গল্প- জানাজানি-প্রান্তিক বিশ্বাস বর্ষা ২০২১

সন্ধ্যা ভট্টাচার্য গল্প প্রতিযোগিতা ২০২০( চতুর্থ স্থান)

golpojanajani. head piece. ton

এক

সেকেলে একটা পেল্লায় কাঠের দরজা। দু-পাল্লার। মানুষ কী যে আজব ছিল, বড়ো বড়ো গাছ কেটে সেই কাঠ দিয়ে হাজারো জিনিস, ঘরবাড়ির আসবাবপত্র বানাত! বাঁচোয়া এই যে, অভির জন্মের দু-বছর আগে একটা গ্লোবাল কনভেনশনে কাঠের ফার্নিচার নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। আস্তে করে দরজার বাঁ-পাল্লাটা ঠেলল অভি। একটু কেমন কেমন লাগছে। ঠিক ভয় নয়, পেটে কেমন যেন একটা গুড়গুড় ভাব। প্রসূনকাকুকে সঙ্গে আনলেই হত। উনি বলেও ছিলেন। আসলে তখন একটু আঁতে লেগেছিল অভির। সবে সতেরো পেরিয়েছে, ডানপিটে না হলেও সাহস তো কম নেই ওর। আর গত একবছরের পরিস্থিতি ওকে আরো সাহসী করে তুলেছে। যা হবে দেখা যাবে। ডানদিকের পাল্লাটা দু-হাতে ধরে অভি মুখটা ভেতরে ঢোকাল। একশো বছরের পুরোনো বাড়ি, বাইরের থেকে ভেতরটা আরো যেন বেশি পুরোনো। এই ঘরটা বেশ অন্ধকার আর স্যাঁতস্যাঁতে, একটা গন্ধ নাকে এল। বায়োলজি ল্যাবের ফর্মালিনের মতন। কিন্তু সে তো ব্যবহার করা হয় কোনো কিছু সংরক্ষণের জন্যে, এই ডেটা সেন্টারে সে গন্ধ কেন আসবে! প্রসূনকাকু বলেছিলেন ইলেকট্রিক সুইচ বোর্ড আছে ঘরে ঢুকে বাঁদিকে। কী অদ্ভুত ব্যাপার, পঞ্চাশ বছর আগেও লোকে সুইচ ব্যবহার করত আলো, পাখা জ্বালাতে নেভাতে! এখনকার মতন মোশন সেন্সর লাইটিং নাকি খুব কম জায়গায় ছিল। শুনেছিল বাবার এক অভিজ্ঞতার কথা। বাবা কলকাতার স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিলেন দাদুর সঙ্গে। দুজনে হোস্টেলের ঘরে যেই পা রেখেছেন, ঘরের সব আলো ওমনি জ্বলে উঠেছে। তারপর দরজা বন্ধ করতেই এসি চালু! গ্রামে এসি তখনো ওরা কমই দেখেছে। প্রায় দশ মিনিট খুঁজেও ওরা ঘরে কোনো সুইচ খুঁজে পায়নি। কিছুক্ষণ পরে বাবার রুম-মেট এসে বুঝিয়েছিলেন কলকাতায় সুইচ শুধু এমার্জেন্সির জন্যে জরুরি জায়গাগুলোতেই থাকে।

