অদিতি ভট্টাচার্য – র সমস্ত গল্প
“এত কী ছবি তুলছ বলো তো? এখানে আছেটা কী?” দেবমাল্য জিজ্ঞেস করল।
“সে বলতে গেলে তো কোথাওই কিছু নেই, আবার সব জায়গাতেই অনেক কিছু আছে। আসলে হচ্ছে তো চোখ, সবার চোখে কি আর সব কিছু ধরা পড়ে?” ডি.এস.এল.আর-এর ডিসপ্লেতে চোখে রেখে আমি উত্তর দিলাম।
দেবমাল্য আর কিছু বলল না, বোধ হয় আমার উত্তরটা পছন্দ হয়নি। ভাবছে এই আগাছা ভর্তি মাঠের মধ্যে একখানা বহুকালের পুরোনো জীর্ণ বাড়ির এত ছবি তোলার কী আছে! তাও আবার যে-বাড়ির এমন বদনাম!
“এবার চলো এখান থেকে, আর থাকা ঠিক হবে না।” দেবমাল্য তাড়া লাগাল।
এখনও বিকেলের মায়া মায়া আলো ছড়িয়ে চতুর্দিকে। আমার আরও কিছুক্ষণ এখানে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছে দেবমাল্যর তাড়ার চোটে সে আর হবে না।
বাড়ির সদর দরজার সামনের রোয়াকে বসে একমনে আমাদের কথা শুনছিল একটা ছেলে। নাম নাড়ু। দেবমাল্যই বলেছে ওর কান বাঁচিয়ে ফিসিফিস করে, “আমাদের গ্রামেরই ছেলে, নাড়ু। মাথার ঠিক নেই, এখানে খুব আসে। তবে সারা গ্রামের সব খবর ওর কাছে থাকে। একেক সময় মনে হয় ভারি সেয়ানা, আবার একেক সময় মনে হয় বদ্ধ উন্মাদ।”
দেবমাল্যর তাড়া দেখে নাড়ু ঘড়ি দেখল। গম্ভীর মুখে বলল, “নাহ্, এখনই যাওয়ার দরকার নেই। আরও কিচুক্ষণ থাকতে পারেন। কিচুক্ষণ মানে আট মিনিট ঊনপঞ্চাশ সেকেন্ড। কিন্তু তারপর এই এতটুকখানি সময়ও নয়। তখন থেকেই ডেঞ্জার টাইম শুরু। বাজনাবাবুর বাড়ি জাগবে, বুঝলেন?”
“এই তুই চুপ কর তো! খালি উলটোপালটা কথা।” দেবমাল্য ধমকে উঠল, “একেবারে ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড হিসেব করে রেখে দিয়েছে! আর বাজনাবাবুর বাড়ি জাগবে আবার কী কথা? তুই দেখেছিস জাগতে? দিন-রাত্তির তো পড়ে আছিস এখানে, বল তো কী করে বাজনাবাবুর বাড়ি জাগে আর কী হয় তখন?”
“এই দেকো! যে পারছে নাড়ুকে খানিক ধমকে দিচ্চে! যেন না ধমকালে পেটের ভাত হজম হয় না। তা বাজনাবাবুর বাড়িই যদি না জাগে, কিচুই যদি না হয় এখানে তাহলে তুমিই-বা অত চলো চলো করে তাগাদা দিচ্চ কেন?” এক লাফে রোয়াক থেকে নেমে নাড়ু বলল।
দেবমাল্য কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু নাড়ু বলতে দিলে তো! “নাড়ুর নামে মিছে কথা বললে ফল ভালো হবে না। দিন-রাত্তির আমি মোটেই এখানে পড়ে থাকি না। যেদিন কাজকম্ম থাকে না, সেদিন এই বেলার দিকে আসি। বাজনাবাবুর বাড়ি তকন ঘুমিয়ে থাকে। তবে যেদিন জাগবে, মানে জাগার মতো জাগবে—অল্পবিস্তর জাগে তো রোজই, কিন্তু তাতে কি কিচু হয়? হয় না। যেদিন জাগার মতো জাগবে সেদিন তার যাকে মনে ধরবে তাকে নিয়েই ছাড়বে। সে তুমি যতই বাড়ির ভেতরে দরজা-জানলা এঁটে থাকো না কেন! মনে না ধরলে এই সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও কিচু হবে না, বুঝলে? বাজনাবাবু কি যে-সে লোক ছিল নাকি, যাকে-তাকে তার পছন্দ হবে? সরো দেখি, মুকের সামনে থেকে সরো, তোমাদের সঙ্গে বকবক করে আমার মেলা সময় নষ্ট হল।”
নাড়ু হনহন করে হেঁটে চলে গেল।
“বাপ রে! এ তো কত কিছু বলে গেল!” আমি বলে উঠলাম।
“এ-বাড়িরই যে কোনও দোষ আছে মানে কিছু ব্যাপার আছে সে-কথা কিন্তু শুধু নাড়ু নয়, এ-গ্রামের সকলেই বিশ্বাস করে। নাড়ু শুধু বাড়িয়ে চড়িয়ে ওই জাগার কথা বলল। মাথার ঠিক নেই তো তাই। বাড়ি আবার জাগে নাকি? তবে এই বেশিদিন নয়, সাত-আট মাস আগে যে-ঘটনাটা ঘটল তাতে বোধ হয় নাড়ুর কথাও কেউ কেউ মানছে। যাক গে, এখন ওসব কথা থাক। এবার চলো সন্দীপদা।” দেবমাল্য বলল।
আমিও আর কথা বাড়ালাম না। পথ তো চেনা হয়েই গেছে। দু-দিন আরও আছি এখানে, নিজেই সুযোগ সুবিধে বুঝে চলে আসতে পারব। এ-জায়গায় আমাকে আরও ঘুরতে হবে। হবেই। এতদিনে যখন সুযোগ হয়েছে, তখন আমাকে এই বাজনাবাবুর বাড়ি আর তার চারপাশ ভালো করে ঘুরে দেখতে হবে। এখনও অবধি যা শুনেছি তাতে মনে হচ্ছে আমার অনুমান নির্ভুল। বিশেষ করে গ্রামটার নাম যখন জীবনতলা। এ নামটা তো আর আমি ভুল করব না।
দেবমাল্য আমার সহকর্মী, আমার থেকে বছর তিনেকের ছোটো। একসঙ্গে কাজ করতে করতে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। একদিন কথায় কথায় বলেছিল, “কলেজে ভর্তি হতেই আমার বাবার কলকাতায় আসা। তারপর যা হয়, এখানেই চাকরি-বাকরি। টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটও বাবার কেনা। আমাদের আসল বাড়ি তো সেই জীবনতলায়।”
নামটা শুনেই আমি চমকেছিলাম, “কী বললি? জীবনতলা!”
