বৈজ্ঞানিকের দপ্তর- মহাবিশ্বে মহাকাশে-১১-এর জালে নিল আর্মস্ট্রং -কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎ২০২১

মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে

bigganneilarmstrong

নিল আর্মস্ট্রং কে? উত্তর সবারই জানা, তিনি হলেন একজন মার্কিন মহাকাশচারী, সামরিক পাইলট ও শিক্ষাবিদ। চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মানুষ হিসেবে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর নেতৃত্বে পৃথিবীর মানুষ প্রথমবারের মতো চাঁদের মাটি স্পর্শ করেছিল। ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদের মাটিতে হেঁটে তিনি এক অমর ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। বাবা স্টেফান কনিগ আর্মস্ট্রং ও মা ভায়োলা লুইসার প্রথম সন্তান। জন্ম ১৯৩০ সালের ৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াপাকোনেটা, ওহিওতে। তাঁর আরও দুই ভাই ছিলেন। ১৯৪৯ সালে তিনি কোরিয়ান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং সেখান থেকে ফিরে এসে অ্যারোনটিকস নিয়ে কলেজের পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি মহাকাশচারী  হিসেবে যে সংস্থায় যোগ দেন তারই বর্তমান নাম নাসা। তাঁর প্রথম মহাকাশ অভিযান ছিল ১৯৬৬ সালে। এই অভিযানে তিনি ও ডেভিড স্কট মিলে দুটি ভিন্ন নভোযানকে সর্বপ্রথম মহাকাশে একত্রে যুক্ত করেন।

১৯৬৯ সালে চন্দ্রাভিযানে তিনি অ্যাপোলো ১১-এর মিশন কমান্ডার ছিলেন। এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় মহাকাশ মিশন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স। ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে এডউইন অলড্রিনকে সঙ্গে নিয়ে নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে অবতরণ করেন। সে সময় মাইকেল কলিন্স মূল নভোযানে অবস্থান করছিলেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা চাঁদে অতিবাহিত করার পর আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন মূল নভোযানে কলিন্সের সঙ্গে মিলিত হন এবং তিনজনেই নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন।

চাঁদে যাওয়া থেকে ফিরে আসা তো বটেই, এমনকি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিল আর্মস্ট্রংয়ের জীবনের সঙ্গে সংখ্যা ‘১১’ যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। বলা যায়, ১১ সংখ্যাটি তাঁর জীবনে একটি ম্যাজিক সংখ্যা।

নিল আর্মস্ট্রং পড়াশোনা করেছিলেন অ্যারোনটিকস নিয়ে। ইংরাজিতে এই শব্দটির বানান ‘aeronautics’- ১১টি অক্ষরের (letter) সমাবেশ। এর পরে তিনি কোরিয়ার যুদ্ধে বোমারু বিমান চালানোর জন্য পাইলটের পদে যোগ দেন। তাঁকে যে যুদ্ধবিমানটি চালাতে দেওয়া হয়েছিল সেটার নাম ছিল ‘নেভি প্যান্থার’ (Navy Panther; again 11 letters), এখানেও ১১টি অক্ষরের সমাবেশ। কোরিয়ার যুদ্ধের ১১ বছরের মাথায় অর্থাৎ, ১৯৬১ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মত দেন যে ওই দশকেই তাঁরা চাঁদে মানুষ পাঠাবেন। সেইমতো নাসা যে পরিকল্পনা করে তার নাম ছিল ‘অ্যাপোলো-১১ মিশন’। আর তদানীন্তন প্রেসিডেন্টের নাম ছিল ‘জন কেনেডি’ (John Kennedy; 11 letters)। আরও একটি মজার ঘটনা হল, কেনেডির ‘K’ অক্ষর বা বর্ণটি ইংরাজি বর্ণমালার ১১তম বর্ণ বা অক্ষর। ১৯৬৯ সালে নাসা চাঁদের মাটিতে মানুষ নামানোর আয়োজন সম্পূর্ণ করে। এই সালটি ১১ দ্বারা বিভাজ্য। এই মিশনের জন্য নভোশ্চারীদের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল তাতে ১১জন নভোশ্চারীর নাম ছিল। সেই তালিকা থেকে নিল আর্মস্ট্রংকে চন্দ্রাভিযানের (Moon mission; 11 letters) দলনায়ক (team leader) হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। এই পরিকল্পনায় চন্দ্রযানকে চাঁদের উদ্দেশ্যে পাঠানোর জন্য নাসার বিজ্ঞানীরা যে রকেটটি বেছে নিয়েছিলেন তার নাম ছিল ‘স্যাটার্ন V’ [Saturn V; Saturn-6 letters, V-(5); 6+5=11]। ‘স্যাটার্ন V’কে উৎক্ষেপণ করার পরিকল্পনা ছিল ‘কেপ ক্যানাভেরাল’ (Cape Canaveral) উৎক্ষেপণ-কেন্দ্র থেকে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এই পরিকল্পনার শেষটুকু দেখে যেতে পারেননি। কারণ জন কেনেডি তার আগেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। কেপ ক্যানাভেরালের নাম পালটে রাখা হয় ‘কেপ কেনেডি’ (Cape Kennedy; 11 letters)।