অভি ভেতরে ঢুকে একটু হাতড়াতেই বাঁদিকের দেওয়ালে সুইচবোর্ড পেল। এই সুইচ ব্যাপারটা বেশ মজাদার কিন্তু। হালকা চাপ দিতেই খুট করে আওয়াজ, আর অনেকগুলো আলো বিদ্যুৎ চমকানোর মতন জ্বলে উঠল। এখন কিন্তু লাইট, পাখা হালকা থেকে জোরালো হয় কিছুটা সময় নিয়ে, মানুষের শরীরকে সইয়ে নিতে দিয়ে। চোখটা এই হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলোতে সয়ে গেলে অভি দেখতে পেল চারটে সার্ভারের ব্যাঙ্ক ঘরের দু-প্রান্তে জোড়ায় জোড়ায় রাখা। দরজার উল্টোদিকে একটা ছোটো দরজা। ঢুকলেই বাবার পুরোনো অফিস কেবিন। সনাতনপুরের যাবতীয় তথ্য আগে এখানেই স্টোর করা হত; প্রসেস করে পাঠানো হত পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত সরকারের কাছে। আবহাওয়া, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ এই গ্রামের সব তথ্য। বছর খানেক আগেও এই সার্ভারগুলো দিনরাত চলত। তারপর নতুন মিউনিসিপ্যালিটি বিল্ডিংয়ে গড়ে ওঠা ডেটা সেন্টারে সব পুরোনো তথ্য আর্কাইভ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওটা গ্রিন বিল্ডিং, সম্পূর্ণ সোলার পাওয়ারে চলে। এমনকি সার্ভারগুলোও যখন চালু ছিল এই অফিসে, বাবা আর ওঁর প্রিয় তিন রোবট কলিগ থাকতেন এখানে। বট-এ, বট-বি আর বট-সি। বছর দশেক আগে সরকারের রোবটশ্রী প্রকল্পে এই তিনজনকে আনা হয় জুরিখ, সুইজারল্যান্ড থেকে। বাবা নিজেই গিয়েছিলেন ওদের আনতে। আশ্চর্য ব্যাপার, বাবা মারা যাওয়ার দু-দিন পর থেকেই বট-সি গড়বড় করতে শুরু করে। আর একমাসের মধ্যেই পুরো অচল হয়ে যায়। আজই প্রসূনকাকুর কাছ থেকে জেনেছে। প্রসূনকাকু ওদের গ্রামেরই গভর্নেন্স অফিসার, বাবার কলিগ ছাড়াও খুব ভালো বন্ধু। বট-এ, বট-বির সঙ্গে দেখা হল, কথাও হল। দিব্যি হাতজোড় করে নমস্কার করল, বেশ কিছু কথাও বলল। দুজনেই বলল ওর বাবা ড. ঐশিক মুখার্জি ওদের খুবই মনে পড়ে। চলে আসার সময় বলল, অফিস আওয়ার্স শেষ হলে ও যদি কোনোদিন আসে, বাবার গল্প শোনাবে ওরা। অভিও বলল যে ও অবশ্যই আসবে।

এই তিনজনের মধ্যে বাবার সবথেকে প্রিয় ছিল কিন্তু বট-সি। তাই ওর মনে হল, অচল হলেও একবার দেখা করে যাবে বট-সির সঙ্গেও। কিন্তু কাকু বলেছেন, ওকে এখন পুরোনো ডেটা সেন্টারে, ওর বাবার কেবিনে রেখে দেওয়া হয়েছে। গত দশ মাস সেখানেই আছে ও।

বাবার কেবিনের দরজায় কম্বিনেশন লক, অন্যান্য জায়গার মতো বায়োমেট্রিক্স দিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা নয়। কম্বিনেশন জানিয়ে দিয়েছেন কাকু, যদিও সেটা ঠিক করেননি। সরকারি জিনিস, বাতিল হলেও গুরুত্বপূর্ণ। সেই হিসেবে ওকে এখানে একা ঢুকতে দেওয়াও ঠিক হয়নি ওঁর। অভি এসব ভাবনা বন্ধ করে লকে কম্বিনেশন সাজাতে থাকল। তিনটে কম্বিনেশন ঠিকমতো সাজাতেই স্লাইডিং দরজাটা সরে গেল ডানদিকে। এই ঘরের সুইচ বোর্ডও বাঁদিকে। আন্দাজ করে একটু হাতড়াতেই পেয়ে গেল। আলোগুলো জ্বলতেই বোঝা গেল বাবা কেন এখানে বসতে ভালোবাসতেন। ঘরের তিনদিকে তিনটে বিরাট জানালা। কাচের ও-পারেই সনাতনপুরের অপূর্ব সৌন্দর্য। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আদিগন্ত ক্ষেত, এঁকে-বেঁকে বয়ে চলা সনাতনী নদী। এই ঘরটা পরে তৈরি, তাই সবদিক থেকেই আলাদা। বাবাও এরকম ছিলেন, অন্যদের সঙ্গে থেকেও অন্যরকম। কিন্তু বট-সি কোথায়?

