের এই মন্তব্য ছিল যথেষ্ট অশালীন এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পরিচয়বাহক নিম্নমানের ইঙ্গিত। রোজালিন্ডের জীবনীকার ব্রিন্ডা মেডক্স এই উক্তির বিরোধিতা করে তাঁর লেখা বইয়ের শিরোনাম দেন ‘দ্য ডার্ক লেডি অফ ডি.এন.এ’।

রোজালিন্ড তাঁর কাজের জায়গায় ফিরে গেলেন। ক্রিক-ওয়াটসন জুটি নতুন করে ডি.এন.এ মডেল নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। এদিকে রোজালিন্ডের অসন্তোষের কথা জানতে পারলেন ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরির দায়িত্বে থাকা বিজ্ঞানী লরেন্স ব্র্যাগ। তিনি রোজালিন্ডের জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পারদর্শিতাকে সম্মান করতেন। ক্রিক-ওয়াটসন জুটিকে তিনি ডি.এন.এ-র কাজ থেকে সরিয়ে দিলেন।

ক্রিক আর ওয়াটসন ব্র্যাগের আদেশ মেনে নিলেও চুপচাপ কিংস কলেজে পাঠিয়ে দিলেন তাদের ডি.এন.এ মডেল। কিংস কলেজ যেহেতু ডি.এন.এ-র গবেষণায় বহু বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করে রেখেছিল, তারা ডি.এন.এ-র গঠনের রহস্য ফাঁসের কৃতিত্ব নিতে চাইছিল। নিরীহ ডি.এন.এ অণু বিজ্ঞান-মহলে প্রবল নোংরা রাজনীতির জোয়ার বইয়ে দিল। রোজালিন্ড বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন ইতালি। সেখানে পাহাড়ে ট্রেকিং করতে লাগলেন, প্রাণভরে প্রকৃতির নিস্তব্ধ সৌন্দর্যে ডুবে গেলেন। আসলে তিনি ডি.এন.এ ঝগড়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। যখন ফিরে এলেন কিংস কলেজে, তখন প্রফেসর র‍্যান্ডাল তাঁকে কিংস কলেজ থেকে কেমব্রিজের অন্য কলেজে ট্রান্সফার করে দিলেন বার্কবেক গবেষণাগারে। কিন্তু কিংস কলেজ থেকে বিদায় নেবার আগে রোজালিন্ড আর গসলিন দুজনে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে বার বার ডি.এন.এ-র এক্স-রে প্লেট খুঁটিয়ে দেখে পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে বসে পড়লেন ডি.এন.এ-র ডাবল হেলিক্স গঠনের ছবি আঁকতে। একেবারে সঠিকভাবে তারা অঙ্ক কষে বার করলেন, কীভাবে এই ডি.এন.এ তার প্রতিরূপ তৈরি করে, কীভাবে অসীম সংখ্যক ডি.এন.এ তৈরি হতে পারে পৃথিবীর বুকে, সৃষ্টি হয় নতুন নতুন জীব। এই কাজ তাদের খুব গোপন রাখতে হয়, কারণ রোজালিন্ড কী কাজ করছেন সেই খবর নিতে কিংস কলেজের অন্য বিজ্ঞানীরা উৎসুক হয়ে থাকতেন।

সেই একই সময়ে ক্রিক-ওয়াটসন জুটি আবার ডি.এন.এ-র গঠন নিয়ে চুপিচুপি কাজ করতে শুরু করে দিয়েছেন। রোজালিন্ডের ফটো-৫১ এবং অন্য সব অপ্রকাশিত কাজ, যা রোজালিন্ড তাঁদের জানিয়েছিলেন, তার ভিত্তিতে আগের সব ত্রুটি সংশোধন করে গড়ে তুললেন ডি.এন.এ-এর ডাবল হেলিক্স মডেল। তারপর ১৯৫৩ সালে নেচার পত্রিকায় এক প্রবন্ধ লিখে তাঁরা জানিয়ে দিলেন যে ডি.এন.এ-র এই গঠন আবিষ্কার করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তাদের। প্রবন্ধের শেষ প্যারাগ্রাফে একবার মাত্র রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের নাম উল্লিখিত হয়। রোজালিন্ড ভেবেছিলেন অঙ্ক না কষে ডি.এন.এ-র গঠন প্রমাণ করা সম্ভব নয় এবং ক্রিক-ওয়াটসন জুটি কোনোদিক থেকেই এই কাজের যোগ্য নন।

কিংস কলেজ ছাড়লেন রোজালিন্ড। নতুন ল্যাবে গিয়ে কাজ নিলেন ভাইরাসের উপর। তখন টোব্যাকো মোসেইক ভাইরাস সবে আবিষ্কার হয়েছে। সেই ভাইরাসের আক্রমণে তামাক গাছের পাতা নষ্ট হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। তামাকের চাষের প্রভূত ক্ষতি হয়ে তামাক ব্যবসায়ীদের ব্যাবসা লাটে ওঠার জোগাড়। ভাইরাসটাকে ভালো করে চিনতে না পারলে প্রতিষেধক তৈরি করা যাবে না। ভাইরাসকে চিনতে গেলে সেই এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ছাড়া গতি নেই, আর সেই কাজ রোজালিন্ড ছাড়া আর কেই-বা ভালোভাবে করতে পারবে? বার্কবেক ল্যাবের প্রধান রোজালিন্ডকে দায়িত্ব দিলেন, কিন্তু পিছন থেকে কলকাটি নাড়তে লাগলেন কিংস কলেজের প্রফেসর র‍্যান্ডাল। কিংস কলেজেরই শুধু ডি.এন.এ-র উপর কাজের একমাত্র অধিকার আছে, এই ভাবনা তিনি সব ডি.এন.এ নিয়ে কাজ করতে থাকা পরীক্ষাগারগুলোকে জানিয়ে দিলেন। আসলে তিনি রোজালিন্ডের উপর বিভিন্ন কারণে চটে ছিলেন। রোজালিন্ডের সোজাসাপটা জবাব, অনমনীয়তা এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কিংস কলেজের অনেক বিজ্ঞানীকেই চটিয়ে দিয়েছিল।