আমার চমকে ওঠাটা দেবমাল্যর নজর এড়ায়নি। “হ্যাঁ, জীবনতলা। এত চমকে উঠলে যে?”
“নামটা অদ্ভুত লাগে আমার, তাই। একবার শুনেছিলাম কার কাছে যেন।” আমি ততক্ষণে সামলে নিয়েছি।
“তাই বলো। আমি ভাবলাম… আসলে একটা কারণ আছে।”
সে-কারণ সেদিন আর বলা হয়নি। সেদিন কেন, তারপর অনেক দিনই বলা হয়নি। খেয়াল করে দেখেছিলাম, ও-প্রসঙ্গ উঠলেও দেবমাল্য এড়িয়ে যায়।
জীবনতলা নামটা আমি জ্ঞান হয়ে থেকে শুনে আসছি। আমার ঠাকুরদা কোনও এক জরুরি কাজে ক্যানিং গেছিলেন। কাজ সেরে তাঁর বাড়ি ফিরে আসার কথা। কিন্তু নির্ধারিত দিন পেরিয়ে গেলেও তিনি আর ফেরেন না। উপায় না দেখে আমার বাবা ছুটলেন সেখানে, যাঁর বাড়িতে ঠাকুরদার যাওয়ার কথা ছিল। তিনি তো সব শুনে হাঁ। তিনি নিজে ঠাকুরদাকে বাসে তুলে দিয়ে এসেছেন, তাহলে তিনি গেলেন কোথায়? তবে কি কোনও দুর্ঘটনা? থানায় খবর দেওয়া হল। দু-দিন বাদে বাবা জানতে পারলেন, জীবনতলা বলে এক গ্রাম থেকে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই, কিন্তু মুখ দেখে মনে হয় তিনি অত্যন্ত ভয় পেয়েছিলেন। বাবা দৌড়লেন সেখানে। হ্যাঁ, সেই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিই আমার ঠাকুরদা ছিলেন। বাবাই তাঁর দেহ সনাক্ত করেন। মুখ-চোখ বিকৃত হয়ে গেলেও বাবা চিনতে পেরেছিলেন। ঠাকুরদার বাঁহাতের বড়ো কালো জড়ুল, হাতের সোনার আংটি, ‘S’ লেখা নকশা করা রুমাল, কাঁধের কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ, কালো রঙের চামড়ার মানিব্যাগ—সবকিছুই বলে দিয়েছিল যে উনিই আমার ঠাকুরদা। কিন্তু তিনি কী করতে জীবনতলায় গেছিলেন তা জানা যায়নি। ওখানে আমাদের পরিচিত কেউ থাকা তো দূরের কথা, ও-গ্রামের নামও কেউ শোনেনি। ওখানকার লোকেদের কাছ থেকে বাবা এক অদ্ভুত কথা শুনেছিলেন। ও-গ্রামে নাকি এক বড়ো বাড়ি আছে। গ্রামের জমিদারের। সেই বাড়িতে কেউ থাকে না। সে-বাড়ির আশেপাশে মাঝেমধ্যে নাকি এরকম কখনো-কখনো কাউকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁরা কী করতে রাতদুপুরে ওখানে যান তা কেউ জানে না। পুলিশ দিনের বেলায় অনেক খোঁজাখুঁজি করে দেখেছে, কিছু বুঝতে পারেনি। শুধু পুলিশ কেন, গ্রামের লোকও দিনের বেলা ওদিকে যায়, তাদের কিছু হয়নি কখনও। কিন্তু সূর্যাস্তের পর তারা ওদিকটা এড়িয়েই চলে। বাড়িটাও গ্রামের একটেরে। গ্রামের লোক বিশ্বাস করে ও বাড়িতেই কিছু আছে, রাতের বেলা ওদিকে কেউ গেলে সে আর জীবিত থাকে না। বাবা ভাসা ভাসা এসব শুনে ফিরে এসেছিলেন। ঠাকুরদার জীবনতলায় যাওয়াটা এক অমীমাংসিত রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।
এসব আমার জন্মের আগেকার ঘটনা। তবে ‘ও জীবনতলা নয় রে, ও তো যমের ঠাঁই! ওখানে অপদেবতাদের বাস, সুস্থ মানুষটাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলল!’ এ-কথা আমার ঠাকুমাকে যে কতবার বলতে শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। ঠাকুরদার কথা উঠলেই তিনি এসব বলতেন আর হা-হুতাশ করতেন।
ছোটোবেলা থেকেই আমি খুব ডাকাবুকো, ভয়ডরের নামগন্ধ নেই। বাবাকে অনেকবার বলেছি, “তোমরা আর কেউ কখনও জীবনতলায় গেলে না কেন? ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে দেখা উচিত ছিল তো। দেশে কি আইনকানুন নেই? একটা লোককে মেরে ফেলবে, অথচ কিছু হবে না?”
