সেদিন রোগী দেখে ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়েছে। বুড়িকিয়ারির মাঠে এসে ঠাকুরদা যখন পৌঁছালেন তখন আঁধার সবকিছুকে ঢেকে দিয়েছে। চেনা রাস্তা বলে ঠাকুরদার সাইকেল চালাতে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি। বুড়িকিয়ারির মাঠের দু-পাশে ধানক্ষেত ধাপে ধাপে নীচে নেমে গেছে। ধানক্ষেতের জল এক ক্ষেত থেকে আরেক ক্ষেতে এসে পড়ছে। দূর থেকেই জলের কুল কুল শব্দ কানে আসছে। ওই বয়ে যাওয়া জলের মুখে ঘুগি পেতে অনেকে মাছ ধরে। ঘুগির মধ্যে একবার মাছ ঢুকে গেলে আর বেরোতে পারে না।
ধানক্ষেতের উপরে রয়েছে দুটো বড়ো পুকুর, গড়িতা আর সায়ের। সেই পুকুরের জল এসে পড়ছে ধান জমিতে। সঙ্গে রুই-কাতলা-ট্যাংরার দলও মহা আনন্দে ভেসে আসছে। দূর থেকেই ঠাকুরদা আন্দাজ করছেন সেইসব মাছের দল সোজা গিয়ে পড়ছে ঘুগির মধ্যে।
সাইকেলে ঠেস দিয়ে তিনি ধানক্ষেতের উপর আবছা অন্ধকারে চোখ চালালেন। ঝিঁঝিঁদের একটানা ডাক আর ব্যাঙের কলতান শোনা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কখন হালকা চাঁদের আলো এসে পড়েছে ধানগাছের মাথায়।
ঠাকুরদা সাইকেল রখে হেঁটে হেঁটে ঘাসজমি পেরিয়ে ধানক্ষেতের আলে এসে দাঁড়ালেন। এসময় ক্ষেতের আলে কাশফুলের মেলা বসে যায়। হালকা কুয়াশা আর মায়াবী চাঁদের আলোয় কাশফুলগুলিকে মনে হচ্ছে সাদা মেঘের দল। মৃদু হাওয়াতে কাশবনে দোলা লেগে সমুদ্রের ফেনা তটে এসে যেভাবে আছড়ে পড়ে, সেরকম একে অপরের গায়ে আছড়ে পড়ছে।
সেই কাশবনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সহদেব। সহদেব একজন নামকরা মাছাল। কাছাকাছি পাঁচ-সাতটা গ্রামে মাছাল হিসাবে তার বেশ নামডাক। ভরা পুকুরের জলে কোথায় মাছের ঝাঁক খেলে বেড়ায় সহদেব তা এক লহমায় বলে দিতে পারে। জল থেকে উঠে আসা বুদ্বুদ্ দেখেই সে বলে দিতে পারে ওখানে কী মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুঁটিমাছ ধরার ছোট্ট ছিপ দিয়ে সহদেব একবার একটা পাঁচ কেজি ওজনের কাতলা মাছ ডাঙায় এনে ফেলেছিল। ওস্তাদ মাছাল না হলে এটা পারা যায় না। অবশ্য এসব তো আর একদিনে হয়নি। খুব ছোটবেলায় সহদেব শুনেছিল, ‘মৎস্য ধরিব খাইব সুখে…’। ব্যস, ওই একটিমাত্র বাক্য ধরেই তার সারাজীবনের পথ চলা। শোনা যায়, সহদেব মাছ ধরার নেশায় কয়লা খাদানের চাকরি ছেড়ে দেয়।
তবে সহদেব সে-বার বড়ো বিপদে পড়ে যায়। গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে দেলবাঁধ। দেলবাঁধের পাড়ে অনেকদিনের পুরোনো একটি ভাঙা দেউল রয়েছে। সেই দেউল থেকেই পুকুরের নাম দেলবাঁধ। গ্রাম থেকে দেলবাঁধ বেশ দূরে হওয়ার কারণে লোকজনের যাওয়া আসা নেই বললেই চলে। তাছাড়া দেলবাঁধের জলে নামারও উপায় নেই। এক মানুষ সমান কাঁটা ঘাস, বুনো পানিফল আর ঘন দাম জলকে ঢেকে রাখে। কেউ সাঁতার কাটতে জলে নামলেই সেগুলোতে আটকে যায়। তাই দেলবাঁধে কেউ স্নান করতেও যায় না।
সে-বার ঠিক ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সহদেব হুইল ছিপ, থেঁতো করা রসুন, উইপোকার মাটি, পিঁপড়ের ডিম ইত্যাদি দিয়ে বানানো খাবার নিয়ে দেলবাঁধে গিয়ে হাজির হল। বাঁধে ছিপ ফেলার জন্য নির্দিষ্ট কোনও ঘাট নেই। তার মধ্যেই সহদেব পাঁচ-কাঁটাওয়ালা টোপে কেঁচো গেঁথে ঝপাং করে জলে ছুড়ে, মাছের জন্য বানানো খাবার ছড়িয়ে দিল টোপের চারপাশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশাল এক রুই টোপে গেঁথে গেল। ছিপে বাঁধা হুইল বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে সুতোয় টান পড়ল। টোপে গাঁথা মাছ চলে গেল মাঝ-পুকুরে। জলে থাকার দরুন মাছের শক্তিও কম নয়। সহদেব শক্ত করে ছিপ ধরে থাকল। কিন্তু মাছটাও কম যায় না। সেটা জলের মধ্যে ভেলকিবাজি দেখাতে লাগল। কখনও বামদিকে কখনও ডানদিকে সাঁই সাঁই করে পাক খেতে লাগল। সহদেব এত বড়ো মাছের লোভ সামলাতে পারল না। ছিপটাকে ধরে সেও মাছের সঙ্গে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে লাগল। পানিফলের কাঁটা পায়ে বিঁধছে। ঘন দাম দু-পাশ থেকে চেপে আসছে। তবুও তার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। এত বড়ো মাছটাকে পালিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। তারপর…
ঠাকুরদা সহদেবকে বেশ ভালো করেই চেনেন এবং এও জানেন যে যেখানে সহদেব সেখানেই মাছ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঠাকুরদা সহদেবের কাণ্ডকারখানা দেখতে এগিয়ে গেলেন। কাশবনের পাশেই একটা নালা রয়েছে। উপরের পুকুর থেকে ওই নালা বেয়ে জল এসে ক্ষেতে পড়ছে। ঠিক নালার মুখেই সহদেবের ‘সিহড়া’ পাতা রয়েছে। সিহড়ার শেষপ্রান্ত মিশেছে লম্বা চোঙার মতো একটা বড়ো ঘুগিতে। সিহড়ার উপর একবার কোনও মাছ এসে পড়লে আর রক্ষে নেই। সহদেব এমনভাবে ফাঁদ পেতেছে যে মাছ গিয়ে পড়ছে সোজা ঘুগির মধ্যে।
সহদেব ডাক্তারবাবুকে দেখে মুচকি হাসল। ডাক্তারবাবুর চোখ রয়েছে ঘুগির দিকে। সেটা লক্ষ করে সহদেব বলল, “কেজি পাঁচেক হালি-পোনা ঘুগির মধ্যে এমন লাফালাফি শুরু করেছে যে মনে হচ্ছে ফাঁদিটাই না খুলে পড়ে।”
এরপর সহদেব ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে করে আরও এক ধাপ উপরে উঠে এল। সেখানে দু-পাশ দিয়ে দুটো নালা নেমে এসে একসঙ্গে মিশেছে। সহদেবের এলেম আছে বলতে হবে। তিনকোনা জালটাকে সে এমনভাবে বিছিয়ে দিয়েছে যে সেখান থেকে একটা মাছও সহজে পালাতে পারবে না। চাঁদের হালকা আলোয় ঠাকুরদা যা দেখলেন তাতে তাঁর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। জালভর্তি রুই-কাতলা-ট্যাংরা খল খল করছে। সব মিলিয়ে কিলো দশেক তো হবেই। এত মাছ পড়েছে!
“ডাক্তারবাবু আপনার সঙ্গে ঝোলা-টোলা কিছু আছে?”
সহদেবের কথায় ঠাকুরদার ঘোর কাটল। এত মাছ দেখে ঠাকুরদা সবকিছু ভুলে গিয়েছিলেন। অনেক দূরে ফাঁকা মাঠের মাঝে পড়ে রয়েছে তাঁর সাইকেল। সাইকেলের পিছনে ওষুধের ব্যাগ। সেই ব্যাগের মধ্যে একটা বড়ো চটের থলি সবসময় রাখা থাকে। রোগীর বাড়ির লোকজন অনেক সময় ডাক্তারবাবুর ফি দিতে পারে না। কেউ কেউ তার বদলে শাকসবজি, মাছ-টাছ দিয়ে ঝোলা ভরে দেয়। এই কারণেই ঝোলাটা তাঁর ব্যাগের মধ্যেই রাখা ছিল।
হঠাৎ একটা বেশ বড়ো আকারের বোয়াল মাছ সহদেবের জালে এসে পড়ে জাল ছিঁড়ে দেবার উপক্রম করল। জালের অন্যান্য মাছগুলো বোয়াল মাছের দাপাদাপিতে ভেসে না যায় ভেবে ঠাকুরদা নালার জলে নেমে পড়লেন। আর সহদেব ছুটল ডাক্তারবাবুর চটের ঝোলা আনতে। চোখের নিমেষে সহদেব ঠাকুরদার চটের থলি নিয়ে হাজির হল। তারপর দুজনে মিলে যখন জাল খালি করে সমস্ত মাছ মাঠে এনে ফেলল তখন মনে হল একটা মাছের পাহাড় হয়ে গেছে। চাঁদের আলো মাছের পিচ্ছিল আঁশে পড়ে চিকচিক করতে লাগল।
ঠাকুরদা মাছ খেতে খুব পছন্দ করেন। সাইকেলের হ্যান্ডেলে এক থলি মাছ ঝুলছে আর তিনি পাঁই পাঁই করে সাইকেল ছোটাচ্ছেন। তাঁর মেজাজটাও বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে। অনেকদিন এভাবে জল ঘেঁটে মাছ ধরা হয়নি। এতক্ষণ মাছের নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলেন বলে ঘরে ফেরার কথাও ভুলে গিয়েছিলেন।
হঠাৎ ঠাকুরদার খেয়াল হল যে, সহদেব গত বছর ঠিক আজকের দিনেই দেলবাঁধের জলে দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। মাছের লোভে বেচারা বেঘোরে প্রাণটা হারায়। গ্রামের লোকজন যখন তাকে জল থেকে তুলে আনে তখনও তার হাতে ছিপের সুতো আর বিশাল আকারের রুই মাছটা ধরা ছিল। ঘন দামে আটকে যাওয়াতে তার সাঁতারটাও কাজে লাগেনি। অবশ্য কেউ কেউ বলেছিল এটা নাকি মেছোভূতের কাজ। তেনারাই নাকি সহদেবকে জলে ডুবিয়ে মারে। সেই সহদেবের সঙ্গে তিনি আজ এতক্ষণ কাটিয়ে এলেন? একটিবারের জন্যও তো সহদেবের জলে ডুবে মরার কথাটা মাথায় এল না!
থলিভর্তি মাছের দু-একটি তখনও লাফালাফি করছিল। সেদিকে তাকিয়ে ঠাকুরদা ভাবতে লাগলেন, সহদেবটা ভূত হয়েছে বটে। তবে লোক হিসেবে খুব ভালো। তা না হলে এই বাজারে কেউ এক থলি মাছ এমনি এমনি দেয়? তারপরই ঠাকুরদার মনে হল, আরে, সহদেব তো এখন আর লোক নয়। সে তো ভূত। তবে সে একজন ভালো ভূত এবং একজন ভালো মাছাল ভূতও বটে!
ছবিঃ মৌসুমী