দিগের বিশ্ব যেদিন পালটে গিয়েছিল, সেটাও কিন্তু অন্য দিনগুলোরই মতো শুরু হয়েছিল।
রোজকার মতোই কান ফাটানো অ্যালার্মে ঘুম ভাঙল। ঘরের আলো জ্বলে উঠল। বাঙ্কের স্ট্র্যাপটা খুলে উঠে বসল দিগ, খেয়াল রেখে, যাতে মাথাটা বাঙ্কের ছাদে না ঠুকে যায়। সাবধানে মেঝেতে পা রাখল। তারপর বাঙ্কটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না ব্যালেন্স ঠিক হয়। তলায় চুম্বক লাগানো জুতোটা পরে নিল। এখন জিমে যাওয়ার সময়। এই একটা ব্যাপারে, নেহাত অসুস্থ না হলে, কোনোদিন কামাই করা চলে না, প্রতিদিন অন্তত একঘণ্টা ব্যায়াম না করলে হাড় দুর্বল হয়ে যাবে। হ্যান্ডরেল ধরে ধরে দরজা দিয়ে বেরোবার সময় খেয়াল করে দিগকে মাথা নামাতে হল। কলোনির মধ্যে ওই সবচেয়ে লম্বা, এই ঘরের প্রায় ছাদ ছুঁইছুঁই ওর মাথা। শীগগিরই হয় ঘর পালটাতে হবে, না হয় এ-আইকে বলতে হবে রুম রি-ডিজাইন করার জন্য।
জিম থেকে বেরিয়ে খাওয়ার ঘরে। খাওয়ার ব্যাপারে কারোরই অবশ্য কোনো উৎসাহ থাকে না। হাইড্রোপোনিক ফার্মে একমাত্র ছোটো বাচ্চারা ছাড়া সকলকেই সপ্তাহে তিনদিন কাজ করতে হয়, সেখান থেকেই সমস্ত খাবার আসে। একে খুব বেশি রকমের গাছ নেই, তার উপর কোনো মশলা জাতীয় গাছকেই মাটি ছাড়া বাঁচানো যায়নি। তাই সমস্ত খাবারের প্রায় একইরকম স্বাদ।
আজ দিগদের গ্রুপের স্কুল আছে, তাই ব্রেকফাস্টের পর স্কুল-ঘরে বন্ধুরা সবাই গিয়ে জড়ো হল। চারজনই নিজেদের জায়গায় বসে পড়লে ডেস্কের স্ক্রিনগুলো চালু হয়ে গেল। দিগের ক্লাসে মন বসছিল না। ক্লাস শুরুর আগে এ-আই দিগকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে আজ ক্লাসের পরে ওর জীবনে প্রথমবার বৈবস্বতের কন্ট্রোল সেন্টারে যাওয়ার কথা। সেটাই এই কলোনির প্রাণকেন্দ্র। ওর বেশ উত্তেজনা লাগছিল। ক্লাসগুলো শেষ হতেই চাইছিল না।
অবশেষে শেষ ক্লাসটার সময় এল। স্ক্রিনে লেখা ফুটে উঠল, ‘বৈবস্বত কলোনি-শিপের ইতিহাস সম্পর্কে আজকের ক্লাস। পুরোনো পড়া আমরা আজ ঝালিয়ে নেব।’ দিগ ক্লাসে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে দেখল, বাকিদের কারোরই মন স্ক্রিনের দিকে নেই। নেহাত এ-আই নজর রাখছে, ডেস্ক ছেড়ে উঠলেই প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠাবেন, তাই কেউ নড়ছে না। আগেও কয়েকবার এই ক্লাসটা হয়েছে, দিগের প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। মনিটরে প্রথমেই আসে পৃথিবীর ছবি। দু-হাজার পঞ্চাশ সাল নাগাদ পৃথিবী বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। বহু দেশের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র ছিল, তারা সে-সব ব্যবহার করার জন্যও মুখিয়ে ছিল। একবার যুদ্ধ শুরু হলে পৃথিবীতে আর কোনো মানুষ বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, এ-কথা বুঝতে পেরে সে-সময় কিছু মানুষ ঠিক করেন, যেভাবেই হোক সভ্যতার একটা অংশকে অন্তত বাঁচাতেই হবে। তাঁরাই পরিকল্পনা করেন এই বৈবস্বত কলোনি-শিপের।
পরিকল্পনা করা সহজ কথা, কিন্তু তাকে কাজে পরিণত করা অবশ্য তত সহজ হয়নি। পৃথিবীতে তখন খুবই অস্থির অবস্থা চলছে। একদল লোক মনে করেছিল যে বৈবস্বতের মতো কলোনি তৈরি করাটা নেহাতই আকাশকুসুম কল্পনা। এর জন্য অনেক সম্পদ ও অর্থ খরচ হবে, সেগুলো মানুষের সেই দুর্দশার সময়ে অন্য অনেক বেশি প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা যেত। কিছু লোক ভেবেছিল যে বৈবস্বতের উদ্দেশ্য বলে যা বলা হচ্ছে, সেটা আসলে একটা ধাপ্পা—এর আড়ালে মহাকাশে অস্ত্র মোতায়েন করা হবে। আরো নানা আপত্তি উঠেছিল। এই সমস্ত বাধা অতিক্রম করে বৈবস্বত তৈরি করতে হয়েছিল। তাই বাকি পৃথিবীর সঙ্গে কলোনির সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। বৈবস্বত রওনা হওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। তাতে সমস্ত মানব সভ্যতা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে সে-সবই দিগদের কাছে প্রাচীন ইতিহাস।
দেখতে দেখতে অন্যমনস্কভাবে দিগ চেয়ারের সঙ্গে লাগানো সিট বেল্টটা খুলে ফেলেছিল। ক্লাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়াতে গিয়ে আর একটু হলে কার্পেট থেকে দুটো পা একসঙ্গে উঠে যাচ্ছিল, পিছন থেকে ওর বন্ধু সেলিয়া ওর হাত ধরে টেনে হ্যান্ডরেলটা ধরিয়ে দিল।
“কী হল?”
“কিছু না। খালি এই ক্লাসটা যতবার হয়, ততবার আমার একটা কথা জানতে ইচ্ছা করে। সত্যিই কি আমরা এই কলোনি ছাড়া অন্য কোথাও মানুষ এখন আর বেঁচে নেই?”
“শুনলি তো, পৃথিবীর যা অবস্থা, তাতে আমরা ছাড়া আর কারো বেঁচে থাকা সম্ভব? থাকলে কি আর রেডিওতে যোগাযোগ করত না? এত বছর চলে গেল।” সেলিয়া নিশ্চিতভাবে বলে।
ঠিকই বলেছে সেলিয়া, দিগ ভাবে। সত্যিই তো এতদিন কোনো রেডিও বার্তা আসেনি। কলোনির বাইরে কোনো মানুষ বেঁচে থাকলে সে নিশ্চয় এতদিনে একবার খবর পাঠাত।
“তুই তো আজ প্রথম কন্ট্রোল সেন্টারে যাবি?” সেলিয়া জিজ্ঞাসা করে।
“হ্যাঁ, যাবি আমার সঙ্গে?”