বাবা উদাস গলায় উত্তর দিতেন, “গিয়ে আর কী হত? যে চলে গেছে সে তো আর ফিরে আসত না? তাছাড়া এ যে চুরি-ছিনতাইর ব্যাপার নয় সে তো বোঝাই গেছিল। হাতের আংটি, টাকাপয়সা সব ছিল। তারপর ওখানকার লোকজনের কাছে যা শুনলাম…”
“আমি হলে ঠিক যেতাম। হয়তো যাবও কোনোদিন।” জেদি, একগুঁয়ে স্বরে আমি বলতাম।
ঠাকুমা শিউরে উঠতেন। “ও-কথা বোলো না দাদুভাই! ও কী সব্বনেশে কথা বলছ! দুগ্গা দুগ্গা! হে মা, রক্ষে করো মা আমার নাতিটাকে!” দু-হাত জোড় করে বার বার কপালে ঠেকাতেন ঠাকুমা।
আমি হাসতাম। বলতাম, “এত ভিতু কেন তোমরা?”
আমাকে নিয়ে আমার ঠাকুমা, বাবা, মার চিন্তার অন্ত নেই। আমার নাকি বড়ো ফাঁড়া আছে। যেমন তেমন ফাঁড়া নয়, একেবারে মৃত্যুযোগ। মা, ঠাকুমা তাই খালি খালি আমাকে নিয়ে এ-মন্দির, ও-মন্দির, সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে নিয়ে ছুটতেন। একটু বড়ো হতেই আমি অবশ্য এসব জায়গায় যাওয়া বন্ধ করেছিলাম। পরিষ্কার বলে দিয়েছিলাম, “তোমরা যেতে চাও যাও, কিন্তু আমাকে জোর করবে না, আমি যাব না।” কারণ আমার এসবে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। না আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী, না ভূতের। অলৌকিক ঘটনা-টটনা আমি গল্পের বইয়ের পাতাতেই পড়তে ভালোবাসি। এসবে—সে ভূতই হোক কি ভগবান, যাদের বিশ্বাস আছে তারা আমার কাছে উপহাস, বিদ্রূপের পাত্র। আমার এই মনোভাবে ঠাকুমা, মা, বাবা দুঃখ পান, কিন্তু আমার কোনও হেলদোল নেই। দেবমাল্যর বাড়ি জীবনতলায় শুনে অবধি এখানে আসার সুযোগ খুঁজছিলাম, কিন্তু হয়ে উঠছিল না। আমিও ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছিলাম। জীবনতলা আমাকে যেন ডাকছিল। দেবমাল্যদের বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়, বহুবছর ধরেই। এবার আমি আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম, “পুজোর সময়ে বাড়ি যাবি তো? তোর সঙ্গে কিন্তু আমিও যাব। তোর আপত্তি নেই তো?”
“আপত্তি! কী যে বলো তুমি সন্দীপদা! আপত্তি কেন থাকবে? কত লোক আসেন আমাদের পুজো দেখতে!” খুব খুশি হয়েই বলেছিল দেবমাল্য।
সেই আমার জীবনতলায় দেবমাল্যদের বাড়িতে আসা। গতকাল রাতে এসে পৌঁছেছি। বাবা-মাকে বলেছি এক বন্ধুর বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে যাচ্ছি, হরিপালের কাছাকাছি। জীবনতলার নামও উচ্চারণ করিনি। করলে আর আমার আসা হত নাকি?
***
“এই বাড়িটার ব্যাপার ঠিক কী বল তো? বাজনাবাবুর বাড়ি, তাই তো বলল ওই নাড়ু? আর সাত-আট মাস আগে কী এমন ঘটনা ঘটল যে সবাই নাড়ুর মতোই বলতে শুরু করেছে?” ফেরার পথে আমি দেবমাল্যকে জিজ্ঞেস করলাম।
দেবমাল্য ইতস্তত করল। আমি আবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালে বলল, “আসলে কী বলো তো, বাইরের লোককে সবকিছু ভেঙে বলা এখানকার মানুষ পছন্দ করে না। বলে, তাতে আমাদের গ্রামের বদনাম হয়। অবশ্য বাইরের কেউ এলে সূর্য ডোবার পর তাকে ওদিকে যেতে বারণ করা হয়। তবে ওই ওইটুকুই। তার বেশি কিছু আর কেউ বলতে চায় না। বলে, ‘সারা গ্রামে ঘোরাঘুরির তো কম জায়গা নেই। যাও না যেখানে খুশি। ওদিকটায় সূর্য ডুবলে আর না যাওয়াই ভালো। আমাদের বলার কাজ, আমরা বললাম, এবার যা ভালো বোঝো করো।’ অবশ্য তোমাকে বললে আর কী হবে? তুমি কি আর বদনাম করে বেড়াবে? তাহলে এদিকটায় সরে এসো, এই ফাঁকায় ফাঁকায় বসে বলি। বাড়িতে এসব কথা বলা যাবে না।”
একখানা বড়ো ঝুপসিমতো গাছ, নাম জানি না। আমি শহুরে ছেলে, গাছ-টাছ বিশেষ চিনি না, ওসব দিকে কোনও উৎসাহও নেই। গাছটার তলায় কোনও এককালে একখানা বাঁধানো ধাপ ছিল। এখন তা ভেঙেচুরে দু-টুকরো হয়ে গেছে। একটা অংশ তবু তার নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে এখনও, আরেকটা পাশে কাত হয়ে পড়ে। আমরা দুজন ওই দুটোর ওপরেই জুত করে বসলাম।
