মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে
পৃথিবী সম্পর্কে প্রাচীন ধারণাসমূহ:
তারা ঝলমলে রাতের আকাশে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলিকে (খালি চোখেই হোক বা দূরবিনের সাহায্য নিয়েই হোক) দেখা সম্ভব হলেও কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে মানুষের মহাকাশে যাবার আগে পর্যন্ত আমাদের বাসভূমি পৃথিবীকে পুরোপুরি দেখা কখনই সম্ভব হয়নি। তাই আমাদের দীর্ঘদিন অজানা ছিল, মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে কেমন দেখায়। আজ অবশ্য সেসব জানা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সেসব কথায় আসব। তার আগে জেনে নেওয়া যাক, প্রাচীনকালে জন্মভূমি সম্পর্কে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ধারণা কেমন ছিল।
মিশর:
প্রথমে আসি মিশরের কথায়। সেখানকার নিম্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস ছিল যে হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবী ও আকাশ একসঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে ছিল। পৃথিবীর অধীশ্বর ছিলেন ‘জেব’।
সূর্যদেবতা ‘রা’ (Ra) তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী জেনেও তিনি রা-কে পাত্তা দিতেন না। একদিন তিনি রা এর অনুমতি না নিয়েই নিজের বোন ‘নাট’-কে বিয়ে করেন। নাট ছিলেন আকাশের দেবী। খবরটা পেয়েই রা ভীষণ রেগে যান। তিনি তাদের পিতা বায়ুদেবতা ‘সু’ এর কাছে যান এবং বুঝিয়ে তাকে রাজী কারান জেব ও নাট-কে আলাদা করে দিতে। সেই ঘটনার পর থেকেই পৃথিবী ও আকাশ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
চিন:
প্রাচীন চৈনিক লোকগাথায় সৃষ্টতত্ত্ব নিয়ে কী লেখা আছে সেটা জেনে নেওয়া যাক। সেখানে বলা আছে, আদিতে ব্রহ্মাণ্ড ছিল মুরগির একটি ডিমের আকারের সমান। এই ডিম-সদৃশ ব্রহ্মাণ্ড প্রায় ১৮ হাজার বছর মহাকাশে ভেসে ছিল। সে সময় অন্তহীন মহাকাশে এছাড়া আর কিছুই ছিল না। এরপর ডিমটি এক সময় ফেটে যায় এবং তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে নানা ধরনের উপাদান। এই উপাদানগুলির মধ্যে যেগুলি হালকা ছিল চিনারা সেগুলির নাম দিল ‘ইয়াং’। এই ইয়াং থেকেই সৃষ্টি হল আকাশ। আর ‘ইন’ অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত ভারী উপাদানগুলি থেকে তৈরি হল পৃথিবী। এছাড়াও ঐ ডিম থেকে বেরিয়েছিল একটি দৈত্য যার নাম ‘পান-কু’। আকাশ আর পৃথিবী যাতে মিশে না যায় তাই দৈত্যটি আকাশ মাথায় নিয়ে পৃথিবীর উপরে দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে দৈত্য প্রতিদিনই তিন মিটার করে লম্বা হতে থাকে। ফলে আকাশ আর পৃথিবীর মধ্যে ব্যবধান বাড়তে থাকে। ১৮ হাজার বছর ধরে আকাশকে ঠেলতে ঠেলতে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। এরপর পান-কু মারা গেল। আকাশ ও পৃথিবী থিতু হল বটে, কিন্তু তারা গাঢ় অন্ধকারে ডুবে রইল। এমন সময় ঘটল এক মজার
ঘটনা। দৈত্যের মাথা থেকে সৃষ্টি হল সূর্য ও চাঁদ, প্রশ্বাস থেকে বায়ু, গলার আওয়াজ থেকে বজ্র আর রক্ত থেকে নদী ও সমুদ্র।
গ্রিক:
পৃথিবীর উৎপত্তি নিয়ে প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যে একটি কল্পকাহিনীর প্রচলন ছিল। ধরিত্রী মাতা রূপে পূজিতা ‘গেইয়া’ (Gaea) গ্রিকদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক দেবী। এই দেবীর ‘কেওস’ নামে এক সঙ্গী ছিলেন। গ্রিকদের বিশ্বাস এরা দু’জনে এক সঙ্গে পৃথিবীতে এসেছিলেন এবং এরাই হলেন পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত প্রথম দুটি সত্ত্বা এদের থেকেই বর্তমান পৃথিবীর সৃষ্টি।