যে রকেটে করে মহাকাশযাত্রীদের চাঁদের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিল, পৃথিবীর অভিকর্ষজ টান অতিক্রম করার জন্য সেটার সর্বোচ্চ বেগ ছিল সেকেন্ডে ১১ কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে চাঁদে যেতে মহাকাশযাত্রীদের মোট পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল ৩,৮০,০০০ কিলোমিটার (৩+৮+০+০+০+০=১১), সেই ১১।

নিল আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে আর যে দুজন মহাকাশযাত্রী চাঁদের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন এডউইন ই. অলড্রিন (Edwin E. Aldrin) এবং মাইকেল কলিন্স (Michael Collins)। অ্যাপোলো-১১ মিশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আবেদনপত্রে এই তিন মহাকাশচারী যে সই করেছিলেন, সেখানেও ম্যাজিক সংখ্যা ১১-এর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এঁরা সই করেছিলেন যথাক্রমে এন. এ. আর্মস্ট্রং (N. A. Armstrong; 11 letters), এডুইন অলড্রিন (Edwin Aldrin; 11 letters) এবং মাইক কলিন্স (Mike Collins; 11 letters) নামে। সবারই সইতে ১১টি করে অক্ষর আছে। এটা একটা কাকতালীয় ব্যাপার। এই মিশনের সঙ্গে তিন নভশ্চর যখন যুক্ত হন তখন নিল আর্মস্ট্রংয়ের বয়স ছিল ৩৮ (৩+৮=১১)। এখানেও ১১ অক্ষরের সমাবেশ। চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রেখেছিলেন আর্মস্ট্রং এবং তারপরে অলড্রিন। কলিন্স ছিলেন মূল মহাকাশযানে, পাইলটের আসনে। প্রথমোক্ত দুই মহাকাশচারী চাঁদের যে অঞ্চলে নেমেছিলেন, সেই অঞ্চলের নাম ছিল ‘ট্র্যাঙ্কুইলিটি’ যার ইংরাজি বানান  ‘TRANQUILITY’। অক্ষর সংখ্যা গুনলে পাওয়া যাবে সেই ‘১১’।

নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে পা রেখেই রেডিও-ওয়েভ মারফত বিশ্ববাসীর উদ্দেশে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন সেটা ছিল “That is one small step for man, one giant leap for mankind.” বাক্যটি পড়ে হয়তো অনেকে ভুরু কোঁচকাবেন। সে সময়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন এই বলে যে ওরকম একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে আর্মস্ট্রং কেন একটি ভুল বাক্য দেশবাসীর উদ্দেশে পাঠালেন? বাক্যটতে ‘man’ না হয়ে ‘a man’ হওয়া উচিত ছিল। কারণ, চাঁদের মাটিতে যে-কোনো মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। প্রথম পায়ের ছাপ পড়েছিল বিশেষ একজন মানুষের, তিনি নিল আর্মস্ট্রং। পৃথিবীতে ফিরে আসার পর তাঁকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন যে তিনি সঠিক বাক্যটিই পাঠিয়েছিলেন। অত দূর থেকে বার্তাটি আসার পথে কোনও গোলমালে পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টারে ‘a’ অক্ষরটি পৌঁছায়নি। যাই হোক, পরবর্তীকালে নাসা বাক্যটি শুদ্ধ করে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে প্রচার করে। ভুল বাক্যটিতে অক্ষর  সংখ্যা ছিল ৪৬। হারিয়ে যাওয়া অক্ষরটি (article ‘a’) যুক্ত হওয়ার পর শুদ্ধ বাক্যটিতে অক্ষর সংখ্যা দাঁড়াল ৪৭। এখন ৪+৭=১১; সেই ম্যাজিক সংখ্যা যা আর্মস্ট্রংকে কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না।