“ও-বাড়ি চৌধুরীদের। এ-গ্রামের জমিদার ছিল তারা।” দেবমাল্য বলতে শুরু করল, “তাদের আরও একটা বাড়ি এ-গ্রামে আছে। ওটাই পুরোনো বাড়ি। ও-বাড়িটা বাজনাবাবু তৈরি করেছিলেন নিজের জন্যে। এ-গ্রামে তাঁদের জমিজিরেত তো কম ছিল না, এখনও অনেক আছে। গ্রামের এক পাশে ও-বাড়ি তিনি তৈরি করেছিলেন নিজের সুবিধের জন্যে। তিনি গানবাজনা-পাগল মানুষ ছিলেন। সেতার কি সরোদ কিছু একটা বাজাতেনও নিজে। আমি ঠিক বলতে পারব না, সব তো শোনা কথা। বাজনাবাবু কি আজকের লোক! তাঁর বাড়িতে নানান রকম বাদ্যযন্ত্র ছিল—ওই জন্যেই তো ওই নাম, বাজনাবাবু। তবে শুনে শুনে আমার মনে হয়েছে শুধু সেতার বা সরোদ নয়, উনি আরও অনেক কিছুই বাজাতে পারতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বাজাতেন নাকি, দিন-রাতের খেয়াল থাকত না। নাচগানের আসরও বসত বাড়িতে। প্রায়শই। বড়ো বড়ো ওস্তাদরা আসতেন, নামকরা নর্তকীরাও। সেসব নাকি এলাহি ব্যাপার হত। বাড়ির অন্য লোকেরা বিরক্ত হত। তাই তিনি আর তাঁর স্ত্রী উঠে এলেন ওই নতুন বাড়িতে। এবার আর কোনও অসুবিধে রইল না। যত খুশি গানবাজনা করো। বাজনাবাবুর স্ত্রী বাড়ির লাগোয়া শিবমন্দির তৈরি করালেন।”
“ওই মন্দিরটা? ওরও তো অবস্থা বিশেষ ভালো নয়।” বললাম আমি, “ভেতরে তো শিবলিঙ্গও নেই, সেসব গেল কোথায়?”
“শিবলিঙ্গ ওখান থেকে পরে তুলে গ্রামের অন্য মন্দিরে আনা হয়েছিল। সে-শিবলিঙ্গ এখনও সেখানে আছে, প্রতিদিন পুজো হয়। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। আগে তুমি যা শুনতে চাইছ তাই শোনো। বাজনাবাবু গানবাজনা-পাগল মানুষ হলে কী হবে, ছিলেন খুব মেজাজি। একবার রাগলে আর হিতাহিত জ্ঞান থাকত না। তখন যে কী করবেন আর কী না করবেন তার কোনও ঠিক নেই। জমিদার বংশের ছেলে তো! ওঁদের ওইরকমই মেজাজ হয়। একদিন সকালে গানবাজনার বড়ো ঘরখানায় বসে বাজনা বাজাচ্ছিলেন, এমন সময় বাইরে হঠাৎ কান্নার আওয়াজ।”
“কান্নার আওয়াজ? কে কাঁদছে আবার?” আমি অবাক হয়ে বললাম।
“একটা ছোটো বাচ্চা ছেলে। বড়োজোর বছর চারেকের হবে। বাজনাবাবুর স্ত্রী তার মাকে নতুন কাজে রেখেছিলেন। সে আমাদের গ্রামের লোক ছিল না। প্রথমটায় বাজনাবাবু অত গা করেননি। কাঁদছে কাঁদুক, তিনি আপনমনে বাজিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সে-ছেলের থামার আর নামই নেই, গলার আওয়াজও চড়ছে সপ্তমে। তার মা তাকে কেন ভোলাচ্ছিল না কে জানে, হয়তো কাজে ব্যস্ত ছিল। বাজনাবাবু রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন সদর দরজার সামনেই সাদা ধবধবে পাথরের সিঁড়ির ওপর বসে একটা বাচ্চা তারস্বরে কেঁদে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে জল গড়াছে, নাক দিয়ে সর্দি। বাজনাবাবুর আর সহ্য হল না, ‘চুপ কর বলছি, চুপ কর!’ বলে গালে ঠাস করে একটা চড় কষালেন। বাচ্চাটা টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে গিয়ে পড়ল নীচের শান বাঁধানো উঠোনে। চিত হয়ে পড়ল, মাথা থেকে খানিক রক্ত বেরিয়ে এল, বারদুয়েক কেঁপে উঠে নিথর হয়ে গেল। বাজনাবাবু ভ্রূক্ষেপও করলেন না, যেরকম দুমদুম করে পা ফেলে বেরিয়ে এসেছিলেন, সেরকম দুমদুম করে আবার চলেও গেলেন। গিয়ে আবার বাজনা নিয়ে বসলেন। বাচ্চাটার মা কাছেই ছিল, ছুটে এসে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আর্তনাদ করে উঠল। শুনেছি সেইভাবেই নাকি সে দৌড়ে ওখান থেকে চলে যায়, এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি। বাচ্চাটাও বাঁচেনি। বাজনাবাবুর অবশ্য তাতে কিছু যায় আসেনি। তার পরেও ও-বাড়িতে জলসা বসেছে। নাচ-গানে রাত ভোর হয়েছে। বাজনাবাবুর স্ত্রী নাকি অনেক খুঁজেপেতে বাচ্চাটার মার কাছে গেছিলেন, ক্ষমা চেয়েছিলেন। সে নাকি একটা কথাও বলেনি, শুধু আগুনভরা দু-চোখ নিয়ে বাজনাবাবুর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিল।”
“তার এরকম প্রতিক্রিয়া কিছু অস্বাভাবিক নয়।” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “তার বাচ্চাকে তো খুন করা হয়েছিল।”
“তখনকার দিনে এরকম যে কত ঘটনা ঘটত! বেশিরভাগ জমিদার-টাররা তো আর সাধারণ মানুষকে মানুষ বলে ভাবত না।” দেবমাল্যও দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “তবে ওই থেকে নাকি বাজনাবাবুর স্ত্রী কেমন হয়ে গেছিলেন। অসুখ-বিসুখে ভুগতেনও খুব। ও-বাড়িতে তো আর আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না, সব খালি চাকরবাকর। ওঁর দেখাশোনা করার কেউ ছিল না। ওঁদের কোনও সন্তানও হয়নি। এক বছর পার হতে না হতেই তিনি মারা গেলেন। তারপর থেকেই সবকিছু পড়তির দিকে। বাজনাবাবুও আর সুস্থ রইলেন না। আকণ্ঠ নেশায় ডুবে থাকতেন। তবে জলসা তখনও বসত। একদিন কাকভোরে ও-বাড়ির বুড়ো চাকর দৌড়তে দৌড়তে এসে পুরোনো বাড়ির সবাইকে ডেকে তুলল। বাজনাবাবু নাকি কীরকম চুপ করে পড়ে আছেন, সাড়া-টাড়া দিচ্ছেন না। বাজনাবাবুর দাদা-ভাইরা সব ছুটল। ততক্ষণে উনি মারা গেছেন। বুড়ো চাকরটা চোখ মুছে বলল, ‘ওই জলসা জলসা করেই কাল হল। শেষ অবধি ওই সেই একই কথা। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, তাও বলছেন, বসবে, বসবে, এ-বাড়িতে জলসা আবার বসবে। বসেই যাবে…’ সেই থেকে ও-বাড়িতে আর কেউ থাকে না। তবে বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণ হত। এখনও যে একেবারেই হয় তা নয়। হয়, না-হলে এটুকুও থাকত না, ইটের ঢিপি হয়ে যেত। কয়েকখানা ঘর এখনও ভালো আছে, দেখলে তো। তবে বোঝোই তো, এত বড়ো বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। তার মধ্যে না এ-বাড়িতে কেউ থাকতে চায়, না কেউ কিনতে চায়। তবে এখন শুনছি চৌধুরীরা নাকি উঠেপড়ে লেগেছে।” দেবমাল্য থামল।
“সে তো বুঝলাম। কিন্তু বাজনাবাবুর বাড়ি জাগার ব্যাপারটাই তো বললি না।”
“ওই তারপর থেকেই নানান কানাঘুষো শোনা যেতে লাগল। রাতের বেলায় নাকি বাজনাবাবুর বাড়িতে আলো জ্বলে ওঠে। গানবাজনার আওয়াজ শোনা যায়, ঘুঙুর পায়ে কেউ যেন নাচে। লোকে বলত, বাজনাবাবুর অতৃপ্ত আত্মা এখনও রয়ে গেছে—তারই কাজ ওসব। চৌধুরীরা ও-বাড়িতে পুজো-আচ্চাও করেছে, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। তারাই ওখানকার মন্দিরের শিবলিঙ্গ তুলে এনে গ্রামের ভেতরের মন্দিরে আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠা করে। ওখানে কে যাবে, কেই-বা পুজো করবে! তারপর গ্রামের দু-একজন নিখোঁজ হল। খুঁজতে খুঁজতে তাদেরকে পাওয়া গেছিল ওই বাজনাবাবুর বাড়ির আশেপাশেই। একসঙ্গে নয়, এক-একবারে একজন করে। তারা সবাই বেশ ডাকাবুকো ছিল। হয়তো রাতের বেলায় বাজনাবাবুর বাড়িতে সত্যিই কিছু হয় কি না দেখতে গেছিল। এরপর থেকে গ্রামের কেউ আর সূর্য ডোবার পরে ওখানে যায় না। তবে কী আশ্চর্য, বেশ কিছু অপরিচিত মানুষেরও প্রাণহীন দেহও ওখানে পাওয়া গেছে। তাঁরা কী করতে ওখানে এসেছিলেন সে-রহস্যের কোনও মীমাংসা হয়নি। পুলিশ কয়েকবার আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখেছে। কিচ্ছু পায়নি। কোনও চোর-ডাকাতের যে ডেরা ওটা তেমন কোনও প্রমাণও নেই। মাঝে অনেক বছর কিছু হয়নি। কিন্তু এই সাত-আট মাস আগে আবার হল। আজ থেকে অনেক বছর আগে এক সন্ন্যাসী এসেছিলেন এ-গ্রামে। দুর্গাপুজোর সময়। এখানে পুজোর সময়ে চণ্ডীতলায় বড়ো মেলা বসে। এখনও অনেক সাধুসন্ন্যাসী আসেন। তা সেই সন্ন্যাসী বলেছিলেন, ‘কেউ সন্ধের পর আর ওদিকে যেও না। ও-সময়ে ও-বাড়ি আর সাধারণ বাড়ি থাকে না। ওখানে তখন নাচগানের আসর বসে। বাজনাবাবুর নতুন নতুন লোক চাই। তাই যাকে পারেন ভুলিয়ে নিয়ে যান, নিয়ে ওখানেই রেখে দেন। দিনের আলো থাকতে থাকতে গেলে কিছু হবে না, কিন্তু তার পরে আর যেও না, সবাইকে সাবধান করে দিও।’ গ্রামের মানুষ তাঁকেই ধরে পড়ল, ‘একটা বিহিত করুন বাবা। খালি মনে হয় সকালে উঠে আবার কার দেহ দেখব! কত লোকের সব্বোনাশ হচ্ছে এভাবে! গ্রামেরও বদনাম।’ তিনি বললেন, ‘বিহিত কিছু করার নেই। যখন ও-বাড়ি থেকে নাচগানের আওয়াজ আসবে, তখন যদি কেউ ওখানে ঢুকেও আবার ফিরে আসতে পারে তবেই বাজনাবাবুর এ-খেলা বন্ধ হবে, না-হলে নয়। তবে সে খুব শক্ত ব্যাপার। একবার বাজনাবাবুর হাতের মধ্যে গিয়ে পড়লে কি আর বেরোনো অত সহজ!’ সে যে হবার নয় এখন গ্রামের লোকও তাই বিশ্বাস করছে। বিশেষ করে এই সাত-আট মাস আগের ঘটনাটা দেখে।”
“এ তো গল্পকে হার মানায় রে! সত্যি এরকম হয়!” আমি না বলে পারলাম না।
দেবমাল্য হাসল। কিছু বলল না। আমার অবিশ্বাসী মনের কথা যে ও একেবারে জানে না তা নয়।
***
জগদ্ধাত্রী পুজো জমে উঠেছে। ঠাকুরদালান লোকজনে সবসময়ই ভর্তি। দেবমাল্যরা যে খুবই আন্তরিকতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো করে তা স্বীকার করতেই হয়। আতিথেয়তারও কোনও তুলনা নেই। আজ রাতে আবার যাত্রাপালা আছে।
“যাত্রা দেখেছ কখনও?” দেবমাল্য জিজ্ঞেস করল, “আমাদের পুজোর এই এক নিয়ম, যাত্রাপালা হবেই। সেই যবে থেকে পুজো হচ্ছে তবে থেকেই হয়ে আসছে। সারা গ্রাম ভেঙে পড়ে দেখতে। এ-দলটার খুব নাম আছে। দেখবে তো?”
