(মার্কিন লেখক স্কট ফিটসজেরাল্ডের কাহিনি অবলম্বনে)
“আলমারিটার খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিয়ে আসতে আমার একটু দেরি হতে পারে, তোমরা অধৈর্য হয়ো না। মিন্টুকে নিয়ে গেলে দোকানের ভেতর এটা ধরবে, ওটা ফেলবে আর আমার কথা বলার সুযোগই হবে না—তার চেয়ে তোমরা বাইরেই দাঁড়াও।” এই বলে ভদ্রমহিলা রিক্সা থেকে নেমে রাস্তা পেরিয়ে একটা ফার্নিচারের দোকানের দিকে এগোলেন। দরজা ঠেলে ঢোকার আগে ঘুরে বললেন, “বায়না ধরলেই যেন কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনে দিও না, এই গরমে আদরিনি কন্যা অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি কিন্তু ঝক্কি সামলাতে পারব না।”
এদিকের ফুটপাথের ধারে একটা পানের দোকানের তাকে সাজানো রঙবেরঙের বোতলের দিকে মেয়েটা অনেকক্ষণ আড়চোখে তাকাচ্ছিল। মার রাগী রাগী গলা শুনে তার আশার আলো দপ করে নিভে গেল। বাবার মুখের দিকে তাকাল, কিন্তু তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন।
বেশ খানিকটা সময় কেটে যাবার পর ভদ্রলোক রিক্সাটাকে ছেড়ে দিয়ে মেয়ের হাত ধরে ছায়ায় পায়চারি করতে আরম্ভ করলেন। দুপুরবেলা লোক প্রায় নেই বললেই চলে, শুধু মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি আর রিক্সা এদিক ওদিক যাচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে ঝিরঝিরে একটু বাতাস বইতে শুরু করল আর উলটোদিকের পুরোনো বাড়িটার দোতলার জানালার একটা পাল্লা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল।
বাবা বললেন, “জানিস তো, দোতলার ওই ঘরটায় এক রাজকন্যা থাকে। দুষ্টু দৈত্য তাকে বন্দি করে রেখেছে। রাজকন্যার এই টানা টানা চোখ আর মাথাভর্তি রেশমের মতো চুল, দৈত্যটার মাথায় বড়ো বড়ো বাঁকা দুটো শিং।”
তারা দুজনেই একসঙ্গে মুখ তুলে জানালাটার দিকে তাকাল। মনে হল লাল শাড়ি পরা একজন ঘরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেল।
“দেখলি তো, ওটাই রাজকন্যা। মনের দুঃখে এ-ঘর ও-ঘর করছে। ওর বাবা আর মাকেও মাটির নীচে পাতালে আটকে রেখেছে। এই তিনজনকে উদ্ধার করতে হলে রাজপুত্রকে খুব তাড়াতাড়ি তিনটে, ওর নাম কী, ইয়ে জোগাড় করতে হবে।” বলতে বলতে বাবা একটু থেমে যান।
“কী বাবা, কী? তিনটে কী জোগাড় করতে হবে?”
“তিনটে… ওই দেখ, আবার রাজকন্যা চলে গেল।”
“তিনটে কী বাবা?”
“তিনটে পাথর, পায়রার ডিমের মাপের। সেগুলো হাতের মুঠোয় ধরে দরজায় তিনবার টোকা মারলেই রাজকন্যা মুক্তি পাবে।”
“আর ওর বাবা-মা, তারা কখন ছাড়া পাবে?”
“তারাও একই সঙ্গে ছাড়া পাবে।” বাবা একবার হাতঘড়িতে চোখ বোলালেন।
“বাবা, দৈত্যটা রাজকন্যার ওপর রাগ করেছে কেন?”
