এই লেখকের অনূদিত ব্ল্যাকউডের আরো গল্প- নেশা
(Algarnon Blackwood- এর কাহিনি অবলম্বনে. অনুবাদ নন্দিনী দাস চট্টোপাধ্যায়)
“আমার খুড়তুতো বোন আসার কথা, আমি বসছি এখানে। আর তো কোনও কাজ নেই, তোমরা শুয়ে পড়ো গে।”
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ বাড়ির কাজের লোকজনকে তাদের ঘরে শুতে পাঠিয়ে অল্পবয়সি গিন্নিটি অপেক্ষা করতে লাগল। এই নির্জন আবাসে এখন সে একদম একা। কতক্ষণ এভাবে কাটাতে হবে কে জানে!
সময় কাটাতে একটা বই টেনে নিল সে। কিন্তু কিছুতেই মনটা ওই কালো কালো অক্ষরগুলোয় আটকে থাকতে চাইল না। বরং হাতের সেলাইটা নিয়ে বসলে হয়, এই ভেবে সেলাইয়ের বাক্সটা নামিয়ে আনল তাক থেকে। কিন্তু এবারও কাজের কাজ কিছুই হল না। হাত চলবে কী, কান পেতে শুনল যেন একটা মৃদু খসখস শব্দ ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ যেন হেঁটে যাচ্ছে ধীরে সুস্থে। কিন্তু এখানে তো সে একেবারে একা! যতসব মনের ভুল, নিজেকেই মনে মনে চোখ পাকিয়ে বকে দিল সে।
তারপর খানিক ভেবেচিন্তে চিঠির কাগজ টেনে নিয়ে কলম খুলে বসল। কিন্তু মনটা বার বার ছুটে যাচ্ছে বন্ধ দরজাটার দিকে। কাঠের ভারী বন্ধ দরজায় চোখদুটো ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল চিঠির পাতায়। কিন্তু এক লাইনও লেখা এগোল না।
কী মনে করে জানালার খড়খড়ি তুলে বাইরে উঁকি মারল। উত্তর কেনসিংটনের এই অঞ্চলে এত রাতে স্বাভাবিকভাবেই গাড়িঘোড়া কমে এসেছে। খোলা খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে তার মৃদু আওয়াজ গুঞ্জনের মতো চলমান জীবনের হদিশ দিচ্ছে। অবশ্য তাদের দেখা যাচ্ছে না, কেননা ঘন কুয়াশার আড়ালে সবকিছু ঢাকা পড়ে গেছে। রাস্তার টিমটিমে আলোগুলো অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করে ম্লান চোখে জেগে আছে।
ঠিক তখনই দরজার কড়া দুটোর জোরালো শব্দ ঘরের অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্যটাকে ভেঙে দিল। দরজাই আই হোলে চোখ রাখতেই ঘরের একমাত্র বাসিন্দার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল—এতক্ষণে তার অপেক্ষা শেষ হল তাহলে! খুড়তুতো বোনটি ঘরে ঢুকতেই তাকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “ভাবছিলাম তুই হয়তো আর এলিই না, সিবিল!”
“আসলে নাটকটা শেষ হতে এত দেরি হল! আর তাছাড়া এত কুয়াশা আজ, যে দু-হাত দূরে নজর চলে না। সেই জন্যেই… তা আমার বাক্সটা পৌঁছেছে তো, বিকেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সে ঠিক তার সময়মতো পৌঁছে গেছে।” কথা বলতে বলতে সিবিলকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে এল মেয়েটি। “তোর ঘরটা একেবারে গুছিয়ে রেখে দিয়েছি। তবে আমার এখানে যারা কাজ করে ওদের ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু তোর কোনও অসুবিধে হবে না দেখিস। বিশ্বাসই হচ্ছে না, যে শেষপর্যন্ত সত্যি সত্যিই এখানে তোর পা পড়ল। কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার!”
ঘটনাটা হল, তার পতিদেবটি দু-দিনের জন্য প্যারিসে গেছে কী একটা কাজে। তাই সিবিল এ-বাড়ির দু-রাতের অতিথি।
জ্ঞাতি বোনটির উচ্ছ্বাস কোনোমতে থামিয়ে সে বলল, “দূর, থাম দেখি এবার, নেংটি ইঁদুর! অনেক হয়েছে হাঁদুরাম!”