“অবশ্যই দেখব।” আমিও মেতে উঠেছি।
যাত্রা শুরু হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল। দেখলাম দেবমাল্যর কথা ঠিক। সত্যিই সারা গ্রাম ভেঙে পড়েছে যাত্রা দেখতে। বিনোদনের এ সুযোগ কেউ ছাড়তে চায় না। বাড়ির পাশে ফাঁকা মাঠে সামিয়ানা টাঙিয়ে যাত্রা হচ্ছে। দেবমাল্য আমার পাশেই বসে ছিল। একজন এসে ওকে আস্তে আস্তে কী বলতে ও উঠে গেল। বুঝলাম কিছু কাজ আছে। বাড়ির পুজো কখনও এভাবে দেখিনি। এখানে দেখে বুঝলাম একখানা পুজো সুষ্ঠুভাবে করা কম কথা নয়। কত যে নিয়মকানুন, কত যে আচার-অনুষ্ঠান! কাজের যেন আর শেষ নেই!
“একবার ওদিকে যাবেন নাকি? না না, একেবারে সামনে যাব না, সে কি যাওয়া যায়! তবে দূর থেকে আপনাকে দেকাতে পারি।”
মন দিয়ে যাত্রা দেখছিলাম, কানের কাছে কথাগুলো শুনে চমকে উঠলাম।
নাড়ু। কখন একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে বুঝতেই পারিনি!
“কোনদিকে যাব? আর কীই-বা দেখাবে তুমি?” বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। যে সে এরকম গায়ের কাছে এসে বসে পড়বে, এ আমার একেবারেই না-পসন্দ।
“কেন, বাজনাবাবুর বাড়ি! সেই দেকতেই তো এসেচেন আপনি। নাড়ুকে কেউ কিচু না বললেও নাড়ু অনেক কিচুই বুজতে পারে। যাবেন তো চলুন। এই বেলা দূর থেকে টুক করে দেখিয়ে আনি। আজ মনে হচ্ছে বাজনাবাবুর বাড়ি জাগছে। এখেনে এইসব যাত্রাপালা হচ্ছে আর বাজনাবাবুর বাড়িতে কিছু হবে না, তাই কখনও হয়? যে-সে লোক ছিল নাকি বাজনাবাবু?” গভীর সম্ভ্রমের সঙ্গে বলল নাড়ু।
বাজনাবাবুর বাড়ি জাগছে! কথাটা শোনামাত্র আমার শরীরের প্রতিটা কোষে কোষে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল, রক্তে লাগল দোলা। ঠাকুমার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ঠাকুরদার বড়ো ফটোটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমার ভেতরের জেদি, ডাকাবুকো আর একগুঁয়ে আমিটা আবার মাথা তুলল। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম দেবমাল্য এখনও ফেরেনি। এই সুযোগ, ও এসে পড়লে আর যাওয়া হবে না।
“চলো।” তড়াক করে উঠে পড়লাম আমি।
“নাড়ু মানুষ চিনতে ভুল করে না। আপনি যে যাবেন এ আমি জানতাম।” সামিয়ানার বাইরে এসে নাড়ু বলল। আত্মপ্রত্যয়ের হাসিও হাসল মনে হল।
সামনে সামনে নাড়ু যাচ্ছে, পেছনে আমি। গ্রামের পথঘাট শুনশান, এত রাতে কে রাস্তায় বেরোবে? আশেপাশের কোনও বাড়িতেও আলো জ্বলছে না। বেশিরভাগ মানুষই তো যাত্রা দেখতে গেছে। যারা আছে তারা এখন গভীর ঘুমে মগ্ন।
কতক্ষণ ওভাবে আমি নাড়ুকে অনুসরণ করলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ দেখি আমি বাজনাবাবুর বাড়ির একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে। এ যে গতকাল বিকেলে দেখা সেই জীর্ণ প্রাসাদ তা কে বলবে! বাড়ির নীচের তলাটা একেবারে আলো ঝলমল করছে—বেহালার ছড়ের আওয়াজ, লোকজনের হাসি শোনা যাচ্ছে। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, শিরদাঁড়ায় একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল।
“নাড়ু, নাড়ু…” আমি ডাকার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোল না। ও তো বলেছিল দূর থেকে দেখাবে, কিন্তু এ তো দেখছি আমি একেবারে সামনে চলে এসেছি! দেড়-মানুষ সমান সিংহদরজাখানা হাট করে খোলা। বলতে গেলে আমার নাকের ডগায়! সিঁড়ির সবচেয়ে নীচের ধাপটায় আমি দাঁড়িয়ে, আর তিনটে ধাপ উঠলেই আমি বাজনাবাবুর বাড়িতে ঢুকতে পারব। এই সিঁড়িতে বসেই কি বাচ্চা ছেলেটা কাঁদছিল? আমার গা শিরশির করে উঠল। হাত-পা কাঁপতে লাগল।
“নাড়ুউউ…” আমি আবার ডাকার চেষ্টা করলাম। আবার কোনও আওয়াজ বেরোল না গলা দিয়ে। নাড়ু ধারেকাছে আছে বলেও তো মনে হচ্ছে না। আমাকে এখানে এনে নিজে পালিয়ে গেল!
কী এক অমোঘ আকর্ষণে আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। আমি বুঝতে পারছি এক ভয়ংকর বিপদের দিকে আমি এগিয়ে যাচ্ছি—সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিকে, কিন্তু আমি আর আমার বশে নেই। এক, দুই, তিন… তিনটে ধাপ উঠে এলাম। কে একজন জোরে হেসে উঠল! হাসি তো নয়, অট্টহাসি। বাড়ির চারদিকে সে-হাসির আওয়াজ প্রতিধ্বনি হতে লাগল—হা হা হা হা হা… আকাশ-বাতাস কাঁপানো সে হাসি। বাজনাবাবু কি? উনি কি এরকম করে হাসতেন?
আমি যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো এগিয়ে যাচ্ছি। ওই তো, ওই ঘর থেকেই আওয়াজ আসছে। বড়ো একটা হলঘর মনে হচ্ছে, বাজনাবাবুর জলসাঘর। পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম জলসাঘরের দরজায়। ঘরের তিনদিকের দেওয়াল ঘেঁষে মোটা গদি পাতা, তার ওপর বাহারি চাদর। সেই গদির ওপর সারিবদ্ধভাবে কত মানুষ যে বসে আছেন! কত কত! আর তাঁদের মধ্যমণি হয়ে দু-পাশে দুখানা তাকিয়া নিয়ে বাজনাবাবু। বাজনাবাবুকে কখনও দেখা তো দূরের কথা, আমি তাঁর কোনও ছবিও দেখিনি। কিন্তু কী আশ্চর্য, এখন একবার দেখেই বুঝতে পারলাম যে উনি বাজনাবাবু। তাঁর সাজপোশাক দেখেই কি? কে জানে। মুখে তাঁর অমায়িক হাসি। সে-হাসিতে অভ্যর্থনার ইঙ্গিত। চোখ দুটোও চকচক করে উঠছে, যেন বলতে চাইছে, ‘দেখো কীরকম নিয়ে এলাম তোমাকে, এসো হে এসো।’
হঠাৎ তবলা বেজে উঠল, ঘুঙুরের আওয়াজ পেলাম। বাজনদাররা তাঁদের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নড়েচড়ে বসেছেন। মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় এক নর্তকী এসে দাঁড়িয়েছেন। আমি তখনও সম্মোহিতের মতো বাজনাবাবুকে দেখে যাচ্ছি। বাজনাবাবু আমার দিকে সেইরকমই সহাস্য মুখে তাকিয়ে ডানহাতখানা সামনে প্রসারিত করলেন। যেন আসন গ্রহণ করতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে সারা ঘর জুড়ে সরু-মোটা নানান স্বরে আওয়াজ উঠল, “আসুন আসুন… এসো এসো… বসো… ওখানে দাঁড়িয়ে কেন… এসো এসো…”
ঘরে সব মানুষ যেন একযোগে আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন! আমার সারা মস্তিষ্ক জুড়ে ধ্বনিত হতে লাগল ওই একই কথা, এসো…এসো…বসো… সে-ডাকে সাড়া না দেওয়া সম্ভব নয়। ডাকছেন, বাজনাবাবু আমাকে ডাকছেন। তাঁর বাড়িতে জলসা দেখতে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন, তা কি উপেক্ষা করা যায়? কখনোই নয়। ওই তো বাজনাবাবুর বাঁদিকে গদিতে খানিক ফাঁকা জায়গা, একজন বসতে পারে। বাজনাবাবু আমাকে ওখানেই বসতে বলছেন, তাঁর পাশে—আর আমি যাব না! একবার যেন কানের কাছে কে বলে উঠল, “যেও না, যেও না, গেলে না আর ফিরতে পারবে না।” কিন্তু সে-স্বর ওই প্রবল আহ্বানের কাছে মিলিয়ে গেল।
এক পা দু-পা করে আমি এগোচ্ছি। এক-আধবার এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছি। ডাকছে, সবাই আমাকে ডাকছে; তাদের একজন হয়ে এ-আসর উপভোগ করতে বলছে। আমি আবার দেখলাম, সত্যিই সবাই-ই ডাকছে? ওই যে ওইদিকে বসা মানুষটি, কই, উনি তো ডাকছেন না! বরং দু-চোখে কী আকুল মিনতি! কী বলতে চাইছেন উনি? কীরকম চেনে চেনা না মুখটা? কোথাও দেখেছি? হাতে কালোমতো ওটা কী? জড়ুল? ওরকম কি কারও ছিল? আমি জানি? আমি আবার বাজনাবাবুর দিকে ফিরলাম। উনি সেইরকমই হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে।
“না!” হঠাৎ সামনে কে এসে গেল, আমি কিছু বোঝার আগেই এক মোক্ষম ঠেলা।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম আমার চারপাশে অনেকগুলো মুখ, উৎকণ্ঠায় ভরা। তাকিয়ে বুঝলাম, আমি একটা ঘরে রয়েছি। না, বাজনাবাবুর জাঁকজমকে ভরা জলসাঘরে নয়, নেহাতই সাধারণ একটা ঘরে।
