FUNবিজ্ঞান-বিচিত্র জীবজগৎ-পিপীলিকার পুষ্যি-যূথিকা আচার্য্য-শরৎ২০২২

বিচিত্র জীবজগত- সব লেখা একত্রে

bigganjeebjagat00

পিপীলিকা নাম শুনে ঘাবড়ে গেলে বুঝি? ভাবছ এ আবার কোন প্রাণী! পিপীলিকা মানে হল পিঁপড়ে। চলিত বাংলায় যার নাম পিঁপড়ে, শুদ্ধ বাংলায় তারই নাম পিপীলিকা। আর পুষ্যি মানে হল পোষা প্রাণী। এই দেখো না, তুমি-আমি কেমন কুকুর, বেড়াল, গোরু, ছাগল, খরগোশ বা টিয়াপাখি পুষি। তাদের যত্ন করে নাইয়ে-খাইয়ে রাখি। তার বিনিময়ে তারা আমাদের দুধ দেয়, আমাদের সঙ্গে খেলা করে, আমাদের বাড়ি পাহারা দেয়। ঠিক তেমনি পিঁপড়েরাও একধরনের পোকাকে তাদের পোষ্য বানিয়ে রাখে।

পিঁপড়েদের এই পুষ্যির নাম হল অ্যাফিড (Aphid)। এদের গাছের গায়ের উকুন বা এঁটুলিও বলতে পারো। খুদে খুদে এঁটুলি যেমন পশুদের শরীরের থেকে রক্ত চুষে খেয়ে নিজেরা মোটাসোটা গোলগাল হয়, তেমনি অ্যাফিডরাও গাছেদের ত্বক ফুটো করে তাদের রস খেয়ে বেঁচে থাকে। বিভিন্ন প্রজাতির অ্যাফিড অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির গাছ পছন্দ করে এবং এই অ্যাফিডদের দেখাশোনা করে, যত্নআত্তি করে তাদের বাঁচিয়ে রাখে পিঁপড়েরা। এমনকি প্রয়োজনে তারা অ্যাফিডদের শত্রু লেডি পোকা বা লেডিবাগদের সঙ্গে লড়াই করতেও ভয় পায় না।

bigganjeebjagat1fightwithladybug

তবে এমনটা যে তারা অমনি অমনি করে তা কিন্তু নয়। দেখাশোনার বিনিময়ে অ্যাফিডদের কাছ থেকে মিষ্টি রস তারা কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে নেয়। এই মিষ্টি রস বা চিনির সিরাপ অ্যাফিডদের শরীরের থেকে বেরোনো রেচন পদার্থ বলতে পারো। আমরা যেমন গোরুর দুধ দুইয়ে খাই, পিঁপড়েরাও তেমনি তাদের শুঁড় দিয়ে টিপে-টুপে পোষ্য অ্যাফিডদের পেট থেকে সিরাপ দুইয়ে নেয়। অ্যাফিডদের শরীর থেকে বেরোনো এই সিরাপ তাদের খিদে ও তেষ্টা দুই-ই মেটায়।

bigganjeebjagat2syrupdoyatebyostopiprera

চিনির রস ঝরানো অ্যাফিডদের সুলুকসন্ধান পিঁপড়েরা প্রথমে কী করে পেয়েছিল তা আমরা আজও জানি না। দেখো, চিনি থাকলেই পিঁপড়ে এসে জ্বালাতন করবে। এত জানা কথাই। রান্নাঘরের মেঝেতে দুটো চিনির দানা পড়েছে কি পড়েনি, দেখবে পিলপিলিয়ে পিঁপড়েরা এসে হাজির। তারা চিনির খবর কোথা থেকে এবং কী করে পায় সে-কথা খোদাই জানেন। তবে বিজ্ঞানীরা যেটা জানতে পেরেছেন তা হল এই যে, এমন আজব পোকার সন্ধান পেয়ে পিঁপড়েরা কিন্তু চুপচাপ বসে থাকেনি। বরং তারা আটঘাট বেঁধে রীতিমতো ‘মাদার ডেয়ারি’-র মতো ‘দুগ্ধ প্রকল্প’ তৈরি করে ফেলেছিল এবং এই ব্যাপারখানা ঘটেছিল মানুষ চাষবাস বা পশুপালন শেখার বহু আগে। তাই সেভাবে দেখতে গেলে পিঁপড়েরাই কিন্তু পৃথিবীর প্রথম চাষি, আমরা নই।

তবে অ্যাফিড পালন যে নিতান্তই সোজা কাজ, এমনটা ভাবা কিন্তু একদম উচিত নয়। গোরু বা মোষ পালনের মতোই হাড়ভাঙা খাটুনি খাটার পর তবেই পিঁপড়েরা চিনির রস পায় এবং বুদ্ধিমান চাষিদের মতোই তারা চাষের জমির কাছাকাছিই নিজেদের বাসভূমিও গড়ে তোলে। যেমন ভুট্টা ক্ষেতের পিঁপড়ে এবং অ্যাফিডদের কথাই ধরা যাক। ইংরিজিতে এদের নাম কর্নরুট অ্যাফিড (Cornroot Aphid) এবং কর্নফিল্ড অ্যান্ট (Cornfield Aphid)। এরা থাকে ভুট্টা ক্ষেতের মাটির বুকে ছোটো ছোটো গর্তের ভেতর। ভুট্টা অ্যাফিডের দল ভুট্টাগাছের রস খেয়ে বেঁচে থাকে। গ্র্রীষ্ম থেকে শরৎকাল কাটে তাদের দিব্যি আনন্দে। অ্যাফিডরা তখন গাছের রস খেয়ে চিনির রস তৈরি করে। পিঁপড়েরা প্রতিদিন সময়মতো সেই চিনির রস দুইয়ে নিজেদের ভাঁড়ারে নিয়ে জমা করে। খাদ্যের পরিবর্তে অ্যাফিড পোষ্যদের রক্ষা করে তারা।

