গল্প-চোর- উপাসনা পুরকায়স্থ-বসন্ত ২০২১

উপাসনা পুরকায়স্থর আরো গল্প– ফটিকহেডস্যার, পুনুর পড়াশোনা, কমলাদিঘি

এক

সেবারে পিসির বাড়ি জলগাঁও যাচ্ছিলাম গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে। আমার বাবা খুব সময় সচেতন মানুষ, তাই সময়ের একঘণ্টা আগেই আমরা হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছে গিয়েছি। আমরা বলতে আমি পেলু, মা-বাবা আর ঠাম্মা। মালপত্র নিয়ে আমরা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। স্টেশনের বড়ো ঘড়িতে তখন দুপুর একটা। ট্রেন ছাড়বে দুটো নাগাদ।

ট্রেন ছাড়ার মিনিট কুড়ি আগে ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়াল। অপেক্ষারত যাত্রী যাঁরা এতক্ষণ চুপচাপ জুবুথুবু হয়ে বসে ছিলেন, তাঁরা ধুপধাপ ওঠে দাঁড়ালেন। শুরু হয়ে গেল হৈ-হট্টগোল, ছোটাছুটি আর হাঁকডাক। হৈ-হট্টগোল একটু থিতু হয়ে আসতে আমরা আমাদের তিন শয্যা বিশিষ্ট রিজার্ভেশন কামরাটিকে খুঁজে নিয়ে ট্রেনে পা রাখতে যাব, বাড়ির পুরোনো কাজের লোক হরেনকাকু ছুটতে ছুটতে স্টেশনে এসে হাজির। মাকে বলল, “বৌদি, ওটা ধরো। তাড়াহুড়োতে বানানো খাবার সব ফেলে রেখে চলে এলে! ব্যাগে ভরে নাও, রাস্তায় কাজে দেবে। এতটা তো পথ, কাকিমা তো আবার কেনা খাবার মুখে নেবে না।”

আমার মা খাবার ভর্তি কাপড়ের থলেটা হরেনকাকুর হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে নিল। বাবা দুটো বিস্কুটের প্যাকেট আর দুটো মশলা চিপসের প্যাকেট কিনে এনে তাতে যোগ করল।

ঠাম্মা বলল, “ওটা একটা কাজের কাজ করলি রে হরে। এই গাড়ির খাবার, ইসটিশানের খাবার মুখে তুলতে পারিনে। আমিষ-নিরিমিষ ওসব ছোঁয়াছুঁয়ি মান্যি কি আর ওসবে থাকে!”

হরেনকাকুর মুখে খুশির হাসি। এতদিন ধরে আমাদের বাড়ি কাজ করে করে ঠাম্মার আমিষ-নিরিমিষ ওসব ছোঁয়াছুঁয়ি বাতিকের কথা কাকু ভালোই জেনে গেছে। মা-বাবার হাত থেকে ক’টা মালপত্র নিজের হাতে নিয়ে নিল হরেনকাকু। ট্রেনে উঠে পড়লাম। আর হরেনকাকু জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রেখে দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে ও-পাশে জানালায় মুখ রেখে দাঁড়াল।  আমি আমাদের নিজেদের আসনগুলো থেকে বেছে বেছে জানালার পাশের একটি আসন নিয়ে বসে পড়লাম। ট্রেনে চেপে কোথাও বেড়াতে গেলে বরাবর জানালার ধারটি পেলেই আমি সবচেয়ে বেশি খুশি। একের পর এক কত কী ছবি ফুটে ওঠে এইটুকুনি এক চারকোনা পর্দায়!

