সত্যজিত দাশগুপ্তর আগের গল্প মোতিবিবি, ক্লাইম্যাক্স, বোলতার চাক, বিশ্বনাথের চিত্রনাট্য, ফ্ল্যাট নম্বর ২০১, সেই মেয়েটা, সুরের জালে
লক্ষ্মীপুজো শেষ হয়ে গেলেও ছুটি এখনও বাকি বেশ কিছুদিন। এর মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই কিডোরা আসছে লোকনাথদাদুর ফ্ল্যাটে। আজও বাদ যায়নি। সুযোগ পেয়ে দাদুভাইয়ের থেকে যতগুলো গল্প শুনে নেওয়া আর কি! আর হবেই-বা না কেন? কত ধরনের গল্প যে মজুত আছে ওঁর মাথায়! সারাজীবন ধরে চাকরি আর ভ্রমণ সূত্রে দেশের এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত ঘুরে অভিজ্ঞতার ঝুলি প্রায় উপচে পড়ে আর কি! এই অভিজ্ঞতার একেকটা উনি বলে চলেন আর সেগুলো গোগ্রাসে গিলতে থাকে কিডো, দ্যুতি, রিবাই আর রায়ানরা। প্রায় পঁয়ষট্টি পেরোনো মানুষটার তিনকুলে কেউ নেই। আত্মীয় বা বন্ধু বলতে এই চারটে খুদে বাচ্চা আর একমাত্র কাজের লোক।
“আজ কী গল্প শুনব?” প্রশ্ন করল কিডো।
“আজ?” বলে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন লোকনাথদাদু।
কিডোরা হাঁ করে চেয়ে ছিল ওঁর দিকে। দাদুভাইকে চুপ করে থাকতে দেখে দ্যুতি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কিডোর দিকে। তারপর লোকনাথদাদুকে জিজ্ঞাসা করল, “আজ গল্প বলবে না দাদুভাই?”
“বলব তো। নিশ্চয়ই বলব।” হেসে বললেন লোকনাথদাদু।
“আজ কীসের গল্প বলবে?” জিজ্ঞাসা করল রিবাই।
তাতে উনি বললেন, “আজ সকালে জানো তো, মৌলালি গেছিলাম।”
“মৌলালি?” ভুরু কুঁচকে বলল রায়ান। গল্পের সঙ্গে এই জায়গাটার কী সম্পর্ক বুঝতে পারল না। বলল, “ওখানে কী আছে দাদুভাই? আর জায়গাটাই-বা কোথায়?”
“মৌলালি হল উত্তর কলকাতায়। শিয়ালদা স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে মিনিট দশেক হাঁটা পথ। ওখানকার রথের মেলা খুব বিখ্যাত। ছেলেবেলায় যেতাম মায়ের সঙ্গে।” বলে একগাল হাসলেন দাদুভাই। কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন ছোটবেলায় ফিরে গেলেন উনি।
ওরা চারজন ততক্ষণে বুঝে গেছে আজকের গল্প মৌলালি নিয়েই। তাই কিডো এবার জিজ্ঞাসা করল, “মৌলালিতে কী আছে দাদুভাই?”
লোকনাথদাদু তখন ভুরু কুঁচকে চোখ সরু করে বললেন, “একটা অদ্ভুত ঘটনা মনে পড়ছিল সকালবেলা, জানো!”
“কী ঘটনা?” কথাটা শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠল দ্যুতি। কারণ, ও ততক্ষণে নতুন গল্পের গন্ধ পেয়ে গেছে। সত্যিই, দাদুভাই এত ঘটনা মাথায় রাখেন কী করে কে জানে? তাই তো লোকে ওঁকে গুগলদাদু বলে। আবার কেউ কেউ তো ওঁকে বলে একালের তারিণীখুড়ো!
দ্যুতির প্রশ্নে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকনাথদাদু বললেন, “তাহলে তো পুরো গল্পটাই বলতে হয়!”