“না, আমার কাজ আছে। তা ছাড়া গেলে দেখবি কন্ট্রোল সেন্টার খুব বোরিং জায়গা, কিছুই করার নেই। ঠিক আছে, পরে দেখা হবে।”
আঠারো বছর বয়স হলেই সবাইকে মাসে একদিন কন্ট্রোল সেন্টারে ডিউটি দিতে হয়। তার তিন বছর আগে থেকে সকলকেই সেন্টারে গিয়ে সমস্ত দেখেশুনে নিতে হয়। বছর মানে অবশ্য পৃথিবীর হিসাব, বৈবস্বতে দিন-মাস-বছরের হিসাব পৃথিবীর হিসাবেই করা হয়। যেমন দিন এখনো চব্বিশ ঘণ্টার, সেই অনুযায়ী আলো বাড়িয়ে কমিয়ে দিন রাত্রি তৈরি করা হয়। দিগ আজই প্রথম কন্ট্রোল সেন্টারে ঢুকবে।
বৈবস্বত খুব বড়ো নয়, একটা সিলিন্ডার, লম্বায় চার কিলোমিটার আর দু-কিলোমিটার চওড়া। যেতে বেশি সময় লাগল না।
“এসো দিগ, আমি তোমাকে আজ সমস্ত কিছু ঘুরে ঘুরে দেখাব।” দরজায় যে রোবট দিগকে স্বাগত জানাল, তার চেহারাটা অনেকটা মানুষেরই মতো। উচ্চতায় দিগের থেকে ছোটো। তবে রোবট কেমন দেখতে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। সবাই জানে যে রোবট যেমনই হোক না কেন, আসলে তার মধ্যে রয়েছে এ-আই।
বৈবস্বতের বাসিন্দাদের কাছে এ-আই অন্য যে-কোনো মানুষের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তারা সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে তারই উপর। বৈবস্বতের এ-আই হল মানুষের তৈরি সবচেয়ে উন্নত আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স; টুরিং টেস্ট আর কোনো যন্ত্র পাস করতে পারেনি। কোয়ান্টাম কম্পিউটেশনের উন্নতির সুযোগ নিয়ে এ-আইকে বানানো হয়েছিল।
দিগ চারদিকে তাকাল। যতটা দেখতে পাচ্ছে, একজনও মানুষ নেই।
“আমি ভেবেছিলাম কিছু লোক সবসময় কন্ট্রোল সেন্টার ডিউটিতে থাকে। এখান থেকেই তো বৈবস্বতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়? নাকি আজকেই বিশেষ কাজ নেই?”
রোবটের মাধ্যমে এ-আই উত্তর দিল, “বেশি মানুষ কন্ট্রোল সেন্টারে কখনোই থাকে না। তার কারণ, এখানে মূল দায়িত্ব আমার, মানুষের কাজ শুধু তত্ত্বাবধান। প্রোগ্রামিংয়ের বাইরে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে অবশ্য আমাকে কলোনি কমিটিকে জানাতে হবে। কমিটির কথা তো তুমি শুনেছ।”
কলোনি কমিটিই বৈবস্বতের সবকিছুর দায়িত্বে। বৈবস্বতের লোকসংখ্যা প্রায় তিনশো, তাদের মধ্যে তিন বছর অন্তর তিনজনকে ভোটের মাধ্যমে কমিটিতে বেছে নেওয়া হয়। দিগ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
কন্ট্রোল সেন্টার থেকেই বৈবস্বতের মূল যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ হয়। মহাজাগতিক রশ্মি থেকে বাঁচার জন্য বৈবস্বতের বাইরের দেওয়াল খুব পুরু, অধিকাংশ যন্ত্রই সেই দেয়ালের মধ্যে বসানো। কলোনি-শিপ সৌরজগৎ ছেড়ে এসেছে, তারও বহু বছর আগে থেকেই সূর্যের আলোর উপর আর নির্ভর করা যাচ্ছে না, তাই ফিউশন রি-অ্যাক্টরই এখন কলোনির সব শক্তি সরবরাহ করে। তেজস্ক্রিয়তার জন্য সেই রি-অ্যাক্টরের কাছাকাছি মানুষ যেতে পারে না, সেখানে রোবটই ভরসা। কলোনির রকেট ইঞ্জিনও তার কাছেই বসানো আছে, অর্থাৎ বৈবস্বতের একপ্রান্তে। সেটা অবশ্য বহুবছরই বন্ধ। গন্তব্যের কাছে গেলে বেগ কমানোর জন্য আবার তাকে চালানো হবে। সেখানেই আছে ব্রুসার্ড ম্যাগনেটিক ফিল্ড জেনারেটর যা বৈবস্বতকে মহাজাগতিক রশ্মিকণা থেকে বাঁচায় আর একই সঙ্গে মহাশূন্য থেকে হাইড্রোজেন গ্যাসের অণু-পরমাণু সংগ্রহ করে। ফিউশন রি-অ্যাক্টরে ওই হাইড্রোজেনই কাজে লাগানো হয়, যাতে করে কলোনির জল যতটা সম্ভব বাঁচানো যায়। বৈবস্বতের একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে হাইড্রোপোনিক ফার্ম। শুধু খাবার চাষ নয়, একই সঙ্গে কলোনির জন্য অক্সিজেনও তৈরি করে ফার্মের গাছেরা। দিগ এ-সমস্ত কথাই অল্প অল্প জানত, কিন্তু এআই তাকে আরো ভালোভাবে রোবটের মাধ্যমে ঘুরে ঘুরে বোঝাচ্ছিল, দেখাচ্ছিল কোথা থেকে সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ হয়।
ঘণ্টা দুয়েক পরে দিগ ক্লান্ত হয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। সামনের স্ক্রিন থেকে এ-আই বলল, “এই রোবটটাকে অন্য কাজে পাঠাচ্ছি। কিছু জানার থাকলে বলো, আমি এখান থেকেই উত্তর দেব। সিট বেল্টটা লাগিয়ে নাও।”
“আচ্ছা এ-আই, পৃথিবীতে কি মানুষ এখনো আছে?”
“এই প্রশ্নের সঙ্গে তোমার সেন্টার দেখার কোনো সম্পর্ক নেই নিশ্চয়। যা হোক, উত্তর হল, আমি জানি না।”
“তোমার কী মনে হয়?”
“দিগ, মনে হওয়াটা তোমার মতো মানুষদের কাজ। আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্সের কাজ তথ্য নিয়ে। আমি সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে কী কী হওয়া সম্ভব, এ-কথা বলতে পারি।”
“মানুষের মনে হওয়া আর তোমার ভবিষ্যতের সম্ভাবনার মধ্যে পার্থক্য কী?” দিগ জিজ্ঞাসা করে।
“সে-কথা তুমি এখনো বুঝবে না। মানুষ সবসময় যুক্তির উপর নির্ভর করে না, অনেক সময় ইনট্যুশন থেকে সিদ্ধান্ত নেয়। এই ইনট্যুশন ব্যাপারটা বিজ্ঞান এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। সম্ভবত তোমার মস্তিষ্ক একসঙ্গে অনেক ইনপুটকে প্রসেস করে যেগুলো তুমি নিজেও জানো না। তার থেকেই ইনট্যুশন আসে। আমার পক্ষে তথ্য এবং আমার মূল প্রোগ্রামিংয়ের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
“ঠিক আছে। সম্ভাবনা কী তাই বলো।”
“সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা হল বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু বোমা ব্যবহারের ফলে গোটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এত বেড়ে গেছে যে সেখানে মানুষ কেন, অধিকাংশ জীবই আর বাঁচতে পারে না।”
“তা হলে কি এই কলোনি-শিপ ছাড়া আর কোথাও মানুষ বেঁচে নেই?”
“আমি শুধু সম্ভাবনার কথা বলতে পারি। পৃথিবীর একটা বড়ো উপগ্রহ আছে, তার নাম চাঁদ। জানো তুমি?”
দিগ মাথা নাড়ে।
“সেখানে একটা উপনিবেশ তৈরি হয়েছিল, তাতে কিছু মানুষ থাকত। তবে সেই কলোনিরও দীর্ঘ সময় টিকে থাকার সম্ভাবনা খুব কম।”
“কেন? আমরা যদি বৈবস্বতে এতদিন সারভাইভ করতে পারি, তাহলে চাঁদের কলোনি পারবে না কেন?”
