FUNবিজ্ঞান-বিচিত্র জীবজগত-বাবুই পাখির বাসা-যূথিকা আচার্য্য-শীত২০২২

বিচিত্র জীবজগত- সব লেখা একত্রে

bigganbabui01

বাবুই পাখির নাম কে কে শুনেছ বলো তো? গ্রাম-বাংলায় যারা থাকো, তারা নিশ্চয় এই ছোট্ট পাখিগুলিকে বাড়ির আশেপাশে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়তে দেখেছ। অনেকে আদর করে এদের তাঁতি পাখি বলেও ডাকে। এদের শরীরের রঙ হালকা বাদামি এবং পুরুষ বাবুইয়ের মাথা ও গলার অংশটি কাঁচা হলুদ রঙের পালক দিয়ে ঢাকা থাকে।

পুরুষ বাবুই পাখির মাথা ও গলার রঙ হলদে কেন জানতে চেয়েছিলাম বলে ছোটোবেলায় আমার দাদু আমাকে একটা ভারি মজার গল্প শুনিয়েছিলেন। সেই গল্পটা হল এইরকম যে—

বাবুই পাখি আসলে ছিল একটি গাঁয়ের ছেলে। ছোটোখাটো, কালোকেলো চেহারা ছিল তার। স্বভাবখানা লাজুক। আমাদের বাবুই ছেলেটি খিচুড়ি খেতে ভারি ভালোবাসত, আর ভালো খিচুড়ি খেতে পেলে খেতও সে অনেকখানি। বয়সকালে বাবুই ছেলের হল বিয়ে। বিয়ের পর নিজের কনে বউকে নিয়ে বাবুই গেল শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়িতে সবাই জানে যে নতুন জামাই খিচুড়ি খেতে বড়ো ভালোবাসে। তাই শাশুড়ি ঠাকরুন নারকেল, মটরশুঁটি, কাজু বাদাম আর কিশমিশ দিয়ে তৈরি করলেন হাঁড়িভর্তি খিচুড়ি। এদিকে হয়েছে কী, বাবুইয়ের কিনা খিচুড়ি দেখলে কাণ্ডজ্ঞান সব লোপ পায়, তাই তার মা-বাবা সবাই তাকে পইপই করে বলে দিয়েছেন যে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আর যাই করিস, লোভীর মতো সব খিচুড়ি একাই খেয়ে ফেলিসনি যেন। তুই নতুন জামাই। রয়ে-সয়ে খাবি। সবকিছুতে বলবি আর না, আর না, এই অনেক। তবে শাশুড়ি ঠাকরুন কিনা তোর মায়ের মতো, তাই তিনি কিছু বললে বলবি, হ্যাঁ মা, কী আর বলব! আপনি যা বুঝেছেন, তাই ঠিক।

মা-বাবার কথামতো শাশুড়ি ঠাকরুন কাঁসার থালায় খিচুড়ি দিতে এলেই বাবুই ছেলে হামলে পড়ে থালার ওপর—“না মা, না মা, অনেক দিয়েছেন, আর দেবেন না।”

শাশুড়ি মা অবাক হয়ে বলেন, “ও কী গো জামাই! এটুকু খাবারে কারও পেট ভরে? হ্যাঁ গো জামাই, বলি পেট-টেট ঠিক আছে তো তোমার?”

আগেই বলেছি যে বাবুই আমাদের ভারি লাজুক, তায় সে নতুন জামাই। ঠাকরুনের প্রশ্নের উত্তরে সে মা-বাবার শেখানো কথাটিই বলল, “হ্যাঁ মা, কী আর বলব। আপনি যা বুঝেছেন, তাই ঠিক।”

শাশুড়ি মা দেখলেন ভারি বিপদ! পাছে লোকে ভাবে যে শ্বশুরবাড়ির রান্না খেয়ে নতুন জামাইয়ের পেটখারাপ হয়েছে, সেইজন্য তাড়াতাড়ি জামাইয়ের সামনে থেকে খিচুড়ির থালাটি সরিয়ে তিনি তাকে খেতে দিলেন কাগজি লেবুর রস দিয়ে চটকানো ভাত আর গুটিকতক গাঁদাল পাতার বড়া।

বাবুই ছেলে কী আর করবে! সে তখন মনখারাপ করে শুধু গাঁদাল পাতা আর লেবু চটকানো ভাত খেল।

তারপর সবাই যখন রাত্রিবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছে, নতুন জামাই তখন চুপিচুপি উঠে রান্নাঘরে গিয়ে খিচুড়ির হাঁড়িটির সামনে বেশ গুছিয়ে বসল। হাঁড়িতে হাত ঢুকিয়ে সে এক-এক খাবলা খিচুড়ি খায় আর বলে, “আহা, কী খেলুম! কী খেলুম!”

ওদিকে রাতদুপুরে রান্নাঘরে হাঁড়িকড়াইর আওয়াজ শুনে শাশুড়ি ঠাকরুন ভাবলেন বুঝি রান্নাঘরে চোর ঢুকেছে। তিনি চেঁচামেচি করে বাড়ির লোকজনকে জাগিয়ে তুললেন। বুঝতেই পারছ যে নতুন জামাইর অবস্থাটা তখন কেমন! সে-বেচারা লজ্জায় তখন খিচুড়ির হাঁড়িটির মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে ভগবানকে বলল, “ঠাকুর, আমাকে পাখি করে দাও। উড়ে পালাই।”

ঠাকুর বললেন, “তথাস্তু।”

বাবুই ছেলে তখন থেকেই বাবুই পাখি হয়ে উড়ে বেড়ায়। খিচুড়ির হাঁড়িটি মাথার ওপর পরে ছিল বলে খিচুড়ি লেগে তার মাথা আর গলার রঙ হয়ে গেল হলুদ। লজ্জায় সে আজও মানুষ হয়নি, আর খিচুড়ির দাগও রয়ে গেল ঠিক তেমনি।

খুব মজার গল্প, তাই না!

এখন দেখো, তাঁতি পাখি আকারে যতই ছোটো হোক না কেন, তাদের তৈরি ঠাস-বুনোটের মজবুত বাসা বানানোর কারিগরি দেখলে কিন্তু আমাদেরও হিংসে হবে। কেমন সুন্দর গোল, উলটনো কুঁজোর মতো দেখতে তাদের বাসা। ঝড়, জল, বাতাস যাই হোক না কেন, বাবুইয়ের বাসা পড়ে যায় না, আবার ভিজে নষ্টও হয় না। খুদে বাসার মধ্যে তাঁতি পাখিরা তাদের ছানাপোনাদের নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। অথচ শিল্পী হিসেবে ওই অতটুকু ছোট্টো পাখির সম্বল শুধু তার খুদে ঠোঁট দুটি এবং দুখানি পা।

পুরুষ বাবুই সাধারণত নারকেল, খেজুর বা তালগাছের নীচের দিকের ডালগুলিকে বেছে নেয়। তাদের বাসা বানানোর জন্য। এর কারণ হল এই যে, এই ধরনের গাছগুলি ভূচর এবং খেচর দুইরকমের শত্রুদের হাত থেকেই তাদের রক্ষা করে। ভূচর অর্থাৎ যারা মাটিতে চলাচল করে। যেমন সাপ, গোসাপ, বেড়াল বা শেয়াল। বুঝতেই পারছ যে নারকেল বা তালগাছের উচ্চতা হয় অনেক বেশি এবং তাদের ডালপালাশূন্য মসৃণ কাণ্ডে চড়তে পারা অত সহজ ব্যাপার নয়। খেজুরগাছের উচ্চতা অপেক্ষাকৃত ছোটো হলেও তার রুক্ষ, কাঁটায় ঢাকা কাণ্ডটি খুব কড়া বর্মের মতোই কাজ করে। আবার এই সমস্ত গাছগুলির মাথার ওপরে শক্ত পাতার ছাউনি থাকায় চিল বা ঈগল পাখির আক্রমণের হাত থেকেও এরা বেঁচে যায়।

বর্ষার শুরুতে পুরুষ বাবুই পাখিরা একসঙ্গে মিলেমিশে একটি বা দুটি পছন্দমতো গাছ খুঁজে বের করে। এরপর তারা বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিজের নিজের বাসা বানানো শুরু করে। এরপর পুরুষ পাখিরা সরু সরু চেরা ঘাস আর খড়কুটো দিয়ে তাদের বাসার বুনুনি তৈরি করতে শুরু করে। বাসা তৈরির কাজ অর্ধেক সম্পূর্ণ হলে পুরুষেরা নেচে-গেয়ে-ডানা ঝাপটিয়ে তাদের প্রেমিকাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। স্ত্রী পাখিরা এরপর তাদের পছন্দমতো পুরুষটিকে নির্বাচন করে এবং প্রেমের প্রাথমিক পর্ব অর্থাৎ নাচ-গান সব শেষ হলে তারা দুজনে মিলে একসঙ্গে বাসা বোনার কাজ শেষ করে।

ঘাসের বুনুনি শেষ হয়ে যাওয়া মানেই যে বাসা তৈরির কাজ শেষ, এমন কিন্তু নয়। ঘরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য এরপর পেটের পালক দিয়ে ঘষে বাসার বাইরের দেওয়ালটিকে মসৃণ করে পুরুষ পাখি এবং স্ত্রী পাখি নেয় ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের দায়িত্ব। অর্থাৎ মুখে করে কাদামাটি এনে, তা দিয়ে ঘরের ভেতরের দেওয়াল লেপে ঘরটিকে এয়ার ও ওয়াটারপ্রুফ করার কাজ করে তারা। অনেকের মুখে শুনেছি যে বাবুই পাখি নাকি জোনাকি পোকা ধরে এনে ঘরের ভেতর কাদার তালে আটকে রাখে। মানে ওই অরগ্যানিক নাইট ল্যাম্প আর কী! তবে এই সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া যায়নি কিছুই। হতেই পারে যে জোনাকি পোকা গুঁজে রাখার ব্যাপারটা হল স্রেফ গালগপ্পো।

গঠন অনুযায়ী বাবুই পাখির বাসা কিন্তু দুইরকমের হয়। শুধু যখন কর্তা-গিন্নি দুজন থাকেন, তখন বাসাটির আকার হয় উলটনো ফুলের সাজির মতো।

bigganbabui02

নীচের দিকের অংশটি থাকে খোলা। তবে ডিম পাড়ার সময় হলে কর্তা বাবুই নীচের দিকে একটি অংশ ঢেকে দিয়ে ডিম রাখার জায়গা তৈরি করে দেন। তখন বাসাটিকে দেখলে মনে হয় যেন উলটনো কুঁজো।

bigganbabui03

ডিম পাড়ার পর মা-পাখি তার ডিমসহ সেই জায়গাটিতে বসে ডিমে তা দেয় এবং বাবা পাখি এখানে সেখানে ওড়াউড়ি করে তার পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করে।

বাবুই পাখিরা সাধারণত দল বেঁধে থাকে। তবে প্রজননের সময় তারা নিজেদের সঙ্গী বেছে নিয়ে একসঙ্গে ঘর বাঁধে। পুরুষ বাবুই বহুগামী হয়। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস অবধি চলে তাদের প্রজননের সময়‍ এবং এই সময়ে নারী ও পুরুষ উভয়েই ভীষণ ব্যস্ত থাকে। পুরুষ পাখি ব্যস্ত থাকে বাসা তৈরির কাজে। স্ত্রী পাখিরা পুরুষদের বাসা বানানোর গতি এবং বাসার সৌন্দর্য দেখে তাদের দিকে আকৃষ্ট হয়। সন্তান পালনের কাজটি অবশ্য মা-বাবা দুজনেই সমানভাবে ভাগ করে নেয়। ডিম থেকে পাখির ছানা ফুটে বেরোনোর পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তারা উড়তে শিখে যায়। ছানারা উড়ে গেলে পুরুষ ও স্ত্রী পাখি আবার উড়ে গিয়ে নিজেদের দলে মিশে যায়। এমনিভাবেই চলতে থাকে তাদের বংশপরম্পরা।

 জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s