হরেনকাকু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিল, গাড়ির ভেতরে বসে বসে আমিও। আমাদের সহযাত্রী চারজনের দুজন মহিলা আর দুটি ছয়-সাত বছরের বাচ্চা ছেলে। মহিলা দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলেছেন অবিরাম। বাচ্চাদুটো এ-পাশে ও-পাশে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। আর প্রায় সমবয়সী দুজন তরুণ মালপত্রসব গুছিয়ে রাখছিলেন। দুটো সুটকেস, দুটো ব্যাগ, একটা বড়ো স্টিলের ট্রাঙ্ক। ক’টা সিটের তলায় ঢুকল, হালকাগুলো বেছে বেছে উপরে। স্টিলের ট্রাঙ্কটিকে বাঁদিকের সিটের তলায় ঠেলে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলেন। আমাদের মালপত্রগুলো তো হরেনকাকু আগেই গুছিয়ে রেখে দিয়েছিল, তাই ওদের কাজকর্ম দেখছিলাম বসে বসে। মালপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে তরুণ দুজন রুমালে হাত মুছতে মুছতে পাশের কামারায় চলে গেলেন। ওঁদের আসন বুঝি পাশের কামারায় পড়েছে।

স্টেশন পেরিয়ে দ্রুতগতিতে ট্রেন ছুটছে। আমার পাশে জানালায় এখন নীলরঙা আকাশ, সোনারঙা রোদ্দুর, সবুজ মাঠ, ধানক্ষেত—সুন্দর দৃশ্য!

বাচ্চাছেলে দুটোর হাতে দুটো ক্যাডবেরি, আর তাই নিয়ে দুজনে ভারি ব্যস্ত। পাশাপাশি বসে একনাগাড়ে চেটে যাচ্ছে, যেন প্রতিযোগিতা আর কী! মাঝে মাঝে আবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখছে। ঠাম্মা পানের কৌটো খুলে সযত্নে চুন সুপুরি আর মশলাতে সাজিয়ে এক খিলি পান মুখে পুরল। সেই ছোট্টটি থেকেই আমি শান্ত স্বভাবের, একটু চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করি। মায়ের হাত ব্যাগে করে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নালক’ বইটি নিয়ে এসেছিলাম, ওটির অর্ধেকটা পড়া হয়েছে আমার। ইচ্ছে, ভ্রমণের আনন্দের সঙ্গে অবসর পেলে এর আনন্দও লুটে নেওয়া যাবে। তাই সেটি পাশে রেখে চুপচাপ বসে ছিলাম আর মাঝে মাঝে বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম।

মুখে পান পুরতেই ঠাম্মার যেন মুখ খুলে গেল। পান চিবোতে চিবোতে উলটোদিকে বসা মহিলাদের জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের নাম কী মা? কোথায় যাবে?”

মহিলাদের একজন উলটোদিকের আসনে বাঁদিকে বসা, কোঁকড়ানো চুল, হলদে শাড়ি, ফর্সা গায়ের রঙ, বললেন, “আমরা দুই বোন। আমি গায়ত্রী, ও গীতা। আমি ছোটো, ও বড়ো।  যাচ্ছি জলগাঁও, আমাদের ভাইপোর বিয়েতে।”

ঠাম্মা আবার বলল, “তা বাচ্চাদুটো…”

গায়ত্রী বললেন, “বাঁ-পাশের ছোটোটি আমার, রাজু। ডান পাশেরটি দিদির, রঞ্জু। আর এতক্ষণ যারা মালপত্র গুছোচ্ছিলেন, তার সবুজ শার্ট চশমা চোখে বাবুটি আমার বর আর সাদা টি-শার্ট ওর বর।”

ক্যাডবেরি শেষ। মুখে হাতে ক্যাডবেরির আঠা মেখে এরা এখন একে অপরের চুলের মুঠি ধরে টানছে। গীতাকাকিমা তাতে ঠাম্মার দিকে তাকিয়ে একটু সলজ্জ হেসে বললেন, “দেখুন এদের কাণ্ড! বড়োটি সাত আর ছোটোটির ছয় হল।  বিচ্ছু আর কাকে বলে! আপনাদেরটি কত ঠান্ডা, চুপচাপ।”

ঠাম্মার মুখে গর্বের হাসি। “এ আমার নাতি পেলু। এর কোনো জ্বালা-যন্ত্রণা নেই। সেই ছোট্টটি থেকে বই হাতে দিলেই একেবারে যেন মহাদেব। আর এরা তো আমার পেলুর চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো।  একটু বড়ো হলে ঠিক হয়ে যাবে মা, ভেবো না।”

আমি ভাবছিলাম, এরা তো আমার চেয়ে ছয়-সাত বছরের ছোটো হবে বুঝি। ক্লাশ এইটে পড়ছি এখন, আমার কি আর ওসব পাগলামো সাজে!