টোব্যাকো মোসেইক ভাইরাসের ডি.এন.এ-র গঠনের উপর কাজ করতে করতে রোজালিন্ডের নজর ভাইরাস গবেষণার দিকে ঝোঁকে। তিনি এবার পোলিও ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন এবং পড়াশুনো করতে থাকেন। রোজালিন্ডের গবেষণার খ্যাতি আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল, তাই বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবার জন্য তাঁর ডাক পড়ে। রোজালিন্ড সেখানে একের পর এক বক্তৃতা দিয়ে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন, যদিও আমেরিকার ল্যাবে কর্মরত বিজ্ঞানীদের তিনি একেবারেই পছন্দ করেননি। আমেরিকায় গিয়ে আবার তিনি প্রকৃতির মাঝে নির্জনতায় বসে মনের শান্তি আনার চেষ্টা করেন। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বেড়াতে গিয়ে খুব আনন্দ পান, যা তাঁর লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্রে জানতে পাওয়া যায়। আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতার বিষয়ের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল কয়লার উপর রোজালিন্ডের গবেষণা, যদিও তিনি যে ততদিনে এই বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ভাইরাসের অনুসন্ধানে মেতে পড়েছেন, সে-কথাও সগৌরবে জানাতে ছাড়েননি।

নিজের কাজের জায়গা বার্কবেক গবেষণাগারে ফিরে এসেই রোজালিন্ড আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ-এ ভাইরাসের গবেষণার জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়ে আবেদন করেন, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দেশের মানুষ তাকে সমর্থন করবে না। এই আবেদনপত্র এক বৈজ্ঞানিক দলিল ছিল, যাতে তিনি বিশদে বুঝিয়ে দেন যে জীব কোষের প্রোটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিডের মধ্যে আছে এক অপূর্ব যোগসূত্র এবং ডি.এন.এ-র মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রোটিন সংশ্লেষের আসল চাবিকাঠি।

গবেষণার অর্থ সংগ্রহে তদ্বির করতে রোজালিন্ড আবার বার্কলে যান। অবশেষে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ তাঁকে তিন বছরের জন্য ভাইরাস গবেষণা, বিশেষ করে পোলিও ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য আর্থিক সাহায্য দেয়। কিন্তু এর পরেই তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে, রোজালিন্ডের জরায়ুতে দুটি বড়ো টিউমার দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে, অপারেশন করা ছাড়া আর গতি নেই। অপারেশন করতে গিয়ে ধরা পড়ে তাঁর জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত, তাই সেটি বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ততদিনে মারণব্যাধি আরও ছড়িয়ে পড়েছে রোজালিন্ডের শরীরে। কিন্তু তিনি হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেই আবার তাঁর প্রিয় বিষয় এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির মাধ্যমে ভাইরাসের গঠন নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। অন্য বিজ্ঞানীদের পরামর্শ দিতে থাকেন নতুন কাজে। ১৯৫৮ সালে তাঁর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। মৃত্যু যে তাঁর খুব কাছে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে, তা হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাই সব অভিমান ভুলে গিয়ে নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চলে যান বহু বছর পর। এমনকি ফ্রান্সিস ক্রিকের সঙ্গেও পুরোনো ঝগড়া ভুলে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন।

মাত্র ৩৭ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন, অতিরিক্ত সময় এক্স-রে নিয়ে কাজ করতে গিয়েই ক্যান্সার বাসা বেঁধেছিল তাঁর শরীরে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার একেবারে শেষ ধাপে এসে রোজালিন্ডের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা। তাঁর মৃত্যুতে বৈজ্ঞানিক মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় শোকসংবাদ ছাপা হয়, যেখানে তাঁর অসামান্য বৈজ্ঞানিক অবদানের কথা লেখা হয়। জানানো হয়, মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি হাসপাতালের শয্যায় কাজ করে গেছেন এবং সেই কাজগুলো ছিল তাঁর জীবনের সেরা কাজ।

১৯৬২ সালে ক্রিক-ওয়াটসন-উইলকিন্সকে ডি.এন.এ-র গঠনতন্ত্র আবিষ্কারের জন্য জীববিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তিন বছর আগেই রোজালিন্ড চলে গিয়েছেন পৃথিবী ছেড়ে, তবু তাঁর নাম নোবেল কমিটির কাছে প্রাস্তাবিত হয়। কিন্তু মারা যাবার পর নোবেল পুরস্কার দেওয়ার নিয়ম নেই, তাই নোবেল পুরস্কারের মুখ না দেখেই চলে যেতে হয় রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনকে।

মৃত্যুর পর রোজালিন্ডকে অনেক সম্মান জানানো হয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তাঁর জীবন ও কাজের উপর বিবিসি তথ্যচিত্র বানায়। তাঁর জীবনী অবলম্বনে সিনেমা তৈরি হয়। নাটকের মাধ্যমে রোজালিন্ডকে মনে করানো হয় বার্মিংহামের নাট্যশালায়। নোবেল না পেলেও তাই ডি.এন.এ-র গঠনতন্ত্রের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য ক্রিক-ওয়াটসন-উইলকিন্সের সঙ্গে আজও সমান আসনে বসানো হয় রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনকে।

জয়ঢাকের  বৈজ্ঞানিকের দপ্তর

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s