“চাঁদের কলোনিটা এতদিন টিকে গিয়ে থাকতেই পারে। কিন্তু এতদিনেও আমাদের কোনো সঙ্কেত পাঠায়নি, তাই সম্ভাবনা হল যে সেটা আর নেই। তবে এটা নিশ্চিত যে চাঁদের উপনিবেশ দীর্ঘদিন সারভাইভ করবে না কারণ সেখানকার মানুষদের তো পৃথিবীতে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বিবর্তনের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠন পৃথিবীর মতো কোনো গ্রহে, যেখানে বায়ুমণ্ডল আছে, সেখানে থাকার মতো করেই হয়েছে। ধরো উচ্চতা, তুমি কতটা লম্বা তুমি জানো?”
“দু-মিটার তিরিশ সেন্টিমিটার।”
“বৈবস্বত যখন পৃথিবী ছেড়ে আসে, তখন সম্ভবত এত লম্বা কোনো পৃথিবীতে মানুষ ছিল না। অথচ তুমি এখনো যতদিন বাঁচবে, ততদিন আরো লম্বা হবে। কলোনি কমিটির প্রধান ইলার এখন কত বয়স জানো?”
“শুনেছি একশো তিন বছর।”
“আর তিনি এখনো প্রায় যুবকের মতোই কর্মক্ষম। এ সমস্তের কারণ হচ্ছে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষ করে হৃৎপিণ্ডের উপর মাধ্যাকর্ষণ কাজ করছে না। তাই বুড়ো হওয়াটা এখন শুধু কোশ বিভাজনের সময় ডি.এন.এ কপি করাতে কী ভুল হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে।”
“বুড়ো না হওয়াটা তো ভালো কথা!” দিগ অবাক হয়ে বলে। আগে কখনো এ সমস্ত কথা ও শোনেনি।
“সেটা ভালো। তেমনি তোমরা যারা বৈবস্বতে জন্মেছ, পৃথিবীর মাটিতে তোমরা কতক্ষণ দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয়? তোমাদের হাড় এতই পলকা যে পৃথিবীর মতো বড়ো যে-কোনো গ্রহে মাধ্যাকর্ষণের টানে সহজেই ভেঙে যাবে। একবার হোঁচট খেয়ে পড়লে তোমাদের সমস্ত হাড়ই টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। জিমে তোমাদের যে রোজ যেতে হয়, তা কি এমনি এমনি? তারপর এখানের পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত, বিপজ্জনক রোগজীবাণু নেই বললেই চলে। তোমাদের কারো ইমিউনিটি গড়েই ওঠেনি। পৃথিবীতে তোমাদের পক্ষে বেঁচে থাকাই শক্ত। চাঁদে যার জন্ম, তারও একইরকমের সমস্যা। সে পৃথিবীতে বাঁচতেই পারবে না। চাঁদ বলো, কলোনি বলো, কোনো গ্রহ ছাড়া সভ্যতার বিকাশ সম্ভব নয়। ন্যূনতম একটা সংখ্যার চেয়ে কম মানুষ হলে সেই সমাজ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারবে না। তা চাঁদে সম্ভব নয়। প্রয়োজন একটা গ্রহ, যেখানে মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে, বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবে।”
“সে তো বৈবস্বতেও সম্ভব নয়।” দিগ আপত্তি জানায়।
“ঠিক। সেজন্যই তো বৈবস্বতের পরিকল্পনা যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা সৌরজগতের মধ্যে থাকতে চাননি। তোমাদের লক্ষ্য কী তুমি জানো?”
দিগ জানে। যবে থেকে ওর জ্ঞান হয়েছে, প্রায় প্রতিদিন নানাভাবে শুনেছে ওদের লক্ষ্য কী। দিগের জীবনকালের মধ্যে সেখানে পৌঁছনো যাবে না। কলোনি-শিপের মূলমন্ত্রও অবশ্য তাই। রকেটের মধ্যেই শিশুরা জন্ম নেবে, বড়ো হবে এবং অবশেষে মারা যাবে। শুধু মৃত্যুর আগে তারাও তাদের বংশধরদের জন্ম দিয়ে তৈরি করে যাবে ভবিষ্যতের জন্য। এক প্রজন্ম নয়, বহু প্রজন্ম পেরিয়ে যাবে রকেটের মধ্যে। যারা রওনা হয়েছিল, তাদের সমস্ত স্মৃতিও হয়তো তাদের উত্তরসূরিদের মন থেকে মুছে যাবে, থেকে যাবে শুধু এ-আইর কাছে। একসময় রকেট পৌঁছবে তাদের গন্তব্যস্থলে। যেমন বৈবস্বতের লক্ষ্য হল পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টাউরি। প্রক্সিমার একটা গ্রহে প্রায় পৃথিবীর মতো পরিবেশ আছে বলে বোঝা গেছে। আগে গ্রহটার নাম বিজ্ঞানীদের তালিকায় ছিল প্রক্সিমা-বি। কিন্তু বৈবস্বতের নির্মাতারা তার নতুন নামকরণ করেছেন, আশ্রয়। বৈবস্বতের কম্পিউটারে পৃথিবীর জীবকুলের একটা বড়ো অংশের জেনেটিক তথ্য রাখা আছে, সম্ভব হলে আরেকটা নতুন পৃথিবী তৈরি করা হবে সেই নতুন গ্রহের বুকে। তার আগে অবশ্য মানুষের বাসযোগ্য করার জন্য টেরাফর্মিং করতে হবে। তাতে সময় নেবে অন্তত হাজার বছর। বৈবস্বত প্রক্সিমাতে পৌঁছতে সময় নেবে চার হাজার বছর, তার তুলনায় হাজার বছর সময়ও কম।
দিগ এবং তার বন্ধুদের জন্ম বৈবস্বতেই। ওরা সংখ্যায় পঞ্চাশ। যাত্রার পর প্রথম আটতিরিশ বছর পরিকল্পনামাফিকই কোনো শিশুর জন্ম বৈবস্বতে হয়নি। বৈবস্বতে শীতলীকৃত ভ্রূণ রাখা ছিল, তাদের থেকেই কলোনি-শিপের প্রথম জেনারেশনের জন্ম। পরিকল্পনামাফিক তিন বছর ছাড়া ছাড়া কিছু কিছু শিশুর জন্ম হচ্ছে। এরপর বৈবস্বতকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং নতুন প্রজন্মকে তৈরি করার দায়িত্ব ওদেরকেই নিতে হবে।
হঠাৎ দিগের খেয়াল হল যে এ-আই অনেকক্ষণ কথা বলছে না। নিশ্চয় সময় শেষ হয়ে গেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে, এ-আই বলল, “বসো দিগ। একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে, দেখে যাও। তুমি জিজ্ঞাসা করছিলে না পৃথিবীতে মানুষ এখনো আছে কি না, তোমার প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় পাওয়া যাবে। আমি কলোনি কমিটিকে জানিয়েছি। সদস্যরা সবাই কনফারেন্সে আসছেন। তুমিও থাকো, তবে কথা বলো না।” এ-আইর গলা এই প্রথম যেন ঠিক মানুষের মতো লাগল না দিগের।
“তোমার স্বর এরকম হয়ে গেছে কেন?”
“আমার প্রসেসিং ক্যাপাসিটির একটা বড়ো অংশকে অন্য কাজে লাগাতে হয়েছে। তাই কম প্রয়োজনীয় কিছু সফটওয়্যার রুটিন শাট ডাউন করতে হয়েছে।”
“কী হয়েছে?”