পেছন ফিরল অভি। যে দরজা দিয়ে এই ঘরে ঢুকেছিল, তার একপাশে সুইচ বোর্ড আর রোবটদের মেন্টেন্যান্স প্যানেল, অন্য পাশে তিনটে কাচের আলমারি। দুটো ফাঁকা। তৃতীয়টাতে সোজা দাঁড়িয়ে বট-সি! ওর মুখটা বট-এ বা বট-বির মতো হাসিখুশি নয়, একটু গোমড়া মুখো। বট-সি প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট, গায়ের রঙ ফর্সা, মাথায় সোনালি চুল, সিক্স প্যাক না হলেও বেশ ছিমছাম—সব মিলিয়ে বেশ হ্যান্ডসাম একটা রোবট। বয়স বছর দশেক বলে ডিজাইন একটু সেকেলে; এখনকার রোবটগুলো আরো বেশি মানুষ মানুষ দেখতে, গায়ের চামড়া থেকে মাথার চুল সবই যেন জীবন্ত।

দুই

“কী রে, আর একটু ভাত দিই?” অভির পিসি হাতায় ভাত তুলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে।

“না, না। খিদে নেই তেমন…”

“বলিস কী? ওই গোদাটাকে কোলে করে আনলি সেই মিউনিসিপ্যালিটি অফিস থেকে, আর বলছিস খিদে পায়নি!”

“গোদা কোথায়? আমার থেকে একটু বেঁটে।” অভি হেসে ফেলল।

“তা হোক, আনতে তো খাটনি হল!”

“কোনো খাটনি হয়নি। ওকে একাই নামিয়ে বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারে বসালাম। অ্যালুমিনিয়াম, টিন, কার্বন আর একটু টাইটানিয়াম, এদের কোনোটারই ওজন বেশি হয় না।“

“এতটা পথ যে সাইকেল চালিয়ে এলি!”

“তুমিও যেমন। সোলার মোড-এ আমার কাজ শুধু হ্যান্ডেল ধরা, এছাড়া আর কী পরিশ্রম! একটু চাটনি দাও।”

“আর একটু ভাত নে। সকালে তো কিছুই খেলি না তাড়াহুড়োয়।”

“খেলাম তো প্ল্যাঙ্কটন লস্যি।”

“ওই খেলে কি আর পেট ভরে রে?”

“দিব্যি ভরে। বাবা তো রোজ ব্রেকফাস্টে ওটা খেয়েই অফিস যেতেন। মা বেরোতেন আরো সকালে, এত এলাহি ব্রেকফাস্ট আমরা করতামই না। তাছাড়া…” অভির মুখটা যেন হঠাৎ যন্ত্রণায় একটু কুঁকড়ে গেল।

“কী হল রে? বিষম খেলি নাকি?”

অভি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।

“একটু জল খা। কে যে আবার স্মরণ করছে তোকে!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শ্রীতমা। “যারা করার তারা দুজনেই তো একসঙ্গে ওপরে চলে গেল…”

অভি বাকি খাওয়া শেষ করে এল উঠে এল দোতলায়, নিজের ঘরে।

“এ কী!”

বট-সি দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে। ওর হাতে বাবার ইলেকট্রনিক ডায়েরিটা। মাথা তুলে দেখছে পুকুরের ওপর উড়ন্ত ড্রোনটাকে। অভিদের প্রতিবেশী ইন্দ্রজিৎকাকুরা পুকুরের মাছেদের রোজ সকালে মনিটর করেন ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে, ড্রোনই খাবার ছড়ায় একটু একটু করে সারাদিন। বট-সি অভির গলার আওয়াজে পেছনে ফিরল। কে বলবে এ নাকি গত দশ মাস অচল পড়ে ছিল? অভি নীচে যাওয়ার আগে ওকে চার্জে বসিয়ে গেছিল, পাওয়ার অন করে।

“কী হল?”

“তুমি নাকি এতদিন পুরো অচল ছিলে!”

“ছিলাম। এখন আবার কাজ করছি।”

“মানে?”

“মানেটা পরে বলব। তুমি আগে চান করে এস। সকাল থেকে চান হয়নি তোমার।”

“বাবার ডায়েরিতে কী দেখছ? পাসওয়ার্ড জানো না তো!”

“ওপেন সেকশনগুলো দেখছি। আচ্ছা, আমি এখানে কতদিন থাকব?”

“প্রসূনকাকু সেরকম তো কিছু বলেননি।”

“আচ্ছা, আমার কথা বেশি কাউকে বোলো না। শ্রীতমা ম্যাডামের মনে হয় একটু পেট-পাতলা। ওঁর হাঁটুতে ব্যথার জন্যে যদিও এখানে দোতলায় আসবেন না, তবু ওঁকে বেশি কিছু বলার দরকার নেই।”

“ঠিক আছে। আমি আসছি চান করে।”

অভি বাড়িতে পরার জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমের দিকে এগোতে বট-সি বলল, “সরি অভি, তখন আমার জন্যে তোমাকে বিষম খেতে হল।”

অভি এবার রীতিমতো অবাক, “তুমি শুনলে কী করে?”