bigganjeebjagat3adifcolonyrrokkhok

তবে হেমন্তের শেষে রানি বা কুইন অ্যাফিডেরা একসঙ্গে যখন ডিম পাড়ে, তখন শুরু হয় পিঁপড়েদের আসল কাজ। অ্যাফিডদের সবক’টি ডিমকে সাবধানে নিজেদের গর্তের ভেতর উষ্ণ কোনও জায়গায় জমিয়ে রাখে তারা। এরপর শীতকাল কেটে গেলে বসন্তের শুরুতে ডিম ফুটে ছানা বেরোতে শুরু করলে সেই পুঁচকে অ্যাফিড ছানাদের ভুট্টার জমিতে রেখে আসার দায়িত্বও পিঁপড়েদের।

তবে বসন্তকালে অবশ্য সেই জমিতে ভুট্টাগাছ থাকে না। তার বদলে গোলাপি-সাদা ফুলওয়ালা একধরনের আগাছার জন্ম হয় চাষের জমির উপর। ইংরিজিতে এই আগাছার নাম হল স্মার্ট উইড (Smart weeds)। অ্যাফিডের ছানারা ছোটবেলায় এই আগাছার রস খেয়েই বড়ো হয় এবং জমিতে লাগানো ভুট্টাগাছের চারা একটু বড়ো হলে পিঁপড়েরা আবার সেই ছানাদের আগাছা থেকে সরিয়ে ভুট্টাগাছে রেখে দেয়। তারপর হেমন্ত ঋতু আসা অবধি পিঁপড়ে এবং তাদের পোষ্যদের জীবনচক্র স্বাভাবিক নিয়মে চলতে থাকে।

এই অবধি পড়ে তোমরা যারা ভাবছ যে আহা পিঁপড়েরা কত ভালো, তারা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে তাদের পোষা অ্যাফিডদের আদর যত্নে ভরিয়ে রাখে, তাদের জন্য বলছি যে সে-কথা মোটেই সত্যি নয়। পিঁপড়েরা অ্যাফিডদের দেখাশোনা করে এ-কথা ঠিক, কিন্তু তাদের প্রিয় সিরাপের পরিমাণ কমে যাওয়ার কোনও সম্ভবনা আছে দেখলে তারা গুন্ডাগিরি করতেও পিছপা হয় না।

দেখো, অ্যাফিডদের চেহারা এমনিতেই গোলগাল, নাদুসনুদুস। স্বাভাবিক অবস্থায় তাদের ডানা থাকে না এবং তাদের শরীরের তুলনায় পাগুলিও নেহাতই ছোটো। বুঝতেই পারছ যে অমন খুদে খুদে পা এবং মোটা শরীর নিয়ে হাঁটাচলা করাটা তাদের জন্য যথেষ্ট কষ্টকর। তাই পিঁপড়েরা বেশি জ্বালাতন করলে যে তারা পালিয়ে যাবে এমনটা সম্ভব নয়। খাবারের খুব বেশি অভাব হলে বা একই কলোনিতে অ্যাফিডদের সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে অবশ্য অন্য ব্যাপার। সেক্ষেত্রে চলাফেরার সুবিধের জন্য অ্যাফিডদের শরীরে ডানা গজায়। কিন্তু পিঁপড়ে প্রভুরা এখানেও বাদ সাধে। অ্যাফিডদের পিঠে ডানা গজাতে দেখলেই তারা তড়িঘড়ি তাদের ডানা ছিঁড়ে ফেলে। এমনকি এও দেখা গেছে যে পিঁপড়েরা তাদের শরীর থেকে নিঃসৃত সেমিওকেমিক্যাল প্রয়োগ করে অ্যাফিডদের চলাফেরার ও ডানা গজানোর ক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়। ফলে অ্যাফিডদের পক্ষে পালানো অসম্ভব হয়ে যায় এবং তারা ধীরে ধীরে পিঁপড়েদের গোলামি করতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যাপারটা দুঃখের তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু কী আর করা যাবে! বোকাদের ওপর বুদ্ধিমানেরা চিরকালই জোর খাটায়। তাই পিঁপড়ে ভায়াদের এই ব্যাপারে অন্তত বেশি দোষ দেওয়ার উপায় নেই।

 জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

 

1 thought on “FUNবিজ্ঞান-বিচিত্র জীবজগৎ-পিপীলিকার পুষ্যি-যূথিকা আচার্য্য-শরৎ২০২২

  1. বাঃ! কত কিছু যে জানিনা! লেখা স্বাদু ও সুখপাঠ্য।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s