চোখে দেখা গল্প- বন্ধু বানরদল-অমরেন্দ্র চক্রবর্তী-বর্ষা ২০২২

chokhedekha0101

মধ্যপ্রদেশে চিত্রকূট নামে একটা জায়গা আছে। তার বেশিটাই পাহাড় আর জঙ্গল। চিত্রকূটের কথা তোমরা রামায়ণের গল্পে শুনেছ নিশ্চয়ই। চিত্রকূটের জঙ্গল-ঢাকা পাহাড় এদেশের মানুষের কাছে এত বিখ্যাত কেন জানো তো? এখানেই রামের বনবাসের দিনগুলো কেটেছে। এখানে সরযূনদীর তীরে একটা পাথরের বুকে নাকি সীতার পায়ের চিহ্ন এখনও দেখা যায়। সেই পাথর-আগলানো সাধু এমনও বললেন, সীতা সরযূতে স্নান সেরে শিলনোড়ার শিলের মতো দেখতে ওই পাথরখণ্ডে দাঁড়িয়ে ভিজে পোশাক বদলাতেন। সত্যি? তবে তো সীতামায়ের পায়ের চিহ্ন আমি না দেখেই ছাড়ব না! খুব জোরাজুরি করতে পাথর-আগলানো সেই সাধু বা পুরুৎ জবাফুলটুল সরিয়ে, পুরু সিঁদুরের প্রলেপ কিছুটা ফাঁক করে যা দেখালেন, সেটা ধ্যাবড়া মতো রাবণের পায়ের ছাপ যদি বা হয়, সীতার কক্ষনো নয়। এই চিত্রকূটেই নদীর একটা ঘাটের নাম ঘোড়াসি ঘাট। ভরত নাকি ঘোড়ায় চড়ে এ পর্যন্ত এসেই রামের পুজোয় বসেন। আবার চিত্রকূট জায়গাটা উত্তরপ্রদেশের বিখ্যাত ডাকাতদের ডেরা, কুখ্যাত চম্বলেরও বেশ কাছেই। ফলে যখন-তখন চম্বলের ডাকাত এসে হানা দেয়। সেই ভয়েই আমাদের সন্ধের পর বাইরে ঘোরাঘুরি নিষিদ্ধ ছিল।  সরযূ নদী, ঘোড়াসি ঘাট, রাম, সীতা, ভরত— এইসবই চিত্রকূটের মানুষের মুখে শোনা। এখানকার রামায়ণের গল্পও মহাকবি বাল্মীকির রামায়ণের সঙ্গে সব খুঁটিনাটি সুষ্ঠু মিলবে তা কিন্তু নয়। তবে চিত্রকূটে আমার সবসময়ই মনে হয়েছে আমি যেন রামায়ণের পুঁথির মধ্যে ঢুকে পড়েছি। চিত্রকূটে রাম-লক্ষ্মণসীতার দেখাসাক্ষাৎ খুব একটা না পেলেও রামের বানরসেনার সঙ্গে ভালোই আলাপ-পরিচয় হল। সেই ঘটনার কথাই বলছি।

চিত্রকূট ঘুরে দেখে আবার যাত্রা শুরু করব, যাব বান্ধবগড়ের জঙ্গলের দিকে, ঘুম থেকে উঠেই তার তোড়জোড় করছি, এমন সময় জেলাশাসকমশাই এসে আমাকে হঠাৎই তাঁর গাড়িতে উঠিয়ে বললেন, আমার অফিসে একজন কেরানি আছেন, তিনি আসলে মাঙ্কিম্যান, হনুমানের সঙ্গে কথা বলেন। একবার দেখে যাবেন না?