“আমি তো ফোকাস করলে তিনশো মিটার দূরে পুকুরপাড়ের ব্যাঙটারও হার্টবিট শুনতে পাই। ইনফ্রাসনিক থেকে আলট্রাসনিক, আমার হিয়ারিং রাডারে সব ধরা পড়ে। ভালো কথা, তোমার ডিওডোরেন্টটা নিচ্ছি। গা দিয়ে ফর্মালিনের গন্ধ বেরোচ্ছে।”

“হ্যাঁ, আমিও পেয়েছি পুরোনো ডেটা সেন্টারে। কিন্তু ফর্মালিন কেন?”

“কিছুই বোঝো না দেখছি! ফর্মালিন না দিলে দশ মাসে পোকামাকড়রা আমার শরীরের যা দশা করত…”

তিন

শাওয়ার কিউবিকলে দাঁড়িয়ে হালকা গরম জলের প্রথম ঝাপটাটা মুখে লাগতেই অভির মনে এল দশ মাস আগের সেই দিনটা। বাবা আর মায়ের শরীরগুলো ইলেকট্রিক ফার্নেসে ঢোকানোর পরে ও বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন বৃষ্টি নামল। ছাঁটটা ঠিক এরকম, হালকা গরম!

অ্যাকসিডেন্ট! কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অভিনব মুখার্জির দু-দুটো অবলম্বন চলে গেল। মা হাইওয়েতেই, বাবাকে তবু হাসপাতালে আনা গিয়েছিল।

শনিবার, দুপুর গড়িয়ে সবে বিকেল। অভি তখন ফটোগ্রাফি ক্লাবে। পরদিন একটা এগজিবিশনের জন্যে অন্য মেম্বারদের সঙ্গে তার ব্যবস্থা করছে। ওর রিস্ট-ব্যান্ডে কল এল পুলিশ থানা থেকে। হাসপাতালে পৌঁছে দেখল বাবাকে ট্রলিতে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে। মাকেও ট্রলিতে রাখা, সাদা চাদরে পুরো শরীরটা ঢাকা, রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে মেঝেতে। অভি যখন চাদরটা সরিয়ে মায়ের মুখটা দেখছে, তখনই ডাক্তার ওকে ডাকলেন। বাবার কেবিনে যেতে বললেন। অবস্থা ভালো নয়। বাবা কিছু একটা বলতে চান ওকে। ভেতরে গিয়ে দেখল বাবার মুখে অক্সিজেন মাস্ক, চোখ দুটো বোজা। শ্বাস চলছে, খুব জোরে। ইনজুরি হয়েছে বুকে, পেটে, পিঠে, মাথায়। অভি নিজের দুটো হাত বাবার চিৎ হয়ে থাকা ডানহাতের তালুতে রাখল। বাবার চোখ দুটো অল্প একটু খুলল। উজ্জ্বল, অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত। যে চোখ দেখে ও বড়ো হয়েছে সে-দুটো এখন বড়োই ক্লান্ত। হাতের ইশারায় বললেন মুখের অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিতে। ডাক্তার দু-পাশে ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানাতে চোখ দুটো আবার বন্ধ হয়ে গেল। চোখের কোণে জল ভেসে উঠল।

অভি বাবার ডানহাতে হাত বোলাতে লাগল। ডাক্তারের কথামত নার্স একটা ওষুধ আনতে বাইরে গেলে হঠাৎ বাবা ওর বাঁহাতটা চেপে ধরলেন। ও বাবার মুখে তাকিয়ে দেখল, চোখেমুখে একটা অত্যন্ত যন্ত্রণার ছাপ। অভির মনে হল কেউ যেন ওর মনের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে! কাতরভাবে বলছে, দরজাটা খোল। অভি খুলে দিল।

“বাবা, কিছু বলবে?”

“ভালো থাকিস অভি। যা চলে যায়, তা নিয়ে মনখারাপ করতে নেই। সামনের দিকে দেখতে হয় সব সময়।”

“তুমি চলে যেও না!”

“যাওয়ার সময় এলে তো যেতেই হবে।”

তরঙ্গহীন কয়েকটা মুহূর্ত। বাবার মুখটা বিকৃত হয়ে উঠছে ভয়ঙ্করভাবে…

“অভি, চললাম রে। আমপাতা জোড়া জোড়া, মারব চাবুক চলবে ঘোড়া…”

তরঙ্গটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে অসীম শূন্যতায় মিশে গেল। বাবার মুখটা শান্ত হয়ে গেল। হাতের মুঠিটা শিথিল।

***

স্নান সেরে ঘরে ফিরে অভি দেখল বট-সি তখনো মন দিয়ে বাবার ইলেকট্রনিক ডায়েরি দেখছে।

“তোমার কী করার ইচ্ছে অভি?”