“বলো না দাদুভাই!” আবদার করে উঠল রিবাই।
ওর সঙ্গে গলা মেলাল রায়ানও। বলল, “হ্যাঁ দাদুভাই, বলো। আমরা গল্প শুনব।”
এর মধ্যে লোকনাথদাদুর কাজের লোক কিডোদের জন্য জলখাবার দিয়ে গেছে। আর লোকনাথদাদুর জন্য পেল্লায় কাপে করে চা। কিডোরা এবার খাবারের থালা থেকে খাবার মুখে তুলে আরও একটু জাঁকিয়ে বসল। লোকনাথদাদুও চায়ের কাপে একটা চুমুক মেরে শুরু করলেন তাঁর নতুন গল্প।
“বহুদিন আগের কথা। প্রতীক ছিল আমার কলেজের বন্ধু। পাশ করার পর পরিবার সমেত পাততাড়ি গুটিয়ে গুজরাত চলে গিয়েছিল। বিয়ে-সাদি করে সেখানেই সংসার পেতে বসেছিল। এর বেশ কিছুদিন পর ওর কোম্পানি কলকাতায় একটা ব্রাঞ্চ খুলল। আর তারপর প্রতীককে কলকাতায় পাঠাল সেই ব্রাঞ্চের ম্যানেজার করে।
“যদিও বহুদিন পর ঘরে ফেরার আনন্দ ওকে পাগল করে দিয়েছিল, কিন্তু আদতে বর্ধমানের ছেলে হওয়াতে কলকাতায় ওর তেমন কেউ একটা চেনাশোনা ছিলা না। আর অন্যান্য বন্ধুবান্ধবও যে তখন কে কোথায় জানত না। তাই অফিস আর বাড়ি ছাড়া আর তেমন একটা কিছু করতও না ও।
“এরপর একদিন ডাইরেক্টরি ঘেঁটে আমার ফোন নম্বর বের করে আমাকে ফোন করল। রাতে অফিস থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে শরদিন্দুর একটা বই নিয়ে বসেছি, ঠিক সেই সময় এল ফোনটা। পড়ার ব্যাঘাত ঘটার জন্য বেশ বিরক্ত হয়েই হ্যালোটা বললাম। ও-পার থেকে একটা অচেনা গলা আমার নাম ধরে ডাকছে শুনে প্রথমটায় অবাকই হয়ে গেছিলাম। শেষে তার মালিক যে প্রতীক সেটা বুঝতে পেরে লাফিয়ে উঠলাম।
“ ‘আরে প্রতীক! তুই! কী খবর তোর? কোথায় আছিস এখন?’
“ ‘আস্তে বন্ধু, আস্তে।’ হেসে প্রতীক বলল, ‘আমি এখন কলকাতায়। সবে ফিরেছি। এখানে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি।’
“ ‘কোথায়? কোথায় ফ্ল্যাট কিনেছিস? চল না, একদিন দেখা করি!’
“ ‘আরে সেই জন্যই তো ফোনটা করলাম রে ভাই। বল, কবে কোথায় দেখা করবি।’ বলল প্রতীক।
“ ‘তুই বল!’ বললাম আমি।
“তাতে ও জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর অফিস কোথায়?’