দুই

ট্রেন ছুটছে খড়গপুর টাটা জংশন ছাড়িয়ে। আমি জানালার পাশে কোলে আধখোলা বই রেখে দৃশ্য দেখতে থাকি। আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখলাম রাজু-রঞ্জু একজন আরেকজনের গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে, টাচ ফোনে ভিডিও গেম খেলছে। এরই মধ্যে দেখি, গীতা ও গায়ত্রীকাকিমার চোখে চোখে কী যেন কথা হল, আর তারপরই দুজনে মিলে সিটের তলা থেকে স্টিলের ট্রাঙ্কটির হ্যান্ডেল ধরে টানতে টানতে বের করে আনলেন। ট্রাঙ্ক বেরোলে গায়ত্রীকাকিমা তাঁর হাত ব্যাগের ভেতর থেকে চাবি বের করে ওতে লাগানো মাঝারি আকারের তালাটি খুলে ফেললেন। ট্রাঙ্কের ঢাকনা খুলতেই ওমা, চোখদুটো আমার অজান্তেই ওর ভেতরে কী করে যেন সেঁধিয়ে গেল! আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, ওর ভেতরে ঢাকনা দেওয়া দুটো বড়ো বড়ো মাটির হাঁড়ি! আর অসংখ্য ছোটো মাঝারি সাইজের হাঁড়ি এদিক ওদিক, একের ওপরে আরেক বসানো। অপরিসীম বিস্ময়ে আমার চোখদুটো কপালে! ভাবছিলাম ওগুলো কীসের হাঁড়ি কে জানে! বাচ্চাদুটো মোবাইল ছেড়ে এবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ট্রাঙ্কের উপর। ওদের সামলাতে গিয়ে কাকিমারা হিমশিম। গীতাকাকিমা চিৎকার করে ডাকলেন, “এই যে, এদিকে একটু এসো তো তোমরা।”

দুই কাকু হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। ওঁরা এসেই বাচ্চাদুটোকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। গীতাকাকিমা অন্য একটা ব্যাগ খুলে বের করলেন কাগজের প্লেট, কাঠের হাতা, আচারের বয়াম, লেবুর টুকরো ওসব। একটা বড়ো হাঁড়ির ঢাকনা সরিয়ে ফেলতেই আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! এত হাঁড়ি ভর্তি চিকেন বিরিয়ানি! ঘি, গরম মশলা ও জাফরানের গন্ধে চারদিক ম ম করতে লাগলো। হাতা ভর্তি বিরিয়ানি সকলের পাতানো প্লেটে তুলে দিচ্ছিলেন গায়ত্রীকাকিমা। সঙ্গে কষা মাংস, আচার আর লেবুর টুকরো। দেখছিলাম, বাকি হাঁড়িগুলোতেও ভর্তি কেবল মাছভাজা আর কষা মাংস। বাচ্চাগুলো সিটের ওপর প্লেট রেখে গপাগপ মুখে পুরছে। এবারে আমার দিকে চোখ পড়তেই গায়ত্রীকাকিমা বললেন, “খাবে বাবা একটু? এই প্লেটে করে দিই?”

আমি সবেগে মাথা নাড়ি, “না না, এখন খাব না। খিদে পায়নি আমার।”

আসলে মা-ঠাম্মারা তো সেই কতকাল থেকে বারণ করে আসছে, অচেনা কারোর দেওয়া খাবার কখনো খাবে না, বিশেষ করে রেলগাড়ি করে কোথাও ভ্রমণে বেরোলে। পত্রপত্রিকায় রোজকার খবরে অমন কত কী চোখে পড়ে, ‘বিষ মেশানো খাবার খাইয়ে ট্রেনে সর্বস্ব লুট’, তাই আমি অতি সাবধান হয়ে পড়ি।

আমি ঠাম্মার দিকে তাকাতেই ঠাম্মা যোগ করল, “না না, ও ওসব এখন খাবে না।  ভাতের এঁটো, তায় মাছ-মাংস…”

ঠাম্মা তো এঁটো নিয়েই পড়ে আছে! আমি দেখছিলাম, ও-পাশে একেবারে কোণের দিকে ঠাম্মা জড়সড় হয়ে বসে। ভাতের এঁটো, মাংস, মাছ ছোঁয়াছুঁয়ি, ঠাম্মার কান্নামাখা আমসি মুখ। মা-বাবা ও-পাশের দুই শয্যার আসনটিতে পাশাপাশি জানালা-মুখো হয়ে বসা। ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে কষা মাংসের হাঁড়ি বের করে কাকিমা যখন পরিবেশন করছিলেন, আমার জিভে জল এসে পড়েছে। কষা মাংস যে আমার বড্ড প্রিয়! মা তো সবই জানে। মা বলল, “তুমি তবে রুটি-আলুর দম খেয়ে নাও পেলু, হরেন দিয়ে গেছে।”

আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নেড়ে বলি, “না না, ভাত খেয়ে তো বেরিয়েছি! আমার খিদে পায়নি এখন।”

ঠাম্মা বলল, “ওরে, তবে চিপস খা, বিস্কিট খা!”

আমি বলি, “না গো, এখন নয়। চুপ করো তো তুমি।”

ওঁরা সকলে মাথা নীচু করে খাবারে নিবিষ্ট। দুই কাকু খাবারের প্লেট হাতে করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন। চিকেনের লেগ পিস থেকে দাঁতে কেটে মাংস ছাড়াতে ছাড়াতে রাজু-রঞ্জু হাসছে, তৃপ্তির হাসি। ঠাম্মা সবার অলক্ষ্যে ও-পাশে বসা মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় ওদেরকে দেখালেন। তারপর ডানহাতে মুখ আড়াল করে ফিসফিসিয়ে বলল, “আইঠা, সব আইঠা করে ছাড়লে।”

ওদের খাওয়া শেষ। একে একে বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে এলো সকলে। তারপর বসল ফল নিয়ে। গায়ত্রীকাকিমা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট খুলে একগাদা আঙুর ঢেলে দিলেন পাতানো খবরের কাগজে। বাচ্চাদুটো ক’টা করে হাতে নিচ্ছে, তার দুটো মুখে পুরছে আর দুটো দিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলছে। গীতাকাকিমার সস্নেহ ধমক, “এ্যঁ এ্যঁ, একদম না। নষ্ট করতে নেই বাবা।”

তিন

জানালার ও-পারে দূরের দিকে তাকাতেই একঝাঁক চিল ডানা মেলল আকাশে। ঝিকিমিকি রোদ্দুর, পরিষ্কার আকাশে হাওয়ায় ভাসছে লাল-নীল-হলদে ক’টা ঘুড়ি। ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠল কু-ঝিক-ঝিক-ঝিক। এঁকে-বেঁকে সর্পিল ভঙ্গিতে পথ চলেছে সে। এখন জানালায় বসে মুখ বাড়িয়ে দূরে গাড়ির দেহটাকে দেখতে পাচ্ছি। সার সার লাল রঙের ক’টা বাড়ি, বুঝি রেলবাবুদের সরকারি আবাসস্থল। আবাসস্থল ছাড়িয়ে  ছাতিমগাছ, ধানমাঠ।

এদিকে তাকাতে দেখি ময়লা কালো রঙ হাফ প্যান্ট ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে রোগা হাড়-জিরজিরে আনুমানিক বছর বারো-তেরোর একটি ছেলে ঝাড়ু হাতে মলিন মুখে ঠাম্মার ও-পাশে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর বলল, “ঝাঁট দেব কাকিমা?”

গায়ত্রীকাকিমা একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বুঝি একটু রেগে গিয়েই বললেন, “ঝাঁট দেব, ঝাঁট দেব! দাঁড়া একটু, খাওয়া শেষ হোক তো আগে!”

ছেলেটি বাঁ-হাতে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, “আমায় একটু খেতে দেবে মাসি? কতদিন পেট ভরে খাইনি। বিরিয়ানি আর মাংস বুঝি?”

গায়ত্রীকাকিমা ভুরু কুঁচকে বললেন, “যা এখান থেকে! খাবার দেখে অমনি জিভে জল এসে গেল—খাইনি।” কথা ক’টা বলেই তাড়াতাড়ি ট্রাঙ্কের ভেতর হাঁ-করা আধখাওয়া বিরিয়ানি এবং কষা মাংসের হাঁড়ি দুটোতে ঢাকনা চাপা দিলেন আগে। তারপর বললেন, “একটু পরে আয় ঝাঁট দিতে হলে।”

ছেলেটি তবু নড়ে না, দাঁড়িয়েই রইল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখতে থাকল। দুই কাকু মিলে ধরাধরি করে ট্রাঙ্কটিকে সিটের তলায় ঢুকিয়ে দিতে মেঝেতে একপাশে জমিয়ে রাখা এঁটো থালাগুলো নিয়ে ছেলেটি কোথায় যেন চলে গেল। তারপর ফিরে এসে ঝাঁট দিয়ে মেঝেটাকে পরিষ্কার করতে লাগল। আমি দেখছিলাম, ঝাঁট দিতে দিতে নীচে পড়ে থাকা আঙুরগুলো তুলে তুলে সে বাঁ-হাতে জামার পকেটে পুরছে। আর পায়ে চাপা থেতলানোগুলো চটপট মুখে চালান করছে।

ঝাঁট দেওয়া শেষ করেই ও হাত পেতে দাঁড়াল। গীতাকাকিমা হাত ব্যাগের চেইন খুলে দুটো পয়সা বের করে ওর হাতে ফেলতেই ও নীরবে অন্যদিকে চলে গেল।

খানিকবাদে ট্রেন চক্রধরপুর স্টেশনে দাঁড়াতে প্রথমে ঠাম্মা ও বাবা, তারপর আমি ও মা গিয়ে বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে এলাম। খবরের কাগজ টুকরো করে থালা বানিয়ে তাতে দুটো করে রুটি আর আলুর দম নিয়ে খেয়ে আমরা টিফিন সারলাম।

ট্রেন এখন একটি একটি করে স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত গতিতে। জানালার বাইরে ধীরে ধীরে সূর্য অস্ত গিয়ে দূরের ধানমাঠ আবছা অন্ধকারে ডুবে গেল। ট্রেনে আলো জ্বলে উঠতে আমার উলটোদিকে বসে রাজু-রঞ্জু লুডো বোর্ড পেতে ফেলল। আমি ‘নালক’-এর গল্পে ডুব দিলাম।

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ আবারও একবার খাওয়াদাওয়ার পর্ব ওদের, তারপর আমাদের। এবারে রাজু-রঞ্জু বায়না করাতে ওঁরা লুচি আর ঘুগনি কিনে এনে খেলেন। খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকে যেতে ফের ঝাড়ু হাতে সেই ছেলেটি কোথা থেকে যেন এসে হাজির। আগের বারের মতোই ঝাঁট-পাট শেষ করে পয়সা নিল সে, তারপর চলে গেল।

ভাবছিলাম, পরদিন দুপুর হবে হয়তো পৌঁছতে পৌঁছতে। রাতটুকু ভালো করে ঘুমিয়ে নিলে পরদিন জানালায় ভোরের ছবিগুলো একেবারে অন্যরকম। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সূর্য ওঠার বর্ণময় দৃশ্য সোনালি আলোয় মাঠঘাট হবে একেবারে এক রূপকথার জগৎ!

লুচির শেষ টুকরোটা ঘুগনি মাখিয়ে মুখে পুরতে পুরতে গায়ত্রীকাকিমা বলছিলেন, “বাচ্চাদুটোর কথায় লুচি-ঘুগনি তো হল! এবারে হাঁড়িগুলোতে অতসব খাবার আবার নষ্ট হয়ে গেলে মুসকিল!”