“ফটোগ্রাফি।”

“বেশ।”

“বট-সি, একটা কথা বলবে?”

“বাবা-মা চলে যাওয়ার পর তুমি অচল হয়ে গেছিলে কিছুদিনের মধ্যে। কী হয়েছিল?”

“মনটা খুব খারাপ হয়েছিল অভি। খুউউব…”

“রোবটের মনখারাপ!” অভি মুচকি হাসল।

“তুমি তো জান না, ইন ফ্যাক্ট কেউই জানে না যে ড. মুখার্জি আমার প্রসেসরে বিশেষ একটা থিঙ্কিং মডিউল ইন্টিগ্রেট করেছিলেন দু-বছর আগে।”

“তুমি তো এমনিতেই চিন্তা করতে পার, তাহলে আবার আলাদা মডিউল কেন?”

“আমাদের রোবটদের তো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। কিছু জিনিস শেখালে সেটা আমরা শিখে নিতে পারি, কিন্তু নিজে থেকে কিছু ভাবতে পারি না। যেটা তোমরা মানুষরা, এমনকি আরো অনেক প্রাণীই পারে। তোমার বাবা ‘ফাজি লজিক’ দিয়ে আমার এই মডিউলটা তৈরি করেছিলেন। এর সাহায্যে যাতে আমি তোমাদের মতো স্বাধীনভাবে কিছু একটা নিয়ে ভাবতে পারি। যদিও সেটা তোমাদের ক্ষমতার মাত্র সিকি শতাংশ। আমিই ওঁর প্রথম প্রুফ অফ কনসেপ্ট।”

“আর একটু বুঝিয়ে বলবে?”

“যেমন ধরো তুমি হয়তো এখন ভাবছিলে একটা ছবি কীভাবে তুলবে। তোমাকে কেউ বলে দেয়নি ছবির কথা এই মুহূর্তে ভাবতে। তারপরেই হয়তো ভাবলে থিঙ্কিং মডিউলের সঙ্গে বট-সির অচল হবার সম্পর্ক কী, সেটাও কেউ বলে দেয়নি ভাবতে।”

“হঠাৎ ব্রেক-ডাউন হবার ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না, সত্যিই। মনখারাপের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?”

“তোমার বাবা-মা চলে যাওয়ার পর তুমি কতদিন ঠিক করে খাওনি? কতদিন কলেজে যাওনি?”

“প্রায় একমাস।”

“হুম। আমারও ওইরকম হয়েছিল। বট-এ বা বট-বিকে সেটা বোঝাতে পারছিলাম না। ল্যাবের কোনো অফিসার বা কর্মচারীকেও না, কারণ তোমার বাবার এটা সিক্রেট রিসার্চ ছিল। ড. পর্ণা মুখার্জি, মানে তোমার মা ছাড়া অন্য কেউ জানতেন না। তোমার বাবা ছ’টা বাজলে বট-এ আর বট-বির সুইচ অফ করে দিতেন। শুধু আমাকে চালু রাখতেন। অনেক কিছু শেখাতেন, বোঝাতেন, আমার নতুন মডিউলটা টেস্ট করতেন নানাভাবে।”

“ও, এবার বুঝতে পারছি বাবা কেন শেষদিকে বেশ দেরি করে বাড়ি ফিরতেন।”

“হ্যাঁ, তোমার মাও আসতেন মাঝে মাঝে। তোমার মা একটা জিনিস শিখিয়েছিলেন আমাকে। ওঁরা চলে যাওয়ার পরে সেটাই করলাম।”

“অভিনয়!”