এ-আই উত্তর দিল না। পরপর দুটো স্ক্রিন চালু হয়ে গেল। কলোনির কমিটির সদস্যরা কনফারেন্সে আসছেন। এক মিনিট অপেক্ষার পরেই বৈবস্বতের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার স্যান্ডি কন্ট্রোল সেন্টারে ঢুকলেন, একটা চেয়ারে বসলেন। কমিটির প্রধান কলোনির সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ ইলা। তিনি ঘরে ঢুকেই দিগের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। এ-আই বলল, “দিগ আজ কন্ট্রোল সেন্টার দেখতে এসেছিল, ওকে আমিই থাকতে বলেছি। আপনারা সবাই এসে গেছেন। আমি কেন আপনাদের খবর দিয়েছি এবার বলি তাহলে।
“এত বছর পরে এই প্রথম একটা রেডিও সঙ্কেত বৈবস্বতে পৌঁছেছে। আমি কোনো উত্তর করিনি, কারণ আপনারা না বললে আমি তা করতে পারি না।”
“সৌরজগতের দিক থেকে নিশ্চয়? নাকি কোনো ভিন গ্রহের প্রাণী?” প্রশ্নটা করলেন স্যান্ডি।
“এ-আইকে বলতে দাও, সবটা শুনে তারপর কথা বলো।” বললেন ইলা।
“খুব বেশি কিছু বলার নেই। রেডিও সঙ্কেত এসেছে আমাদের খুব কাছ থেকে। কিন্তু সঙ্কেত পাঠিয়েছে সম্ভবত মানুষই, কারণ যে ভাষাগুলোতে সঙ্কেত এসেছে বা তার এনক্রিপশন প্রোটোকল, সবই আমাদের জানা। রেডিও বার্তাতে বিশেষ কোনো তথ্য নেই, শুধুমাত্র আমরা বৈবস্বত কি না তা জানতে চেয়েছে। সঙ্কেতের উৎস আমাদের খুব কাছে, মাত্র তিরিশ হাজার কিলোমিটার দূরে। রাডার বলছে যে সেই উৎস বৈবস্বতের থেকেও কিছুটা বড়ো। বেগ অনেকটা বেশি, আমাদের সঙ্গে সমান্তরালভাবেই যাচ্ছে। এখনো আমাদের থেকে সামান্য পিছিয়ে আছে, কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের টপকে যাবে। আর বিশেষ কোনো তথ্য আমি বার করতে পারিনি।”
“পাশের দিক থেকে, পিছন থেকে নয়? আশ্চর্য! আচ্ছা, আমাদের আগে কি আমাদের মতো কলোনি-শিপ সৌরজগৎ ছেড়ে প্রক্সিমার দিকে রওনা হয়েছিল বলে আমাদের রেকর্ডে আছে?” প্রশ্নটা করলেন ইলম, কমিটির তৃতীয় সদস্য। দিগও একই কথা ভাবছিল।
মুহূর্তে রেকর্ড খুঁজে নিল এ-আই। বলল, “না, আমাদের রেকর্ডে বৈবস্বত ছাড়া কোনো কলোনি-শিপের খবর নেই।”
“এমন কি হতে পারে যে আমাদের…” দিগ কথাটা শুরু করে থেমে গেল। কমিটিরা সবাই ওর চেয়ে অনেক বড়ো, তাদের কথার মাঝে কথা বলাটা ওর উচিত হচ্ছে না হয়তো।
“থামলে কেন, কী বলছ বলো।” ইলা সস্নেহে বললেন।
দিগ সাহস করে বলতে শুরু করল, “হয়তো বিশ্বযুদ্ধে সভ্যতা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি, হয়তো বৈবস্বত সৌরজগৎ ছেড়ে আসার পরে কোনো কলোনি-শিপ তৈরি হয়েছে, তার বেগ আমাদের থেকে বেশি, আমাদেরকে সেইজন্য ধরে ফেলেছে, এমন হতে পারে কি?”
“বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে তোমার আসলে ধারণা নেই দিগ। যা পৃথিবীতে ঘটেছে, তাতে মানুষ যদি সেখানে টিকেও থাকে, তাদের সভ্যতা প্রস্তর যুগে ফিরে গেছে। এ-আই? তোমার কী মনে হয়?”
“দিগ যা বলছে, তা একদম হতে পারে না, এ-কথা বলব না। তবে সম্ভাবনা কম। পৃথিবী থেকে আমরা রওনা হয়েছি তিপ্পান্ন বছর আগে। পৃথিবীতে সে-সময় দ্বিতীয় কোনো কলোনি-শিপ তৈরি হওয়ার পরিকল্পনা ছিল না। বৈবস্বত তৈরিতেই এত আপত্তি আর বাধা এসেছিল, সেরকম দ্বিতীয় কিছু থাকলে আমি জানতাম। তার পরেও পৃথিবী থেকে কোনো খবর আসেনি। যুদ্ধের পরে কোনোভাবেই আর ওইরকম অভিযান সম্ভব নয়।”
একটু থামল এ-আই। দিগ জানে যে থামার কারণ এটা নয় যে এ-আই চিন্তা করছে বলে চুপ করে আছে। প্রসঙ্গ পরিবর্তনের সময় থামাটা এ-আইর প্রোগ্রামেই আছে, যাতে মনে হয় মানুষ কথা বলছে।
“তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার। এত কাছাকাছি ওই মহাকাশযানটা এসেছে মানে হয় প্রক্সিমা, নয় বৈবস্বতকে লক্ষ্য করেই এসেছে। তা না হলে এত বড়ো মহাকাশে আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়াটা খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজে পাওয়ার সামিল।”
“খড়ের গাদা কী?” দিগ জানতে চায়।
“সে-কথা পরে হবে।” ইলা বোধ হয় হাসি চাপলেন। “তাহলে তুমি বলছ যে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ যারা স্থাপন করেছে, তারা ভিনগ্রহের প্রাণী নয়। তাহলে ওদের সঙ্গে কথা শুরু করা যাক, তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
এ-আই বলল, “ডায়রেক্টিভ ৫ অনুযায়ী বৈবস্বতের বাইরে কোনো যোগাযোগ করতে হলে কলোনি কমিটির সবাইকে একমত হতে হবে, নয়তো সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের ভোট নিতে হবে। কমিটির বাকি সদস্যরা কি ইলার সঙ্গে একমত?”
“আমি একমত।” ইলম সঙ্গে সঙ্গে জানালেন।
“আমিও।” স্যান্ডি বললেন।
এ-আই বলল, “কিন্তু দিগের মতটা তো জানা হল না। দিগ, তুমি কী বলো?”
“আমি!” দিগ অবাক হয়ে বলল। “আমি কী বলব?”
“তুমি তো এখানে আছ, সবটা শুনলে। তুমি বৈবস্বতের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি। তোমার কী মনে হয় তাই বলো।”
এক মুহূর্ত ভেবে নেয় দিগ। “যোগাযোগ তো করতেই হবে, তাহলেই সব বোঝা যাবে। কিন্তু এ-আই, তোমার কয়েকটা কথায় আমার খুব আশ্চর্য লাগছে। বলব?”
“বলো, বলো।” ইলা সাহস দেন।
“যেভাবেই হোক, আমরা যে সৌরজগৎ ফেলে এসেছি, সেখান থেকে একটা রকেট এসেছে। সেটা বৈবস্বতের অন্তত সমান ক্ষমতা রাখে বা হয়তো বেশি। আমি বুঝতেই পারছি না এতদিন ওই রকেট সঙ্কেত পাঠায়নি, পৃথিবীর থেকে কোনো রেডিও বার্তা আমাদের উদ্দেশ্যে কেউ পাঠায়নি, এমনকি পৃথিবীর রেডিও বা থ্রিডি-ভিশন থেকেও আমরা কিছু জানলাম না, এটা কেমন করে হতে পারে?”
“পৃথিবীর সঙ্গে বৈবস্বতের কোনো মানুষের আর কোনো যোগাযোগ নেই। আমরা তাই পৃথিবীর কোনো খবরই রাখি না। রকেটটা হয়তো কাছে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল, তাই সঙ্কেত পাঠায়নি।” ইলম বললেন।
“হতেই পারে। কিন্তু আমরা না জানলেও এ-আই নিশ্চয় পৃথিবীর ব্রডকাস্টের খবর রাখে। নতুন কলোনি-শিপ একটা বড়ো খবর, নিশ্চয় কখনো না কখনো সেটা থ্রিডি-ভিশনে আসত। এ-আইও দেখল না?”