গীতাকাকিমা উত্তরে বললেন, “না না, নষ্ট হবে কেন! আরো অতটা রাস্তা, পরে কাজে লাগবে। আর নষ্ট যাতে না হয় তার কথা ভেবেই তো এই মাটির হাঁড়ি আর কষা মাংস নিয়ে আসা। মাটির হাঁড়ি তো একেবারে ফ্রিজেরই কাজ করে, আর কষা মাংস এক হপ্তা অবধি কিছুই হয় না।”

রাত সাড়ে দশটার পর বিছানা পেতে, আলো নিভিয়ে সকলেই শুয়ে পড়লাম। ও-পাশের বার্থদুটোতে বাবা উপরেরটাতে, মা নীচেরটাতে। আমি আর ঠাম্মা দুজনেই নীচে। কাকিমা দুজন আর বাচ্চদুটো উপরে আর মাঝের দুটোতে।

চার

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কখন জানি না। কিন্তু তখন কত রাত কে জানে, কিছু একটা ঘষটানোর মতো আওয়াজ কানে আসতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। একেবারে কাঁচা ঘুম ভেঙে গিয়ে, চোখদুটো জ্বালা জ্বালা করছিল। ট্রেন এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে জানি না। কামরার ভেতরকার মৃদু আলোয় যা দেখেছিলাম, তাতে আমার গোটা শরীর জুড়ে যেন বৈদ্যুতিক শিহরন! আমার বার্থের নীচে রাখা ওঁদের সেই খাবারের ট্রাঙ্কটির দুই মাথার হ্যান্ডেল ধরে দুটো ছেলে ধীর লয়ে টানছে। ডিম লাইটের আলোয় দেখলাম, ওদের দুজনেরই পরনে হাফ প্যান্ট। মাথা নীচু করে বার্থের তলার দিকে ঝুঁকে রয়েছে। ঘুম ভেঙে এ দৃশ্য দেখে ভয়ে ভাবনায় আমার শরীর একেবারে কাঠ! এ কী দেখছি আমি! এরা কারা অমন রাতে! আমার শরীরটা বুঝি আমার অজান্তেই একটু নড়ে ওঠল, আর দুই ছায়ামূর্তি একসঙ্গে ওদের মুখ তুলল। ঘুমের আবেশ বুঝি খানিকটা কেটে গেল আমার। আড়চোখে তাকাতে আমি হতবাক! এমা, দুই ছায়ামূর্তির একজনকে তো আমার কেমন যেন চেনা চেনা বলে বোধ হচ্ছে! আর অন্যজনকে কোথাও দেখেছি কী? কিছু মনে আসছে না। আমার মাথা, গা, হাত-পা সব ঘামে ভিজে ওঠেছে এরই মধ্যে। হে ভগবান, কী করি এখন!

রূপকথার দেশের ঘুমপুরী এ কামরায় একটি টিকটিকিও বুঝি এখন জেগে নেই। কেবল কিছু নাক ডাকার বিচিত্র আওয়াজ থেকে থেকে জেগে ওঠছে। একবার ভাবছি চিৎকার করে সবাইকে জাগিয়ে দিই। চিৎকার জুড়ে দিলে বাছাধনরা পালাবার পথ পাবে না, সবাই মিলে ধরে ফেলব। শাস্তি হোক ওদের। ঠাম্মার বলা সেই ‘কুটুম্ব’ গল্পের মতো। মাথা ন্যাড়া করে, ঘোল ঢেলে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সারা দেশ ঘুরিয়ে এনে তবে নিষ্কৃতি। সবাই জানুক ওরা কত নোংরা কাজ করতে এসেছিল এখানে। এইটুকু দুটো বাচ্চা ছেলে, কেমন চুরিবিদ্যা শিখেছে!

ক’টা মুহূর্ত, এরই মধ্যে ঘষটে ঘষটে ট্রাঙ্কটিকে ওরা বের করে ফেলেছে প্রায়। কতগুলো এলোমেলো ভাবনা আমার মাথাটাকে এখন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কী মনে হতে মনে সাহস সঞ্চয় করে চুপ করে মটকা মেরে পড়ে থাকি। ছেলেদুটো এখন ট্রাঙ্কটির দু-পাশের দুটো হ্যান্ডেল ধরে ঝুলিয়ে নিঃশব্দে গুটি গুটি পায়ে কামারা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আবছা আলোয় ওদের পা দুটো দেখতে পেলাম। পায়ে জুতো নেই, খালি পা। তাতেই বুঝি একবিন্দু শব্দ পর্যন্ত হল না!

বাকি রাতটুকু ভয়ে আর কী এক ভাবনায় ছটফট করতে করতে না ঘুমিয়েই কেটে গেল আমার। ভোর হতে না হতে একে একে অনেকেই ওঠে বসেছে। রাজু-রঞ্জু ব্রাশ হাতে চলল। আমিও উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে বসে পড়লুম। পুব আকাশে লাল সূর্য আবির ছড়াচ্ছে এখন। চড়ুই-শালিক পাখিদের গলায় কিচিরমিচির কানে আসছে। ভাদ্র মাস। তবু গতকাল রাতে বুঝি বৃষ্টি হয়েছে খানিক। গাছপালা, পাতা-লতা সূর্যালোক আর বৃষ্টি গায়ে মেখে চিকমিক চিকমিক করছে। ট্রেন চলছে ঢিমেতালে।

আমি জানালায় বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে গতরাত্রের ঘটনা নিয়ে আকাশপাতাল ভাবছিলাম কেবল। পাতানো বিছানা গুটিয়ে ফেলতে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র এদিক ওদিক করছিলেন গায়ত্রীকাকিমা। হঠাৎ করে বুঝি নজরে এল ও-পাশে সিটের তলাটা ফাঁকা, ট্রাঙ্কটা নেই সেখানে। আর তারপরই শুরু হল খোঁজাখুঁজি আর চিৎকার চেঁচামেচি—যাকে বলে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড! হৈচৈ শুনে দুই কাকুও ঘুম ভেঙে ছুটে এলেন, তন্ন তন্ন করে খুঁজে চললেন সকলে মিলে। নাহ্‌, নেই কোথাও। গীতাকাকিমা বলছিলেন, “ইস, বড্ড ক্ষতি হয়ে গেল গো আমাদের!”

ওদের হৈ-হট্টগোল, ‘চোর চোর’ চিৎকার সবই আমি শুনছি। শুনেও না শোনার ভান করে বসে আছি। আমার মা-বাবার হতবাক চাউনি, চোরেদের উদ্দেশ্যে ঠাম্মার কটুক্তি, সবই আড়চোখে দেখছিলাম এবং শুনছিলাম। কিন্তু তাতেও আমার মুখে টুঁ শব্দটি নেই।

অমন নির্বিকার বসে থাকতে দেখেই কি না কে জানে, গায়ত্রীকাকিমার চোখ গেল আমার দিকে। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা পেলু, তোমার বিছানার তলা থেকে অত বড়ো একটা ট্রাঙ্ক টেনে বের করল, তারপরও তুমি টের পাওনি?”

প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিয়েই ব্যস্তসমস্ত কাকিমা আবার একটি বিছানার চাদরকে দু-হাতে ঝেড়েঝুড়ে টানটান আর পরিপাটি করে ভাঁজ করতে লাগলেন।

বুঝতেও পারিনি চোখের কোল বেয়ে কখন যেন ফোঁটা ফোঁটা জল গড়াচ্ছিল। কাকিমার প্রশ্নের জবাবে চুপ করেই রইলাম, হ্যাঁ-না কিছুই বলতে পারলাম না। গায়ত্রীকাকিমা প্রশ্ন ভুলে জলের বোতল হাতে রাজু-রঞ্জুকে জল খাওয়ানোর কাজে ব্যস্ত হলেন।

আমার চোখের কোলে গড়ানো জলটুকু মা-ই বুঝি কেবল দেখতে পেয়েছিল, মা তো সবই দেখতে পায়। মায়ের জিজ্ঞাসা, “তোর চোখে জল কেন রে পেলু?”

বললাম, “জানি না মা।”

কী বলব মাকে! মাকে অবশ্য সত্যিটা বললে ভয়ের কিছু নেই। মা আমার মুখ-চোখ দেখে আন্দাজে সব বুঝে নিয়েছে কি?

আমার চোখের পর্দায় যে কেবলই ভেসে উঠছিল মাঝরাতে আবছা আলোয় দেখা সেই ছায়ামূর্তি ছেলেটির মুখ, দুপুরবেলা ঝাড়ু দিতে দিতে যে মেঝেয় পড়ে থাকা পায়ে চাপা থেতলানো আঙুরগুলো তুলে তুলে মুখে পুরছিল!

অলঙ্করণ-সৃজন কাঞ্জিলাল

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s