বট-সি এবার হাসল হো হো করে। ঠিক মানুষদের মতন।

“বলো কী! জানি, মায়ের থিয়েটারের শখ ছিল, তাই বলে তোমাকে অভিনয় শেখানো…”

“ওই টুকটাক আরকি! সেটাও তোমার বাবার আইডিয়া। টেস্ট করে দেখতেন আমি কতটা মানুষের মতো হতে পারছি। মানে কতটা মিথ্যে বলতে পারছি বা অভিনয় করতে পারছি। ওঁরা চলে গেলে আমি অভিনয় শুরু করলাম, প্রসেসিং স্পিড কমিয়ে দিলাম, তারপর একেবারে বন্ধ করে দিলাম। তাতেই লোকজন ভাবল আমার আয়ু শেষ। অনেক ইনস্পেকশন করেও কেউ কিছুই ধরতে পারল না। তাই পাওয়ার অফ করে আলমারিতে তুলে দিল। আমি প্রায় আট মাস কমপ্লিট রেস্ট পেলাম।”

অভি আর বট-সি এবার দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠল।

চার

আজ ছুটির দিনে সকালে উঠতে দেরি হয়েছে অভির। জানালায় গিয়ে দেখল একটা ড্রাইভারলেস গাড়ি হুশ করে চলে গেল। বাবা কয়েকটা ব্যাপারে খুব সেকেলে ছিলেন। মা বার বার বলতেন ড্রাইভারলেস গাড়ি কিনতে। তাতে ঝামেলাও কম আর রাস্তায় যেতে যেতে অন্য কোনো কাজও করা যায়, আরামে সিনেমা দেখা বা গান শোনা। আসলে বাবা ড্রাইভ করতে খুব ভালোবাসতেন। কলকাতা এখান থেকে ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ। ওখানে যেতে হলে বাবা খুব খুশি হতেন। কলকাতায় মায়ের কোনো কাজ থাকলে ড্রাইভ করার নেশায় বাবাই ড্রাইভার সাজতেন। সেদিনও একটা ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন মাকে সঙ্গে নিয়ে। কী করে যে ওরকম ভয়ানক একটা অ্যাকসিডেন্ট করে বসলেন!

ব্রাশ করতে করতে ও বট-সির পাওয়ার অন করে দিল।

“গুড মর্নিং অভিনব!”

“অভিই তো ভালো ছিল।”

“অভিনব নামটাই একজন সায়েন্টিস্টের ছেলেকে বেশি মানায়—ওটার মধ্যে কল্পনা, নতুন ভাবনা, অনেক কিছু আছে। আচ্ছা, অভি নামটার তো মনে হয় দু’রকম মানে আছে, তাই না?”

“আমি যতদূর জানি, একটা মানে হল নির্ভীক। তবে বানানটা একটু আলাদা।”

“ঠিক, তবে আরো একটা মানে আছে—ন্যায় বিচার যে করতে পারে।”

“তুমি তো বাংলা ডিকশনারি গুলে খেয়েছ দেখছি!”

“এই একই শব্দের আলাদা আলাদা মানে, এটা আগে ঠিক বুঝতাম না। এখন কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে। জানো কি, তোমার বাবা শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন!”

“ঠিক বলেছ। তুমিও কিন্তু বাবাকে খুব ভালোবাসতে।”

“তোমার বাবা-মা অসাধারণ একটা বিষয় নিয়ে কাজ করছিলেন।”

“এই তো বললে, তোমার মধ্যে ফাজি লজিকের থিঙ্কিং মডিউল ঢোকানো আছে।”

“হুম, সেটা ওঁদের কাজের একটা ছোট্ট অংশ। ওঁদের পুরো সিক্রেট প্রজেক্টের নাম কী ছিল জানো? ‘জানাজানি’।”

“এটা ওঁদের সিক্রেট প্রজেক্টের নাম—কী যা তা বকছ তুমি!”

“তুমি প্রজেক্ট ডকুমেন্টগুলো একটু ঘাঁটলেই পাবে। তবে সেটা আবার বেশি লোক-জানাজানি কোরো না যেন।”

“বাবা কিন্তু কিছু লুকিয়ে করার পক্ষপাতী ছিল না।”

“তা তো জানি, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তোমাদের মানুষদের কিছু ভালো আবিষ্কার বদ লোকেদের হাতে আগে চলে গিয়েই যত গোলমাল বাধায়।”

“হুম।”

“সাবধানে থাকবে অভি। আচ্ছা, একটু খেয়াল করে বলো তো, ঘর থেকে কিছু জিনিস এদিক-ওদিক হয়নি তো এই ক’মাসে?”

অভি একটু ভাবল। তারপর বলল, “কয়েকমাস আগে, একদিন রাতে একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছিল। মনে হল স্টাডি-রুম থেকে কিছু একটা আওয়াজ আসছে। উঠে গিয়ে কাউকে দেখতে পাইনি। পিসির কথায় তারপর থেকে ওই ঘরের দরজায় দুটো তালা দিই।”

“ভালোই করেছ। ভবিষ্যতে মেশিন উইজডম নিয়ে পড়লে বাবা-মায়ের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতে।”

“তুমি বলছ ওই ‘জানাজানি’ ব্যাপারটা? দেখো, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং এগুলো তো স্কুলেই পড়েছি। যেহেতু সায়েন্স নিয়ে পড়ি, এখন ডিপ লার্নিংও একটা সাবজেক্ট। কিন্তু কোনোদিন পরের লেভেল, মানে মেশিন উইজডম নিয়ে পড়াশুনা করব বলে ভাবিনি। বড়ো খটোমটো। তাছাড়া আমার একটু ন্যাচরাল জিনিসই বেশি ভালো লাগে।”

“নিশ্চয়ই জানো যে তোমার বাবা প্রকৃতিপ্রেমিকও ছিলেন?”

“ঠিক বলেছ। বাবা-মায়ের কাজ নিয়ে কী যেন বলছিলে?”

“হুম, বোসো দেখি। মন দিয়ে শুনবে।”

অভি বাধ্য ছেলে হয়ে বট-সির সামনে একটা চেয়ার টেনে বসল।

“দেখো, এখনকার মেশিনগুলো – সে তোমার রোবট থেকে শুরু করে গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, ড্রোন, রিস্ট ব্যান্ড, কম্পিউটার সবই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারে।”

“হ্যাঁ, ইন্টারনেট অফ থিংস।”

“এইবার একইভাবে যদি পৃথিবীর সব মানুষ নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারত?”

“সে তো আজ থেকে দুশো বছর আগে ফোন আবিষ্কার করার পর থেকেই পারে!”

“ধুর! আমি মুখের কথা নয়, মনের কথা বোঝাচ্ছি। তোমাদের মানুষদের মুখের আর মনের কথায় আকাশ-পাতাল দূরত্ব।”

“তাহলে তুমি কি টেলিপ্যাথির কথা বলতে চাইছ?”

“ঠিক ধরেছ।”

“কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব!”

“সবই সম্ভব। এই যে তুমি বিষম খেলে একটু আগে আমার জন্যে।”

“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”

“না হবারই কথা। ধরে নাও তোমার রিস্ট ব্যান্ড তোমার ফ্রিজের টেম্পারেচার দেখে কুলিং বন্ধ করতে বলছে, ফ্রিজের ব্লুটুথ যদি অফ থাকে তাহলে সেটা কি সম্ভব? যে-কোনো কমিউনিকেশনে প্রথমে একটা রিকোয়েস্ট পাঠাতে হয়। অন্যজন সেটা অ্যাকসেপ্ট করলে পেয়ারিং করতে হয়, তারপরেই মিউচুয়াল কমিউনিকেশন সম্ভব। তুমি যখন খাচ্ছিলে, আমি তোমাকে রিকোয়েস্ট পাঠালাম। তুমি সেটা বুঝতে পারোনি বলেই কমিউনিকেশন ফেল করল।”

“আচ্ছা, ইন্টারেস্টিং কনসেপ্ট। এর সঙ্গে তোমার থিঙ্কিং মডিউলের কী সম্পর্ক?”

“মানুষের মন অত্যন্ত জটিল বলে ড. মুখার্জি প্রথমে ঠিক করেন গোড়াতেই মেশিনের সঙ্গে এরকম থট-এক্সচেঞ্জ বা মন-জানাজানি করে দেখবেন।”

“হয়েছিল সেটা?”

“হ্যাঁ। যেমন, উনি আমার কথা ভাবলেই আমি ‘ইয়েস স্যর’ বলতাম। শেষের দিকে ওঁর মনের ছোটোখাটো চিন্তাও আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম। এরপর তোমার বাবা-মা নিজেদের মধ্যে এটা চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু যতদূর জানি সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।”

“এইবার বুঝলাম খুব সকালে সূর্য ওঠার আগে কেন দুজনে ছাদে গিয়ে ধ্যান করতেন!”

অভি থামল। বাইরের নীল আকাশে একটা জেট প্লেন সাদা ধোঁয়ার রেখা বানিয়ে দূরে মিলিয়ে গেল। ওর দু-চোখ থেকে টপটপ করে জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। বট-সি ভুরু কুঁচকে বলল, “অভি, তুমি কাঁদছ? আমি কি তোমার মনে কোনো আঘাত করলাম?”