“কারণ, তাকে জন্মদিনে নেমন্তন্ন করা হয়নি। রাজপুত্র এইমাত্র একটা পাথর খুঁজে পেল লালকেল্লার গম্বুজের মাথায়। দ্বিতীয়টাকে খুঁজতে হবে আফ্রিকাতে হটেনটটের দেশে। জানিস তো, পাথর খুঁজে পেলেই রাজকন্যার ঘরে একটা নীল আলো জ্বলে ওঠে। তুই যখন ওই দোকানের বোতলগুলোর দিকে দেখছিলি তখন পরপর দু-বার আলো জ্বলতে দেখলাম।”
“তাই নাকি, বাবা? ওই দেখো আরেকবার নীল আলো জ্বলল, এবার তুমি দেখতে পেলে না। তার মানে তিন নম্বর পাথরটাও পাওয়া গেছে, রাজপুত্র এল বলে।”
মাথা নামিয়ে চাপা স্বরে বাবা বললেন, “তাকিয়ে দেখ, সামনের রাস্তাটা দিয়ে দুষ্টু দৈত্যটা আসছে, ছদ্মবেশে।”
ছোটো একটা ছেলে লম্বা লম্বা পা ফেলে এসে বাড়িটার দরজায় ধাক্কা দিল, কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। তখন ছেলেটা পকেট থেকে চকখড়ি বার করে সবুজ দরজায় হিজিবিজি কাটতে লাগল।
“জাদুর চিহ্ন আঁকছে।” বাবা ফিসফিসিয়ে বললেন, “যাতে রাজকন্যা কিছুতেই না বেরিয়ে যেতে পারে। বুঝতে পেরেছে যে রাজা আর রানিকে মুক্ত করে রাজপুত্র এখুনি এসে পড়বে।”
ছোটো ছেলেটা জানালার তলায় গিয়ে কাকে যেন ডাকল। এক মহিলা, লাল শাড়ি নয়, গলা বাড়িয়ে কী যেন বলল ঠিক বোঝা গেল না।
“রাজকন্যাকে ভালো করে তালাচাবি দিয়ে বন্ধ রাখতে বলল, বুঝলি?”
“দেখো, দেখো বাবা, দৈত্যটা জানালার তলাতেও জাদুচিহ্ন আঁকছে, আবার কীরকম তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে। কেন বাবা?”
“জাদু, জাদু, সব জাদু, ওটাও জাদুনৃত্য। নাহ্, এবার আর রাজকন্যাকে মনে হচ্ছে কিছুতেই বাঁচানো যাবে না।”
ছদ্মবেশী দৈত্যটা লাফাতে লাফাতে চলে গেল। এই সময় দুজন মোটাসোটা লোক হাত নেড়ে কথা বলতে বলতে পাশের গলিতে ঢুকল।
“ওরা কারা, বাবা?”
“রাজার দুই প্রধান সেনাপতি। মনে হচ্ছে সৈন্যবাহিনী কাছে পিঠে এসে পড়েছে, শুধু চক্রব্যূহ রচনা করা বাকি। চক্রব্যূহ মানে জানিস তো?”
“খুব জানি, যাতে অভিমন্যু আটকে পড়েছিল, আর বেরোতে পারেনি। ওরাও কি সৈন্য, ওই যারা আসছে?”
“ঠিক ঠিক। আর দূরের ওই বুড়ো মানুষটাই মনে হচ্ছে স্বয়ং রাজামশাই। একটু ঝুঁকে হাঁটছে আর লম্বা দাড়ি রেখেছে যাতে দৈত্যের দলবল চিনতে না পারে।”
“সেনাপতিরা এসে গেছে মানে এবার দৈত্যদের দফা শেষ, না বাবা?” আনন্দে মিন্টু হাততালি দিয়ে উঠল।
হাওয়া লেগে পাল্লা দুটো আচমকা বন্ধ হয়ে গিয়েই আবার ধীরে ধীরে খুলে গেল।
“ওটা পরি আর চেড়িদের কাজ।” বাবা বোঝালেন, “পরিরা চাইছে জানালাটা খোলা রাখতে আর চেড়িরা বার বার বন্ধ করে দিচ্ছে যাতে রাজকন্যাকে কেউ দেখতে না পায়। ওরা অবশ্য সবাই অদৃশ্য, তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি না।”
“পরিরা এখন জিতছে, না বাবা?”
“হ্যাঁ।” বলে বাবা টুক করে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, “তুই-ই আমার ছোট্ট পরি, বাকিরা সব চেড়ি, চেড়ি, চেড়ি।”
“ওই লোকটা কে বাবা, ওই যে ছাতা মাথায় আসছে?”
“ছাতা নয় রে বোকা, ওটাও একধরনের অস্ত্র। ও হল সেনাপতির পিসতুতো ভাই, বিরাট বীর। বোম্বাইতে থাকে তোর পাম্পুদাদার মতো, আজ যুদ্ধের জন্যে এখানে এসেছে।”
“আর বাবা, ওই দেখো রানিমা। ওইদিকে ভালো করে দেখো, ওটাই ঠিক মহারানি, তাই না?”
“না রে, উনি হলেন শ্রীমতী ঝিকিমিকি।” অন্যমনস্কভাবে বাবা হাই তুললেন। কাল রাতের ক্লাবের জলসার কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। চোখ দুটোও হঠাৎ যেন ঘুমে ঢুলে আসছে। আধবোজা চোখের ফাঁকে দেখতে পেলেন মিন্টু, তাঁদের ছ’বছরের মিষ্টি মেয়ে মিন্টু, বড়ো বড়ো চোখে সামনের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি নীচু হয়ে ঝুঁটি-বাঁধা চুলের মধ্যে চুমু খেলেন। কী সুন্দর গন্ধ।
“ওই যে লোকটা বড়ো একটা বরফের বোঝা নিয়ে হনহন করে আসছে, সেও কিন্তু রাজার দলে। দৈত্যটার মাথায় বরফ চাপিয়ে দিলেই মগজ জমে পাথর হয়ে যাবে, বাছাধন আর কোনও চালাকি করতে পারবে না।”
আবার জানালাটা বন্ধ হয়েই খুলে গেল।
“দেখলে বাবা, পরিরাই আবার জিতল। চেড়িরা কিছু করতে পারছে না। তার মানে লড়াই একটু বাদেই থেমে যাবে।”
নিঃশ্বাস ফেলে বাবা ভাবলেন, কী আশ্চর্য, এই পুরোনো বাড়ি, ভাঙা রাস্তা আর সারি সারি ফার্নিচারের দোকানের মধ্যে ওর চোখের সামনে একটা মায়ার জগৎ কী সহজেই না খুলে দিলাম, অথচ আমিই কিছু দেখছি না, সেখানে আমারই প্রবেশ নিষেধ। চোখ দুটো বন্ধ করে তিনি একবার প্রাণপণে চেষ্টা করলেন মিন্টুর চোখ দিয়ে চারপাশটা দেখতে, জাদুটা যদি এক মুহূর্তের জন্যেও ধরা দেয়। কিন্তু অসম্ভব সম্ভব হল না। ক্ষমাহীন সময়ের কাছে হার মেনে, মেয়ের কাঁধে দু-হাত রেখে তিনি রাস্তার দুটো কুকুর আর একটা ক্রাচ নিয়ে হাঁটা লোককে চট করে গল্পের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।
মিন্টুর মা দোকান থেকে বেরিয়ে বললেন, “এতক্ষণ লেগে যাবে বুঝতেই পারিনি। তোমরা ভেতরে চলে গেলে না কেন? বাইরে এই গরমে…”
বাবা বললেন, “বা রে, তাহলে তো এই দারুণ ব্যাপারটা দেখাই হত না। বরং তোমার আর একটু দেরি হলে আমরা শেষ উদ্ধার-পর্বটাও দেখতে পেতাম।”
মা কিছুই বুঝতে পারলেন না। রিক্সায় বসে বাবা আর মেয়ে তাঁকে সবটা বোঝাল। মিন্টুর কল্পনায় অবশ্য রাজকন্যা উদ্ধারের আর কিছু বাকি ছিল না। সে অনর্গল বকে যেতে লাগল। রাজার সৈন্যদের সঙ্গে দৈত্যদের ভয়ানক যুদ্ধ হল, তাতে রাজা, রানি আর দৈত্যদের সবাই মরে গেল, রাজকন্যা এখন রানি হয়ে সিংহাসনে বসেছে, প্রজারা সব নতুন জামাকাপড় পরে আনন্দ করছে ঠিক দুর্গাপুজোর মতো।
বাবার মনে ছবিটা অন্যরকম ছিল। রাজা ও রানির অপমৃত্যু তাঁর ঠিক পছন্দ হল না। ভুরু কুঁচকে বললেন, “রাজকন্যাকে তুই আবার সিংহাসনে বসালি কেন? আমি তো জানি বুড়ো রাজাই রাজত্ব করছে আর রাজপুত্রকে বিয়ে করার পর দুজনে মজা করে দেশবিদেশ বেড়াতে গেল।”
বিকেলের পড়ন্ত রোদে থেকে থেকে ঘণ্টি বাজিয়ে রিক্সা চলেছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে মা তৃপ্ত মনে ভাবছেন তাঁর বহুকালের শৌখিন আলমারির শখ এবার মিটতে চলেছে। বাবার মনে হচ্ছে সদ্য যেন লটারিতে অনেক টাকা জিতেছেন। আর মেয়ের চোখের সামনে তখনও রাজকন্যা, শিংওলা দৈত্য আর রাজপুত্র, যার হাতে তিনটে তিন রঙের পাথর, নতুন নতুন নাটক জমিয়ে তুলছে।
অলঙ্করণ- অংশুমান
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস