মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে
মহাকাশে মিটমিট জ্বলছে যে আলোকবিন্দুগুলি ওগুলো কী? প্রতি রাতে কারা জ্বেলে দিয়ে যায় ওই আলো? এদের মধ্যে যারা মিটমিট করে না তারা নিয়ত স্থান পরিবর্তন করে। প্রায় দশ হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পাননি। তাই তাঁরা কিছু কাল্পনিক গল্পের সাহায্য নিয়ে এদের মধ্যে একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য তাঁদের দোষারোপ করা যায় না। কারণ সে সময় তাঁদের হাতে না ছিল উন্নত বিজ্ঞান, না ছিল কোনো প্রযুক্তি। খালি চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রাথমিক জ্ঞানের সাহায্যে মহাকাশের রহস্যের যে ব্যাখ্যা তাঁরা দেবার চেষ্টা করেছিলেন তাতে ভুলত্রুটি তো থাকবেই। যাই হোক, ধীরে ধীরে বিজ্ঞান এগোতে থাকে মানুষের জ্ঞানও বাড়তে থাকে। একদিন তাঁরা বুঝতে পারে মিটমিট না করা আলকবিন্দুগুলি আর মিটমিট করা আলোকবিন্দুগুলি এক নয়। সরে সরে যাওয়া আলোকবিন্দুগুলি এক ধরনের পরিব্রাজক জ্যোতিষ্ক। গ্রিক ভাষায় ‘প্ল্যানেট’ শব্দের অর্থ ‘পরিব্রাজক’। তাই ওই জ্যোতিষ্কগুলির নাম রাখা হল ‘প্ল্যানেট্স’। বাংলায় এদেরই বলা হয় গ্রহ। এক একটি গ্রহের নাম রাখা হয় এক একটি দেবতার নামানুসারে। দূরত্বের বিচারে পৃথিবীর পরের গ্রহটির নাম মঙ্গল গ্রহ। সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ।
মঙ্গলের জন্ম কি পৃথিবী থেকে?
না কোনো কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়। জ্যোতির্বিদদের একাংশের এমনই ধারণা। গণিতের সাহায্যে চাঁদ সম্পর্কিত কয়েকটি অমীমাংসিত মহাজাগতিক ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা থেকেই তাঁদের এমন ধারণা হয়েছে। অবশ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সবাই যে এই তত্ত্ব মেনে নিয়েছেন এমনটা নয়। যাঁরা মেনে নিয়েছেন তাঁরা কী বলছেন, দেখে নেওয়া যাক।
একটি নক্ষত্রের জন্ম কীভাবে হয় তা এখন প্রায় সকলেরই জানা। যেহেতু সূর্য একটি নক্ষত্র তাই তারও জন্ম হয়েছিল ঠিক একইভাবে। সৌরজগতের সৃষ্টিও প্রায় একই সময়ে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন বছর আগে। সেসময় মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা বিপুল মহাজাগতিক ধূলিকণা জায়গায় জায়গায় জড়ো হয়ে জমাট বাঁধতে শুরু করে আর তা থেকেই সৃষ্টি হয় গ্রহগুলি। পৃথিবী তখন একটি সদ্যজাত গ্রহ। শরীরের বাইরেটা তখনও কঠিন হয়নি। এমন সময় হঠাৎ-ই একটি ধূমকেতু এসে পড়ে পৃথিবীর কাছাকাছি। গ্রহটির আকর্ষণ এড়াতে না পেরে প্রচণ্ড গতিতে আছড়ে পড়ে তার বুকে। সেই ধাক্কায় পৃথিবীর গা থেকে ছিটকে ওঠে দুটো টুকরো। বড়ো টুকরোটা পৃথিবীর আকর্ষণ কাটিয়ে মহাশূন্যে চলে গেলেও সূর্যের আকর্ষণ কাটাতে না পেরে তার চারপাশে ঘুরতে লাগল। জন্ম হল মঙ্গল গ্রহের। ছোট টুকরোটা কিন্তু বন্দী হয়ে রইল পৃথিবীর আকর্ষণের বাধায়। সেটাই চাঁদ হয়ে ঘুরতে লাগল তার চারপাশে। যাঁরা এই তত্ত্বে বিশ্বাসী তাঁরা আরও একটা চমকপ্রদ কথা শুনিয়েছেন। তাঁরা গণিতের সাহায্যে যে সূত্র পেয়েছেন সেটা হল মঙ্গল ও চাঁদের মিলিত আয়তন ও প্রকৃতির সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের আয়তন ও প্রকৃতি দারুণভাবে মিলে যায়।
পৃথিবী থেকে চাঁদ ও মঙ্গলের জন্মের এই তত্ত্বটি এখনও নিশ্ছিদ্রভাবে প্রমাণিত হয়নি। তবে অন্যান্য তত্ত্বগুলির তুলনায় এই তত্ত্বটি এখনও পর্যন্ত বেশী সম্ভাবনাময় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। বিশেষ করে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট জ্যোতর্বিজ্ঞানী ড. আর এ লিট্ল্টনের অভিমত এমনটাই।
মঙ্গলের আকৃতি ও ভূমিরূপ
মঙ্গল কি গোল? না, মঙ্গল গ্রহ গোলাকার নয়। অনেকটা পৃথিবীর মতোই। অর্থাৎ, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু অঞ্চল কিছুটা চাপা। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের চেয়ে উত্তর মেরু অঞ্চল কিছুটা বেশি চাপা। গ্রহটির আরেকটি বিশেষত্ব হল এর কেন্দ্র কিছুটা দক্ষিণ ঘেঁষা। ফলে কেন্দ্র থেকে উত্তর মেরুর দূরত্ব দক্ষিণ মেরুর চেয়ে ৩·৪ কিলোমিটার বেশি। ১৯৭৩ সালে তিনটি অক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহটির ব্যাসার্ধের পরিমাপ করে যে ফল পাওয়া গেছে তা নিম্নরূপঃ
১) দীর্ঘতম নিরক্ষীয় অক্ষ (১০৫০ দ্রাঘিমা) ৩,৩৯৪ কিলোমিটার।
২) এই অক্ষটির সঙ্গে সমকোন সৃষ্টিকারী নিরক্ষীয় অক্ষ ৩,৩৯৬ কিলোমিটার।
৩) মেরু অক্ষ ৩,৩৭৬ কিলোমিটার।
উল্লেখ্য দীর্ঘতম নিরক্ষীয় অক্ষটি সিরটিস মেজর এবং উচ্চতর থারসিস অঞ্চলের দ্রাঘিমার মধ্যগামী রেখার উপর অবস্থিত।
গ্রহটির আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হল উত্তর মেরু অঞ্চলে স্তরীভূত শিলাস্তর দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের স্তরীভূত শিলাস্তরের তুলনায় বেশি পুরু। দুটি কারণে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি- (১) আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্নুৎপাতের সঙ্গে উদ্গত লাভা জমে অথবা (২) সঞ্চরণশীল ভূতাত্ত্বিক পাত-এর পারস্পরিক সংঘর্ষের ফলে। ঠিক যেভাবে পৃথিবীতে হিমালয় সহ অন্যান্য পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি হয়েছে।
পর্যবেক্ষণের কাজে মঙ্গলের আকাশে যেসব মহাকাশযান পাঠানো হয়েছিল তাদের পাঠানো তথ্য থেকে জানা যায় যে গ্রহটির দুটি মেরু অঞ্চলে রয়েছে মালভূমি। আর নিরক্ষীয় অঞ্চলে উঁচু পর্বতমালার বেষ্টনী। কোথাও অতিকায় গিরিখাত বা ক্যানিয়ন (Canyon) আবার কোথাও শিলাস্তরের মধ্যে দীর্ঘ ও গভীর ফাটল যেগুলিকে বলা হয় ক্যায়োস (Chaos)। ১৮৭৭ সালে ইটালির জ্যোতির্বিজ্ঞানী গিওভান্নি শিয়াপারেলি ২১ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি দুরবিনের সাহায্যে পৃথিবী থেকে এই গিরিখাতগুলোকেই সরু সরু রেখার মতো দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ক্যানিলি (Canali) ইতালীয় ভাষায় যার অর্থ গর্ত বা খাদ। জ্যোতির্বিজ্ঞানী শিয়াপারেলি কোনো ভুল করেননি। তিনি দাগগুলির সঠিক নামকরণই করেছিলেন। ভুলটা হয়েছিল পরবর্তীকালে। বিজ্ঞানীদের ভুলে একসময় ‘ক্যানিলি’ হয়ে গেল ‘ক্যানাল’। অর্থাৎ, খাদ হয়ে গেল খাল।
মঙ্গলের অধিকাংশ পাহাড়-পর্বতই গ্র্যানিট পাথরে তৈরি। বিভিন্ন মহাকাশযান থেকে পাওয়া ছবি পর্যবেক্ষণ করে অনুমান করা হয় যে গ্রহটিতে এখনও কিছু জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে। কারণ কিছু কিছু পাহাড়ের শীর্ষে ঘন ধোঁয়াশা ও মেঘের উপস্থিতি দেখা গেছে। সেগুলি সম্ভবত জ্বালামুখ থেকে নির্গত গ্যাস ও জলীয় বাষ্প।
মঙ্গল গ্রহে বিজ্ঞানীরা আরও একটা চমকপ্রদ ঘটনা লক্ষ্য করেছেন। এখানকার ভূমিরূপে দেখা গেছে দক্ষিণ গোলার্ধের তুলনায় উত্তর গোলার্ধে গহ্বরের সংখ্যা অনেক কম। এরকম হওয়ার কারণ সম্ভবত উল্কার আঘাতে সৃষ্ট গহ্বরগুলি উত্তর গোলার্ধের আগ্নেয়গিরি থেকে উদ্গীরিত লাভায় ঢেকে গেছে। তাই উত্তর গোলার্ধে সমতল ভূমির পরিমাণ দক্ষিণ গোলার্ধের তুলনায় অনেক বেশি। এ থেকে আরও একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে দক্ষিণ গোলার্ধের তুলনায় উত্তর গোলার্ধে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির সংখ্যা এক সময় অনেক বেশি ছিল।
মঙ্গল গ্রহে সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গের নাম অলিম্পাস মন্স্। এর উচ্চতা ২৬ কিলোমিটারের মতো (মাউন্ট এভারেস্ট-এর চেয়ে প্রায় ৩ গুণ উঁচু)। ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যাশন্যাল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল ইউনিয়ন পর্বতশৃঙ্গটির এই নামকরণ করেন। বিজ্ঞানীদের অনুমান এটি সৃষ্টি হয়েছে লাভা জমে। বিশাল জ্বালামুখ সহ এই বিশাল আগ্নেগিরিটি থারসিস স্ফীতি অঞ্চলে অবস্থিত। এই অঞ্চলে আরও তিনটি বৃহৎ আগ্নেগিরি আছে। তবে অলিম্পাস মন্স্ সবচেয়ে উঁচু। বিজ্ঞানীদের ধারণা এত উঁচু আগ্নেগিরি সৌরজগতে আর কোনো গ্রহে নেই।
মঙ্গলের আবহাওয়ামণ্ডল
মঙ্গলের আকাশে দুটি স্তরে দু’ধরনের মেঘ রয়েছে। নীচের স্তরের মেঘ হালকা হলুদ রঙের। বিজ্ঞানীদের অনুমান মঙ্গল পৃষ্ঠ থেকে ধুলো ও সূক্ষ্ম বালুকণা উড়ে গিয়ে এই মেঘের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন মানমন্দির থেকে পর্যবেক্ষণের সময় দেখা গেছে এই মেঘের স্তর মাঝে মাঝেই গ্রহটাকে স্পম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে। সেটা কখনো সপ্তাহের পর সপ্তাহ আবার কখনো মাসের পর মাস চলতে থাকে। এই স্তরটি ঊর্ধ্বাকাশে ১৮ কিলোমিটারের উপরে দেখা যায় না। এর উপরের স্তরটি হালকা বেগুনি রঙের। ১৮ থেকে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই স্তরটি নীচের স্তরের মতো ঘন নয়, বরং স্বচ্ছ। এই মেঘ থেকে কোনো বৃষ্টি ঝরে না।
পৃথিবীর বায়ুচাপের তুলনায় মঙ্গলের বায়ুচাপ অত্যন্ত কম। পৃথিবীতে যেখানে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় জল বাষ্পীভূত হয় সেখানে মঙ্গল গ্রহে জল বাষ্পীভূত হয় মাত্র ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায়। আমরা জানি যত ঊর্ধ্বাকাশে যাওয়া যায় তত বায়ুচাপ কমে। পৃথিবীতে এমনটাই হয়। কিন্তু মঙ্গলে ঊর্ধ্বাকাশে ২৮ কিলোমিটার ওঠার পর বায়ুচাপ বাড়তে থাকে। মঙ্গলে বায়ুপ্রবাহ আছে তবে তার বেগ পৃথিবীর বায়ুপ্রবাহের তুলনায় অনেকটাই কম। এখানকার আবহাওয়ামণ্ডলের বেশির ভাগটাই কার্বন ডাইঅক্সাইড। মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষনের টান খুবই দুর্বল, পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র। তাই গ্রহটি কার্বন ডাইঅক্সাউইড ছাড়া অন্যান্য হালকা গ্যাসগুলি ধরে রাখতে পারেনি। ছিটেফোঁটা যেগুলি ধরে রাখতে পেরেছে সেগুলি হল— নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, আর্গন, কার্বন মনোক্সাইড, নিয়ন, ক্রিপটন, জেনন, ওজন এবং জলীয় বাষ্প। তাই সেখানেও সকাল-সন্ধ্যায় পৃথিবীর মতো গোধূলির আলো দেখা যায়।
‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অফ জাপান’ ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মঙ্গলের আবহাওয়ামণ্ডলের উপর বেশ কয়েকবার পর্যবেক্ষণ চালায়। সে পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যাবলি বিশ্লেষণ করে জাপানের জ্যোতির্বিজ্ঞানী টি. সাহেকি এক চাঞ্চল্যকর খবর দেন। তিনি বলেন গ্রহটির ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার ঊর্ধাকাশে বিস্তৃত এক ধরনের বিচিত্র মেঘের সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের রং ধূসর। এই মেঘের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে সেই রহস্য এখনও বিজ্ঞানীদের অজানা। যদিও কারও কারও মতে গ্রহটিতে অবস্থিত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপা্তের ছাই থেকে এই মেঘের সৃষ্টি।
অনেকের মনে হতে পারে মঙ্গলগ্রহের পৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে পৃথিবীর মতোই মেঘের আনাগোনা দেখা যাবে। না, তেমনটা নয়। সেখানকার মেঘ অত্যন্ত হাল্কা এবং স্থানিক ও সর্বত্র।
মঙ্গলে ধূলিঝড়
(লেখার সঙ্গে মঙ্গলের সাঙ্ঘাতিক ধুলোর ঝড়ের বিষয়ে নাসা-র এই ভিডিও রিপোর্টটা রইল~ সম্পাদক)
মঙ্গলগ্রহে মাঝে মাঝে ধূলিঝড় বইতে দেখা যায়। এই ঝড় দক্ষিণ গোলার্ধের তুলনায় উত্তর গোলার্ধে বেশি হয়। এমনটা কেন হয় তার কারণ খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিজ নিজ কক্ষপথে সূর্যকে পরিক্রমণের সময় পৃথিবী ও মঙ্গল যখন সূর্যের একদিকে চলে আসে তারা পরস্পর কাছাকাছি হয়। শুধু তাই নয়, এই সময় গ্রহদুটি সূর্যেরও নিকটতম অঞ্চলে অবস্থান করে। গ্রহদুটির এই ধরনের অবস্থানকে বলা হয় ‘প্রতিযোগ’ (Opposition) দশা। দেখা গেছে এই সময়েই মঙ্গলের আকাশে ধূলিঝড় শুরু হয়। এর ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্রতিযোগ দশার সময় সূর্য থেকে উত্তিত প্রচণ্ড সৌরঝড়। এই ঝড়ের প্রকোপে মঙ্গলের আবহাওয়ামণ্ডল বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শুরু হয় প্রবল ঝঞ্ঝা সেই সঙ্গে ধুলিঝড়।
মঙ্গলে সবুজ
মঙ্গলগ্রহকে আমরা লাল গ্রহ বলেই চিনি। খালি চোখে একে একটু লালচে দেখায়। এই লালচে রঙের জন্য এক সময় মঙ্গলকে নিয়ে নানা ধরনের কাল্পনিক গল্পের সৃষ্টি হয়েছিল। তবে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, এই লালচে রঙের উৎস সেখানকার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা পাথরগুলি। সেগুলি দেখতে অনেকটা মরচে ধরা লোহার মতো লালচে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পাথরগুলিতে থাকা সিলিকন ও অ্যালুমিনিয়ামের অক্সাইডের সঙ্গে মিশে থাকা প্রচুর পরিমাণে আয়রনের অক্সাইড জারিত হয়ে সেগুলি লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন মরুভূমির কোনো কোনো অঞ্চলে অনেক সময় এই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
কিন্তু শক্তিশালী দূরবিনের সাহায্যে দেখলে এর কিছু কিছু অঞ্চলে সবুজের রেখা দেখতে পাওয়া যায়। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এই রঙ পাল্টাতে থাকে। শীতে কিছুটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বসন্ত এলে আবার গাঢ় সবুজ রঙ ফিরে আসে। কিন্তু গরম পড়লেই রঙটা কালচে হয়ে যায়। গ্রীষ্মের শেষে হলদে বা ধূসর। এই ভাবে প্রতি বছরই চক্রাকারে ঐ বিশেষ এলাকার রঙের পরিবর্তন হতে থাকে। সবুজ রঙের রহস্য ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানী মহলে তিন ধরনের মতবাদ আছেঃ-