এবার ফিরে আসার পালা। আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন পাটাতন বেয়ে লুনার মডিউল (Lunar Module; 11 letters)-এ ঢুকে পাটাতনটা গুটিয়ে যে মুহূর্তে প্রবেশপথটা বন্ধ করলেন, সেই মুহূর্ত সময়ে পৃথিবীতে হাউসটনে নাসার ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছিল ঠিক দুপুর ১টা বেজে ১১ মিনিট। এবার লুনার মডিউলটি দুই নভোশ্চরকে নিয়ে ছুটে চলল মূল মহাকাশযানের দিকে। মহাকাশযানটি এতক্ষণ কলিন্সকে নিয়ে চাঁদের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মূল যানের সঙ্গে লুনার মডিউলটি যুক্ত হলে আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন মহাকাশযানে প্রবেশ করেন। এবার তিনজনে চাঁদকে টা টা জানিয়ে কলিন্স মহাকাশের মুখ পৃথিবীর দিকে ঘুরিয়ে দিলেন।

এখন শুধু অপেক্ষা। আগে থেকেই ঠিক ছিল তিন নভোশ্চরকে নিয়ে বিশাল ক্যাপসুলটি প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে নেমে আসবে। নির্দিষ্ট উচ্চতায় নভশ্চরেরা যখন ক্যাপসুলের বিশাল প্যারাসুট তিনটি খুলে দিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘড়িতে বেজেছিল দুপুর ১২টা ৪৪ মিনিট। এখানেও সেই ম্যাজিক সংখ্যা ‘১১’। কীভাবে হল? দেখে নেওয়া যাক, ১+২+২+৪=১১।

ক্যাপসুল থেকে নভশ্চরদের উদ্ধার করার জন্য ইউ.এস.এস হরনেট নামে একটি উদ্ধারকারী জাহাজ আগে থেকেই প্রশান্ত মহাসাগরে দাঁড়িয়ে ছিল। মজার ঘটনা হল, জাহাজটি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার ঠিক ১১ নটিকাল মাইল দূরে ক্যাপসুলটি প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে নেমেছিল। চন্দ্রজয়ী নভশ্চরদের সম্মান জানানোর জন্য জাহাজের ক্যাপটেন তিনটে ব্যাজ সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নভশ্চরদের বরণ করে ব্যাজ তিনটি তাঁদের পোশাকে আটকে দেন। প্রত্যেকটি ব্যাজে লেখা ছিল ‘হরনেট প্লাস থ্রি’ (HORNET PLUS THREE)। লেখাটা সামান্য পালটে নিলে দাঁড়ায়, ‘HORNET+THREE’। সেই ম্যাজিক ‘১১’।

নিল আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে সংখ্যা ১১-র এই সম্পর্ককে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? যাঁরা অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন তাঁরা এর মধ্যে অলৌকিক কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করে সহজ একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু যাঁরা বাস্তব চিন্তায় বিশ্বাসী? তাঁরা একে কাকতলীয় ছাড়া আর কিছু বলবেন বলে মনে হয় না। আর যাঁরা গণিতশাস্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তাঁদের কাছে এটা ‘থিওরি অফ প্রোবাবিলিটি’-র একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

নিল আর্মস্ট্রং ছিলেন ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। তাঁর মেধা ছিল প্রখর। শান্ত ও তীক্ষ্ণ ছিল তাঁর চিন্তার পরিধি। চাঁদ অভিযানে যে নভোযানটি পরিচালনা করেছিলেন সেটি যখন পৃথিবীতে নামছিল তখন ধীরে ধীরে তার জ্বালানি শেষ হয়ে আসছিল। তখনও তিনি ঠান্ডা মাথায় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সবকিছু পরিচালনা করেছিলেন।

ইতিহাসখ্যাত এই মানুষটি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট ইহলোক ত্যাগ করেন। সে সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। আর্মস্ট্রংয়ের মৃত্যুতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে উল্লেখ করেন, ‘নিল শুধু নিজের সময়ের জন্য হিরো ছিলেন না, তিনি সবসময়ের জন্যই আমেরিকার হিরো।’ সহকর্মী অলড্রিনের কথায়, ‘চাঁদের মাটিতে আমার বন্ধু নিলের ছোটো পদক্ষেপ মানব ইতিহাসে এক বিরাট লাফ যা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s