এসব আদরের খুনসুটি এদের মধ্যে লেগেই থাকে।
ভিতু বোনটি হেসে উঠল। বলল, “না না, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়! আসলে রাতের লন্ডনের ট্রাফিককে এখনও কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। আর হ্যারিকে ছাড়া থাকিনি তো কখনও! এই প্রথম ও এরকম একা দূরে কোথাও গেল, তাই মনে হচ্ছিল…”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সে আর জানি না!” হেসে উঠল সিবিল। স্বভাবটা তার অত্যন্ত প্রাণবন্ত। হাসিখুশি থাকতেই সে পছন্দ করে। তাই প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বলল, “জামার হুকটা খুলে দে তো ভাই, এই বাইরের পোশাকটা ছেড়ে ড্রেসিং গাউনটা পরে আগুনের পাশে একটু আরাম করে বসি।”
সিবিলের জামাকাপড় পালটানো হলে গুছিয়ে বসল দুই বোন।
“হ্যারিকে ছাড়তে গিয়েছিলাম ভিক্টোরিয়া স্টেশনে। এই তো পৌনে ন’টায় ওর গাড়ি ছাড়ল।” তরুণ গৃহকর্ত্রীটি মিষ্টি হেসে বলল।
“নিউহাভেন থেকে দিয়েপ হয়ে যাবে তো?”
“হুঁ, সাতটার মধ্যে প্যারিস পৌঁছানোর কথা। পৌঁছেই ফোন করতে বলেছি ওকে।”
“পাগলি! তোর পাল্লায় পড়ে বেচারা দেখছি খরচ করে করে ফতুর হয়ে যাবে!” সিবিল ওর পিছনে লাগতে ছাড়ল না।
“আহা, কী এমন খরচ করালাম!”
“ওখান থেকে তিন মিনিটের কলের খরচ জানিস, কম করে দশটি শিলিং! শুধু কি তাই? তোকে হয় জি.পি.ও-তে যেতে হবে, নয়তো ম্যানসন হাউস, অথবা ট্রাঙ্কল ধরা যায় এমন কোনও জায়গায়।”
“তাই! আমি ভেবেছিলাম এমনি যেমন ফোন আসে বাড়ির ফোনে, সেরকমই। শুধু একটু দূর থেকে ফোনটা আসবে এই যা।”
“বেচারা কি বলার সুযোগ পেয়েছিল?” খিলখিলিয়ে হেসে উঠল দুই বোন।
ফায়ার প্লেসের ধার ঘেঁষে পোশাক-আশাক সামলে বসে ছিল দুজনে। এখন অনেক রাত, ঘড়ির কাঁটা দেখাচ্ছে মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। কিন্তু দুজনের কথাই যেন শেষ হচ্ছিল না। সিবিল দু-নম্বর সিগারেটটা ধরাল।
“আমি বোধ হয় তোকে ঘুমোতে দিচ্ছি না। আসলে আজ আমার চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে গেছে।”
“আমারও। আজকের নাটকটা দেখে আমি এত উত্তেজিত, কী বলব!” সিবিল তার উত্তেজনাকে যতদূর সম্ভব ফুটিয়ে নাটকের কাহিনি বলা শুরু করল।
গল্প তখন প্রায় মাঝামাঝি, হলঘর থেকে টেলিফোনের ঘণ্টি বেজে উঠল ট্রিং… ট্রি…ইং…
মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট।
“ওই আবার!” সিবিলের বোনটি চমকে উঠে চাপা গলায় বলল, “যবে থেকে হ্যারি বাড়িতে টেলিফোন এনেছে, তবে থেকে এই উৎপাত শুরু হয়েছে। যখন তখন ট্রিং ট্রিং, শব্দটা যেন বুকে এসে ধাক্কা দেয়, বিরক্তির একশেষ।”
“তুই খামোখা এত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন? এ তো টেলিফোনের সেই পুরোনো রোগ! ওটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নাকি!” সিবিল ওকে ভরসা জোগাচ্ছিল সাধ্যমতো। তারপর একটু থেমে ওর এলোমেলো চুলগুলোকে ঘেঁটে দিয়ে বলল, “আসলে তোর এখনও এটাতে অভ্যেস হয়নি। এ-রোগের একটাই দাওয়াই, বুঝলি! সিধে এক্সচেঞ্জে ফোন করে একটা অভিযোগ ঠুকে দে, ব্যস, তক্ষুনি সব রোগবালাই উধাও হবে। আরে বাবা, এ জগতে নিজের জোরটা রাখতে হলে সময়মতো অভিযোগটা…”
সিবিলের কথার মধ্যেই তার বোনটি বলে উঠল, “ওই, ওই আবার! চুপ করুক হতচ্ছাড়াটা!” ভয়ে তার গলা কাঁপছে। কোনোমতে বলল, “শুধু মনে হচ্ছে, কে যেন হলঘরে দাঁড়িয়ে আছে, কিছু বলতে চাইছে আমাকে!”