১) ঐ অঞ্চলে জল আছে। তাতে আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরনের জন্য সবুজ রঙের সৃষ্টি।
২) শ্যাওলা বা লাইকেন জাতীয় উদ্ভিদ আছে। বসন্ত কালে সামান্য জল ও অক্সিজেন পেয়ে সেগুলি সজীব হয়ে ওঠে। তখন ঐ এলাকা গাঢ় সবুজ দেখায়।
৩) কোনোটাই নয়। সবটাই চোখের ভুল। আসলে মঙ্গলের লালচে-কমলা রঙের সঙ্গে ধূসর রং মিশে সবুজ রঙের বিভ্রম সৃষ্টি করে।
উপরোক্ত তিনটি তত্ত্বের কোনোটাই বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি মেনে নিতে পারেননি। তাই মঙ্গলের সবুজের সমারোহ এখনও রহস্যময়।
মঙ্গলে বরফের চাদর
মঙ্গলে জল আছে এমন ধারণা প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। তবে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। লালচে গ্রহটিতে বায়ুমণ্ডলের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও জলের কোনো হদিস মেলেনি। তাহলে জল গেল কোথায়? গ্রহটির দুই মেরু অঞ্চল ধব ধবে সাদা চাদরে মোরা। তাহলে সমস্ত জল কি সেখানে জমে আছে? মঙ্গলের মেরু প্রদেশের এই বরফের মুকুট ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে আয়তনে বাড়েকমে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হার্শেল সর্বপ্রথম এই ঘটনাটি লক্ষ্য করেন। তবে এই বরফের টুপি কী দিয়ে তৈরি তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক ছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানী এ. সি. র্যানিয়ার্ড এবং জি. জে. স্টোনের মতে এই মেরু টুপির উপাদান জল নয়, কার্বন ডাইঅক্সাইডের বরফ (Dry ice) দিয়ে তৈরি। তাঁদের এই মতবাদ প্রথমদিকে বিজ্ঞানীরা মেনে নিতে পারেননি।
প্রায় ৫০ বছর পরে মেরু টুপির উপাদানের রহস্য উন্মোচনে পৃথকভাবে কজ শুরু করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জি. পি. ক্যুইপার এবং এ. ডলফাস। দু-জনেই মেরু মুকুটের বস্তু সামগ্রীর প্রতিফলত ধর্ম বিচার পদ্ধতি অবলম্বন করেন। পরীক্ষানিরীক্ষার শেষে দু-জনেই একই কথা বলেন যে ওই বরফের চাদর কার্বন ডাইঅক্সাইডের বরফ দিয়ে নয়, জল দিয়ে তৈরি। এরপর বছর ২০ ওই মেরু মুকুটের উপাদানের রহস্য নিয়ে নাড়াচাড়া না হলেও কয়েকজন বিজ্ঞানীর মনে খটকাটা রয়ে গেল।
১৯৭১ সাল। মেরু চাদরের রহস্য উন্মোচনে রেডিয়োমিটার ও ইনফ্রারেড স্পেকট্রোমিটারের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন একদল বিজ্ঞানী। এই দলে ছিলেন আর. শার্প, আর. লাইটন, বি. মারে, এন. সোডারব্লোম এবং জে. কট্স। পর্যবেক্ষণ শেষে তাঁরা একমত হয়ে বলেন, মঙ্গলের মেরুদ্বয়ের মুকুট মুখ্যত কার্বন ডাইঅক্সাইডের বরফ দিয়ে তৈরি। শীতে মেরু অঞ্চলের এই বরফের চাদরের আয়তন বৃদ্ধি পায় আর গ্রীষ্ম এলেই এটি ছোট হয়ে যায়।
ভাবা গিয়েছিল, এবারে হয়তো মেরুটুপির রহস্য নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল তা থামবে। কিন্তু না, থামেনি। এই বিতর্কের ইতি টানতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।
জয়ঢাক প্রকাশন থেকে এই লেখকের লেখা মহাবিশ্বে মহাকাশে বইটি কিনতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে