আগের পর্ব- বন্ধু বানরদল
যাত্রীসুদ্ধু আস্ত একটা রেলগাড়ি জাহাজে উঠবে, সেই জাহাজে চড়েই সাগর যা পাড়ি দেব-শুনে তো আমি রাতে ভালো করে ঘুমোতেই পারলাম না। জার্মানির বার্লিন থেকে যাব সুইৎজারল্যান্ডের ইন্টারলাকেন। পথে সাগর পড়বে। সেই সাগর পার হতে হবে জাহাজে।
ট্রেনে আমি যে কামরায় উঠেছি, তার দু’ধারে দুজন করে যাত্রী। মাঝে ছোট খালি জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে দু’পাশের কাচ লাগানো চওড়া দরজা দিয়ে মাঝে মাঝে বাইরের সুন্দর সব দৃশ্য দেখছি। তবে বেশিটাই চলেছি একটা বই পড়তে পড়তে। সেই বইয়ে সুইৎজারল্যান্ডের দশ হাজার ফুট উঁচু রেলপথের কথা আর ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু রেলস্টেশন ইয়ুমফ্রাউয়ের বর্ণনা পড়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি। শুনেছ হয়তো, ইয়ুমফ্রাউ আসলে বিরাট একটা হিমবাহ। হিমবাহ, ইংরেজিতে যাকে বলে গ্লেসিয়ার, কী জানো তো? মস্ত বড়ো পাহাড়ে লক্ষ লক্ষ বছরের জমাট বরফ।
দশ হাজার ফুট উঁচু ইয়ুমফ্রাউ যাবার ট্রেন যে স্টেশন থেকে ছাড়ে, সেই স্টেশনে যেতে দু-তিনবার ট্রেন বদলাতে হয়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, কখনও পাহাড়ের গা বেয়ে সেই লাল রঙের ট্রেনের ছবিও দেখছি এই চমৎকার বইটিতে। আজ মাঝরাতে ইন্টারলাকেন পৌঁছে কাল সকালেই ইয়ুমফ্রাউয়ের উদ্দেশে বেরব। বইটাতে তাই একেবারে ডুবে গেছি।
হঠাৎ শুনি কামরার মাইক্রোফোনে ঘোষণা হল, ট্রেন জাহাজে ঢুকছে। জাহাজের সাততলার রেস্টোর্যান্টে যাত্রীরা লাঞ্চ খেয়ে নিতে পারেন।
হাতের বই ও সঙ্গের সুটকেস কামরায় রেখে শুধু ক্যামেরা নিয়ে ট্রেন থেকে জাহাজের পেটে নেমে পড়লাম। সামনেই ঘোরানো লোহার সিঁড়ি। সাততলায় উঠে চোখে তো আর পলক পড়ে না। অশেষ আকাশের নীচে অসীম নীল সমুদ্র। কোথাও আর কিছু নেই। শুধু আমাদের এই জাহাজ। আকাশ থেকে হঠাৎ হঠাৎ অ্যালবাট্রস পাখি বিরাট ডানা নাড়তে নাড়তে এসে জাহাজের মাস্তুলে বসে।
জাহাজের সাততলার মানুষজন, মাস্তুলে উড়ে আসা পাখি, সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে নীল জলরাশি- সবই ক্যামেরায় তুলে যাচ্ছি। কতক্ষণ কেটেছে খেয়াল নেই। হঠাৎ শুনি মাইকে ঘোষণা হচ্ছে জাহাজ এখনই ডাঙা ছোঁবে। ট্রেন এখানেই জাহাজ থেকে নেমে যাবে। তার আগেই যে যার কামরায় ফিরে যান। না হলে জাহাজ আপনাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবে।
সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের সাত তলা ফাঁকা করে সবাই দুদ্দাড় করে নীচে নামতে লাগল। আমিও সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়ে রেস্টোর্যান্ট দেখেই থামলাম। আমার তো কিছু খাওয়াই হয়নি। ট্রেন ইন্টারলাকেন পৌঁছবে রাত বারোটায়। তখন তো কোথাও আর খাবার সুযোগ পাব না।
রেস্টোর্যান্ট বন্ধ হবার মুখে। এক মিনিটে কী পাওয়া যাবে? শুনে রেস্টোর্যান্টের মহিলা কর্মী নিজেদের জন্য তৈরি হতে থাকা ফিশ ফ্রাই কড়াই থেকে তুলে কাগজের প্লেটে স্টিলের মোটা কাঁটা সমেত আমাকে দিল। তাড়াহুড়োয় কামড় বসিয়েই চিৎকার করে উঠলাম। মনে হল একটুকরো জ্বলন্ত কয়লায় কামড় দিয়েছি। কামড়েওছি এত জোরে যে মোটা ভারী কাঁটায় জোরে ঠুকে গিয়ে নীচের পাটির দুটো দাঁত গোড়া থেকে আলগা হয়ে গেল। জিভ পুড়ে যাওয়ার জ্বালায় দাঁতের যন্ত্রণা তখনই তেমন টের পেলাম না অবশ্য। তবে ব্যথার চোটে পরের পুরো সপ্তাহটা শুধু তরল খাদ্য খেয়ে থাকতে হয়েছিল। খেতামও খুব সাবধানে, গালের একপাশ দিয়ে গিলে।
এক ইঞ্চি পুরু আগুন-গরম ফিশ ফ্রাই নামিয়ে রেখে দ্রুত নেমে এলাম। ট্রেন তখনও জাহাজে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
কলকাতায় এসে দাঁতের ডাক্তার প্রথমে ভাঙা দাঁতের একটা তুলে ফেলে বাঁধানো দাঁত লাগিয়ে দিলেন। ক’দিন পর আরও একটা। সে-বছরই পৌষ মাসের শেষ দিন গঙ্গাসাগর মেলায় গিয়ে বঙ্গোপসাগরের জলে সেই ভাঙা দাঁত-দুটো যতটা পারি দূরে ছুঁড়ে দিলাম। এভাবেই আমি দূর সমুদ্রকে মনে মনে আমার দাঁত দান করলাম। কথায়ই তো আছে, কিছু পেতে হলে কিছু দিতেও হয়। ট্রেনে যেতে যেতে জাহাজ থেকে চারদিকে নীল আকাশের নীচে সেদিনের সেই নীল সমুদ্র দেখা কি কিছু কম পাওয়া !
অলঙ্করণ– যুধাজিৎ সেনগুপ্ত
“স্বর্ণাক্ষর” থেকে প্রকাশিত ‘চোখে দেখা গল্প বই থেকে নেয়া। লেখক ও প্রকাশকের অনুমতিক্রমে।
বইটি অর্ডার করতে কিংবা স্বর্ণাক্ষর-এর সম্পূর্ণ গ্রন্থতালিকার
যে-কোনো বই কিনতে