“সন্দীপদা, ও সন্দীপদা…” দেবমাল্যর গলা পেলাম। “কী বিপদ ডেকে আনছিলে বলো তো তুমি? আমি একটু উঠেছি আর তুমি একেবারে বাইরে বেরিয়ে চলে গেলে! ওদিকে কোথায় যাচ্ছিলে? আর কিছুটা গেলেই তো বাজনাবাবুর বাড়ি!” দেবমাল্য বলল, “আমি দেখলাম তুমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলে। আমি ভাবলাম আর যাত্রা দেখতে ভালো লাগছে না, হয়তো ঘুমও পেয়েছে, তাই শুতে গেলে। আমিও আর বিরক্ত করিনি। তখন কি জানতাম যে ক্যামেরা নিতে ঘরে ঢুকেছ! কিছুক্ষণ পরে কেমন যেন সন্দেহ হল। ডাকতে গিয়ে দেখি দরজা ভেজানো, ঘরে তুমি নেই! তারপরে লোকজন নিয়ে বেরিয়ে খুঁজতে খুঁজতে তোমাকে পেলাম। বাজনাবাবুর বাড়ির সামনে নয় এই যা রক্ষে। অনেকটাই দূরে রাস্তার ওপর পড়ে ছিলে তুমি, পাশে তোমার ক্যামেরা। কেউ করে এরকম! কিছু হলে কী হত?”
“ক্যামেরা নিতে? আমি ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়েছিলাম? কই, আমার তো মনে পড়ছে না! আমাকে তো নাড়ু ডাকল। বলল, ‘দেখবে আসুন বাজনাবাবুর বাড়ি জাগছে,’ আমি সেই শুনে তার সঙ্গে গেলাম। তারপর…”
তারপরের কথা মনে পড়ামাত্রই সেই কনকনানিটা আবার আমার শিরদাঁড়ায় বয়ে গেল। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
“কী বলছ? ও সন্দীপদা? নাড়ুকে কোথায় পেলে তুমি? নাড়ু তো নেই, সে তো চন্দননগরে তার কোন পিসির বাড়িতে গেছে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখবে বলে। যাওয়ার আগে সারা গ্রামে সে-কথা রাষ্ট্র করে গেছে। না-হলে যাত্রাপালা শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে থেকে এসে বসে থাকে। তুমি আবার নাড়ু নাড়ু কী বলছ?” বলল দেবমাল্য।
“নাড়ু চন্দননগরে গেছে? গ্রামে নেই?” আমি স্খলিত স্বরে বললাম।
“পরশু বিকেলে নাড়ু অত বকবক করল না, বাজনাবাবুর বাড়ি জাগে-টাগে কত কিছু বলল, তোমার মাথায় ওই ঘুরছিল। তারপর ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছ। তুমি যে কিছুতে বিশ্বাস করো না এ তো আমি জানিই। তবে এ কিন্তু খুব হঠকারী কাজ করেছ। দেখলে তো কী হল? বাজনাবাবুর বাড়ির কাছাকাছি যে চলে যাওনি এই আমাদের অনেক ভাগ্য।” দেবমাল্য আবার বলল, “যাই হোক, এখন আর ওসব কিছু ভেবো না, যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। এবার কি উঠে বাড়িতে যেতে পারবে? এটা তো বরুণাপিসিদের বাড়ি। তোমাকে রাস্তা থেকে তুলে এখানেই নিয়ে এসেছি, কাছে বলে।”
“পারব।” আমি আস্তে আস্তে উঠলাম।
দেবমাল্য আমাকে একেবারে ঘরে শুইয়ে দিয়ে গেল। বলল, “কিচ্ছু ভাবনা-চিন্তা করবে না। এখন বিশ্রাম করো। আবার ঘোরাঘুরি শুরু কোরো না যেন। আমি একটু পরে আসছি আবার।”
আমি কোনও উত্তর দিলাম না। ক্লান্ত হাসি হাসলাম। মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরছে, আমাকে ডেকে নিয়ে গেল কে? নাড়ু তো নেই-ই এখানে, তাহলে? তবে কি নাড়ু যা বলেছিল তাই ঠিক? যেদিন বাজনাবাবুর বাড়ি জাগার মতো জাগবে সেদিন বাজনাবাবুর যাকে মনে ধরবে তাকে নিয়েই ছাড়বে? সে তুমি যতই বাড়ির ভেতরে দরজা-জানালা এঁটে থাকো না কেন! বাজনাবাবুর ছল-বল-কৌশলের অভাব হয় না। তাই তো আমার ঠাকুরদা ক্যানিং থেকে বাড়ি না ফিরে কী করে যেন জীবনতলায় চলে আসেন, নাড়ুর মতো দেখতে কেউ আমাকে এসে ডেকে নিয়ে যায়!
ঘরে কেউ নেই। আমি নিজের মনেই বললাম, ‘দেবমাল্য, আসলে কী হয়েছিল তা আমিই জানি। এখনও মনে আছে কিছু কিছু। তবে যাই হোক, বাজনাবাবুর এ ভয়ংকর খেলা এবার বন্ধ হল। আর কারও সর্বনাশ হবে না। আমি যে ফিরে এসেছি ওখান থেকে! আর কে আমাকে ফিরিয়ে দিলেন তাও জানি।” জল গড়িয়ে পড়ল আমার চোখ দিয়ে।
ছবি- শ্যামসুন্দর সেন