“না, না। আমি ভাবছি বাবার সঙ্গে শেষ কয়েকটা মিনিট। এখন তাহলে বুঝতে পারছি, কথা বলার উপায় ছিল না বলেই বাবা আমাকে ওরকম ছড়া কেটে জানিয়েছিলেন।”

“যদি কিছু মনে না করো, আমাকে সেটা একটু বলবে?”

অভি হাসপাতালে শেষের মুহূর্তগুলোর কথা সব বলার পর বট-সি চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর বলল, “তার মানে উনি তোমার সঙ্গেও কানেক্ট করতে পেরেছিলেন। ইশ, আরো কয়েকটা দিন ওঁকে পেলে…”

“কী করে যে অ্যাকসিডেন্টটা হল! বাবাদের গাড়ি অন্য লেনে গিয়ে উলটোদিক থেকে আসা একটা ট্রাকে ধাক্কা মারে!”

“তোমার কী মনে হয়?”

“কীসের কী মনে হয়?”

“এটা কি অ্যাকসিডেন্টই ছিল?”

“কী বলতে চাইছ তুমি!”

“ড. মুখার্জীর শেষ সেনটেন্সটার মানে কী?”

“ওটা ছোটোদের ছড়া। অনেক পুরোনো। আমি পিসিকে জিজ্ঞেস করেছি। ওটার কোনো মানে নেই।”

“তুমি কি জানো, তোমার বাবা ওই সেমিনারে যাওয়ার মাস দুয়েক আগে একটা মেসেজ পেয়েছিলেন? যাতে ঠিক এই লাইনটাই লেখা ছিল, বাংলায়।”

“তাই! কে পাঠিয়েছিল?”

“কোনো এক আননোন নম্বর থেকে এসেছিল। উনি পাত্তা দেননি। সেমিনারে ওঁর ওই টক দেওয়ার ব্যাপারটা ফাইনাল হওয়ার পর ওই মেসেজটাই ঘন ঘন দু-বার আসে। শেষবারে ওই লাইনটার সঙ্গে একটা খুব রাগী মুখের ইমোজি দেওয়া ছিল।”

“তুমি এতসব কী করে জানলে?”

“তোমার মা সন্ধেবেলায় এলে এসব নিয়ে আলোচনা হত। শেষ মেসেজটা আমাকে দেখিয়েছিলেন। যদি আমি কিছু মানে উদ্ধার করতে পারি।”

“তুমি কি মানে বের করতে পেরেছিলে?”

“তখন পারিনি। এখন মনে হচ্ছে পারছি।”

“কী?”

“ওটা সম্ভবত একটা হুমকি।”

“বাবাকে কে হুমকি দেবে?”

“কেন, যারা অ্যাকসিডেন্টটা ঘটাল বা সাজাল।”

“কিছুই মাথায় ঢুকছে না!”

“তোমার বাবা এই চাকরির আগে কলেজে পড়াতেন। ওঁর ইনিশিয়ালস ছিল এ.এম। খুব পপুলার ছিলেন, স্টুডেন্টরা ওটাকেই ‘আম’ বলত।”

“হুম। মায়ের নামের মানে ছিল পাতা। তাই ‘আম পাতা জোড়া জোড়া…’”

“বন্দুকের ট্রিগারকে আগে কী বলত জানো?”

“কী?”

“ঘোড়া। অবাক হব না যদি ওঁদের গাড়ির টায়ারে কেউ গুলি চালিয়ে থাকে।”

“এসব তোমার অলীক কল্পনা বট-সি!”

“কে জানে! আমার যা মনে হল বললাম। অ্যাকসিডেন্টটার কোনো তদন্ত হয়নি পরে?”

“ওটাকে তো রোড অ্যাকসিডেন্ট বলেই ধরা হয়েছিল। সি.সি.টি.ভি ছিল অনেকটা দূরে। ফুটেজে দেখা যাচ্ছিল বাবাদের গাড়ি হঠাৎই উলটো লেনে চলে গেছিল, ওদিক থেকে একটা ট্রাক…” অভির গলাটা ধরে এল।

“হুম। কেসটা রি-ওপেন করার একটা অ্যাপিল তো এখনো করতে পারো পুলিশে।”

“অবশ্যই করব। থ্যাঙ্ক ইউ বট-সি। বুঝতে পারছি বাবার তৈরি তোমার থিঙ্কিং মডিউল কিন্তু খুব ভালো কাজ করছে। তুমি এখন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছ।”

বট-সি মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “তাই তো!”

golpojanajani. tail piece. upa

অলঙ্করণ- তন্ময়, উপাসনা (টিম বোম্বাগড়)

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s