সিবিল ঝটকা মেরে উঠে পড়ল। তারপর ওর হাত ধরে টেনে আনল হলঘরে।
টেলিফোনটা সত্যি বাজছিল। এক্সচেঞ্জ থেকে কল এলে যেমন দ্রুত বাজতে থাকে ট্রিং… ট্রিং, তেমনভাবেই বাজছে যন্ত্রটা। সিবিল দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে রিসিভারটা কানে ঠেকাল। শুনতে পেল অপারেটারের গলা, “কেউ কি লাইন পেতে চেষ্টা করছেন?”
সে ঝাঁঝিয়ে উঠল, “না, মশাই। বরং একঘেয়ে এই বিচ্ছিরি আওয়াজে আমরা দু-চোখের পাতা এক করতে পারছি না।”
তারপর অপারেটারের সঙ্গে সিবিলের কী কথা হল, সেটা তার সঙ্গিনীর জানার কথা নয়। তাই কথা শেষ করে তার দিকে ফিরল সে। বলল, “বুঝলি, লোকটাকে বেশ ভদ্রই বলা চলে। আমাদের অসুবিধেটা মন দিয়ে শুনে খুব দুঃখ-টুঃখ জানিয়েছেন। ভদ্রলোক বললেন, তোর এই লাইনটায় আজ কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে, যেটা এক্সচেঞ্জ থেকে ওরা ধরতে পারছে না। হতে পারে ক্রস কানেকশন হচ্ছে, বা অন্য কোনও সমস্যা। কাল সকালে ওরা লোক পাঠাবে। আর বললেন আজ রাতের মতো রিসিভারটা উঠিয়ে রাখতে, তবে অন্তত ওই বিচ্ছিরি আওয়াজটার হাত থেকে আপাতল রেহাই পাওয়া যাবে।”
কাজেই জায়গামতো না বসে রিসিভারটা ঝুলতে লাগল দেওয়ালের গায়ে।
দুই বোন এবার নিশ্চিন্তে আগুনের ধারে আড্ডা মারতে লাগল। হ্যারির বৌটি বলল, “সত্যিই রে, আমি একটা ভিতু গাধা। তুই ঠিকই বলেছিস, যন্ত্রটার সঙ্গে আমি এখনও ততটা সড়গড় হতে পারিনি। আমাদের খামারবাড়িটায় এসব ঝামেলা ছিল না, দেখেছিস তো!” বলতে বলতে হঠাৎ কপাল কুঁচকে ঘুরে তাকাল হলঘরের দিকে, যেন আবার সে ওই টেলিফোনের ঘণ্টি শুনতে পেয়েছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে, ও খুব চেষ্টা করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখছে। তারপর সিবিলের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কী হচ্ছে বল তো! কেমন একটা অস্বস্তি মনের মধ্যে পাক খাচ্ছে! কীসের অস্বস্তি, কেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“কী হল, কী তোকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না?”
“সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছে, এই ফ্ল্যাটে আমরা ছাড়া আরও কেউ যেন আছে, কিছু বলতে চাইছে আমাকে!”
সিবিল চট করে ওর পাশের দেওয়ালে লাগানো ইলেক্ট্রিক বাতির সুইচটা টিপে দিল। আলো-আঁধারি ঘরটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুহূর্তে। সে অজানা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া বোনটিকে জড়িয়ে ধরে বোঝাতে লাগল, “কোথায় কে! দেখ, সবটাই তোর মনের ভুল। এতদিন তুই ছিলি শহর থেকে দূরে, তোদের নির্জন খামারবাড়িতে। আর এখন একেবারে খোদ লন্ডনের হৈ-হট্টগোলের মধ্যে। তাছাড়া, একে তো আজ রাতে হ্যারি এখানে নেই, তার উপর এমন ঘন কুয়াশা! সবকিছু মিলেমিশে তোর মনটাকে অশান্ত করে তুলেছে। নিজে একবার যুক্তি দিয়ে ভাব, দেখবি…”
“দাঁড়া দাঁড়া, শুনতে পাচ্ছিস?” গলা কাঁপছে, যেন কিছুতে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে মেয়েটি, দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে বুঝি আতঙ্কে। “প্যাসেজে কে যেন হাঁটছে না!” উত্তেজনায় পিঠ টানটান, চোখ বড়ো বড়ো, মুখখানা ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে!