“আমি তখন শিয়ালদাতে। ওকে তা বলতে ও জানাল ওর অফিস পার্ক সার্কাসে। আমি তখন বললাম, ‘তাহলে চলে আয় তৃপ্তিতে।’
“তাতে ও এককথায় রাজি হয়ে গেল। সেদিনটা ছিল সোমবার। ঠিক হল, বুধবার আমরা দেখা করব তৃপ্তি রেস্তোরাঁতে। তৃপ্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কলেজ লাইফ থেকে। রেস্তোরাঁটা মৌলালিতে। কাছেই একজন প্রফেসরের কাছে প্রাইভেট পড়তাম। ক্লাস শেষে আমি আর প্রতীক প্রায়ই সময় কাটাতাম ওখানে। আকাশছোঁয়া একটা বিল্ডিংয়ের ছ’তলায় তৃপ্তি। কাচের দেওয়ালের একেবারে ধারে দুটো চেয়ার নিয়ে নীল আকাশ আর চলন্ত কলকাতা দেখতে দেখতে কত স্বপ্ন দেখতাম তখন! আজ এতদিন পর পুরোনো দিনে ফিয়ে যাবার একটা সুযোগ পেয়ে ভেতরটা চনমনিয়ে উঠল।
“সময়টা ঠিক হয়েছিল ঠিক বিকেল চারটে। তখন তো আর এখনকার মতো মোবাইল ফোনের সুবিধে ছিল না, তাই মাঝে আর প্রতীকের সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ আমি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
“হেঁটে পৌঁছতে মিনিট পাঁচ-সাতেকের বেশি লাগল না। চারটে বাজতে পাঁচ নাগাদ পৌঁছলাম তৃপ্তির সামনে। থেকে থেকেই পুরোনো দিনে ফিরে যাচ্ছিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। দেখলাম ম্যানেজার সেই একই আছেন। শুধুমাত্র চেহারাটা বদলে গেছে। মনে হল, ভদ্রলোক কি আমায় চিনতে পারবেন? একবার ভাবলাম নিজে গিয়ে পরিচয় দিলে কেমন হয়? তারপর ভাবলাম রোজ কত লোকই তো আসে এখানে! সবাইকে কি মনে রাখা সম্ভব? তার ওপর আমরা এতদিন আগেকার খদ্দের।
“রেস্তোরাঁতে ঢুকে আগের মতোই আজও ধারের একটা টেবিল দখল করে নিলাম। এখান থেকে বাইরেটা পরিষ্কার আর খুব সুন্দর দেখায়। তবে কলকাতা যে আগের থেকে অনেক বেশি ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে সেটা এখান থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছিল। একবার ঘড়ি দেখলাম। চারটে বেজে দশ। এখনও প্রতীকের দেখা নেই। অবাক হলাম এই ভেবে যে, প্রতীকের সময় জ্ঞান ছিল অসম্ভব নিখুঁত। এক মিনিট এদিক ওদিক হলে ও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠত। চারটে মানে ওর কাছে ছিল চারটেই।
“আমার নজর তখন রাস্তার দিকে। মানুষজন থেকে শুরু করে গাড়িঘোড়া, সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। চোখের মণি অশান্ত হয়ে ওঠাতে বুঝতে পারছিলাম ওগুলো প্রতীককে খুঁজছে। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছিল। ভাবছিলাম, ওকে কি চিনতে পারব? রেস্তোরাঁর মেইন গেটটা এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। তাই কেউ এলে নজর এড়াবে না। কিন্তু এতদূর থেকে মুখ বোঝা কোনোমতেই সম্ভব নয়। তবুও চেয়ে রইলাম রাস্তার দিকে।
“বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে কাটল। আনমনে চেয়েছিলাম রাস্তার দিকে। প্রতীক তখনও এসে পৌঁছায়নি। এমন সময় বেয়ারা এস অর্ডার চাইল, ‘স্যার, কী নেবেন?’