সেখানে গিয়ে দেখি, ঝাঁক ঝাঁক কাকের মতো কালো কোটধারী উকিলবাবুদের জটলা, এটাই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি। ম্যাজিস্ট্রেটমশাই এসেই তার গর্বের মাঙ্কিম্যানকে ডেকে পাঠালেন। গায়ের রং কুচকুচে কালো, লম্বা গোঁফদাড়িতে মুখ, গলা ও বুক ঢাকা। কাঁধ পিঠ ছাপিয়ে চমরি গাইয়ের মতো চুল— কেরানিবাবুকে দেখে অস্বাভাবিক বা অলৌকিক কেউ বলেই বিশ্বাস জন্মায়। গলা দিয়ে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ সুরেলা আওয়াজ বার করতেই দূর-দূর গাছের ডালপালায় নাড়াচাড়ার শব্দ জাগল, দুয়েকটা হনুমানের লম্ফঝম্পের শব্দ ক্রমশই স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আওয়াজ যতই বাড়তে লাগল, হনুমানের সংখ্যাও ততই বাড়ে। ক্রমশ তারা দূরের গাছপালা থেকে লাফিয়ে আশপাশের সব গাছ ভরে ফেলল! লোকটা তখনও মুখ দিয়ে আওয়াজ করে চলেছে। সেইসঙ্গে ছোলাভাজা ছড়িয়ে দিচ্ছে। খাবার দেখে দলে দলে হনুমান গাছ থেকে লাফিয়ে নেমে লোকটাকে ঘিরে ধরল।

এ তো রামায়ণের হনুমান না হয়েই যায় না। রামায়ণ ছাড়া একসঙ্গে এত বানরের কথা আর শুনিনি। নরের সঙ্গে বানরের এরকম ঘনিষ্ঠতা দেখে আমার বড় আহ্লাদ হল। আমিও পরমানন্দে বানরদলের মধ্যে গিয়ে বসলাম। তখন যা একখানা হুলুস্থুল কাণ্ড হল, সে আর কী বলব! আমার হাতে পায়ে গায়ে মাথায় হনুমানের হইচই পড়ে গেল।

chokhedekha0102

তাদের মধ্যাহ্নভোজের পর বানরদলকে কেরানিবাবু যে-যার গাছে ফিরে যাবার আদেশ দিলেন, তারাও একে একে নিমন্ত্রণ প্রাঙ্গণ খালি করে তাদের নিজের নিজের বৃক্ষাবাসে ফিরে গেল।

আমাদের দলে অস্ট্রেলিয়ার ‘লোনলি প্ল্যানেট’-এর ভ্রমণসাংবাদিক, বিশিষ্ট ভারত-পর্যটক ফিলিপা স্যাক্সটনও ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, তুমি তো বেশ জন্তুজানোয়ার ভালোবাসো! আমিও তাই। তবে মাঙ্কিম্যান বিশ্বাস করার দরকার কী? নিয়মিত খাবার নিয়ে চেনা স্বরে ডাকলে মাঙ্কিরা তো আসবেই, হরিদ্বারে, বেনারসে যেমন অনেকেই ভোরবেলা পায়রাদের দানা খাওয়ায়। তোমার সাহসের অবশ্য তারিফ করতে হবে। তোমার সেই ছবিও আমি তুলেছি। ওই ছবি আমি কিন্তু টাইম ম্যাগাজিনে বিক্রি করব, দুটো তুলেছি, একটা নিশ্চয়ই তোমাকে পাঠাব।

শীর্ষচিত্র- যুধাজিৎ সেনগুপ্ত

“স্বর্ণাক্ষর” থেকে প্রকাশিত ‘চোখে দেখা গল্প বই থেকে নেয়া। লেখক ও প্রকাশকের অনুমতিক্রমে।

বইটি অর্ডার করতে কিংবা স্বর্ণাক্ষর-এর সম্পূর্ণ গ্রন্থতালিকার 
যে-কোনো বই কিনতে 

Screenshot_20221214-212524_Facebook

 

3 thoughts on “চোখে দেখা গল্প- বন্ধু বানরদল-অমরেন্দ্র চক্রবর্তী-বর্ষা ২০২২

  1. জয়ঢাক-এর পাঠকদের জন্য আমার এই গল্পের পরিবেশনা চমৎকার। শুধু “ঝাঁকঝাঁক” ঝকঝক হয়ে আছে, শুধরে দিলে ভালো হয়। গল্পের নাম আর লেখকের নাম আলাদা লাইনে রাখা সম্ভব কি?

    Like

    1. ঠিক করে দেয়া হল।
      গল্প ও লেখকের নাম এক লাইনে আসবার একটা প্রযুক্তিগত সুবিধে আছে। ওতে সার্চ ইঞ্জিনদের লেখা বা লেখকের বিষয়ে অনুসন্ধান একটু বেশি ফোকাসড হয়।

      Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s