বোনের ভয় পাওয়া অতি সতর্ক ভাব দেখে সিবিলও কান খাড়া করল, আদৌ যদি সেই শব্দ শোনা যায়।
ঘরের মধ্যে তখন অবিচ্ছিন্ন নিস্তব্ধতা, একটা পিন পড়ার শব্দও কোথাও নেই।
হঠাৎ যেন কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলেছে, এমনভাবে চেঁচিয়ে উঠল সিবিল, “ও! তোকে নিয়ে আর পারা যায় না! আমি ফায়ার প্লেসের বাইরের এই বিটটায় পা ঠুকছিলাম। তুই সেই শব্দই শুনেছিস। এই দেখ।” বলে বোনটিকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওই বিটে পা ঠুকতে লাগল।
“হয়তো তাই। কিন্তু…” সিবিলের যুক্তিতে যে খুব একটা খামতি আছে তা নয়, কিন্তু তবুও সন্দেহটাকে সে পুরোপুরি তাড়াতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আমতা আমতা করে বলল, “কেমন ভয় ভয় করছে। শুধু মনে হচ্ছে, আর কেউ যেন ঢুকেছে এই ফ্ল্যাটে, সেই যখন তুই এলি না! তখন থেকেই। দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছে আর কেউ আছে এখানে। অদ্ভুত! তারপর থেকেই টেলিফোনটাও থেকে থেকে বাজতে শুরু করল।”
“ওহ্! তোর মাথা থেকে এই ভূত সহজে নামবে না দেখছি। এবার হয়তো বলবি, সিঁড়ি দিয়ে হাতি উঠে আসার থপ থপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিস।” সিবিল হাসতে হাসতে বলল, “কিন্তু কথা বলতে বলতে রাত একটা বেজে গেল যে! শুবি না!” সে তার ভয়ে চুপসে যাওয়া জ্ঞাতি বোনটিকে তাড়া লাগায়, “ওঠ শিগগির, শুয়ে পড় দেখি এবার চুপটি করে! তবে তার আগে এই নে, চকোলেট খা।”
ভীত, সন্ত্রস্ত মেয়েটি আগে টের পায়নি রাত এতটা বেড়ে গেছে। যখন শুনল রাত একটা বেজে গেছে, একটু যেন চমকে উঠল। যেন নিজেকেই শুনিয়ে বলল, “রাত একটা… হ্যারির জাহাজ তাহলে এতক্ষণে মাঝপথ পেরিয়ে গেছে।” তারপরেই হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে সিবিলকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কিন্তু আজ তুই আসায় আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে! তোর অত বড়ো বাড়ির আরাম ছেড়ে…” গরম চকোলেটের তুলতুলে স্রোত গলা দিয়ে নামায় তার আর কথা বলার উপায় রইল না।
খাটের দিকে এগোতে গিয়ে সিবিলের চোখ পড়ল বাতাসে দুলতে থাকা রিসিভারটার দিকে। মুচকি হেসে বেশ বিজয়ীর ভঙ্গিতে বলল, “যাক, আজ রাতে বাছাধন আর তোমাকে বাজতে হচ্ছে না।”
“হ্যাঁ, যা বলেছিস! উৎপাতের হাত থেকে আপাতত রেহাই। তবে এখন কিন্তু আমার আর ভয়-টয় করছে না। খামোখা তোকে ঝামেলায় ফেললাম। আমি সত্যিই একটা যা-তা।”
ফ্ল্যাটে ঢোকার দরজা লাগোয়া জানালার খড়খড়ির সরু ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল সিবিল। বলল, “কুয়াশা কাটছে, আস্তে আস্তে চারপাশ পরিষ্কার হচ্ছে।”
খানিক আগের উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে, কাজেই ঘুম আসতে দেরি হওয়ার কথা নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্ল্যাটটি একেবারে শান্ত হয়ে গেল। কোথাও আর কোনও আওয়াজ নেই, শুধুমাত্র দুটো ক্লান্ত মানুষের ছোটো বড়ো ভারী নিশ্বাস ছাড়া। রাস্তার গাড়িঘোড়ার আওয়াজও প্রায় নেই, এমনকি টেলিফোনের গা-জ্বালানো ট্রিং-ট্রিংটাকেও থামানো গেছে শেষপর্যন্ত।
কিন্তু এই নিস্তব্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হল না।
আবার, আবার শুরু হল সেই একঘেয়ে শব্দ। প্রথমে যন্ত্রটার ভিতর থেকে খুব মৃদু কম্পন বাতাসে তরঙ্গ তোলা শুরু করল। কিন্তু ক্রমশ বাড়তে থাকল তার জোর এবং তীক্ষ্ণতা। প্রত্যেকটা কম্পনে তার শক্তি বাড়ছিল। জোরালো তীক্ষ্ণ শব্দতরঙ্গ ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঘরময়।
এ-বাড়ির অল্পবয়সি গিন্নিটির চোখে এক মুহূর্তের জন্যও ঘুম আসেনি, চুপটি করে চোখ বুজে শুয়েছিল মাত্র। টেলিফোনের ঘরের দরজাটা বোধ হয় ইচ্ছে করেই বন্ধ করেনি। যন্ত্রটার প্রায় অশ্রুত শব্দও টের পেয়েছিল ও। বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে এগোতে গিয়ে দেখতে পেল সিবিলও উঠে পড়েছে। ঘরের আলোগুলো জ্বালিয়ে দিল দুজনে।
কেমন একটা গন্ধ… জল থেকে ওঠা সোঁদা ঠান্ডা ঠান্ডা গন্ধ, কে জানে বোধ হয় রাতের নিজস্ব গন্ধ এটা।
“ব্যাপারটা কী, বল দেখি! আমাকে তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলি! হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি তুই গোঁ গোঁ করছিস।”
“ওই যে ওটা, ওটা আবার বাজছে!” মেয়েটির গলায় আতঙ্ক, ভয়ে ঠোঁট দুটো ফ্যাকাসে। “শুনতে পাচ্ছিস! কেউ বার বার ফোন করার চেষ্টা করছে, কী একটা বলতে চাইছে আমাকে!”
সিবিল তাকাল ওর দিকে। যদিও চোখে মুখে আগেকার মতো জোরালো আত্মবিশ্বাস যেন নেই। হাসতে গেল, কিন্তু হাসিটা গলার ভেতর থেকে বাইরে এল না। তবুও সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটছে, এমন একটা ভাব দেখিয়ে বলল, “কই, আমি তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না।”
তার কথায় স্বাভাবিক জোরের অভাব বোধ হয় তার নিজেরও কান এড়াল না। তারপর বোধ হয় নিজেকে বোঝাতেই বলল, “আর তাছাড়া বাজবেই-বা কেমন করে, তুই-ই বল, সেটা কি সম্ভব? ওটা, ওটা তো জায়গামতো বসানোই নেই। দেখ, দেখ ভালো করে।” দেওয়ালে অসহায়ের মতো ঝুলন্ত রিসিভারের দিকে দেখাল সে। “কী করে বাজবে ওটা? বাজতেই পারে না। তুই খামোখা এত ভয় পাচ্ছিস। ওহ্! এত ভয় পেয়েছিস, যে মুখখানা দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে।”
যাকে এতগুলো কথা বলা হল, সেগুলো তার কানে ঢুকেছে বলে মনে হল না। সে হঠাৎ প্রায় ছুটে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিল। বলল, “কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।” তার দু-চোখে অজানা আশঙ্কা, সিবিলের দিকে রিসিভারটা বাড়িয়ে দিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “শোন। শুনতে পাচ্ছিস না, কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে? বার বার কিছু বলতে চাইছে?” বলতে বলতে রিসিভারের গোল বাটিটা নিজের কানে চেপে ধরল। তারপর এমনভাবে অপেক্ষা করতে লাগল যেন ফোনের ও-পারে কেউ কিছু বলছে।
সিবিল এটা নিয়ে মজা করবে ভেবে ও কেমন থতমত হয়ে থেমে গেল। যেন কী করা উচিত তার খেই হারিয়ে ফেলেছে। সে আদৌ কোনও টেলিফোন বাজার আওয়াজ শুনতে পায়নি।