“আমি তাতে বাইরের দিকে চেয়েই বললাম, ‘এখন না, একটু পর।’
“আসলে অনেকক্ষণ কেটে যাওয়াতে উৎসাহ একটু হলেও কমে গেছিল।
“ ‘একটা স্টার্টার দিই?’ আবার বলল বেয়ারা।
“ ‘আহ্, বললাম তো একটু পর!’ বেশ বিরক্ত হয়ে একইভাবে বাইরের দিকে চেয়ে থেকে বললাম আমি।
“তখন বেয়ারা আবার বলল, ‘আপনি হয়তো কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। ততক্ষণে দুটো চিকেন সুইট কর্ন স্যুপ দিয়ে যাই। যিনি আসবেন, তিনি এলে খেতে পারবেন।’
“বার বার বিরক্ত করছে বলে প্রথমটায় চটে গেলেও অবাক হলাম এই ভেবে যে, প্রতীকের খুব প্রিয় ছিল এই চিকেন সুইট কর্ন স্যুপ। কিন্তু সেটা বেয়ারা জানল কী করে? তাই ঝট করে ঘুরে বসে চোখের সামনে প্রতীকের হাসি হাসি মুখটা আবিষ্কার করে চমকে উঠলাম। ‘আরে তুই!’
“ ‘স্যুপ অর্ডার দেওয়া যেতেই পারে। কী বল?’ হাসতে হাসতে সামনে চেয়ারটা টেনে বসল প্রতীক। এত বছর কেটে গেছে। চেহারাতে সামান্য পরিণত ভাব এলেও তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। কে বলবে যে ও চল্লিশের কোঠায় পা দিয়ে ফেলেছে!
“ ‘আসলে একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।’ হাসতে হাসতে বলল ও। তারপর বেয়ারাকে স্যুপ আনতে বলে দিল।
“ ‘ওহ্, তুই একদম বদলাসনি।’ আমিও হাসতে হাসতে বললাম।
“ ‘তাতে ও বলল, ‘বদলাব কেন রে? জীবনে কত ঝড়ঝাপটাই তো আসবে। সবসময় হিমালয়ের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সব বিপদ ধাক্কা খেয়ে গুঁড়িয়ে যাবে।’ বলে আবার হো হো করে হেসে উঠল প্রতীক। তারপর আমাকে একটা পেন দিয়ে বলল, ‘এই নে, তোর জন্য।’
“ ‘সত্যি, তুই…’ বলেই থামলাম। বদলাসনি আর বললাম না। আসলে আগেও যে-কোনো আছিলায় মানুষকে উপহার দিতে পছন্দ করত প্রতীক। জন্মদিন, নতুন বছর, যখন পারত তখনই একে ওকে এটা সেটা উপহার দিত। সেটা ছিল ওর একটা নেশা। বুঝলাম, এতদিন পর দেখা বলে ও পেনটা আমার জন্য এনেছে। এর মধ্যে স্যুপ এসে গেছে। সেটার সদ্ব্যবহার করতে করতে আমরা অন্যান্য খাবারেরও অর্ডার করে দিলাম।
“আস্তে আস্তে আড্ডা জমে উঠছিল আমাদের। কখন যে কলেজের দিনগুলোয় ফিরে গেছিলাম বুঝতে পারিনি। সুনীল গাভাস্কার, ভিভ রিচার্ডস, ইমরান-কপিল, পেলে-মারাদোনা সবই চলে আসছিল আমাদের আলোচনায়। বুঝতে পারছিলাম, বহুদিন পর যেন নিজেকে ফিরে পেয়েছিল প্রতীক। ঠিক হল একদিন অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখতে যাব। তারপর যাব অনাদি কেবিনে মোগলাই খেতে। ততদিনে আরও অনেক রেস্তোরাঁ খুলে গেছে বটে কলকাতায়, তবুও এগুলো আমাদের নস্টালজিয়া। ঠিক হল, একদিন ওর বাড়ি যাব। এবার প্রতীক বলল সিগারেট খাবে। এখানে বসে সিগারেট খাবার অনুমতি ছিল না। তা করতে গেলে আমাদের যেতে হত ব্যালকনিতে। সেটা এই রেস্তোরাঁর স্মোকিং জোন। মানে ধূমপায়ীদের ধূমপান করার জন্য তৈরি বিশেষ একটা জায়গা। এমনটা কলকাতা এয়ারপোর্টেও আছে দেখেছি। আজকাল তো অনেক কোম্পানিতেও এই ব্যবস্থা রয়েছে।
“আমি নিজে এই সুখে বঞ্চিত। মদ্যপান বা ধূমপান কোনোটাই আমার চলে না। তবুও প্রতীককে সঙ্গ দিতে আমাকে ওর সঙ্গে যেতে হল।
“উঁচু থেকে কলকাতা শহরের অপূর্ব শোভা উপভোগ করছি। প্রতীক বলল, ‘সিটি অফ জয় এতটুকু বদলায়নি রে।’
“উত্তরে আমি মুচকি হাসলাম। আরও কিছুক্ষণ এইভাবেই কাটল আমাদের। সময় বয়ে চলেছে। চেষ্টা করেও ধরে রাখা যাচ্ছে না। ঠিক এমন সময় চোখের সামনে ঘটে গেল একটা মর্মান্তিক ঘটনা!
“রেস্তোঁরাটা ছিল বড়ো রাস্তার একেবারে গা ঘেঁষে। ব্যালকনি থেকে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছিল। বিকেলের কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা। ছুটে চলা লোকজন, চলন্ত বাস, ট্যাক্সি, অটো। তার ওপর ফুটপাথে চা-সিগারেটের দোকান তো আছেই। যদিও এত উঁচু থেকে দেখার জন্য সবকিছু দেখাচ্ছিল একেবারে কড়ে আঙুলের মতো।
“তো এমনই এক জীবন্ত কলকাতার রাস্তায় এবার চোখ পড়ল হলুদ জামা আর কালো প্যান্ট পরা একটা লোকের ওপর। তবে ওর মুখ দেখা যাচ্ছিল না। রাস্তার ওপারটায় দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। মাঝে মাঝে ডানহাতটা মুখের কাছ নিয়ে যাওয়া দেখে বুঝতে পারছিলাম সে সিগারেট খাচ্ছে। হাবেভাবে মনে হচ্ছিল যে সে রাস্তার এ-পারে আসতে চায়। আমার অনুমান যে সত্যি, সেটা এবার বুঝতে পারলাম যখন লোকটা রাস্তা পার হবার জন্য পা বাড়াল।
“কলকাতার রাস্তায় ট্র্যাফিক সিগন্যাল ব্রেক করাটা যেন একটা ফ্যাশন। বাস-ট্যাক্সি ধেয়ে আসছে, তার মধ্য দিয়েই আগে আগে রাস্তা পার হওয়াটা কিছু মানুষ বিশেষ বাহাদুরি বলে মনে করে থাকে। তাতে অ্যাকসিডেন্টও হয় অনেক। যেমন হল এই লোকটার। রাস্তার ধারে একটা বাস দাঁড়িয়ে লোক তুলছিল। লোকটা ভেবেছিল বাসটাকে পেরিয়ে চলে আসবে। সেইমতো যেই সে ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় নেমেছে, ঠিক তখন ঘটল অঘটনটা। দূর থেকে সেই সময় প্রচণ্ড জোরে ধেয়ে আসছিল একটা ম্যাটাডোর। কিন্তু বাসের আড়ালে থাকাতে সেটা চোখে পড়েনি লোকটার। এবার সে বাসের আড়াল থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে ম্যাটাডোরটা প্রচণ্ড জোরে এসে ধাক্কা মারল লোকটাকে। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রায় উড়ে গিয়ে ফুটপাথের ওপর পড়ল সে। দেখতে দেখতে লোক জমে গেল রাস্তায়। কিন্তু সবাই হট্টগোল করতে ব্যাস্ত, কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না!
“সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে আমরা চোখের পলকও ফেলার সময় পেলাম না। প্রতীক মুখে একটা ইস্ শব্দ করে পাশে রাখা ছাইদানিতে ঘষে সিগারেটটা নেভাল। তারপর ঘটনাস্থলের দিকেই চোখ রেখে বলল, ‘কী মর্মান্তিক!’
“ ‘হ্যাঁ রে,’ আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘কেন যে এরা দেখে রাস্তা পার হয় না!’
“ও তখন বলল, ‘কী আশ্চর্য দেখ, লোকটা পড়ে আছে, অথচ কেউ ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে না!’
“আমি তাতে বললাম, ‘জানিস তো, দিনকাল পালটে যাচ্ছে।’
“ ‘কিন্তু এটা অন্যায়!’ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল প্রতীক। বলল, ‘লোকটার পরিবারের কথা ভাব! বাড়িতে তে তো ওর স্ত্রী, মা, ছেলে থাকতেই পারে। তাদের কী হবে? আজ যদি আমি ওই লোকটার জায়গায় থাকতাম?’
“আমি তখন ওকে বললাম, ‘এই প্রতীক, কী যা-তা বলছিস?’
“ও তখন করুণভাবে আমার দিকে চেয়ে থেকে বলল, “এই লোকা, চল না, লোকটাকে দেখে আসি।’
“আমি আর অ্যাকসিডেন্ট দেখে মনখারাপ করতে চাইছিলাম না। বললাম, ‘না না, এখন ওসব সহ্য করতে পারব না।’
“ ‘আহ্, চল না রে!’ আমাকে জোর করে টেনে নিতে চেয়ে ও বলল, ‘হতেও তো পারে, লোকটার অবস্থা আমার মতো।’
“ ‘তোর মতো মানে?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
“ও তখন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘হতেও তো পারে, লোকটা আমার মতোই বহুদিন পর বাইরে থেকে কলকাতায় ফিরেছে। কাউকে চেনে না। ওর কিছু হলে কেউ জানতেও পারবে না। বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আর ওর বাড়ির লোক হাঁ করে ওর পথ চেয়ে বসে থাকবে দিনের পর দিন। শেষে ‘মিসিং’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব আশা ছেড়ে দেবে!’
“আমি প্রতীকের কথা হাঁ করে শুনছিলাম। ও বলল, ‘হতে পারে লোকটার শরীরে এখনও প্রাণ আছে। কেউ ওর সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না। আমরা গেলে হয়তো বেচারা প্রাণে বেঁচে যেতে পারে।’
“ওর কথা শুনে আমার ভেতরটা হু হু করে উঠল। তবে যেচে গিয়ে অ্যাকসিডেন্টের মামলায় জড়াব? ভেবে কেমন ভয় ভয় করছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রতীকের জোরাজুরির সামনে আমাকে হার মানতে হল। খুব তাড়াতাড়ি রেস্তোরাঁর বিল মেটাল প্রতীক। আমি টাকা দিতে চেয়েছিলাম, ও দিতে দিল না। এবার আমরা দৌড়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরোলাম। লিফট দেরি করায় সিঁড়ি নিলাম। তারপর নীচে নেমে দৌড় লাগালাম ঘটনাস্থলের দিকে। রাস্তায় তখন অনেক মানুষ জমে গেছে। একটা পুলিশের গাড়ি চোখে পড়ল। যে ম্যাটাডোরে লোকটা ধাক্কা খেয়েছিল, সেটা দেখলাম রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুনলাম তার ড্রাইভার ফাঁক পেয়ে পালিয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স এসে এখনও পৌঁছতে পারেনি। সামনে এন.আর.এস হাসপাতাল। তবুও কেন এমন অবস্থা জানি না। আমরা ভিড় ঠেলে এগোচ্ছিলাম। ভেতরে ভেতরে একটা আনচান ভাব অনুভব করছিলাম। ঘটনাস্থলের দিকে যত এগোচ্ছিলাম, সেটা তত বাড়ছিল। কারণ মনে একটাই আশঙ্কা, চেঁচামেচি, ধাক্কাধাক্কি করে সামনে গিয়ে যাকে দেখব, জানি না সে আর এ জগতে আছে কি না। আর দু-পা এগোতে এবার লোকজনের ভিড় কাটিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। আমাদের ঠিক সামনে তখনও রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে লোকটা। তাকে ঘিরে শ-খানেক লোক। চেঁচামেচি, হট্টগোল। সে এক চরম অবস্থা! সবাই ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রয়েছে লোকটার দিকে। কেমন দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে লোকটা। পা-জোড়া বেঁকে গেছে। কোমরেও মনে হয় চোট লেগেছে। জামাপ্যান্ট ছিঁড়ে গেছে। হলুদ জামার অনেকটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। এবার আমার চোখ গেল লোকটার মুখের দিকে। আর আচমকা নিজে নিজেই আমার ডানহাতটা গিয়ে খামচে ধরল বুক-পকেটে রাখা প্রতীকের দেওয়া পেনটাকে। তারপর মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এল একটা আর্তনাদ, ‘প্রতীক!’ সঙ্গে সঙ্গে ঝট করে ঘুরে তাকালাম পেছনে। ডাইনে বাঁয়েও খুঁজলাম। কিন্তু প্রতীক কোথাও নেই। হাত-পা কাঁপতে লাগল আমার। জোরে জোরে বার চারেক ডাকলাম ওর নাম ধরে। তারপর ধীরে ধীরে ঝাপসা দৃষ্টিটা পরিষ্কার হয়ে আসতে মাটিতে পড়ে থাকা প্রতীকের মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার চোখের সামনে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পুলিশ আমায় জিজ্ঞাসা করল আমি ওকে চিনি কি না। উত্তরে মাথাটা সামনের দিকে দু-বার ঝোঁকালাম।’
এতটা বলে থামলেন লোকনাথদাদু। গল্প শুনে কিডোরা ততক্ষণে একবারে থ মেরে গেছে। এমন গল্প ওরা জীবনে শোনেনি। কেউ মারা যাবার পরে ভূত হয়ে দেখা দিল, সেটা ওরা শুনেছে। কিন্তু এ তো উলটো! তাহলে যে এসেছিল, সে কে?
প্রশ্নটা লোকনাথদাদুকে করতে উনি মাথা নেড়ে হেসে বললেন, “পৃথিবীতে কখনো-সখনো এমন কিছু ঘটে, যার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে সেই মানুষটা, সে প্রতীক হোক বা অন্য কেউ, সে যদি সেদিন আমাকে টেনে না নামিয়ে নিয়ে যেত, তাহলে সেদিন আর প্রতীককে বাঁচাতে পারতাম না।”
“মানে?” অবাক হয়ে বলল দ্যুতি।
“তোমার বন্ধু সেদিন বেঁচে গেছিলেন?” জিজ্ঞাসা করল রায়ান।
“হ্যাঁ, ওকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। আঘাত খুবই গুরুতর হলেও বহুদিন চিকিৎসা করার পর ও সুস্থ হয়ে উঠেছিল।”
“তারপর তুমি ওঁকে ওই ঘটনার কথা বলেছিলে?” জিজ্ঞাসা করল রিবাই।
তাতে মাথা নেড়ে লোকনাথদাদু বললেন, “বহুবার বলতে চেয়েছি, পারিনি। ও যা ইয়ার্কিবাজ ছেলে, প্রতিবারই আমার কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিত।”
“তাহলে পেনটা? তোমার বন্ধু তোমায় পেনটা সেদিন উপহার দেননি?” পরপর প্রশ্ন করল কিডো আর দ্যুতি।
তাতে লোকনাথদাদু বললেন, “সেদিন পেনটা আমি উপহার পেয়েছিলাম, সেটা সত্যি। কিন্তু সেটা কী করে বা কার থেকে, সেটা আজও আমার কাছে রহস্য।”
অলঙ্করণ-জয়ন্ত বিশ্বাস