জার্মান ও নর্ডিক:
প্রাচীন জার্মান ও নর্ডিক জনগোষ্ঠীর লোককথা অনুযায়ী দেবতারা দেবলোকে সুখে শান্তিতে বসবাস করছিলেন। তখনও মিডগার্দ অর্থাৎ পৃথিবীর সৃষ্টি হয়নি। ‘ওয়াইমির’ নামে শুধু এক দৈত্য হিমশীতল অন্ধকারে ঘুরে বেড়াত। তার থাকার কোনো জায়গা ছিল না। তাই সে মাঝে মাঝেই দেবলোকে হানা দিত। তার অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে দেবতারা একদিন তাঁদের পিতা ওডিন-এর কাছে গিয়ে দৈত্যের হাত থেকে তাঁদের রক্ষা করতে অনুরোধ করেন। ওডিন তখন তাঁর দুই ভাই ভিলি ও ভি-কে সঙ্গে নিয়ে ওয়াইমির-কে বাধা দিলে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধে দৈত্য ওয়াইমির নিহত হয়। এরপরেই ঘটে এক অত্যাশ্চার্য ঘটনা। ওয়াইমির দেহের মাংস থেকে সৃষ্টি হয় পৃথিবী এবং অন্যান্য অংশ থেকে তৈরি হয় পাহাড়-পর্বত, আকাশে ভাসমান মেঘরাশি ইত্যাদি। পৃথিবীকে নিয়ে এরকম নানা পৌরাণিক কাহিনী পৃথবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। সে সময় বিজ্ঞান এত উন্নত ছিল না। তাই ব্রহ্মাণ্ডের অপার রহস্যের ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে তাঁরা নানারকম কাল্পনিক গল্পের আশ্রয় নিয়েছিলেন। যাই হোক, পৌরাণিক যুগের কাহিনীগুলিকে পাশে সরিয়ে রেখে এবার আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা করি।
পৃথিবীর উৎপত্তি:
পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হল তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে নানা মতবাদ আছে। তবে যে মতবাদটি অধিক মান্যতা পেয়েছে সেই অনুযায়ী এক বিশাল গ্যাসীয় পিণ্ড সঙ্কুচিত হতে শুরু করে। হিমশীতল এই গ্যাসীয় পিণ্ড যত সঙ্কুচিত হতে থাকে তত সেটি উত্তপ্ত হতে থাকে। এই সময় ঐ গ্যাসীয় পিণ্ডে থাকা ভারী মৌলিক পদার্থগুলি কেন্দ্রের দিকে সরে এসে জড়ো হতে থাকে। আর হাল্কা পদার্থগুলি কেন্দ্রাঞ্চল থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। এই ভাবে দুটি বলের সৃষ্টি হয়— একটি কেন্দ্র-মুখী এবং অপরটি কেন্দ্রাপসারী। এই দুই বিপরীত-মুখী বলের ফলে গ্যাসীয় পিণ্ডে ঘূর্ণনের সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণনের গতি যখন অত্যাধিক বেড়ে গেল তখন গ্যাসীয় পিণ্ডটি টুকরো টুকরো হয়ে মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রথমদিকে বাইরের তল থেকে ছিটকে তৈরি হল ইউরেনাস, নেপচুনের মতো দূরের গ্রহগুলি। এই গ্রহগুলিতে ভারী লোহার উপস্থিতি যৎসামান্য, নেই বললেই চলে। আর কেন্দ্রের কাছাকাছি অংশ থেকে তৈরি হল সূর্যের নিকটবর্তী গ্রহগুলি। তাই শুক্র ও পৃথিবীর মতো গ্রহগুলিতে লোহার পরিমাণ খুব বেশি। পৃথিবী সৃষ্টির নতুন কোনো তত্ত্ব না আসা পর্যন্ত আপাতত এই তত্ত্বেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
পৃথিবীর আকৃতি:
আমরা যে গ্রহটিতে বাস করি সেই গ্রহটির অর্থাৎ পৃথিবীর আকৃতি কেমন? মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিল। প্রথম দিকে মানুষের ধারণা ছিল এটি দেখতে চারকোনা পাটাতনের মতো। ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পিথাগোরাস প্রথম বলেছিলেন পৃথিবী দেখতে গোল। পরবর্তীকালে গবেষণায় জানা যায়, পৃথিবীর নিরক্ষীয় ব্যাস মেরু ব্যাসের তুলনায় প্রায় ৪২ কিলোমিটারের মতো বড়। তাই গোল বলতে যা বোঝায় পৃথিবী সেই অর্থে গোল নয়, বরং গোলাকার বলা শ্রেয়। পৃথিবীর নিরক্ষীয় ব্যাস ১২,৭৫৬ কিলোমিটার এবং মেরুব্যাস ১২,৭১৪ কিলোমিটার। এখন একটা প্রশ্ন হতে পারে, পৃথিবী গোলাকার হল কেন? এর কারণ পৃথিবীর অভিকর্ষ বল। এই বলের দরুন কেন্দ্র পৃথিবীর উপরিতলের প্রত্যেকটি অংশ সমানভাবে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। তবে পৃথিবী নিটোল গোল নয়, বরং কিছুটা এবড়ো খেবড়ো। উঁচু অংশগুলি পাহাড়-পর্বত, মালভূমি আর নীচু জায়গাগুলি সমুদ্র। বিজ্ঞানীদের মতে এইটুকু অসমতল হওয়াটা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে ঘুরছে তাই তৈরি হচ্ছে কেন্দ্রাতিগ শক্তি। এরফলে পেটের দিকটা কিছুটা ফোলা। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ৮,৮৫৮ মিটার। এটাই পৃথিবীর স্থলভূমির উচ্চতম অঞ্চল, আর প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা খাতের গভীরতা ১১,০০০ মিটারেরও বেশি। এটাই পৃথিবীর নিম্নতম অঞ্চল।
পৃথিবী সম্পর্কে জানার জন্য যেসব কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে তাদের মধ্যে ১৯৫৮ সালে পাঠানো ‘ভ্যানগার্ড’ উপগ্রহটির প্রেরিত তথ্যসমূহ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে-
(১) পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু চাপা হলেও উত্তর মেরু কিন্তু চাপা নয়।
(২) দক্ষিণ মেরু ২০ মিটারের মতো নীচু, আর উত্তর মেরু ঠিক ততটাই উঁচু।
(৩) দক্ষিণ গোলার্ধের মধ্য অক্ষাংশ ৮ মিটার ফুলে উঠেছে, আর উত্তর গোলার্ধের মধ্য অক্ষাংশ ৮ মিটার বসে গিয়েছে।
তাই বলা যায়, পৃথিবী দেখতে অনেকটা ন্যাসপাতির মতো। আর নিরক্ষীয় অঞ্চলের ফোলা অংশটি ঠিক মাঝ বরাবর নেই, সামান্য দক্ষিণ ঘেঁষে আছে।
পৃথিবীর গতি:
এক সময় মনে করা হত পৃথিবী স্থির আর তার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে মহাজাগতিক সমস্ত জ্যোতিষ্ক। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই বিশ্বাসে প্রথম আঘাত হানেন নিকোলাস কোপারনিকাস। তিনি সূর্য কেন্দ্রিক সৌরজগতের কথা বলেন এবং এটাও বলেন যেন যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। ধর্ম যাজকদের ভয়ে তিনি অবশ্য তাঁর মতবাদ সারাজীবন লুকিয়ে রেখেছিলেন। প্রকাশ করেছিলেন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে। তাঁর এই মতবাদকে সমর্থন করতে গিয়ে জিওদার্নো ব্রুনোকে জীবন্ত আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছিল, গ্যালিলিও গ্যালিলিকে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল। তবে কেপলার ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় পরবর্তীকালে কোপার্নিকাসের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।
পৃথিবীর চার ধরনের গতি আছে। পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে পাক খেতে খেতে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এই কক্ষপথটি উপবৃত্তাকার। এছাড়া মহাকাশে প্রচণ্ড বেগে ধাবিত হচ্ছে। এই তিনটি গতি ছাড়াও পৃথিবীর আরও একটি গতি আছে। দম কমে এলে লাট্টুর মাথাটা যেমন একটি ছোট বৃত্তে ঘুরতে থাকে পৃথিবীর অক্ষ সোজা খাড়া না হয়ে ২৩·৫ ডিগ্রি হেলানো হওয়ায় অক্ষটি লাট্টুর মতোই ছোট একটি বৃত্তে ঘোরে।
পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট ৪·০৯৯ সেকেন্ডে একবার পাক খায়। একে বলে আহ্নিক গতি। পৃথিবীর এই আহ্নিক গতি সর্বত্র সমান নয়। সবচেয়ে বেশি নিরক্ষরেখা বরাবর, ঘন্টায় প্রায় ১,৭০০ কিলোমিটার। নিরক্ষরেখা থেকে উত্তরে বা দক্ষিণে এই বেগ ক্রমশ কমতে থাকে এবং মেরুদ্বয়ে শূন্য হয়। সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কিলোমিটার (ঘন্টায় প্রায় ৯৬,০০০ কিলোমিটা) বেগে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৫·৫ সেকেন্ড। এই সময়ে পৃথিবী অতিক্রম করে ১০৯,৪৩,০৮,৫৬৫ কিলোমিটার পথ।
ঋতু পরিবর্তন:
পৃথিবী মোটামুটি গোলাকার হওয়ায় ভূ-পৃষ্ঠে সূর্যরশ্মি সর্বত্র সমান পড়েনা— কোথাও লম্বভাবে আবার কোথাও তির্যকভাবে। এরফলে ভূ-পৃষ্ঠে তাপমাত্রার তারতম্য ঘটে। এছাড়াও পৃথিবী সূর্যকে যে পথে প্রদক্ষিণ করে সেটা উপবৃত্তাকার হওয়ায় সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে এবং পৃথিবীর কক্ষতলের উপর নিজের মেরুরেখা ৬৬·৫ ডিগ্রি কোণে হেলানো হওয়ায় কখনো উত্তর গোলার্ধ সূর্যের কাছে আসে আবার কখনো দক্ষিণ গোলার্ধ কাছে আসে। এর ফলে যেমন দিবা-রাত্রির দৈর্ঘ্যের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে তেমন উষ্ণতার পার্থক্য হয়। উষ্ণতার তারতম্য অনুসারে বছরকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। এক একটি ভাগকে ঋতু বলা হয়। এই ভাগগুলি হল, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত ও বসন্ত।
অনেকেই হয়তো অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে বর্ষা ও হেমন্ত এই দুটি ঋতুর কথা উল্লেখ করলাম না কেন? ভারতে এই দুটি ঋতুর আলাদা করে উল্লেখ থাকলেও পৃথিবীর সর্বত্র নেই। বর্ষা মানে প্রচুর বৃষ্টি। পৃথিবীতে কোথাও গ্রীষ্মকালে, কোথাও শীতকালে আবার কোথাও সারা বছর ধরেই বৃষ্টিপাত হতে দেখা যায়। আর শীতকালের প্রথম ভাগ হল হেমন্তকাল। তাই পৃথিবীর সব অঞ্চলকে মাথায় রেখে এই দুটি ঋতুকে আলাদাভাবে নির্দিষ্ট করা হয় না।
ভারতে বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই দু-মাস গ্রীষ্মকাল, আষাঢ় ও শ্রাবণ হল বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্বিন শরৎকাল, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল, পৌষ ও মাঘ শীতকাল এবং ফাল্গুন ও চৈত্র এই দু-মাস হল বসন্তকাল। এভাবেই ভারতে ৬টা ঋতু আবর্তিত হতে থাকে।
পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডল:
সৌরজগতে পৃথিবী ব্যতীত আর একটি গ্রহও বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাননি যেখানে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে। এর অন্যতম কারণ পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডল। তবে সৃষ্টিলগ্নে পৃথিবী এমনটা ছিল না। ছিল অতি উত্তপ্ত এক গোলক পিণ্ড। আর তার ভিতর আটকে ছিল নানা ধরনের গ্যাস ও জলীয় বাষ্প। গ্রহটি যত ঠাণ্ডা হতে লাগল চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারফলে ভিতরে আটকে থাকা গ্যাস ও জলীয় বাষ্প বাইরে বেরিয়ে এসে সৃষ্টি করল বায়ুমণ্ডল। প্রথম দিকে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত থাকলেও ধীরে ধীরে তা ঠাণ্ডা হতে থাকে এবং বায়ুমণ্ডলে থাকা জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হতে শুরু করে। এদিকে পৃথিবী আরও শীতল হতে থাকে। তখন ভূপৃষ্ঠের নীচ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে লাভা। এই লাভায় মিশ্রিত থাকা জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলে জমে থাকা জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশতে থাকে। এভাবে জলীয় বাষ্পের চাপ বাড়তে থাকে যতক্ষণ না পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে নেমে এসেছিল। উষ্ণতা আরও কমে গেলে ওই জলীয় বাষ্প বৃষ্টিধারায় নেমে আসে পৃথিবীর বুকে।
উপাদান ও রাসায়নিক গঠন অনুসারে বায়ুমণ্ডলকে প্রথমত দুটি স্তরে ভাগ করা হয়ে থাকে— (১) হোমোস্ফিয়ার বা সমমণ্ডল এবং (২) হেটেরোস্ফিয়ার বা বিষমণ্ডল। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৯০ কিলোমিটার ঊর্ধ পর্যন্ত বায়ুমণ্ডল হল হোমোস্ফিয়ার আর এর উপরের বায়ুমণ্ডলকে (৯০কিলোমিটার থেকে ১০,০০০ কিলোমিটার) বলা হয় হেটেরোস্ফিয়ার। হোমোস্ফিয়ার স্তরে বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাত মোটামুটি একই রকম থাকে। হেটেরোস্ফিয়ার স্তরে তা থাকে না। এই দুটি স্তরের প্রত্যেকটিকে আবার তিনিটি করে উপবিভাগে ভাগ করা হয়। হোমোস্ফিয়ারের উপবিভাগগুলি হল— ট্রপোস্ফিয়ার, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার ও মেসোস্ফিয়ার। আর হেটেরোস্ফিয়ারের তিনটি উপবিভাগ হল— আয়নোস্ফিয়ার, এক্সোস্ফিয়ার এবং ম্যাগনিটোস্ফিয়ার।
ক) ট্রপোস্ফিয়ার: এই স্তরটি নিরক্ষীয় অঞ্চলে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৭ কিলোমিটার এবং মেরু অঞ্চলে ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। মেঘ, বৃষ্টি, ঝড় ইত্যাদি এই স্তরেই হয়ে থাকে।
খ) স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার: এই স্তরে জলীয় বাষ্প, ধুলো থাকে না বললেই চলে। এই স্তরের বিস্তৃতি ট্রপোস্ফিয়ারের উপর ১৮-৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত।
গ) মেসোস্ফিয়ার: এটি হোমোস্ফিয়ারের শেষ স্তর। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ঊর্ধে প্রায় ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। মহাকাশ থেকে যেসব উল্কা পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে সেগুলি এই স্তরেই জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যায়। হোমোস্ফিয়ারের সর্বোচ্চ সীমানা যথেষ্ট শীতল। এই অঞ্চলটিকে মেসোপজ (Mesopause) বলা হয়।
এবারে আসি হেটেরোস্ফিয়ারের তিনটি উপবিভাগের কথায়—
ঘ) আয়নোস্ফিয়ার: হোমোস্ফিয়ারের ঊর্ধে ১০০-৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চল। সূর্য থেকে ধেয়ে আসা অতিবেগুনি রশ্মি, রঞ্জন রশ্মি ও নানা ধরনের মহাজাগতিক রশ্মিসমূহের সংঘাতে এই স্তরে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়নের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবী থেকে প্রেরিত বেতার তরঙ্গ এই স্তরেই প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসে। এছাড়াও পৃথিবীর দুই মেরুতে মেরুজ্যোতি সৃষ্টি হওয়ার কারণও এই স্তরটি।
ঙ) এক্সোস্ফিয়ার: এটি আয়নোস্ফিয়ারের উপরের স্তর। এখানে বায়ুস্তর এত হাল্কা যে তার অস্তিত্ব বোঝাই যায় না।
চ) ম্যাগনিটোস্ফিয়ার: এই স্তরে বায়ুমণ্ডলকে বেষ্টন করে আছে একটি চৌম্বকক্ষেত্র (Mahnetic field)। এখানে পৃথিবীর চৌম্বকত্বের দরুন আটকে পড়া কণিকাগুলো পৃথিবীর চৌম্বক বলরেখা বরাবর ছড়িয়ে থাকে। একে বলা হয় ভ্যান অ্যালেন বলয়। এই বলয় বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এর অস্তিত্ব কখনো কখনো এক লক্ষ কিলোমিটার দূরেও ধরা পড়ে।
পৃথিবীর অভ্যন্তর:
পৃথিবীর পৃষ্ঠতলে যেসব বস্তু রয়েছে সেগুলি আমরা দেখতে পাই। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি দূরবিনের চোখ দিয়ে মহাকাশের দূর-দূরান্ত আজ আমাদের দৃষ্টি সীমার মধ্যে। কিন্ত প্রযুক্তির এত উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর অভ্যন্তর আজও আমাদের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে। কারণ অনেক চেষ্টার পরেও আমরা ৮ কিলোমিটারের বেশি গভীর কোনো গর্ত খুঁড়তে পারিনি। তাহলে কি পৃথিবীর অভ্যন্তরে কী আছে তা জানা এখনও আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে? বিজ্ঞানীরা অবশ্য হাল ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে ছিলেন না। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নানা উপায়ে তাঁরা পৃথিবীর ভূ-স্তরের নীচের উপাদানগুলির চিত্র গ্রহণে সমর্থ হয়েছেন। এই চিত্র বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর কেন্দ্র অঞ্চলটিকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন—
(১) ভূত্বক বা ক্রাস্ট। এই স্তরটি সবার উপরে রয়েছে যাকে আমরা মাটি বলি। এই মাটির উপরেই জন্মায় গাছপালা, প্রাণীদের বিচরণভূমি, আমাদের বসবাস ইত্যাদি। এই স্তরটি কিন্তু খুব বেশি পুরু নয়, মাত্র কয়েক কিলোমিটার।
(২) এই মাটির স্তরের নীচে রয়েছে ম্যান্টল বা বর্ম। এটি মাটি ও গ্র্যানিট পাথর দিয়ে গঠিত। এই স্তরটি সর্বত্র সমান পুরু নয়। ভূস্তরের নীচে গড়ে ৩৫ কিলোমিটার হলেও সমুদ্রের তলদেশে ৫ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই স্তরটির নীচে রয়েছে ব্যাসল্ট স্তর নামে পরিচিত শক্ত ও ভারী পাথরের স্তর।
(৩) সর্বশেষ স্তরটিকে বলা হয় কেন্দ্রমণ্ডল বা কোর অঞ্চল।
ম্যান্টল ও ভূত্বকের মাঝে যে সীমাতল রয়েছে তাকে বলা হয় মোহোরোভিসিক (সংক্ষেপে মোহতল)। ম্যান্টলের উপরের অংশ ও ভূত্বককে একত্রে বলা হয় লিথোস্ফিয়ার বা শিলামণ্ডল। এটি ১০০-১৫০ কিলোমিটার পুরু। এর নীচে রয়েছে অ্যাসথেনোস্ফিয়ার। এটি কিন্তু কোনো কঠিন স্তর নয়। থকথকে গলা পিচ বা জেলির মতো এই স্তরের উপর মহাদেশ, সাগর ও মহাসাগরগুলিকে নিয়ে লিথোস্ফিয়ারের পাত বা প্লেটগুলি ভাসছে। এই পাতগুলি যখন নড়াচড়া করে তখনই সৃষ্টি হয় ভূকম্প, অগ্নুৎপাত, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি। পৃথিবীর কোর এলাকার উপরের স্তরটি তরল হলেও শেষ স্তরটি কিন্তু কঠিন।
শেষ কথাঃ
পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও প্রাণের বিকাশ হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বিজ্ঞানীরা সৌরজগত তো বটেই, সৌরজগেতের বাইরেও এখনও কোনো প্রাণের হদিস পাননি। মাঝে মাঝে সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও সেটা সম্ভাবনার মধ্যেই আটকে আছে, নিশ্চিত করে বিজ্ঞানীরা এখনও কিছু বলতে পারেননি। তাই একমাত্র গ্রহটি থেকে প্রাণের অস্তিত্ব মুছে যাক তা নিশ্চয়ই আমরা চাইব না। কিন্তু আমাদের কি সেদিকে খেয়াল আছে? যেভাবে দূষণের মাত্রা পৃথিবীতে বেড়ে চলেছে তাতে বিপদ আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো সময় ঘরের ভিতর ঢুকে পড়বে। তখন পৃথিবী হয়তো টিকে থাকবে, কিন্তু আমরা থাকতে পারব?
বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে