“মা, আপনি কি তাম্রপত্রটা দেখেছেন?”
একরাশ বাসনের মধ্যে বসে হিমশিম খাচ্ছিল মাধবী।
শোভাদেবীর বোধ হয় একটু ঝিম লেগে গিয়েছিল। মাধবীর গলা পেয়ে চমকে উঠে বললেন, “পাচ্ছ না তো? আমি জানতাম, ঠিক জানতাম একটা কিছু হারাবেই। কাল বিকেল থেকে মনটা আমার কেমন হুশ হুশ করছে। তখনই জানি।”
“উহ্, আপনি আবার শুরু করলেন তো! আপনাকে কিছু বলাই বিপদ।”
“আমি ঠিক বুঝেছিলাম কিছু একটা ঘটবেই। নইলে এই সাত দুপুরে ভুলো আমার গা ঘেঁষে যায়?”
“উহ্ মা, ওটা ভুলো নয়। তিন্নির টেডি বিয়ার।”
“অ্যাঁ, বিয়ার! বিয়ার তো বোতলে থাকে বৌমা, আমি দেখেছি। সে আবার কুকুরের মতো লোমওয়ালা কবে হল?”
“আপনি বিয়ারও জানেন মা!”
“তোমার শ্বশুর লুকিয়ে লুকিয়ে খেত যে আমার শ্বশুরের দেরাজ থেকে চুরি করে এনে।” বলেই শোভাদেবী ফোকলা দাঁতে এমন লজ্জার হাসি হাসলেন যেন নববধূটি।
“এ বিয়ার সে বিয়ার নয় মা। এ বিয়ার মানে ভল্লুক।”
“সে কি! সে কি বৌমা, ভল্লুক এল কোথা থেকে? চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়েছে নাকি?” বলে ধড়মড়িয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন তিনি।
মাধবী তাঁকে হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল, “আপনাকে নিয়ে আর পারা যায় না। ওটা সাবুর খেলনা ভল্লুক, তিন্নি ওকে পুজোয় দিয়েছে।”
“এই এতক্ষণে মনে পড়েছে বৌমা। তুমি তাম্রপত্রের কথা বলছিলে না? ওটা সাবুই সরিয়েছে।”
“কী যে বলেন না আপনি! ওই আট বছরের শিশু সরাবে কিনা এই তাম্রপত্র? ওজনটা কি ভুলে গেছেন তাম্রপত্রের?”
“ও-মেয়ে সব পারে। যা দস্যি! সেদিন ওইটুকুন হাতে পাঁচটা নাড়ু নিয়েছিল।”
“আপনি কী করে দেখলেন? আপনি তো দেখতেই পান না। ছানি পড়েছে তো। শুধু শুধু মেয়েটাকে দুষছেন।”
মাধবী গজ গজ করতে করতে উঠে ভাঁড়ারের দিকে গেল।
এই হয়েছে এক সমস্যা। শাশুড়ির বয়স হয়েছে, কানে শোনেন না, চোখে ছানি, সব কথা আজকাল মনেও রাখতে পারেন না, তবু এমন নিশ্চিত হয়ে ভুল বলে দেবেন যে মাঝে-মাঝেই সবার মাঝখানে মাধবী বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কিন্তু এটাও ঠিক, তাম্রপত্রটা গেল কোথায়? কাল রাতে নবমী পুজোর পরেই সে নিজে লিস্ট মিলিয়ে সব গুছিয়ে রেখেছে। ফল-ফলারি থেকে শুরু করে বাসনপত্র মায় দধিকর্মার দ্রব্যাদি অবধি। দশমীর পুজো শেষ হল। বিকেলে সিঁদুর বরণ করে প্রতিমা বিসর্জন হবে। তার আগে জলভরা তাম্রপত্র রাখতে হবে মায়ের সামনে। সবাই বরণ করে তাতেই তো মায়ের মুখ দর্শন করবে। অনেক বাড়িতে মায়ের মুখ দর্পণে দর্শন হয়, কিন্তু এ-বাড়ির প্রথা মস্ত তাম্রপত্রে জল রাখার। আর সে কি আজকের জিনিস? শাশুড়ির দিদিশাশুড়ির বাপের বাড়ি থেকে তত্ত্বে এসেছিল। যেমন তার ওজন, তেমন তার আয়তন। সাবুর মতো দুটো মেয়ে অনায়াসে তার মধ্যে বসে থাকতে পারে।
হরিমতি ভাঁড়ার ঘরের বারান্দায় বসে ঠাকুরের মাজা বাসনগুলো একটা শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে রাখছিল একপাশে। মাধবী তাকে বলল, “হরি, তাম্রপত্রটা দেখেছিস?”
হরিমতি মাথা না তুলেই বলল, “সে তো কাল রাতে তুমি ভাঁড়ার ঘরের একপাশে গুছিয়ে রেখেছিলে। আমি সকালে ঠাকুর দালানে রেখে এলাম।”
“কিন্তু সেখানে তো নেই।”
“কী বলো? দাঁড়াও, আমি একবার দেখে আসি।”
হরিমতি চলে গেল ঠাকুর দালানে। মাধবী ভাবতে লাগল, এত বড়ো থালাটা কে নেবে? যার তার পক্ষে তো তোলাই সম্ভব নয়। আর নিয়ে করবেটাই-বা কী? আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে হরিমতি ফিরে এল।
“না বৌদি, কোত্থাও দেখতে পেলাম না। তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল লাহা-বাড়ির মায়ের মুখ দেখার শতাব্দীপ্রাচীন তাম্রপত্র হারিয়েছে। বাড়িতে তখন আত্মীয়-অনাত্মীয় মিলে প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক, এছাড়া পাড়ার লোক। সবাই মিলে শুরু হল খোঁজাখুঁজি। মাধবীর ননদের মেয়ে পূর্বী ফরেনসিক নিয়ে পড়াশোনা করছে। সে তো রীতিমতো মাধবীকে গোয়েন্দাদের মতো জেরা করতে শুরু করে দিল। ‘মামিমণি, তুমি থালাটাকে কখন শেষ দেখেছিলে?—হরিমতিমাসিকে কি তুমি ঠাকুর দালানে রাখতে দেখেছিলে?—কোনও লোক বাড়িতে নতুন এসেছে?—কেউ থালাটা সম্বন্ধে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিল?—থালাটার ওজন কত? থালাটার ডায়ামিটার কত?’
উফ্, মাধবীর অবস্থা তো তখন ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি হয়ে উঠল। শেষমেশ একটা পুরোনো ছবি বের হল যাতে থালাটা বেশ ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। নীচে প্রায় দু-ইঞ্চি খুড়ো দেওয়া উঁচু থালা। তাতে টলটল করছে জল।
বেলা বয়ে যাচ্ছে। মাধবী তার কর্তা আর দেওর, জা-কে ডেকে আলোচনায় বসল থালাটা না পাওয়া গেলে বাকি কাজ কীভাবে সারা হবে। এক্ষুনি বাসনের সিন্দুক খুলে দেখা দরকার ওইধরনের কোনও বাসন আর আছে কিনা যাতে এবারের মতো কাজ চালানো যায়।
শোভাদেবী তো কেঁদেকেটে আকুল হচ্ছেন। তাঁকে ঠাকুর দালান থেকে তোলা যায়নি। যতক্ষণ তাম্রপত্র না পাওয়া যাবে ততক্ষণ তিনি উঠবেন না। তিনি তো একই কথা বলে চলেছেন যে সাবুই নিয়েছে। সাবু হরিমতির মেয়ের ঘরের নাতনি। অকাল বিধবা মেয়ে সত্য হরিমতির সঙ্গে এ-বাড়িতেই থাকে। সাবু সত্যর মেয়ে। খুব মিষ্টি মেয়ে সে। মাধবীর বড়ো প্রিয়। একটু আধটু আচার-বিস্কুট চুরি করে খায় বটে, তবে তাতে মাধবীর সায় থাকে ষোলো আনা। কিন্তু তাম্রপত্র নেওয়ার কথা বলাটা তার শাশুড়ির বাড়াবাড়ি। হরিমতি তিরিশ বছরের পুরোনো লোক। সত্যও এ-বাড়িতেই মানুষ। তারা শোভাদেবীর কথায় কিছু মনে করে না। কিন্তু সমস্যা হল, সাবুকে সকালের পর থেকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। হরিমতি, সত্য নানা জায়গায় খুঁজেছে, কোথাও নেই। মাধবীর মনে হচ্ছে মেয়েটা ভয় পেয়েছে, তাই কোথাও লুকিয়ে আছে। সত্য আর হরিমতি কান্নাকাটি করছে। খুব বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা বাড়ির। মাধবীরও আর ভালো লাগছে না। মা দুর্গার কাছে মানত করল সে তাম্রপত্র আর সাবু দুই পাওয়া গেলে সে সামনের বছর মাকে সোনার টিপ দেবে।
দুপুরে যখন খাওয়ার সময় হল তখন তাঁর দুই ছেলে গেল শোভাদেবীকে বুঝিয়ে খেতে নিয়ে আসার জন্য। পিছনে পিছনে নাতনি পূর্বী। মোটাসোটা মানুষ শোভাদেবী। অন্যের সাহায্য ছাড়া উঠতে পারেন না।
অনেক বুঝিয়ে তাকে টেনে তুলতেই বিরাট হৈ-চৈ শুরু হয়ে গেল চারদিকে। পূর্বী দৌড়ে এসে মাধবীকে খবর দিল, তাম্রপত্র পাওয়া গেছে।
“কোথায় পাওয়া গেল রে?”
“দিম্মা চেপে বসে ছিল। শাড়িতে ঢেকে ছিল, তাই কেউ দেখতে পায়নি।”
“সে কি রে? কী কাণ্ড!”
দিম্মা পিঁড়ি ভেবে বসে পড়েছিল। চোখে দেখে না তো। উঠে বলল, তাই ভাবছিলাম এত ঠান্ডা আর বড়ো পিঁড়ি কোথা থেকে এল!”
মাধবী হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সে করজোড়ে মাকে প্রণাম করল। কিন্তু সাবু? সে কোথায়?
বিকেল হতেই বরণ শুরু হবে। সামনে ঐতিহ্যমতো তাম্রপত্রে জল রাখা। এখন আর শোভাদেবী শরীরের কারণে বরণ করতে পারেন না। তাই বড়ো বৌ মাধবী প্রথমে বরণ করবে। মাধবী একরাশ মনখারাপ নিয়ে বরণ করল মাকে। পানপাতা দিয়ে মুখ মোছাতে মোছাতে চোখের জলে মাকে আকুতি জানাল, সাবুকে এনে দাও মা!
বরণ শেষে তাম্রপত্রে মায়ের মুখের ছবি দেখতে গিয়ে মাধবী অবাক। জলে দুর্গার মুখের সঙ্গে এ কার মুখ? তাড়াতাড়ি ঘুরে তাকিয়ে দেখে দুর্গার গলার পাশ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে সাবু। বেচারি ভয়ে ওখানে গিয়ে লুকিয়েছে। অত উঁচুতে সে উঠল কী করে? মাধবী বরণের থালা ছোটো জায়ের হাতে দিয়ে একটা সন্দেশ হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে মূর্তির পিছনে গেল। সেখানে একটা লম্বা টুলের ওপর উঠে বসে আছে ছোট্ট সাবু। মাধবী কাছে গিয়ে হাত বাড়াতেই ঝাঁপিয়ে এল মাধবীর কোলে। মাধবী ওর ফোলা ফোলা গালে সন্দেশটা ঢুকিয়ে দিয়ে একটা বড়ো হামি খেল ওর মুখে।
ছবি-মৌসুমী