“হ্যারি! তুমি!” ফিসফিসিয়ে বলে উঠল ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েটি। এখন তার মুখ দেখে যে-কেউ বলবে, সত্যি সত্যিই টেলিফোনের তার বেয়ে কোনও কথা তার কানে পৌঁছচ্ছে। সামান্য বিরতির পর সে বলে উঠল, “কিন্তু হ্যারি, তুমি এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলে! কীভাবে? … কী বললে? … হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি, তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু খুব আস্তে, যেন অনে–ক দূর থেকে। … কী বলছ? তোমার এবারকার সফরটি বেশ হয়েছে? সময়ের অনেক আগে পৌঁছে গেছ? তা বেশ! … কিন্তু এ আবার কী কথা, তুমি প্যারিস যাওনি! তবে কোথায়? ডার্লিং, বলো, জোরে বলো, আমি শুনতে পাচ্ছি না। … বুঝতে পারছি না তোমার কথা … কী বললে … সমুদ্রের যন্ত্রণা এর কাছে কিছুই না … কী কথা বলছ? … তুমি জানো না … কী, কী জানো না?…”
সিবিল এসে ওর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কীসব আবোল-তাবোল বকছিস! তুই স্বপ্ন দেখছিস। এই ঘোর থেকে বেরিয়ে আয়। ফোনের ও-পারে কেউ নেই, থাকতে পারে না।”
“শ-শ-শ, ভগবানের দোহাই! শ-শ-শ।” মেয়েটি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করার ইশারা করল। কেমন বিভ্রান্ত চোখমুখ—ভয়, অবিশ্বাস সবকিছু একসঙ্গে ছায়া ফেলছে সেখানে। দেওয়ালের গায়ে একটু ঝুঁকে কেমন রহস্যময় স্বরে বলল, “আমি এখনও হ্যারির গলা শুনতে পাচ্ছি। অনেক, অনে-ক দূর থেকে কথা বলছে। অনেকক্ষণ থেকে ও আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রথমে সরাসরি আমার চিন্তাস্রোতে ঢুকে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল, পারেনি। তারপর, তারপর, এসব কী বলছে ও! আর হয়তো কোনোদিন আমার কাছে ফিরতে পারবে না—কী বলছে ও! কিছুই বুঝতে পারছে না, জমাট ঠান্ডায় নাকি ওর ঠোঁট দুটো জমে যাচ্ছে! ওমা গো, হ্যারি!” তীক্ষ্ণ চিৎকার করে রিসিভারটাকে মেঝের দিকে ছুড়ে ফেলল সে। চিৎকার করে করে কেঁদে উঠে বলতে লাগল, “হ্যারি, হ্যারি কোথায়? ওর কি কিছু হয়েছে? বেঁচে আছে তো? কিছুই বুঝতে পারছি না!”
***
সে-রাতে ইংলিশ চ্যানেলে রাত একটার কিছু পরে দুটো জাহাজে সংঘর্ষ হয়েছিল। হ্যারির স্ত্রী সরকারিভাবে খবরটা পেয়েছিল বটে, অবশ্য তা অনেক পরে। আরও ঠিকঠাক বলতে গেলে, পরের দিন।
একটা নৌকো হ্যারিকে জল থেকে যখন খুঁজে পেয়েছিল, তখন তার জ্ঞান নেই। জ্ঞান ফেরার পর সে নিজেকে আবিষ্কার করেছিল দিয়েপের একটা হোটেলে। কী হয়েছিল, কেমন করে সে এখানে এল, সে-সব ভাবতে গিয়ে একটা কথাই সে মনে করতে পেরেছিল, যে অন্য আরেকটা জাহাজে ধাক্কা লেগেছিল, জাহাজ ডুবে যাচ্ছিল। আর ডুবতে ডুবতে তার তীব্র ইচ্ছে হচ্ছিল বাড়িতে তার স্ত্রীর কাছে খবরটা পৌঁছে যাক।
টেলিফোন অফিস থেকে পরেরদিন সকালেই সারানোর লোক চলে এসেছিল। একটা চমকপ্রদ খবর পাওয়া গেল তাদের কাছে। আগের রাতে মাঝরাতের কিছু পর থেকে প্রায় ভোর তিনটে অবধি এক্সচেঞ্জে এই লাইনটার তারে ফ্ল্যাশিং হচ্ছিল, কারণটা তারা ধরতে পারেনি।
যাই হোক, প্রায় দশ মিনিট ধরে অনেকরকম পরীক্ষানিরীক্ষা করেও কোনও রোগ না পেয়ে টেলিফোন মেকানিক নিজের মনেই গজগজ করতে করতে চলে গেল, “লাইনে কোনোই গোলমাল নেই। খামোখা আমাদের ছুটিয়ে মারা, যত্তসব!”
অলঙ্করণ-স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
বহুদিন বাদে এমন টানটান রহস্য-গল্প পড়লাম অনুবাদে। প্রথমে ভূতই ভেবে বসেছিলাম, কিন্তু ভূত না হওয়ায়, আরও জমাটি হলো ব্যাপারটা।
LikeLike