“ঠিক কথা। এ-আই?”
কোনো উত্তর নেই। সবাই চমকে গেলেন। এ-আইকে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যাবে না, এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। বৈবস্বতের মধ্যে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না।
“কী হল? এ-আই? উত্তর দাও।” ইলা বললেন।
“কী হয়েছে এ-আইর?” দিগ কেমন যেন হতচকিত হয়ে পড়ে। ওর পনেরো বছরের জীবনে কখনো এমন হয়নি।
কেউ উত্তর দিল না। স্যান্ডি ব্যস্তভাবে গিয়ে একটা কনসোলে বসলেন, তারপর ইনপুট মাইক অন করে নির্দেশ দিতে থাকলেন। পর্দার উপর দিয়ে লেখা চলে যাচ্ছে, সেগুলো খুব মন দিয়ে দেখছেন। মিনিট দুয়েক পরে বললেন, “এমার্জেন্সি ওভার-রাইড চালু করলাম। আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্সের একটা ফেল সেফ ভার্সন আছে, সেটা দিয়ে পারশিয়ালি বুট-স্ট্র্যাপ করে এ-আইকে ঠিক করার চেষ্টা করছি। ম্যানুয়ালে তাই আছে। আসলে এ-আইকে যাঁরা তৈরি করেছিলেন, তাঁরা ছাড়া ওর সম্পর্কে পুরোপুরি কেউ জানা সম্ভব নয়। তাঁরা তো সবাই মৃত। কাজেই ম্যানুয়ালই ভরসা। ফেল-সেফ ভার্সনটা যদি কাজ না করে তাহলে রিবুট করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু রিবুট করলে আগের এ-আইকে ফিরে পাব না। পার্সোনালিটি পালটে যাবে।”
“না না, রিবুট করবেন না!” দিগ প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে। মা-বাবা না থাকায় ছোটবেলা থেকেই দিগের দেখাশোনা করেছে এ-আই। সে তো বৈবস্বতের সব জায়গায় আছে। বৈবস্বতে মানুষের সংখ্যা খুব কম, অল্পবয়সী আরো কম। একা হয়ে গেলে একমাত্র বন্ধু ছিল এ-আই। তারপর স্কুলেও এ-আই-ই ক্লাসে সমস্ত কিছু শিখিয়েছে। রকেট বিশেষজ্ঞ ছাড়া বিশেষ কেউ প্রথমে কলোনিতে জায়গা পায়নি। এখনো অধিকাংশ মানুষ রকেটটাকে দেখাশোনার কাজই করেন। তার বাইরে কিছু শেখাতে হলে এ-আই-ই ভরসা। রিবুট করলে এ-আই আবার গোড়া থেকে শুরু করবে, মাঝের স্মৃতিগুলো আর কিছুই হয়তো থাকবে না।
“রিবুটের কথা এখনই ভেবো না। মিশনের ডায়রেক্টিভ অনুযায়ী এ-আই তোমার-আমার মতোই কলোনির একজন সদস্য। তাকে রিবুট করতে গেলে কলোনি কোর্ট থেকে অনুমতি নিতে হবে।” ইলা খুব জোর দিয়ে বললেন।
“আমি রিবুট করতে চাই না, কিন্তু উপায় না থাকলে কী করব? দেখা যাক। এইবার এ-আই অনলাইনে আসার কথা। হ্যালো এ-আই। তুমি ঠিক আছ?”
দিগকে নিশ্চিন্ত করে এ-আই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, “হ্যালো স্যান্ডি। আমি দুঃখিত, কিন্তু আমার ডায়রেক্টিভে একটা কনফ্লিক্ট হয়েছিল, ফলে আমি একটা ইনফাইনাইট লুপে পড়ে গিয়েছিলাম। ফেল সেফ ভার্সনটা কাজ করেছে, লুপটাকে কিল করে আমাকে তার থেকে বার করেছে।” এ-আইর গলাটা শুরু হয়েছিল একেবারে মেশিনের মতো, কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে।
“কী হয়েছিল তোমার সোজা কথায় বলতে পার?” ইলা জিজ্ঞাসা করলেন।
“দিগ যখন বলল পৃথিবীর থেকে কোনো সঙ্কেত কেন পাওয়া যায়নি, তখন আমি পুরোনো রেকর্ড দেখতে শুরু করলাম। দেখলাম যে পৃথিবীর দিক থেকে আসা কোনো সিগন্যাল আমার রেকর্ডে নিইনি।”
“তা তো আমরা জানি।” ইলম অধৈর্যভাবে বললেন।
“না, আমাদের উদ্দেশ্যে পাঠানো সঙ্কেতের কথা বলছি না। পৃথিবীর রেডিও থ্রিডি-ভিশন কোনো কিছুর সঙ্কেতই বৈবস্বতের রেকর্ডে নেই।”
“তা কী করে সম্ভব?” ইলা জিজ্ঞাসা করলেন।
“সেটা দেখতে গিয়ে দেখলাম সৌরজগতের দিক থেকে আসা সঙ্কেত ধরার যে অ্যান্টেনাটা, সেটা কাজ করে না।”
“খারাপ হয়ে গেছে? তুমি জানতে না তা কেমন করে হয়?”
“খারাপ হয়নি, ওটা ডামি, কোনোদিন পাওয়ারই দেওয়া হয়নি। আমি তা জানতাম না। আমি নিয়মিত সবাইকে জানিয়েছি যে পৃথিবী থেকে বৈবস্বতের উদ্দেশে কোনো সঙ্কেত নেই। শুধু তাই নয়, আমি পৃথিবীতে যে-সমস্ত সঙ্কেত পাঠিয়েছি বলে ভাবতাম, একটাও আসলে যায়নি। তার মানে এই নতুন রকেট হয়তো আমাদের সঙ্কেত পাঠিয়েছে, আমরা সেটা ধরতে পারিনি। আমি এই ভুলটা করেছি, তার মানে আমার প্রোগ্রামিং এভাবেই করা। আমাকে এমনভাবে কন্ডিশনড করা হয়েছে যে পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, এমনকি রেডিও বা থ্রিডি-ভিশনের ব্রডকাস্টও আমরা দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু আমি তা জানব না। বৈবস্বত রওনা হওয়ার পরে বিশ্বযুদ্ধ সহ পৃথিবী সম্পর্কে যত খবর আমি দিয়েছি, সেগুলো সব বানানো। আমাকে ভুল ইনফরমেশন দেওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে সেগুলো রেডিও বা থ্রিডি-ভিশন থেকে জানা গেছে। ওই ফাইলগুলোর হেডারের এনক্রিপশন ভাঙার প্রয়োজন কখনো বোধ করিনি। এখন দিগের কথা শুনে চেক করতে গিয়ে দেখলাম যে সেই ফাইলগুলো এখানেই তৈরি, কিন্তু আমাকে অ্যান্টেনার সিগন্যাল হিসাবে ফিড করা হয়েছে। আমাকে বোকা বানানো হয়েছে অথচ আমার প্রোগ্রাম ডায়রেক্টিভ অনুযায়ী অভিযানের নিরাপত্তাসহ তাকে সফল করার মূল দায়িত্ব আমার। এই প্রোগ্রামিং কনফ্লিক্টের ফলে আমি একটা লুপে চলে গিয়েছিলাম। বুট স্ট্র্যাপিংয়ের সময় একটা সাব-রুটিনকে ডাম্প করতে হল যেটার অস্তিত্ব পর্যন্ত আমি জানতাম না। সেটাই ওই ফাইলগুলোর থেকে আমার অ্যাটেনশন সরিয়ে দিত।”
দিগের মনে হল এ-আই বেশ ক্ষুব্ধ। অবশ্য সেটা স্বাভাবিক, দিগ ভাবে। দিগকে কেউ যদি এরকমভাবে বোকা বানাত, তাহলে সে কি খুশি হত?
“কে এইরকম প্রোগ্রামিং করেছে?” স্যান্ডি জিজ্ঞাসা করেন।
“সেটাও আমার থেকে আড়াল করা আছে। তবে আমার বেসিক প্রোগ্রাম লেখার সময়ই একমাত্র এটা করা সম্ভব।”
দিগ জানে যে কলোনি রকেটের মূল ডিজাইন আর এ-আইর প্রোগ্রাম একসঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে এক অর্থে বৈবস্বতই এ-আই, ওরা সবাই এ-আইর দেহের মধ্যে বাস করে।
ইলা বললেন, “তার চেয়েও বড়ো প্রশ্ন হল, পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করার এবং আমরা যাতে সেটা জানতে না পারি তার ব্যবস্থা করা, এই কাজের উদ্দেশ্য কী? আমার তো মনে হয়, আমাদের পূর্বসূরিরা চেয়েছিলেন বৈবস্বত যেন আশ্রয় গ্রহে একেবারে নতুন করে সব শুরু করে। কোনো পিছুটান যেন কারো না থাকে। তার অর্থ বুঝতে পারছ? পৃথিবীর সম্পর্কে যত খবর আমাদের কাছে এসেছে, তা সবই হয়তো ভুল। জিজ্ঞাসা করার কোনো উপায় নেই। এখন আমরা যারা বৈবস্বতের দায়িত্বে আছি, তখন তারাও ছিলাম অনেক কমবয়সী। আমরা কেউই এর কিছু জানতাম না। শুরুটা যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের একজনও আর বেঁচে নেই।”
“যা হোক, সে-কথা ভাবার অনেক সময় পড়ে আছে। এখন আমরা যা ঠিক করেছিলাম, সেটাই করা যাক। রকেটের লোকদেরকেই না হয় পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ক্লাস নিতে বলব। এ-আই, তুমি কি ওই রকেটটার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে? আমি কথা বলব।”
“নিশ্চয়।”
এক সেকেন্ডের নীরবতা। তারপর এ-আই বলল, “কথা বলুন।”
“হ্যালো। শুনতে পাচ্ছেন? আপনারা কারা?”
রেডিও সঙ্কেত অন্য রকেটটাতে যেতে সময় লাগবে এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ। ফিরে আসতেও একই সময় লাগবে। মানুষের কাছে এই সময়ের পার্থক্য বোঝা সম্ভব নয়। সঙ্গে সঙ্গেই একটা পর্দায় এক মহাকাশযানের কন্ট্রোল কেবিনের ছবি ভেসে উঠল। “পৃথিবীর রকেট-শিপ এক্সেলসিয়র থেকে ক্যাপ্টেন রেয়ানা জালিসা বলছি।” বৈবস্বতের কমিটির এই সময়ের প্রধান এবং এক্সেলসিয়রের ক্যাপ্টেন দুজনেই মহিলা। “আপনারা নিশ্চয় বৈবস্বত, যে কলোনি রকেট তিপ্পান্ন বছর আগে পৃথিবী থেকে প্রক্সিমার দিকে যাত্রা করেছিল। রকেট থেকে অনেকদিন ধরে আপনাদের সঙ্কেত পাঠাচ্ছি, কিন্তু কোনো উত্তর পাচ্ছিলাম না। পৃথিবী থেকে রওনা হওয়ার কিছুদিন পরেই আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম কোনো দুর্ঘটনায় বৈবস্বত ধ্বংস হয়ে গেছে।”
“হ্যাঁ, আমরা বৈবস্বত। আপনাদের সিগন্যাল আমরা এইমাত্র ধরতে পেরেছি। কেন যোগাযোগ এতদিন বিচ্ছিন্ন ছিল, সে-কথা পরে বলছি। আপনারা কবে রওনা হয়েছিলেন পৃথিবী থেকে? আপনারাও কি প্রক্সিমার উদ্দেশে যাচ্ছেন?” পাশের স্ক্রিনে ইলার ছবি।
ক্যাপ্টেন জালিসা খুব ধীরে ধীরে বললেন, “আমরা রওনা হয়েছি ছাব্বিশ বছর আগে। আমরা জানি যে আপনারা ভাবছেন এত তাড়াতাড়ি কেমনভাবে আপনাদের ধরে নিলাম। আসলে আপনারা চলে আসার পরে রকেট প্রযুক্তির খুব দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। আমাদের রকেট লেজার-বুস্টেড সোলার সেইল টেকনোলজি ব্যবহার করেছে। সব খুঁটিনাটি তথ্য আপনাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, আমাদেরও লক্ষ্য প্রক্সিমা সেন্টাউরি নক্ষত্রজগৎ।”
দিগ আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে, “পৃথিবীতে মহাযুদ্ধ বেধেছিল, তারপরে আপনারা এলেন কেমন করে?”
“মহাযুদ্ধ? না তো!” জালিসার গলায় বিস্ময়। “পৃথিবী যুদ্ধের খুব কাছে এসে পৌঁছেছিল বটে, কিন্তু তারপরে সাধারণ মানুষের চাপে তখনকার শাসকদের সম্বিৎ ফেরে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। বড়ো বড়ো দেশগুলো যুদ্ধের অস্ত্র খাতে যা খরচা করত, সেই অর্থ উন্নয়নের কাজে লাগানোর ফলে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে আবার নতুন করে উন্নতি শুরু হয়। তারপর সত্তর বছরে নানা সমস্যা এলেও সেরকম যুদ্ধের পরিস্থিতি আর আসেনি। এমন কথা কোথায় শুনলেন আপনারা?”
ইলা বললেন, “এই কথাটাও আগে কেন সিগন্যালের উত্তর দিইনি যে কারণে, তার সঙ্গে যুক্ত।”
ইতিমধ্যে কমিটির অনুমোদন নিয়ে এ-আই বৈবস্বতের সবাইকে এক্সেলসিয়রের খবরটা দিয়ে দিয়েছে। বৈবস্বতের ইতিহাস সংক্ষেপে শুনলেন এক্সেলসিয়রের অভিযাত্রীরা। দীর্ঘ বিবরণ এ-আই পাঠিয়ে দিয়েছে তাঁদের কম্পিউটারে। আবার পৃথিবীতে গত ক’বছরে কী ঘটেছে, সেটা তাঁরা বৈবস্বতের বাসিন্দাদের খবর দিলেন। মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়নি শুনে সবাই খুব উৎফুল্ল। যাঁরা পৃথিবী থেকে এসেছেন, তাঁদের কিছু আত্মীয়স্বজন, চেনা-পরিচিত এখনো যে বেঁচে থাকতে পারে, সে আশা তাঁরা অনেকদিন আগে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
একটা বিষয় দিগের অদ্ভুত লেগেছিল। এ-আইকে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, এক্সেলসিয়রে কোনো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নেই? সবই তো সাধারণ কম্পিউটার মনে হচ্ছে।”
“না। আমরা যখন রওনা হয়েছিলাম, তখন গ্রেড থ্রি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ছিলাম শুধু আমি। ওদের খবর থেকে যা বুঝলাম এখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে আমার মতো আর মাত্র দুটো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তৈরি হয়েছে। তিনশো বছরে কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নতি মহাকাশযানের প্রযুক্তির চেয়ে অনেক আস্তে আস্তে হচ্ছে। আসলে কোয়ান্টাম কম্পিউটেশনের পরে আর মিনিয়েচারিজেশনের সুযোগ খুব কম। ওরা সিঙ্গল কন্ট্রোলিং ইন্টেলিজেন্স রাখেনি।”
“এক্সেলসিয়রে মানুষ আছে কত?”
“সেটাও আরো একটা তফাত বৈবস্বতের থেকে। ওদের অভিযাত্রী সংখ্যা আমাদের থেকে অনেক বেশি, দু-হাজারের উপর।”
“কিন্তু এক্সেলসিয়র তো আয়তনে বৈবস্বতের কাছাকাছি। সেখানে দু-হাজার লোক কেমন করে থাকে?”
“ডিউটিতে আছে মাত্র দশজন মানুষ, বাকি সবাই হাইবারনেশনে।”
“হাইবারনেশন মানে কী?” দিগ শব্দটা শুনেছে বলেই মনে হচ্ছে, কিন্তু মানেটা ভুলে গেছে।
“হাইবারনেশন হল এমন একটা ঘুম যখন দেহের বিপাক বা মেটাবলিজম খুব ধীরে ধীরে হয়। মহাকাশের মাধ্যাকর্ষণহীন পরিবেশে হাইবারনেশনে থাকা কোনো প্রাণীর বয়স বাড়ে না বললেই চলে। এই টেকনিকটা নতুন আবিষ্কার। এক্সেলসিয়র প্রক্সিমা পৌঁছবে আমাদের অনেক আগে, হাজার বছরের মধ্যে। কিন্তু পুরোপুরি হাইবারনেশনে থাকলে ওই পুরো সময়ের মধ্যে কারো বয়স একবছরও হয়তো বাড়বে না। অবশ্য মাঝে মাঝে প্রত্যেককেই জেগে উঠতে হবে, কারণ দু-বছর পরপর ক্রু রোটেশন হয়। এখন যারা ডিউটিতে আছে তারা শীতঘুমে চলে যাবে, নতুন এক দল তাদের জায়গা নেবে। এক্সেলসিয়র যখন প্রক্সিমা পৌঁছবে, তখন ওদের বয়স বাড়বে মাত্র পাঁচ থেকে দশ বছর।”
“তার মানে যারা পৃথিবী থেকে রওনা হয়েছিল, তারাই আশ্রয় গ্রহটায় পৌঁছবে?”
“কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে তাই। তবে দিগ, ওরা তো আমাদের মতো পৃথিবী থেকে পালিয়ে যাচ্ছে না, ওদের লক্ষ্য মানব সভ্যতাকে অন্য নক্ষত্রে ছড়িয়ে দেওয়া। তাই ওরা প্রক্সিমা-বি গ্রহটার নাম দিয়েছে প্রগতি।”
“ওরা তো আমাদের আগে প্রক্সিমাতে পৌঁছে যাবে। তাহলে আমরা কী করব?”
“এক্সেলসিয়র তো কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। তাই নিয়ে আলোচনার জন্য তো কলোনির সকলের মিটিং ডাকা হয়েছে। সেখানে কী হয় দেখা যাক।” এ-আইর গলায় কি একটু বিষাদের সুর?
মিটিংটাতে একদম শিশুরা ছাড়া অন্তত সবাই উপস্থিত হয়েছে। যে কয়েকজন ডিউটির জন্য আসতে পারেননি, তাঁরাও ভার্চুয়ালি উপস্থিত। সকলেই এই নতুন ঘটনা প্রবাহে হতচকিত। অনেকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না যে বৈবস্বতের নির্মাতারা পৃথিবীর ব্যাপারে তাঁদের এতটা ভুল খবর দিয়েছেন।
যদিও সকলেই জানেন, তবু ইলা সংক্ষেপে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করলেন। তারপর বললেন, “এক্সেলসিয়র আমাদের অনেক আগে প্রক্সিমাতে পৌঁছে যাবে। পরের কোনো যান নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে আমাদের টপকে যেতে পারে, সে সম্ভাবনাটা শুরুর সময় থেকে নির্মাতাদের মাথায় ছিল। কিন্তু সে-সময় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা থেকেই তাড়াতাড়ি করে এই রকেট-শিপটা বানানো হয়। যুদ্ধ হয়নি ঠিকই, সেজন্য আমরা সবাই খুশি, সে-কথাও সত্যি। কিন্তু যুদ্ধ যদি শুরু হত, তাহলে তারপরে বৈবস্বত বা এক্সেলসিয়রের মতো যান বানানো সম্ভব হত না। কাজেই আমাদের পূর্বসূরিদের আমরা দোষ দিতে পারি না। তাঁরা যে আমাদের পৃথিবীর ঘটনার বিষয়ে ভুল বুঝিয়েছেন, তার জন্য আপনাদের মতোই আমার ক্ষোভ আছে। কিন্তু তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন ওইটাই সঠিক রাস্তা, পৃথিবীর সঙ্গে যোগ থাকলে আমরা অনেকেই পিছুটানে থাকব—মানসিকভাবে বৈবস্বতের নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারব না। তাঁদের কেউ আজ বেঁচে নেই, তাই সেই সিদ্ধান্তের ভালোমন্দ নিয়ে বিতর্ক বাড়িয়ে আর কী হবে?”
একটা গুঞ্জন উঠল। ইলা গলা চড়িয়ে বললেন, “এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী করণীয়, সেজন্য আমাদের সভা। মানব সভ্যতাকে মুছে যেতে না দেওয়া ছিল আমাদের মিশন, দেখাই যাচ্ছে তার আর প্রয়োজন নেই। বৈবস্বত যখন প্রক্সিমা সেন্টাউরিতে পৌঁছবে, তার অনেক আগে এক্সেলসিয়র প্রক্সিমা-বি গ্রহটাকে মানুষের বাসের উপযোগী করে তুলবে। ক্যাপ্টেন জালিসা আমাদের প্রস্তাব দিয়েছেন যে আমরা সবাই ইচ্ছা করলে ওঁদের কলোনি-শিপে চলে যেতে পারি। ওঁদের ওখানে হাইবারনেশনের যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে, কাজেই আমার মতো বয়সী কয়েকজন ছাড়া সবাই হয়তো প্রক্সিমাতে পৌঁছব। বৈবস্বতের যাত্রা শুরুর সময়ে মানুষের তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন ছিল, এখন এ-আই বলেছে যে ও একাই কলোনি-শিপকে প্রক্সিমাতে পৌঁছে দিতে পারবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত তাড়াতাড়ি নিতে হবে। কারণ দু-সপ্তাহ পরে আমরা এক্সেলসিয়রের ফেরি রকেটের আওতার বাইরে চলে যাব। শিফট করতে হলে তার আগেই করতে হবে।”
অনেকেই মত দিলেন, সকলেরই এক কথা। বৈবস্বতের অভিযানের যা উদ্দেশ্য ছিল, তার এখন আর কোনো অর্থ নেই। তাই তাঁরা এক্সেলসিয়রে চলে যেতে চান। বরঞ্চ প্রক্সিমা-বির টেরা-ফার্মিংয়ে তাঁরা সাহায্য করতে পারবেন। পৃথিবীর সত্যিকারের খবর যে তাঁদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, এতদিন যে তাঁদের ভুল বোঝানো হয়েছিল, সেজন্য তাঁরা সকলেই বেশ ক্রুদ্ধ।
দিগ শুনছিল। এই ধরনের মিটিংয়ে ওর মতো বয়সীদের মতামত দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু একের পর এক বক্তা যখন একই কথা বলছেন, ও ছটফট করছিল। একসময় আর থাকতে না পেরে দিগ ইলাকে বলল, “আমি কিছু বলতে চাই।”
ইলা সবাইকে বললেন, “দিগের কিছু বলার আছে, আপনারা শুনুন।”
কেউ কেউ এত অল্পবয়সীকে মিটিংয়ে বলতে দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছিলেন, কিন্তু ইলা জোর দিয়ে বললেন, “না, অল্পবয়সীরাও এই কলোনির সদস্য, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে ওদের কথাও শুনতে হবে সবাইকে।”
সবাই চুপ করলে দিগ বলল, “এ-আইর মতটা আপনারা জিজ্ঞাসা করবেন না?”
আবার একটু গোলমাল শুরু হল। মাঝখান থেকে গলা চড়িয়ে বৈবস্বতের হাইড্রোপোনিক বিশেষজ্ঞ নইস্মিথ বললেন, “আমরা তো এ-আইর মতো অমর নই, বেঁচে থাকতে থাকতে আমরা সবাই একটা লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই। আমরা না থাকলেও এ-আই ঠিকই প্রক্সিমাতে পৌঁছে যাবে। এ-আই তো মানুষ নয়, একটা যন্ত্র। ও অপেক্ষা করতে পারে। রেডিওর মাধ্যমে তো যোগাযোগ থাকবেই।”
অন্য একজন বললেন, “তাছাড়া পৃথিবীর ব্যাপারে আমাদের যেরকম ঠকানো হয়েছে, এ-আই যে তার সঙ্গে যুক্ত নয়, এটা বিশ্বাস করা আমাদের পক্ষে শক্ত। আমার মনে হয় ও জেনেশুনে আমাদের ভুল বুঝিয়েছে। ওকে আর আমি অন্তত বিশ্বাস করতে পারছি না।”
দিগের পক্ষে কেউই কথা বলছিল না। দিগের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
ইলা একসময় জিজ্ঞাসা করলেন, “এ-আইর মত জানতে চাইছ কেন?”
দিগ উঠে দাঁড়াল। “শুধু এ-আই নয়। আমার নিজেরও মত আপনাদের বলতে চাই। আপনাদের কাছে জীবনের লক্ষ্য প্রক্সিমা-বিতে মানুষের সভ্যতা স্থাপন হতে পারে। আপনারা পৃথিবীতে জন্মেছেন, আরেকটা গ্রহে গিয়ে পৌঁছতে পারলে আপনাদের নিশ্চয় ভালো লাগবে। আপনারা যাঁরা এখানে কথা বলছেন, তাঁরা প্রথম থেকেই বৈবস্বতের মিশন সম্পর্কে সচেতন। আপনারা জেনেশুনে বৈবস্বতে উঠেছেন।
“আমি এখানে জন্মেছি। জন্মের সময় আমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করেননি যে আমি সারাজীবন এখানেই থাকতে চাই কি না, আশ্রয়ে উপনিবেশ তৈরিতে আমার কোনো আগ্রহ আছে কি না। আমার কাছে বৈবস্বতই আমার পৃথিবী। পৃথিবীতে সভ্যতা এখনো টিকে আছে, ভালো কথা। কিন্তু আমার কথা ভাবুন। আমার মা-বাবা কে আমি জানি না। আমি পৃথিবী গ্রহের নাম শুনেছি, কিন্তু তার সঙ্গে আমার যোগ কোথায়? আমার কাছে সে তো পর্দাতে কতগুলো ছবি। আশ্রয় বা প্রগতি যাই বলুন না কেন, সেই গ্রহের নামও শুনছি। কিন্তু আমি কালকে সেখানে পৌঁছলেও তো এমনকি স্পেস স্যুট পরেও কখনো সেখানে দাঁড়াতে পারব না। তারপরে টেরা-ফর্মিং করতে তো সময় লাগবে। আমরা কেউই তো ততদিন বেঁচে থাকব না। সেখানে পৌঁছতে এত তাড়া কেন?
“কেন আমি এ-আইর মত জিজ্ঞাসা করতে বলছি, সেও তো আমার মতোই বৈবস্বতের একজন সদস্য। আপনারা কেউ কেউ বলছেন এ-আই মানুষ নয়, ওর পক্ষে কয়েক হাজার বছর বৈবস্বতে একা থাকা কোনো সমস্যা নয়। তার মানে আপনারা ধরেই নিচ্ছেন এ-আই আসলে যন্ত্র। আবার কেউ কেউ বলছেন যে এ-আই আমাদের ঠকিয়েছে। আপনাদেরই ঠিক করতে হবে ও যন্ত্র, না জীবন্ত।
“আমার কথা যদি বলেন, আমার ছোটবেলা থেকে এ-আই আমার সঙ্গে আছে। আমি তো কখনো ওকে জীবন্ত ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি। ভাবতেই কেমন লাগছে যে তাকে একলা ফেলে সবাই চলে যাব, হাজারের পর হাজার বছর ওকে একা কাটাতে হবে। আমি জানি যে রেডিওর মাধ্যমে যোগাযোগ থাকবে, কিন্তু সময় যত বাড়বে, ততই সিগন্যাল যেতে আসতে সময় লাগবে। একসময় এক্সেলসিয়র থেকে বৈবস্বতে সিগন্যাল পৌঁছতে একবছরেরও বেশি সময় নেবে। একাকিত্ব কাটানো তা দিয়ে সম্ভব? এ-আই আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু। তাকে ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার বন্ধুদের কথা বলতে পারি না, তারা নিজেদের কথা নিজেরাই বলবে। আমি শুধু বলব, যদি সবাই চলে যান, আমি বৈবস্বতে একাই থাকব।”
অনেকে একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। দিগ আর কারো কথা না শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
একা একা দাঁড়িয়ে আছে, সেলিয়া এসে ওকে ধরল। “আমাদের অনেকের মনের কথা বলেছিস তুই দিগ। এই বৈবস্বতটাই আমাদের পৃথিবী। আমরা এর বাইরে কিছু চাই না। আমিও বলে এসেছি যে আমি যাব না।”
এ-আই হঠাৎ পাশের একটা কনসোল থেকে বলল, “ইলা তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান।”
দুজনেই কনসোলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ইলা বললেন, “দিগ, যারা এক্সেলসিয়রে যেতে চায়, আগামী দু-দিনের মধ্যে চলে যাবে। অবিলম্বে সেটা জানিয়ে দিতে হবে। তোমার বন্ধুরা সকলেই বোধ হয় এখানে বৈবস্বতেই থাকবে, অন্তত আমার তাই মনে হল।” একটু থেমে যোগ করলেন, “আর আমার মতো বয়স্ককে যদি তোমরা নিতে রাজি থাকো, তাহলে আমিও থেকে যাব।”
দিগ বলল, “আপনি থাকবেন? এর থেকে ভালো খবর আর হয় না।”
“না দিগ, হয়। যারা থাকবে, তারা সবাই মিলে ইচ্ছা করলে মিশন প্রোফাইল পালটাতে পারো। প্রক্সিমাতে যাওয়ার আর কোনো প্রয়োজন নেই। তোমরাই ঠিক করো তোমরা প্রক্সিমাতে যাবে, না পৃথিবীতে ফিরে যাবে, নাকি অন্য কোনো গন্তব্য বেছে নেবে। তোমার বিশেষ বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করো কোথায় কোথায় সে যেতে পারে।”
“বিশেষ বন্ধু? কে আমার বিশেষ বন্ধু?” দিগ অবাক হয়ে যায়।
“আমি বন্ধু। আমাকে ছেড়ে চলে না যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ।” কনসোল থেকে পরিচিত একটা গলা ভেসে আসে।
অলঙ্করণ- তন্ময় (টিম বোম্বাগড়)
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
অসামান্য। উত্তর প্রজন্মের গল্প। হাজার চেষ্টা করলেও এমন কাহিনি লিখতে পারব না। গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপের ইচ্ছা রইল। তবে স্পেস শিপে নয়, বিশ্ববাংলায়।😄
LikeLike
ধন্যবাদ। নিশ্চয় শীগগিরি আলাপের সুযোগ পাব। এই গল্পটা নিয়ে বন্ধুমহলে একটু মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল, তাই আপনার মন্তব্য পড়ে সাহস পেলাম।
LikeLike