জয়তী রায়ের আগের গল্প- চোখ, গজুমামা জিন্দাবাদ, আলোর কৌটো
বিল্টু ছোট্ট পাথর কুড়িয়ে পেল একটা। লালচে। গোল। সাইজ মার্বেলের মতো। প্রশ্ন হল, ফ্ল্যাটবাড়ির মধ্যে পাথর এল কোথা থেকে? এখন বাড়িতে কাজের লোক আসছে না। চব্বিশ ঘণ্টা দরজা বন্ধ। যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিয়ে বাবা বাইরে গিয়ে কিছু কেনাকাটা সেরে আসছে। তারপর সারাদিন অনলাইন কাজ। মা তো আরো ব্যস্ত। দু-মিনিট কথা কইতে গেলেই হল আর কি! চোদ্দবার শুনতে হবে কোভিড নিয়ে হাজার কথা! আচ্ছা! বিল্টু পড়ে ক্লাস ফাইভে। সে জানে না এমন কিছু আছে? অনলাইন ক্লাস চলছে। টিভি চলছে। মানুষের সারাদিন বকরবকর চলছে। বাচ্চাদের কান দুটো সঙ্গে নেই নাকি!
এর মধ্যে হঠাৎ দেখে এই পাথর। এল কোথা থেকে? কে নিয়ে এল? লালচে। আলোয় ধরলে কী একটা ছিটকে আসছে।
মা বলল, “আলো ছিটকে আসছে? পারিস তুই। মাথা খারাপ করিস না। যা।”
বাপি গম্ভীর মুখে বলল, “জ্বালিও না।”
অগত্যা গতি সেই মুনিয়াদিদি। টেলিফোনে দিদি বলল, “ওই আমফানের দিন এসেছে? তোরা টের পাসনি? এক কাজ কর, ছবি তুলে পাঠিয়ে দে।”
আমফান ঝড় খুব মনে আছে বিল্টুর। মনে হচ্ছিল ভেঙে যাবে পৃথিবী। সাংঘাতিক অবস্থা। ফট করে লাইট চলে গেল। জানালাগুলো দমাস দমাস পড়ছে। জল ঢুকছে। ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল কতগুলো বাজে এলিয়েন ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে আসছে। তারপর থেকে ঝড় এলেই ভয় করে। ঘুরে ঘুরে প্রকাণ্ড বেগে দৈত্যের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কালো কালো হানাদার জন্তুর মতো ঝড়কে ভোলা খুব মুশকিল। সেই সময় ছিটকে এল পাথর? কে জানে।
***
রাতে ঘুমোনোর আগে একটা গল্প মা বলবেই। বেশিরভাগ সময় রামায়ণ-মহাভারতের গল্প। কিন্তু এই বিচ্ছিরি ভাইরাস এসে উৎপাত শুরু করার পর থেকে মা কেমন অন্য মানুষ। ‘বিল্টু, যাও শুয়ে পড়ো। লাইট নিভিয়ে দাও।’
ধুর, ভালো লাগে না। আজকাল তবু ওই পাথরটা আছে। ঘর অন্ধকার হলেই মিষ্টি লাল রঙ ছড়িয়ে পড়ে। বিল্টু মুগ্ধ হয়ে দেখে। কে জানে কোথা থেকে, কত দূর থেকে এসেছে! ভাবতে বেশ লাগে। মনে মনে কথা বলে বিল্টু, ‘জানো পাথর ভাই, এখন কারোর মন ভালো নেই। সবাই খুব কষ্টে আছে।’
পাথর চুপ করে শোনে। অন্তত বিল্টুর তেমন মনে হয়। যেন লাল রঙ তিরতির করে কাঁপে। একটু হলুদ আভা দেখা যায়? মনের ভুল! যাক গে। বিল্টুর কল্পনা পাখা মেলে। সে বলে, ‘তুমি এলে কোথা থেকে পাথর ভাই? কেমন সেই জায়গা? বন-জঙ্গল-পাহাড়-নদী এখন ভালো লাগছে না। তাই না? আমার বইয়ের টেবিলে থাকতে ভালো লাগে নাকি! পাথর ভাই, তুমি গল্প করতে পারলে বেশ হত।’
বলতে বলতে তলিয়ে যায় ঘুমের অতলে বিল্টু। এরকম গল্প চলে রোজ রাত্তিরে। পাথর চুপ করে শোনে। বিল্টুর খুব মজা। নতুন এক দুনিয়া গড়ে উঠেছে। বেশ লাগে! তবে কাউকে বলেনি এই কথা। কেন জানি ভিতর থেকে মনে হল, সব কথা সব্বাইকে বলতে নেই। ছোটো হলে কী হবে, সে বুঝে গেছে, এক-এক দুনিয়ার এক-একরকম ভাষা। বড়োদের কত সমস্যা! তাদের আদ্ধেক কথা বিল্টু বুঝতে পারে না। হঠাৎ করে কেন তারা গোমড়া, হঠাৎ করে কেন ধুমধাম ঝগড়া করে আর ঝগড়া করবে তো ভাব কিছুতেই করবে না। একদিন বলছিল রাজা, ‘বুঝলি বিল্টু, বড়োদের মাথায় পোকা আছে। মাঝে মাঝে সেটা নড়ে ওঠে।’
কথাটা শুনে দুই বন্ধু মিলে খুব হেসেছিল সেদিন। আবার এটাও সত্যি, ছোটোদের বেশিরভাগ কথা বড়োদের কানেই ঢোকে না। দোষ দিয়ে আর লাভ কী! সবকিছু কত্ত বদলে গেল মাত্তর ক’টা দিনে। বিল্টু কি বোঝে না? খুব বোঝে। অফিস থেকে বাবাইয়ের হইহই করে ফেরা। মায়ের সুন্দর সুন্দর সাজ। গাড়ি করে লং ড্রাইভ। হাজার সেলফি। কত্ত ফটো। আইসক্রিম। আর স্কুল… ইস। মাঠে দৌড়াদৌড়ি। এখন যেন স্যারদের বকুনি শুনতেও খুব ইচ্ছে করে। খু-উ-ব। এগুলো কাউকে বলা যায়? যায় না। সব কথা কক্ষনো বলতে নেই।
***
পাথর ভাই এসেছে আজ একমাস হল। বিল্টু একটা গোল কৌটো জোগাড় করে তার মধ্যে পাথরটা রেখেছে। মাঝে একবার কী মনে হল, একটু জল দিয়েছিল পাথরের উপর। মনে হল, যেন রেগে গেল। মনে হল, নাকি কেউ মনের মধ্যে ঢুকে কথাটা বলল? কে জানে! বিল্টু তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে ঘষে ঘষে শুকনো করে বলল, “সরি পাথর ভাই, ভুল করে করেছি।”
পাথর কোনো সাড়া দিল না। সেদিন বিল্টুর খুব অভিমান হল। সরি তো বলেইছে। তবে এমন কেন করছে পাথর ভাই?
শুয়ে শুয়ে সে দুঃখের গলায় বলল, “এইটুকুতেই রাগ করলে? জানো, সহ্য করা শিখতে হয়!”
ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো অল্প মনখারাপ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বিল্টু। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে, নাকি জেগে জেগে সে শুনতে পেল কেউ ডাকছে তাকে। মৃদু মিহি সুরে। “বিল্টুকুমার, ওঠো, ওঠো।”
কে ডাকে এই রাতের বেলা? বিল্টু চোখ কচলে দেখে ঘরের মধ্যে আলোর রামধনু খেলা। ঢেউ খেলছে আলোর। ও মা! এত আলো কোথা থেকে এল! বিল্টু দেখে, পাথর ভাইয়ের গোল কৌটো থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো। সে এক্কেবারে মহা অবাক। এ কি ম্যাজিক? কেমন করে হচ্ছে এসব?
বেজে উঠল মিহি গলা, “বিল্টু, ম্যাজিক নয় গো। এ এক অন্য দুনিয়ার কথা। সেই যে তুমি বলো, সবাই সব কথা বোঝে না। সেইরকম আর কী!”
“তুমি কে, পাথর ভাই?”
“আমি হলাম অশ্বথামার মাথার মণি। মণি বলেই আমার অত রঙ। বিশেষ শক্তি আছে আমার।”
“মহাভারতের অশ্বত্থামা?” বিল্টু উত্তেজিত হয়।
“তুমি জানো?”
“জানি, জানি।”
“আমি তাঁর মাথার মণি। তিনি খুব দুঃখী গো। অমর হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শরীর জুড়ে ব্যাধি।”
“একটু বলবে গল্প?”
“মহাবীর দ্রোণাচার্যের পুত্র তিনি। নিজেও মহাবীর। তবে ছোটো থেকেই কেমন এলোমেলো হয়ে গেল জীবন।”
“কেন গো! এলোমেলো মানে কী?”
“ওই যে কেবল তুলনা করা হত। বুঝলে বিল্টু, তুলনা করতে নেই কখনো। অর্জুনের সঙ্গে তুলনা শুনতে শুনতে নিরীহ ছেলেটা ক্রমশ রাগী হতে হতে একসময় কী যে করে বসল… পৃথিবী ধ্বংস করার জন্য মারণ অস্ত্র ছেড়ে দিল। ঠিক তোমাদের ভাইরাসের মতো।”
“ভাইরাসকে কেউ মারতে পারছে না। ওই মারণ না কী বললে, তাকেও কেউ মারতে পারেনি?”
“কে বলেছে পারেনি? শ্রীকৃষ্ণ বাঁচিয়ে দিলেন পৃথিবী। ওই অস্ত্র সংযত করলেন তিনি।”
“করোনা তবে আরো শক্তিশালী। আর আমাদের কৃষ্ণও নেই।”
“বিল্টু, এমন ছলছল চোখ করে না। করোনা একদিন তোমরাই প্রতিরোধ করতে পারবে। কৃষ্ণ নেই কে বলল? তিনি ইচ্ছে হয়ে আছেন বুকের ভিতর।”
বিল্টুর দেখল বাইরের আলো জমাট বাঁধছে। ধীরে ধীরে মূর্তির রূপ নিচ্ছে। কেমন দুলে দুলে সেই আলোর মূর্তি বলল, “বিল্টু, আমি অশ্বত্থামা। এই মণি হল আমার শক্তি। অন্যায় করেছিলাম। তাই কৃষ্ণ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন মণি। খোঁজ পেয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। যত্ন করে গুছিয়ে রাখলে বলেই তো সহজে পেলাম।”
“মণি পেলে তোমার অভিশাপ দূর হয়ে যাবে অশ্বত্থামাকাকু?”
হা হা হা করে হেসে উঠল দোল খাওয়া জেলি মূর্তি। বলল, “চিন্তা কোরো না। মানবজাতির জন্যেও মণি আসবে শিগগির। অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে তোমরাও।”
“আলো আসবে?”
“আলো আসবে।”
অলঙ্করণ- শিমুল সরকার